শিক্ষা না নিলে ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে by বদিউল আলম মজুমদার
ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে, অনেক সময় আরও ভয়াবহ আকারে—এটিই অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের শিক্ষা। তবে হেগেলের মতে, ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে আসলে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। আমাদের ক্ষেত্রে এটি সম্ভবত আরও প্রকটভাবে সত্য। এর মাশুল জাতি হিসেবে আজ আমরা দিচ্ছি এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও নগ্নভাবে আমাদের তা দিতে হবে।
স্মরণ আছে ১৯৭০-৭১ সালের কথা? ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। জাতীয় সংসদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে দলটি দুটি বাদে সবগুলো আসন লাভ করেছিল। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই এ অর্জন সম্ভব হয়েছিল। পক্ষান্তরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপল্স ্পার্টি ৮৬টি আসন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুরই সরকার গঠন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু ভুট্টো ও সেনাবাহিনীর দুরভিসন্ধির কারণে বঙ্গবন্ধুকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত এবং বাঙালিদের ন্যায্য অধিকারকে পদদলিত করা হয়, যার মাধ্যমে সংবিধানও চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। আর তা করেই ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষান্ত হয়নি, তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। লাখ লাখ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে। তবুও পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়নি। অর্থাৎ অন্যায় ও জোর করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরিণাম মঙ্গলকর হয়নি।
প্রায় দেড় বছর আগে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে তিনজন ব্যক্তি—একজন চেয়ারম্যান ও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন উপজেলায়, সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘স্থানীয় শাসন’ পরিচালনার লক্ষ্যে। জনগণ তাঁদের নির্বাচিত করেছে ‘প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য’ তত্ত্বাবধান, ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষা’ এবং ‘জনসাধারণের কার্য (Public Service) ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন’ [অনুচ্ছেদ ৫৯(২)] করার দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। আর তা করা হয়েছে যাতে, সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, প্রশাসনের প্রত্যেক একাংশ বা স্তরে জনপ্রতিনিধিদের তথা গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী, উপজেলা তথা স্থানীয় সরকারের আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে সংবিধানের এসব, বিশেষত ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ উপেক্ষা করা যাবে না [কুদরত-ই-এলাহি পনির বনাম বাংলদেশ ও অন্যান্য, ৪৪ডিএলআর(এডি)(১৯৯২)]।
পক্ষান্তরে প্রত্যেক একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত ৩০০ জন এবং সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত ৪৫ জন নারী সদস্যের ওপর, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের ‘আইন প্রণয়ন ক্ষমতা’ প্রদান করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, সংবিধানে যাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, জনগণের পক্ষে, সংবিধানের অধীনে এবং কর্তৃত্বে, তিনি শুধু সে দায়িত্বই পালন করবেন। সংবিধানে ক্ষমতার এমন বিভাজনের নীতি (Principles of Separation of Powers) অন্তর্ভুক্ত করার কারণেই বাংলাদেশ হাইকোর্ট আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ [১৬বিএলটি(এইচসিডি)(২০০৮)] মামলার রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে রায় দেন: ‘একজন সংসদ সদস্যের জেলা বা অন্যান্য প্রশাসনিক একাংশে উন্নয়ন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ও দায়িত্ব নেই। অতএব, মামলার বাদী, যিনি একজন সংসদ সদস্য, পিরোজপুর জেলা সম্পর্কে তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব নেই।’
সংবিধানের এমন সুস্পষ্ট বিধান এবং আদালতের দ্বিধাহীন রায় সত্ত্বেও আমাদের নবম জাতীয় সংসদ তার প্রথম অধিবেশনে যে উপজেলা আইন পাস করে, তার মাধ্যমে ৩০০ সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করে উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ বিধানের মাধ্যমে সংবিধান পদদলিত করে এবং উচ্চ আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে সংসদ সদস্যগণ কোটারি স্বার্থে অন্যায়ভাবে উপজেলা পরিষদের ওপর তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। দুর্ভাগ্যবশত, এ ক্ষেত্রে আমাদের নেতারা অতীতে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের পরিণতির ইতিহাস বেমালুম ভুলে গিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভার সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তও প্রণিধানযোগ্য। গণমাধ্যমের খবর থেকে আমরা জেনেছি যে, মন্ত্রিসভা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উপজেলার মুখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ সিদ্ধান্তও হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ সংবিধানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’ (অনুচ্ছেদ-১১)—বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের প্রত্যেক একাংশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর ‘স্থানীয় শাসন’-এর দায়িত্ব অর্পণ করেছে, প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা যার অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু, উপজেলার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা জনগণের ভোটে নির্বাহী দায়িত্ব পালনের জন্য ইতিমধ্যেই নির্বাচিত হয়েছেন। তাই আইন সংশোধন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব দিলে বর্তমানের বিরাজমান দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা। আমরা কি তা-ই চাই? তাতে কি কারও সম্মান বাড়বে? জনগণের কল্যাণ হবে?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের এখন এমনিতেই সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা দুরূহ হয়ে পড়েছে এবং তাঁদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করা হলে এ অবস্থার কোনোভাবেই উন্নতি হবে না; বরং এর মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে যাবে। আমরা মনে করি, ভারতের মনি শংকর আয়ার ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর মতো, যাঁরা যুগ্ম সচিব থাকাকালীন ভারতীয় সংবিধানের স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত যুগান্তকারী ৭৩ ও ৭৪ সংশোধনী পাসের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন, আমাদেরও আজ এ ধরনের দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাশীল একদল সরকারি কর্মকর্তা প্রয়োজন।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ইতিহাস থেকে আমাদের আরও গুরত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করার আছে। আমাদের মতো ভারতের রাজনীতিতেও সন্ত্রাস, দুর্নীতি তথা দুর্বৃত্তায়ন বিরাজমান। সেখানেও ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং সে দেশেও উগ্রবাদ ক্রমাগতভাবে বিস্তার লাভ করছে। ভারতের রাজনীতিও দ্বন্দ্ব, হানাহানি ও সহিংসতায় ভরপুর। তা সত্ত্বেও ভারতের দীর্ঘ ৬৩ বছরের ইতিহাসে অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শক্তি কর্তৃক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎখাত হয়নি, যদিও নির্বাচিত ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫-৭৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, তাও স্বল্পকালের জন্য—তিনি দুই বছরের মাথায় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ভারতে কেন কখনো অনির্বাচিত সরকার দ্বারা নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়নি? এর মূল কারণ হলো, স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই পণ্ডিত নেহরুর প্রজ্ঞাশীল নেতৃত্বে সেখানে ক্ষমতার বিভাজন নীতি অনুসরণে, কতগুলো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং এগুলোকে ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী করা হয়, যা পাকিস্তানে করা হয়নি। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম। শুরু থেকে লোকসভা ও রাজ্যসভাকে কার্যকর ও কলুষমুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেমন, ১৯৫১ সালে এইজি মুডগাল এক সংসদ সদস্যকে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন করার কারণে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া ভারতের সরকারি কর্মকমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী। এসব কার্যকর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মূলত ভারতে সমস্যা সমাধানের ও রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার প্রচেষ্টা চালানো হয়, রাজপথে নয়। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনে দুর্নীতিমূলক আচরণের জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টই ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভার সদস্যপদ বাতিল করেন, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকরতারই প্রতিফলন।
মিছিল, হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট ইত্যাদি অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, বরং এগুলোর মাধ্যমে সমস্যা আরও ব্যাপক ও প্রকট আকার ধারণ করে। বিরোধী দলের রাজপথের আন্দোলন প্রতিহত করতে গিয়ে সরকারও রাজপথে তা মোকাবিলা করার নামে সাধারণত দমননীতির আশ্রয় নেয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্ব-সহিংসতায় রূপ নেয়। এভাবে অবস্থা নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে চলে যেতে পারে, যা অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতা দখলের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
ভারতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ধারাবাহিকতা রক্ষার পেছনে সরকারের বাইরেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা নাগরিক সমাজ হিসেবে পরিচিত এবং গণমাধ্যম যার অংশ। নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট ছোবলে ভারতীয় নাগরিক সমাজ বিভক্ত হয়নি। ফায়দাতন্ত্রের বিষাক্ত থাবাও সেখানে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত নয়, যা নাগরিকের নিরপেক্ষ আচরণের পথে একটি বড় বাধা। সেখানে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও হুমকি-ধমকি নেই। ফলে ভারতীয় নাগরিক সমাজ অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও নাগরিকের অধিকার হরণের পথে অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ, যাকে সুশীল সমাজ বলে প্রতিনিয়ত গাল দেওয়া হয়, আজ অত্যন্ত করুণ অবস্থায় এবং সংগত কারণেই তারা নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর এর পরিণাম মঙ্গলজনক নয়। কারণ বলিষ্ঠ নাগরিক সমাজ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র কার্যকারতা লাভ করেনি।
এটি সুস্পষ্ট যে একটি গ্রহণযোগ্য আইনি কাঠামো, কতগুলো কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও সোচ্চার নাগরিক সমাজের কারণে ভারতীয় গণতন্ত্র অগণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রতিহত করতে পেরেছে। তাই গণতন্ত্রকে সুসংহত ও দৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে আমাদেরও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে এবং রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যা সমাধানের পথে এগোতে হবে। যেমন, বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রেখে মামলা প্রত্যাহারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে সংস্কার-প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর করতে হবে।
পৃথিবীর দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ইতিহাস থেকেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। পাশ্চাত্যের, বিশেষত ইউরোপের দেশসমূহে আজ যে গণতন্ত্রের চর্চা করা হয়, তা নির্বাচন দিয়ে শুরু হয়নি। সেসব দেশে নাগরিক সমাজের এবং অসংখ্য পণ্ডিতের শত শত বছরের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে প্রথমে আইনের শাসন ও নাগরিকদের বাক্-স্বাধীনতাসহ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে কতগুলো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে, ক্ষমতার বিভাজন নীতি অনুসরণে, সামন্তবাদী প্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। তার পরই আস্তে আস্তে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়, যা বিংশ শতাব্দীতে এসে সর্বজনীন ভোটাধিকারে রূপ নেয়। তাই বিরাজমান নির্বাচনসর্বস্ব ‘এক দিনের গণতন্ত্র’-এর বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের গণতন্ত্রচর্চা করতে হলে আমাদেরও নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠান গড়ার এবং কার্যকর করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
স্মরণ আছে ১৯৭০-৭১ সালের কথা? ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। জাতীয় সংসদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে দলটি দুটি বাদে সবগুলো আসন লাভ করেছিল। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই এ অর্জন সম্ভব হয়েছিল। পক্ষান্তরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপল্স ্পার্টি ৮৬টি আসন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুরই সরকার গঠন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু ভুট্টো ও সেনাবাহিনীর দুরভিসন্ধির কারণে বঙ্গবন্ধুকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত এবং বাঙালিদের ন্যায্য অধিকারকে পদদলিত করা হয়, যার মাধ্যমে সংবিধানও চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। আর তা করেই ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষান্ত হয়নি, তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। লাখ লাখ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে। তবুও পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়নি। অর্থাৎ অন্যায় ও জোর করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরিণাম মঙ্গলকর হয়নি।
প্রায় দেড় বছর আগে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে তিনজন ব্যক্তি—একজন চেয়ারম্যান ও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন উপজেলায়, সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘স্থানীয় শাসন’ পরিচালনার লক্ষ্যে। জনগণ তাঁদের নির্বাচিত করেছে ‘প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য’ তত্ত্বাবধান, ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষা’ এবং ‘জনসাধারণের কার্য (Public Service) ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন’ [অনুচ্ছেদ ৫৯(২)] করার দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। আর তা করা হয়েছে যাতে, সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, প্রশাসনের প্রত্যেক একাংশ বা স্তরে জনপ্রতিনিধিদের তথা গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী, উপজেলা তথা স্থানীয় সরকারের আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে সংবিধানের এসব, বিশেষত ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ উপেক্ষা করা যাবে না [কুদরত-ই-এলাহি পনির বনাম বাংলদেশ ও অন্যান্য, ৪৪ডিএলআর(এডি)(১৯৯২)]।
পক্ষান্তরে প্রত্যেক একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত ৩০০ জন এবং সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত ৪৫ জন নারী সদস্যের ওপর, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের ‘আইন প্রণয়ন ক্ষমতা’ প্রদান করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, সংবিধানে যাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, জনগণের পক্ষে, সংবিধানের অধীনে এবং কর্তৃত্বে, তিনি শুধু সে দায়িত্বই পালন করবেন। সংবিধানে ক্ষমতার এমন বিভাজনের নীতি (Principles of Separation of Powers) অন্তর্ভুক্ত করার কারণেই বাংলাদেশ হাইকোর্ট আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ [১৬বিএলটি(এইচসিডি)(২০০৮)] মামলার রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে রায় দেন: ‘একজন সংসদ সদস্যের জেলা বা অন্যান্য প্রশাসনিক একাংশে উন্নয়ন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ও দায়িত্ব নেই। অতএব, মামলার বাদী, যিনি একজন সংসদ সদস্য, পিরোজপুর জেলা সম্পর্কে তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব নেই।’
সংবিধানের এমন সুস্পষ্ট বিধান এবং আদালতের দ্বিধাহীন রায় সত্ত্বেও আমাদের নবম জাতীয় সংসদ তার প্রথম অধিবেশনে যে উপজেলা আইন পাস করে, তার মাধ্যমে ৩০০ সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করে উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ বিধানের মাধ্যমে সংবিধান পদদলিত করে এবং উচ্চ আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে সংসদ সদস্যগণ কোটারি স্বার্থে অন্যায়ভাবে উপজেলা পরিষদের ওপর তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। দুর্ভাগ্যবশত, এ ক্ষেত্রে আমাদের নেতারা অতীতে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের পরিণতির ইতিহাস বেমালুম ভুলে গিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভার সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তও প্রণিধানযোগ্য। গণমাধ্যমের খবর থেকে আমরা জেনেছি যে, মন্ত্রিসভা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উপজেলার মুখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ সিদ্ধান্তও হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ সংবিধানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’ (অনুচ্ছেদ-১১)—বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের প্রত্যেক একাংশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর ‘স্থানীয় শাসন’-এর দায়িত্ব অর্পণ করেছে, প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা যার অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু, উপজেলার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা জনগণের ভোটে নির্বাহী দায়িত্ব পালনের জন্য ইতিমধ্যেই নির্বাচিত হয়েছেন। তাই আইন সংশোধন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব দিলে বর্তমানের বিরাজমান দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা। আমরা কি তা-ই চাই? তাতে কি কারও সম্মান বাড়বে? জনগণের কল্যাণ হবে?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের এখন এমনিতেই সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা দুরূহ হয়ে পড়েছে এবং তাঁদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করা হলে এ অবস্থার কোনোভাবেই উন্নতি হবে না; বরং এর মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে যাবে। আমরা মনে করি, ভারতের মনি শংকর আয়ার ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর মতো, যাঁরা যুগ্ম সচিব থাকাকালীন ভারতীয় সংবিধানের স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত যুগান্তকারী ৭৩ ও ৭৪ সংশোধনী পাসের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন, আমাদেরও আজ এ ধরনের দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাশীল একদল সরকারি কর্মকর্তা প্রয়োজন।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ইতিহাস থেকে আমাদের আরও গুরত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করার আছে। আমাদের মতো ভারতের রাজনীতিতেও সন্ত্রাস, দুর্নীতি তথা দুর্বৃত্তায়ন বিরাজমান। সেখানেও ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং সে দেশেও উগ্রবাদ ক্রমাগতভাবে বিস্তার লাভ করছে। ভারতের রাজনীতিও দ্বন্দ্ব, হানাহানি ও সহিংসতায় ভরপুর। তা সত্ত্বেও ভারতের দীর্ঘ ৬৩ বছরের ইতিহাসে অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শক্তি কর্তৃক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎখাত হয়নি, যদিও নির্বাচিত ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫-৭৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, তাও স্বল্পকালের জন্য—তিনি দুই বছরের মাথায় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ভারতে কেন কখনো অনির্বাচিত সরকার দ্বারা নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়নি? এর মূল কারণ হলো, স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই পণ্ডিত নেহরুর প্রজ্ঞাশীল নেতৃত্বে সেখানে ক্ষমতার বিভাজন নীতি অনুসরণে, কতগুলো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং এগুলোকে ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী করা হয়, যা পাকিস্তানে করা হয়নি। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম। শুরু থেকে লোকসভা ও রাজ্যসভাকে কার্যকর ও কলুষমুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেমন, ১৯৫১ সালে এইজি মুডগাল এক সংসদ সদস্যকে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন করার কারণে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া ভারতের সরকারি কর্মকমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী। এসব কার্যকর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মূলত ভারতে সমস্যা সমাধানের ও রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার প্রচেষ্টা চালানো হয়, রাজপথে নয়। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনে দুর্নীতিমূলক আচরণের জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টই ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভার সদস্যপদ বাতিল করেন, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকরতারই প্রতিফলন।
মিছিল, হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট ইত্যাদি অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, বরং এগুলোর মাধ্যমে সমস্যা আরও ব্যাপক ও প্রকট আকার ধারণ করে। বিরোধী দলের রাজপথের আন্দোলন প্রতিহত করতে গিয়ে সরকারও রাজপথে তা মোকাবিলা করার নামে সাধারণত দমননীতির আশ্রয় নেয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্ব-সহিংসতায় রূপ নেয়। এভাবে অবস্থা নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে চলে যেতে পারে, যা অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতা দখলের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
ভারতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ধারাবাহিকতা রক্ষার পেছনে সরকারের বাইরেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা নাগরিক সমাজ হিসেবে পরিচিত এবং গণমাধ্যম যার অংশ। নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট ছোবলে ভারতীয় নাগরিক সমাজ বিভক্ত হয়নি। ফায়দাতন্ত্রের বিষাক্ত থাবাও সেখানে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত নয়, যা নাগরিকের নিরপেক্ষ আচরণের পথে একটি বড় বাধা। সেখানে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও হুমকি-ধমকি নেই। ফলে ভারতীয় নাগরিক সমাজ অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও নাগরিকের অধিকার হরণের পথে অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ, যাকে সুশীল সমাজ বলে প্রতিনিয়ত গাল দেওয়া হয়, আজ অত্যন্ত করুণ অবস্থায় এবং সংগত কারণেই তারা নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর এর পরিণাম মঙ্গলজনক নয়। কারণ বলিষ্ঠ নাগরিক সমাজ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র কার্যকারতা লাভ করেনি।
এটি সুস্পষ্ট যে একটি গ্রহণযোগ্য আইনি কাঠামো, কতগুলো কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও সোচ্চার নাগরিক সমাজের কারণে ভারতীয় গণতন্ত্র অগণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রতিহত করতে পেরেছে। তাই গণতন্ত্রকে সুসংহত ও দৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে আমাদেরও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে এবং রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যা সমাধানের পথে এগোতে হবে। যেমন, বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রেখে মামলা প্রত্যাহারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে সংস্কার-প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর করতে হবে।
পৃথিবীর দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ইতিহাস থেকেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। পাশ্চাত্যের, বিশেষত ইউরোপের দেশসমূহে আজ যে গণতন্ত্রের চর্চা করা হয়, তা নির্বাচন দিয়ে শুরু হয়নি। সেসব দেশে নাগরিক সমাজের এবং অসংখ্য পণ্ডিতের শত শত বছরের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে প্রথমে আইনের শাসন ও নাগরিকদের বাক্-স্বাধীনতাসহ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে কতগুলো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে, ক্ষমতার বিভাজন নীতি অনুসরণে, সামন্তবাদী প্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। তার পরই আস্তে আস্তে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়, যা বিংশ শতাব্দীতে এসে সর্বজনীন ভোটাধিকারে রূপ নেয়। তাই বিরাজমান নির্বাচনসর্বস্ব ‘এক দিনের গণতন্ত্র’-এর বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের গণতন্ত্রচর্চা করতে হলে আমাদেরও নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠান গড়ার এবং কার্যকর করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
No comments