ধীরে চালাও তরণী -চিরকুট by শাহাদুজ্জামান
ওয়াশিংটনের একটি মেট্রো স্টেশনে সকালবেলা বেহালা বাজাতে শুরু করেন একজন। স্টেশনে শত শত মানুষের ঢল। মহা ব্যস্ততায় কাজে যাচ্ছেন সবাই। বেহালাবাদকের দিকে লক্ষ করার ফুরসত নেই কারও। বেহালাবাদক মহান সুরকার সিবাস্তিয়ান বাখের সুর বাজাতে থাকেন।
একজন মাঝবয়সী লোক বেহালাবাদকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গতি একটু শ্লথ করেন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মেট্রো আসতেই দ্রুত চলে যান তিনি। কিছুক্ষণ পর সেই বাদক তাঁর দিনের প্রথম কয়েনটি পান। আরও কিছু সময় পেরিয়ে গেলে একজন মহিলা চলতে চলতেই ফ্লোরে উল্টে রাখা বেহালাবাদকের টুপিতে ছুড়ে দেন আরেকটি কয়েন। মানুষের স্রোত চলেছে বেহালাবাদকের চারপাশ দিয়ে। একজন লোক সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বেহালা শোনেন কিন্তু একটু পরই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে সরে পড়েন। বেহালাবাদকের দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয় একটি তিন বছরের শিশু। শিশুটি বেহালাবাদকের সামনে দাঁড়িয়ে একাগ্র হয়ে বেহালা শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু তার মা তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকলে শিশুটি হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে যতক্ষণ সম্ভব বেহালাবাদককে দেখতে থাকে। বেহালাবাদক ঘণ্টাখানেক পর তাঁর বাজনা থামান। বলা বাহুল্য, কোনো তালি বাজে না। মেট্রো স্টেশনে হঠাত্ নেমে আসে সংগীতহীন নীরবতা। বেহালাবাদক তাঁর টুপির কয়েনগুলো গুনে দেখেন, রোজগার হয়েছে সাকল্যে ৩২ ডলার।
কেউ টের পায় না, মেট্রোতে এতক্ষণ যিনি বেহালা বাজালেন তিনি আসলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাদকদের একজন, জোসুয়া বেল, যাঁর সংগীত বিক্রি হয় মিলিয়ন ডলারে। মাত্র দুই দিন আগে বোস্টনে যাঁর কনসার্ট হয়ে গেছে, যে কনসার্টের প্রতিটি টিকিটের দাম ছিল ১০০ ডলার; কিন্তু একটি সাধারণ স্থানে, অনুপযোগী একটি সময়ে, অপ্রত্যাশিত একটি পরিস্থিতিতে কেউই চিনে উঠতে পারেনি জোসুয়া বেলকে। বেল মেট্রোতে ভিখারি সেজে বেহালা বাজিয়েছিলেন বস্তুত একটি গবেষণার অংশ হিসেবে। গবেষকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, মানুষ যখন তাড়ায় থাকে তখন তার পক্ষে সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব হয় না। তার সামনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী শ্রেষ্ঠতম সুর বাজালেও তা তার নজর এড়িয়ে যায়।
তাড়াহুড়ায় হয়তো অবিরাম আমরা জীবনের এমনি ছোট-বড় অগণিত মাধুরী উপেক্ষা করে যাচ্ছি। আমরা সবাই বস্তুত একেকটি তাড়া খাওয়া প্রাণীতে পরিণত হয়েছি। সিংহের হুঙ্কারে ভীত তাড়া খাওয়া জেব্রা যেমন ছুটে চলে প্রান্তরে। জীবিকার প্রতিযোগিতায় সিংহ হুঙ্কার দিচ্ছে পেছনে আর আমরা ছুটে চলেছি সবাই। প্রান্তরেই ছুটছি। জানি না, কোথায় ঠিক নিরাপদ আশ্রয়। ছুটে চলা মানুষের সময় কোথায় কাচপোকার ওড়াওড়ি দেখার। কান পেতে শোনার, কে গাইছে ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’। সৌন্দর্য উপভোগ করানোর জন্য চাই অবসর। ছুটে চলা মানুষ একে অন্যকেও বা জানবে কী করে? জীবনের লেনদেন এতটাই ব্যস্ত করে ফেলেছে আমাদের যে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে কেবলই দূরে সরে যাচ্ছি, যেমন মহাশূন্যে তারারা নিরন্তর একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। সব পাখি ঘরে ফিরলে, জীবনের সব লেনদেন ফুরালে যে অন্ধকার নামে সেখানে স্থির হয়ে মুখোমুখি বসলেই কেবল বনলতা সেনকে চেনা যায়।
জীবনের লেনদেন পশ্চিমা দুনিয়ায় এসে ঠেকেছে ভোগে আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নিছক টিকে থাকায়। দুটোর জন্যই ছুটতে হচ্ছে দুই পক্ষকে। সব মিলিয়ে আমাদের তুমুল ব্যতিব্যস্ত রাখছে জীবন। পশ্চিমা দুনিয়ার দ্রুততা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন এখানকার চিন্তাবিদেরাও। লেখক মিলান কুন্ডেরা সম্প্রতি উপন্যাস লিখেছেন স্লোনেস নামে। দ্রুততাকে তিনি তুলনা করেছেন বিস্মৃতির সঙ্গে, গতির মানসিক নেতিবাচকতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন তিনি। বাংলা উপন্যাসের পাঠকের কাছে অবধারিত মনে পড়ে যাবে যাযাবরের সেই পুরোনো সংলাপ, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। শুধু আবেগ নয়, পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন জীবনই কেড়ে নিচ্ছে বেগ। ডায়রিয়া, যক্ষ্মা নয় পশ্চিমা বহু দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ এখন মোটরগাড়ি অ্যাকসিডেন্ট। নিজেদের তৈরি বাহারি গাড়িতে দ্রুততম সময় ছুটতে গিয়ে অবিরাম মরছে তারা। বহুকাল আগে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘মোটরগাড়ি আমার কাছে একটা বড় খটকার ব্যাপার মনে হয়। আমি যেখানে যেতে চাই সেখানে পায়ে হেঁটে যাবার অবসর আমার আছে।’ ব্যাপারটিকে নেহাত কবিসুলভ রোমান্টিকতা মনে হলেও কৌতূহলোদ্দীপকভাবে দেখতে পাচ্ছি, মোটরগাড়ি একটা খটকার ব্যাপার বলেই আজকাল জোরে আওয়াজ তুলছে পশ্চিমা দেশের বহু মানুষ। পরিবেশবিদেরা গাড়ির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
ইউরোপের প্রায় ৪০টি দেশ বছরে এক দিন গাড়িবিহীন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করে উচ্চ পার্কিং মূল্য ধার্য করে গাড়িকে নিরুত্সাহিত করার চেষ্টা চলছে। খটকার মোটরগাড়িগুলো আমাদের মতো চাপা শহরগুলোতে গাদাগাদি করে পাঠিয়ে ইউরোপের শহরগুলোতে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে বাইসাইকেল। বিপদ টের পেয়ে গতি শ্লথ করার একটা হাওয়া ওঠালেও ব্যাপারটি অত সহজ হচ্ছে না, কারণ পেছন থেকে শিং দিয়ে ঠেলছে গাড়ি ব্যবসায়ীর দল। আর শিং তো মনের ভেতরেই গজিয়েছে সবার, যে শিং বিলাসের, প্রতিযোগিতার। সেই শিংয়ের গুঁতোয় ছুটে চলা আর থামছে না। ছুটতে গিয়ে ওরা মরছে আর আমরা জট পাকিয়ে বসে আছি। কে জানে হয়তো রক্ষা হতো পুরোপুরি ডোবার আগে কেউ যদি সবার কানে কানে বলে যেত, ‘নাইয়া, ধীরে চালাও তরণী।’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
একজন মাঝবয়সী লোক বেহালাবাদকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গতি একটু শ্লথ করেন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মেট্রো আসতেই দ্রুত চলে যান তিনি। কিছুক্ষণ পর সেই বাদক তাঁর দিনের প্রথম কয়েনটি পান। আরও কিছু সময় পেরিয়ে গেলে একজন মহিলা চলতে চলতেই ফ্লোরে উল্টে রাখা বেহালাবাদকের টুপিতে ছুড়ে দেন আরেকটি কয়েন। মানুষের স্রোত চলেছে বেহালাবাদকের চারপাশ দিয়ে। একজন লোক সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বেহালা শোনেন কিন্তু একটু পরই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে সরে পড়েন। বেহালাবাদকের দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয় একটি তিন বছরের শিশু। শিশুটি বেহালাবাদকের সামনে দাঁড়িয়ে একাগ্র হয়ে বেহালা শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু তার মা তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকলে শিশুটি হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে যতক্ষণ সম্ভব বেহালাবাদককে দেখতে থাকে। বেহালাবাদক ঘণ্টাখানেক পর তাঁর বাজনা থামান। বলা বাহুল্য, কোনো তালি বাজে না। মেট্রো স্টেশনে হঠাত্ নেমে আসে সংগীতহীন নীরবতা। বেহালাবাদক তাঁর টুপির কয়েনগুলো গুনে দেখেন, রোজগার হয়েছে সাকল্যে ৩২ ডলার।
কেউ টের পায় না, মেট্রোতে এতক্ষণ যিনি বেহালা বাজালেন তিনি আসলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাদকদের একজন, জোসুয়া বেল, যাঁর সংগীত বিক্রি হয় মিলিয়ন ডলারে। মাত্র দুই দিন আগে বোস্টনে যাঁর কনসার্ট হয়ে গেছে, যে কনসার্টের প্রতিটি টিকিটের দাম ছিল ১০০ ডলার; কিন্তু একটি সাধারণ স্থানে, অনুপযোগী একটি সময়ে, অপ্রত্যাশিত একটি পরিস্থিতিতে কেউই চিনে উঠতে পারেনি জোসুয়া বেলকে। বেল মেট্রোতে ভিখারি সেজে বেহালা বাজিয়েছিলেন বস্তুত একটি গবেষণার অংশ হিসেবে। গবেষকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, মানুষ যখন তাড়ায় থাকে তখন তার পক্ষে সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব হয় না। তার সামনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী শ্রেষ্ঠতম সুর বাজালেও তা তার নজর এড়িয়ে যায়।
তাড়াহুড়ায় হয়তো অবিরাম আমরা জীবনের এমনি ছোট-বড় অগণিত মাধুরী উপেক্ষা করে যাচ্ছি। আমরা সবাই বস্তুত একেকটি তাড়া খাওয়া প্রাণীতে পরিণত হয়েছি। সিংহের হুঙ্কারে ভীত তাড়া খাওয়া জেব্রা যেমন ছুটে চলে প্রান্তরে। জীবিকার প্রতিযোগিতায় সিংহ হুঙ্কার দিচ্ছে পেছনে আর আমরা ছুটে চলেছি সবাই। প্রান্তরেই ছুটছি। জানি না, কোথায় ঠিক নিরাপদ আশ্রয়। ছুটে চলা মানুষের সময় কোথায় কাচপোকার ওড়াওড়ি দেখার। কান পেতে শোনার, কে গাইছে ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’। সৌন্দর্য উপভোগ করানোর জন্য চাই অবসর। ছুটে চলা মানুষ একে অন্যকেও বা জানবে কী করে? জীবনের লেনদেন এতটাই ব্যস্ত করে ফেলেছে আমাদের যে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে কেবলই দূরে সরে যাচ্ছি, যেমন মহাশূন্যে তারারা নিরন্তর একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। সব পাখি ঘরে ফিরলে, জীবনের সব লেনদেন ফুরালে যে অন্ধকার নামে সেখানে স্থির হয়ে মুখোমুখি বসলেই কেবল বনলতা সেনকে চেনা যায়।
জীবনের লেনদেন পশ্চিমা দুনিয়ায় এসে ঠেকেছে ভোগে আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নিছক টিকে থাকায়। দুটোর জন্যই ছুটতে হচ্ছে দুই পক্ষকে। সব মিলিয়ে আমাদের তুমুল ব্যতিব্যস্ত রাখছে জীবন। পশ্চিমা দুনিয়ার দ্রুততা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন এখানকার চিন্তাবিদেরাও। লেখক মিলান কুন্ডেরা সম্প্রতি উপন্যাস লিখেছেন স্লোনেস নামে। দ্রুততাকে তিনি তুলনা করেছেন বিস্মৃতির সঙ্গে, গতির মানসিক নেতিবাচকতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন তিনি। বাংলা উপন্যাসের পাঠকের কাছে অবধারিত মনে পড়ে যাবে যাযাবরের সেই পুরোনো সংলাপ, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। শুধু আবেগ নয়, পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন জীবনই কেড়ে নিচ্ছে বেগ। ডায়রিয়া, যক্ষ্মা নয় পশ্চিমা বহু দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ এখন মোটরগাড়ি অ্যাকসিডেন্ট। নিজেদের তৈরি বাহারি গাড়িতে দ্রুততম সময় ছুটতে গিয়ে অবিরাম মরছে তারা। বহুকাল আগে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘মোটরগাড়ি আমার কাছে একটা বড় খটকার ব্যাপার মনে হয়। আমি যেখানে যেতে চাই সেখানে পায়ে হেঁটে যাবার অবসর আমার আছে।’ ব্যাপারটিকে নেহাত কবিসুলভ রোমান্টিকতা মনে হলেও কৌতূহলোদ্দীপকভাবে দেখতে পাচ্ছি, মোটরগাড়ি একটা খটকার ব্যাপার বলেই আজকাল জোরে আওয়াজ তুলছে পশ্চিমা দেশের বহু মানুষ। পরিবেশবিদেরা গাড়ির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
ইউরোপের প্রায় ৪০টি দেশ বছরে এক দিন গাড়িবিহীন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করে উচ্চ পার্কিং মূল্য ধার্য করে গাড়িকে নিরুত্সাহিত করার চেষ্টা চলছে। খটকার মোটরগাড়িগুলো আমাদের মতো চাপা শহরগুলোতে গাদাগাদি করে পাঠিয়ে ইউরোপের শহরগুলোতে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে বাইসাইকেল। বিপদ টের পেয়ে গতি শ্লথ করার একটা হাওয়া ওঠালেও ব্যাপারটি অত সহজ হচ্ছে না, কারণ পেছন থেকে শিং দিয়ে ঠেলছে গাড়ি ব্যবসায়ীর দল। আর শিং তো মনের ভেতরেই গজিয়েছে সবার, যে শিং বিলাসের, প্রতিযোগিতার। সেই শিংয়ের গুঁতোয় ছুটে চলা আর থামছে না। ছুটতে গিয়ে ওরা মরছে আর আমরা জট পাকিয়ে বসে আছি। কে জানে হয়তো রক্ষা হতো পুরোপুরি ডোবার আগে কেউ যদি সবার কানে কানে বলে যেত, ‘নাইয়া, ধীরে চালাও তরণী।’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
No comments