নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি' by ড. জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস
আমি এবং আমার সহকর্মী ড. আনছার আলী খুলনার আইলা আক্রান্ত দাকোপে যাই ২৭ অক্টোবর ২০০৯। তখনও আক্রান্ত এলাকা জুড়ে টালমাটাল অবস্থা।
বেশ কিছু গ্রাম আর গ্রাম নেই বলা যায়। দাকোপের ঢাকি নদীর পারে কামারখোলা এমনি এক ভেসে-যাওয়া গ্রাম। নদীবরাবর বাঁধ ভেঙে স্বাভাবিক এক খাল অস্বাভাবিক আকার নিয়েছে। সেখানেই এক মহিলার সঙ্গে আমাদের কথা হয়। অবলীলায় সে বলে যায় অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের কথা। বাঁধের স্লুইসগেট ভেঙে পানি উপচেপড়ার কথা। দুর্বল বাঁধ-ব্যবস্থাপনার কথা। স্থানীয় প্রশাসনের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কথা। সরকারি সাহায্য নিয়ে ক্ষোভের কথা। সঙ্গে নদীর অপরপাড়ে যে ক্ষতি হয়নি সে কথাও বলতে বাকি রাখেনি।
এরপরই সহসা দার্শনিক-ভঙ্গিমায় কথার সুর পাল্টায়, 'এবার ওপারে বাঁধ ভাঙেনি, কিন্তু এরপরে যে ভাঙবে না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?' মেয়েটির চেহারা বোধকরি রবিঠাকুরের কালো মেয়ের মতো। তবে পরনে রংচটা শাড়ি আর কপালে মলিন সিঁদুর। হাতে সাদা চুড়ি। আমি তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করি। তার কথায় অনুযোগের সুর, 'কী আর করবে, পাকা ধান ভেসে গেল, জমি এখনও জলের তলায়। মাছ ধরে সংসার চলে। তাও আর মেলে না।' কিছুটা উত্তেজিত মনে হয় তাকে। এই মহিলার কাছে আর আমি কিছু জানতে চাইনি। তবুও যেন আরও কথা রয়ে যায়। আমার সহকর্মী জানতে চায় কেন এমনটি হচ্ছে। মহিলা দু'হাত দুদিকে ছড়িয়ে আপন মনেই বলে উঠে, কী জানি বাপু! আমার বাপ্-ঠাকুরদার আমলেও এমন হয়েছে শুনেছি। তবে তাদের সারাজীবনে একবার কি দু'বার। আর আমাদের জীবনে এসব কী দেখছি! এবারে উল্টো আমাদের প্রশ্ন করে বসে, 'সারা দ্যাশ নাকি ডুবে যাবে? আমরা তাহলে কোথায় যাব? খাব কী?' এতক্ষণে আমার মনে হলো গ্লোবাল-ওয়ার্মিংয়ের কথা জানুক আর না-জানুক, এর প্রতিফল কি হতে পারে তা তারা জেনে গেছে ইতোমধ্যেই। যাহোক তার প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব আমাদের কাছে ছিল না। আমরা জানি, জলবায়ু সম্পর্কিত আন্তঃসরকার প্যানেল এমন কথাই বলেছে। আজকের থেকে তাপমাত্রা যদি ১.৫্ন সেন্টিগ্রেড-এর ওপরে চলে যায় তাহলেই দেশের ১৮ শতাংশ এলাকা ডুবে যাবে। নোনাপানি উঠে আসবে অনেক ভেতর পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বাড়বে এবং আগের চেয়ে ঘন ঘন হবে। এসবই বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধরনের ম্যাথমেটিক্যাল মডেল-নির্ভর ভবিষ্যৎ বাণী। আর যতই দিন যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আরও বস্তুনিষ্ঠ ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা চলছে। তবে কোনো গবেষণাই আশাপ্রদ কিছু বলছে না। আর সত্যিকথা হলো আমাদের দেশের দক্ষিণের মানুষের জন্য এসব আর ভবিষ্যতের কিছু না। বর্তমানেই তা ঘটছে। তারা এসবের সরাসরি শিকার। আজ এখানে হচ্ছে তো কাল ওখানে হওয়ার সম্ভাবনা। যাহোক বলছিলাম মহিলার কথা। আমরা তার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে ভয়ঙ্কর সত্যি কথাটি তাকে বলিনি। শুধু বলেছিলাম, ভয় নেই। সারাবিশ্বের নেতারা তাড়াতাড়িই এক মিটিংয়ে বসছেন। সেখানে আপনাদের এই অসুবিধেগুলো প্রশমনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ আমরা কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনের কথা বলতে চেয়েছিলাম। যেটা এই মাত্র শেষ হলো।
এরপরই সহসা দার্শনিক-ভঙ্গিমায় কথার সুর পাল্টায়, 'এবার ওপারে বাঁধ ভাঙেনি, কিন্তু এরপরে যে ভাঙবে না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?' মেয়েটির চেহারা বোধকরি রবিঠাকুরের কালো মেয়ের মতো। তবে পরনে রংচটা শাড়ি আর কপালে মলিন সিঁদুর। হাতে সাদা চুড়ি। আমি তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করি। তার কথায় অনুযোগের সুর, 'কী আর করবে, পাকা ধান ভেসে গেল, জমি এখনও জলের তলায়। মাছ ধরে সংসার চলে। তাও আর মেলে না।' কিছুটা উত্তেজিত মনে হয় তাকে। এই মহিলার কাছে আর আমি কিছু জানতে চাইনি। তবুও যেন আরও কথা রয়ে যায়। আমার সহকর্মী জানতে চায় কেন এমনটি হচ্ছে। মহিলা দু'হাত দুদিকে ছড়িয়ে আপন মনেই বলে উঠে, কী জানি বাপু! আমার বাপ্-ঠাকুরদার আমলেও এমন হয়েছে শুনেছি। তবে তাদের সারাজীবনে একবার কি দু'বার। আর আমাদের জীবনে এসব কী দেখছি! এবারে উল্টো আমাদের প্রশ্ন করে বসে, 'সারা দ্যাশ নাকি ডুবে যাবে? আমরা তাহলে কোথায় যাব? খাব কী?' এতক্ষণে আমার মনে হলো গ্লোবাল-ওয়ার্মিংয়ের কথা জানুক আর না-জানুক, এর প্রতিফল কি হতে পারে তা তারা জেনে গেছে ইতোমধ্যেই। যাহোক তার প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব আমাদের কাছে ছিল না। আমরা জানি, জলবায়ু সম্পর্কিত আন্তঃসরকার প্যানেল এমন কথাই বলেছে। আজকের থেকে তাপমাত্রা যদি ১.৫্ন সেন্টিগ্রেড-এর ওপরে চলে যায় তাহলেই দেশের ১৮ শতাংশ এলাকা ডুবে যাবে। নোনাপানি উঠে আসবে অনেক ভেতর পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বাড়বে এবং আগের চেয়ে ঘন ঘন হবে। এসবই বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধরনের ম্যাথমেটিক্যাল মডেল-নির্ভর ভবিষ্যৎ বাণী। আর যতই দিন যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আরও বস্তুনিষ্ঠ ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা চলছে। তবে কোনো গবেষণাই আশাপ্রদ কিছু বলছে না। আর সত্যিকথা হলো আমাদের দেশের দক্ষিণের মানুষের জন্য এসব আর ভবিষ্যতের কিছু না। বর্তমানেই তা ঘটছে। তারা এসবের সরাসরি শিকার। আজ এখানে হচ্ছে তো কাল ওখানে হওয়ার সম্ভাবনা। যাহোক বলছিলাম মহিলার কথা। আমরা তার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে ভয়ঙ্কর সত্যি কথাটি তাকে বলিনি। শুধু বলেছিলাম, ভয় নেই। সারাবিশ্বের নেতারা তাড়াতাড়িই এক মিটিংয়ে বসছেন। সেখানে আপনাদের এই অসুবিধেগুলো প্রশমনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ আমরা কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনের কথা বলতে চেয়েছিলাম। যেটা এই মাত্র শেষ হলো।
কিন্তু কী হলো সেই মহিলাকে আশ্বাস দেয়া কোপেনহেগেনের পরিণতি। এর আলোচনার টানাপড়েনের একপর্যায়ে পদত্যাগ করে বসলেন ড্যানিস পরিবেশমন্ত্রী এবং ওই সম্মেলনের সভাপতি মিসেস কোনি হেডগার্ড। তাঁর ভাষায় যখন সম্মেলনে আলোচনার ফুলঝুরি চলছে, তখনই একজন বাংলাদেশি নারী আশ্রয় শিবিরে ত্রাণের আশায় ধুঁকছে। মালির একজন কৃষক তার জমিতে সেচ দিতে পারছে না। অন্তত এদের কথা মনে করে হলেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কিছু একটা করা উচিৎ।
সব ভালো যার শেষ ভালো। আসলে শেষ যা হয়েছে তাতে আমাদের মতো দেশের তেমন কিছু হয়নি। কোপেনহেগেনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, গরীব দেশগুলোর জন্য জলবায়ু সাহায্য, বনবিষয়ক ইস্যু, বিভিন্ন দেশ প্রদত্ত ওয়াদাসমূহ মনিটরিং এবং আইনি কাঠামো দাঁড় করানো। কিন্তু এখানে কৃষি কোথায়? কিছু দান-ধ্যান পুনর্বাসনের কথা উঠেছে অবশ্য। অথচ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ_এ বিষয় নিয়ে নিশ্চয়ই কিছু বলেছে। তারপরও সমস্যাকে আরও একবছরের জন্য ঝুলিয়ে দেয়া হলো। পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ কার্বনের মাত্রারোধের চুক্তিতে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াল উন্নয়নপ্রত্যাশী কিছু দেশ। অথচ তারা ভাবল না কার্বনের পরিমাণ মাত্র ৩০ বছরে বেড়েছে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ। প্রতি সেকেন্ডে বাড়ছে ১১ হাজার টন কার্বন ডাইঅক্সাইড।
কোনি হেডগার্ডকে ধন্যবাদ। তিনি আমাদের এক নারীর হয়ে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় থাকায় সবাই সমবেদনা প্রকাশ করেছে। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। আর বলতেই হয়, ওই সম্মেলনে কিছু না হলেও আমাদের উপদ্রুত এলাকার জনগণ পরিস্থিতি সামলে নেবে আশা করি। কারণ হলো নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে এই মানুষগুলোর অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা আছে। আমাদের আলোচিত মহিলাটি হয়তো কোনি হেডগার্ডের কল্পিত মহিলার বাস্তব প্রতিরূপ। সে তার ভাইকে হারিয়েছে, সম্পদ হারিয়েছে, তারপরেও আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় আছে। তার স্বামী বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করেছে। গ্রামের ভেতর দিয়ে তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক খালটাকে তার গ্রামের মানুষ স্বাদু পানির রিজার্ভার বানানোর পরিকল্পনার করছে এবং সে মোতাবেক তারা তাদের এলাকায় কৃষি ও পানি ব্যবস্থাপনার কথা ভাবছে। আসলে আমাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের নিয়ে দুর্ভাবনা করলেও আমাদের পোড়খাওয়া মানুষগুলো এতটা ভাবে না। সময়ে ঠিকই একটা ব্যবস্থা তারা করে নেয়। শুভম্।
====================================
গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী' ফিচার- ‘অতল জলের আহ্বান' by রুবাইয়াত মনসুর ভ্রমণ- 'গৌড়ের পথে পথে' by মৃত্যুঞ্জয় রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'সেদিন বঙ্গভবনে কী ঘটেছিল রাজনৈতিক আলোচনা- 'রাজনীতি পুরনো পথেই' by আবদুল্লাহ আল ফারুক খবর- ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক আলোচনা- 'বাংলাদেশে মিডিয়া ও তার ভবিষ্যৎ' by সাইফুল বারী প্রবন্ধ- রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের 'অবরোধবাসিনী' ফিচার- ‘হিমশীতল শহরগুলোর দিনরাত' by তামান্না মিনহাজ গল্পালোচনা- ''সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর' সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন
কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস
মুখ্য বৈজ্ঞনিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
এই নিবন্ধ'টি পড়া হয়েছে...
গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী' ফিচার- ‘অতল জলের আহ্বান' by রুবাইয়াত মনসুর ভ্রমণ- 'গৌড়ের পথে পথে' by মৃত্যুঞ্জয় রায় রাজনৈতিক আলোচনা- 'সেদিন বঙ্গভবনে কী ঘটেছিল রাজনৈতিক আলোচনা- 'রাজনীতি পুরনো পথেই' by আবদুল্লাহ আল ফারুক খবর- ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক আলোচনা- 'বাংলাদেশে মিডিয়া ও তার ভবিষ্যৎ' by সাইফুল বারী প্রবন্ধ- রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের 'অবরোধবাসিনী' ফিচার- ‘হিমশীতল শহরগুলোর দিনরাত' by তামান্না মিনহাজ গল্পালোচনা- ''সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর' সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন
কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস
মুখ্য বৈজ্ঞনিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
এই নিবন্ধ'টি পড়া হয়েছে...
No comments