আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আত্মোত্সর্গ -ঈদুল আজহা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
‘ঈদুল আজহা’ শব্দদ্বয় আরবি। ‘ঈদ’ অর্থ খুশি আর ‘আজহা’ অর্থ কোরবানি বা আত্মোত্সর্গ। তাই ‘ঈদুল আজহা’ অর্থ হলো আত্মোত্সর্গের খুশি। মূলত মুসলমানদের ঈদের খুশি সাধারণ অর্থে নয়; বরং উত্সর্গ ও ত্যাগের মাধ্যমে ধর্মীয় কর্তব্য পালনের আনন্দ। ঈদুল আজহার সঙ্গে কোরবানি সম্পৃক্ত বিধায় একে কোরবানির ঈদ বলা হয়। ‘কোরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরব’ ধাতু থেকে উদ্ভূত, এর অর্থ হলো নৈকট্য; আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে আত্মোত্সর্গ করাই কোরবানি। শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর নামে কোনো কিছু উত্সর্গ করাকে কোরবানি বলে। প্রচলিত অর্থে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নির্দিষ্ট কিছু হালাল পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির একটি নিয়ম নির্দিষ্ট করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩৪)
কোরবানি করার বিষয়টি মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। নবী করিম (সা.)-এর শরিয়তের আগেও এর প্রচলন ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীরা কোরবানি করেছেন। তবে একেক উম্মতের কোরবানির পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন রকম। ইতিহাসে হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোরবানির সূত্রপাত হয়। আল্লাহ তাআলা তাদের কোরবানির কথা উল্লেখ করেছেন, ‘(হে নবী!) আর তুমি তাদের আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) ঘটনা সঠিকভাবে শুনিয়ে দাও। যখন উভয়েই এক একটি কোরবানি উপস্থিত করল এবং তন্মধ্য থেকে একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হলো আর অপরজনের কবুল হলো না; সেই অপরজন বলতে আরম্ভ করল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। উত্তরে সে বলল, ‘আল্লাহ ধর্মভীরুদের কোরবানি কবুল করে থাকেন।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২৭)
এরপর আল্লাহর নবী হজরত নূহ (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.) ও হজরত মূসা (আ.)-এর সময়ও কোরবানির প্রচলন ছিল। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ-প্রেমে স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আদিষ্ট হন। তিনি পরপর তিন দিন দৈনিক ১০০ করে মোট ৩০০ উট কোরবানি করেন। কিন্তু কোরবানি কবুল হলো না, বারবার আদেশ করা হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি কর’। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন, প্রাণাধিক প্রিয়পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উত্সর্গ করতে হবে।
শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) নিজের জানকে আল্লাহর রাহে উত্সর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বস্তুত হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি এটা ছিল আল্লাহ তাআলার কঠিন পরীক্ষা মাত্র। তাই ধারালো ছুরি হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর একটি পশমও কাটতে পারেনি। এর পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে বেহেশত থেকে দুম্বা এসে হাজির হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টাপ্রেমে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কোরবানি। আত্মত্যাগের সুমহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য কোরবানি করাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাঁদের স্মরণে এ বিধান অনাদিকাল তথা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর সমীপে না তার গোশত পৌঁছে, আর না তার রক্ত; বরং আল্লাহর কাছে তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে থাকে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩৭)
কাল পরিক্রমায় প্রতিবছর হজের পরে ঈদুল আজহা ফিরে আসে। ঈদুল আজহার প্রধান আকর্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কোরবানি। ঈদের দিন কোরবানিকে কেন্দ্র করে ধুমধামের সঙ্গে চলে ঈদের মহোত্সব। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, খুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্লমন হও।’ (ইবনে মাজা, তিরমিজি)
কোরবানির মর্মবাণী সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া মুস্তাহাব। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরিব-দুঃখীদের দান করে দিতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত, দীন-দুঃখী ও শীতার্তরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষ্যে কেবল ভোগ নয়, ত্যাগ-তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত অকাতরে বিলিয়ে দিতে হবে এবং তাদের দান-খয়রাত করতে হবে। মুমিন মুসলমানদের মনে রাখা প্রয়োজন হালাল উপার্জন, ইখলাস এবং একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার অপরিহার্য শর্ত। কোরবানি হতে হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে খুশি করার জন্য। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘বলো! আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু, সবকিছু আল্লাহর জন্য, যিনি সারা জাহানের মালিক ও প্রভু।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৬২)
ঈদুল আজহা আমাদের শিক্ষা দেয় আল্লাহপ্রেমে পূর্ণ তাকওয়া বা আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা নিয়ে কোরবানি করতে হবে, লোক দেখানোর জন্য নয়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এ কোরবানির উত্সব বা ঈদুল আজহা শুধু প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্র নয়। এর প্রকৃত রূপ হলো মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর নামে উত্সর্গ করা। তাই কোরবানির মধ্যে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর (কোরবানির) উটগুলোকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের বহুবিধ কল্যাণ নিহিত আছে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩৬)
যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ সুদৃঢ় প্রত্যয় ও ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের অনুসারীরাও তাঁদের অনুসৃত পথে চলেছেন। তাই মুসলমানদের শুধু কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো স্রষ্টাপ্রেমে জাগরিত হয়ে জানমাল নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য সবাইকে উত্সর্গিত ও নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অন্তর থেকে পাশবিক শক্তিকেও কোরবানি করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কোরবানি জীব-জানোয়ার বা পশু হনন করতে আসে না, বরং গৃহপালিত পশু কোরবানির মাধ্যমে পাশবিক প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার যে এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা সে অতিসূক্ষ্ম কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা প্রতিবছর ফিরে আসে।
আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে ইসলামের ইতিহাসে কোরবানির সঠিক দীক্ষা নিয়ে সুন্দর সচেতন সুশীল সমাজ, পাপমুক্ত পরিবেশ, হিংসামুক্ত রাজনীতি, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ, প্রেম ও ভালোবাসা বিজড়িত বিশ্ব গড়ে তুলি। ত্যাগ-উত্সর্গের মাধ্যমে অসহায় নিরন্ন-আশ্রয়হীন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটাই। তাহলেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনাবিল সুখ-শান্তির ফল্গুধারা, আর আদায় হবে পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির পরম সার্থকতা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo
কোরবানি করার বিষয়টি মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। নবী করিম (সা.)-এর শরিয়তের আগেও এর প্রচলন ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীরা কোরবানি করেছেন। তবে একেক উম্মতের কোরবানির পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন রকম। ইতিহাসে হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোরবানির সূত্রপাত হয়। আল্লাহ তাআলা তাদের কোরবানির কথা উল্লেখ করেছেন, ‘(হে নবী!) আর তুমি তাদের আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) ঘটনা সঠিকভাবে শুনিয়ে দাও। যখন উভয়েই এক একটি কোরবানি উপস্থিত করল এবং তন্মধ্য থেকে একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হলো আর অপরজনের কবুল হলো না; সেই অপরজন বলতে আরম্ভ করল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। উত্তরে সে বলল, ‘আল্লাহ ধর্মভীরুদের কোরবানি কবুল করে থাকেন।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২৭)
এরপর আল্লাহর নবী হজরত নূহ (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.) ও হজরত মূসা (আ.)-এর সময়ও কোরবানির প্রচলন ছিল। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ-প্রেমে স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আদিষ্ট হন। তিনি পরপর তিন দিন দৈনিক ১০০ করে মোট ৩০০ উট কোরবানি করেন। কিন্তু কোরবানি কবুল হলো না, বারবার আদেশ করা হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি কর’। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন, প্রাণাধিক প্রিয়পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উত্সর্গ করতে হবে।
শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) নিজের জানকে আল্লাহর রাহে উত্সর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বস্তুত হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি এটা ছিল আল্লাহ তাআলার কঠিন পরীক্ষা মাত্র। তাই ধারালো ছুরি হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর একটি পশমও কাটতে পারেনি। এর পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে বেহেশত থেকে দুম্বা এসে হাজির হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টাপ্রেমে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কোরবানি। আত্মত্যাগের সুমহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য কোরবানি করাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাঁদের স্মরণে এ বিধান অনাদিকাল তথা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর সমীপে না তার গোশত পৌঁছে, আর না তার রক্ত; বরং আল্লাহর কাছে তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে থাকে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩৭)
কাল পরিক্রমায় প্রতিবছর হজের পরে ঈদুল আজহা ফিরে আসে। ঈদুল আজহার প্রধান আকর্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কোরবানি। ঈদের দিন কোরবানিকে কেন্দ্র করে ধুমধামের সঙ্গে চলে ঈদের মহোত্সব। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, খুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্লমন হও।’ (ইবনে মাজা, তিরমিজি)
কোরবানির মর্মবাণী সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া মুস্তাহাব। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরিব-দুঃখীদের দান করে দিতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত, দীন-দুঃখী ও শীতার্তরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষ্যে কেবল ভোগ নয়, ত্যাগ-তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত অকাতরে বিলিয়ে দিতে হবে এবং তাদের দান-খয়রাত করতে হবে। মুমিন মুসলমানদের মনে রাখা প্রয়োজন হালাল উপার্জন, ইখলাস এবং একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার অপরিহার্য শর্ত। কোরবানি হতে হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে খুশি করার জন্য। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘বলো! আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু, সবকিছু আল্লাহর জন্য, যিনি সারা জাহানের মালিক ও প্রভু।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৬২)
ঈদুল আজহা আমাদের শিক্ষা দেয় আল্লাহপ্রেমে পূর্ণ তাকওয়া বা আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা নিয়ে কোরবানি করতে হবে, লোক দেখানোর জন্য নয়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এ কোরবানির উত্সব বা ঈদুল আজহা শুধু প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্র নয়। এর প্রকৃত রূপ হলো মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর নামে উত্সর্গ করা। তাই কোরবানির মধ্যে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর (কোরবানির) উটগুলোকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের বহুবিধ কল্যাণ নিহিত আছে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩৬)
যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ সুদৃঢ় প্রত্যয় ও ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের অনুসারীরাও তাঁদের অনুসৃত পথে চলেছেন। তাই মুসলমানদের শুধু কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো স্রষ্টাপ্রেমে জাগরিত হয়ে জানমাল নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য সবাইকে উত্সর্গিত ও নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অন্তর থেকে পাশবিক শক্তিকেও কোরবানি করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কোরবানি জীব-জানোয়ার বা পশু হনন করতে আসে না, বরং গৃহপালিত পশু কোরবানির মাধ্যমে পাশবিক প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার যে এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা সে অতিসূক্ষ্ম কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা প্রতিবছর ফিরে আসে।
আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে ইসলামের ইতিহাসে কোরবানির সঠিক দীক্ষা নিয়ে সুন্দর সচেতন সুশীল সমাজ, পাপমুক্ত পরিবেশ, হিংসামুক্ত রাজনীতি, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ, প্রেম ও ভালোবাসা বিজড়িত বিশ্ব গড়ে তুলি। ত্যাগ-উত্সর্গের মাধ্যমে অসহায় নিরন্ন-আশ্রয়হীন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটাই। তাহলেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনাবিল সুখ-শান্তির ফল্গুধারা, আর আদায় হবে পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির পরম সার্থকতা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo
No comments