ঈদ মানে সবার জন্য আনন্দ -উৎসব by মোজাফ্ফর আহমদ
ঈদ অর্থ আনন্দ—এ তো আমাদের সবারই জানা, কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি—ঈদ অর্থ সবার জন্য আনন্দ? আজকাল সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য শিক্ষা, সবার সমান অধিকার এমন নানা কথা নানা সময়ে নানা উচ্চারণে আমরা শুনে থাকি। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা যে অনেক কঠিন এবং এ জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের নিত্যসময়ের সার্বিক অঙ্গীকার ও কার্যক্রম প্রয়োজন হয় সে বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলন ও কার্যক্রম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। সবার জন্য শিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা ব্যক্তিক ও জাতীয় সক্ষমতা সৃষ্টি করতে চাই, যার মাধ্যমে সমাজ এবং ব্যক্তি সৃজনশীল ও সচল হয়ে ওঠে। কিন্তু এও আমাদের অভিজ্ঞতা, সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা একটি কঠিন সংগ্রাম। এখানে কেবল অর্থ অথবা পরিকাঠামো থাকলেই হয় না। এ জন্য প্রয়োজন হয় নিবেদিত শিক্ষা-অন্তপ্রাণ একদল কর্মীর, যাঁরা শিক্ষার্থীদের কাছে টানেন, তাদের মনের পাললিক স্তরে মূল্যবোধের বীজ উপ্ত করেন, যা থেকে সার্বিকভাবে দায়বদ্ধ একটি মন ও মননের মহিরুহ সৃষ্টি হয়। এই মহিরুহ যখন ফুল, পাতা ও ফলে সুশোভিত হয় এবং তার সুবাসে ও সুফলে নানাজন নানাভাবে আকর্ষিত হয়ে জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া পায়, তখনই সবার জন্য শিক্ষা সুন্দর ও সুস্থ সমাজের বাস্তবতাকে অর্জন করে।
সবার জন্য স্বাস্থ্য এমনি আরেকটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রক্রিয়া। সুস্বাস্থ্য কেবল সুন্দর জীবনের ভিত রচনা করে না, এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নীরব, মঙ্গলদায়ী ও কর্মক্ষম সমাজের অবস্থা নির্ণয় করে। এ কাজও অনেক কঠিন। আমরা জানি যে অনেক উন্নত দেশে আজও সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিষম সমাজ অনেককে সক্ষমতার গণ্ডিতে প্রবেশই করতে দেয় না। দুস্থ ও বঞ্চিত মানুষ সমাজের নানা স্তরে নানাভাবে ছড়িয়ে থাকে। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে নানা কারণে নানা সময়ে বিভিন্ন জন অসুস্থ থেকে সমাজের অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এর ফলে আত্মহনন থেকে অন্যের অধিকার হরণের বিচিত্র মানসিকতা আমরা বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসের নানা বাঁকে, সমাজের নানা স্তরে বিচিত্ররূপে দেখতে পেয়েছি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সবার জন্য আনন্দ—আমাদের আদর্শই স্মরণ করিয়ে দেয়—এটি নিশ্চিত করতে হলে সমাজকে প্রস্তুত হতে হয়। অন্যভাবে বললে, সমাজকে প্রস্তুত করতে হয়। যে সমাজ মানুষের একত্ম এবং বহুবিধ বিভিন্নতাকে গ্রহণ করে এর মনুষ্যত্ববিনাশী মননকে ত্যাগ করতে পারে, সে সমাজেই বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও একে অন্যের জন্য সংবেদী মন সৃষ্টি হয়। যখন আমরা অন্যকে কাছে টানতে ব্যর্থ হই, বিভেদ যেখানে বড় হয়ে ওঠে, সেখানে সুন্দরকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না, সেখানে এই আনন্দের সমদর্শিতা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই আনন্দের একটি ভিত হলো অন্যের জন্য অনুভব করা এবং অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া। আজকালকার ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজে প্রতিযোগিতার নামে আমরা মানুষকে কাছে না টেনে অনেক সময়ই দূরে ঠেলে দিই। আমরা এগিয়ে যেতে চাই, তাই অন্যকে পেছনে ফেলে দিই। সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়ার যে আনন্দ সেটা আমাদের হূদয়ে অনুভবও করি না। মানুষ যখন সৃষ্টিকর্তার নামে এক সারিতে দাঁড়ায়, সেটা কেবল তথাকথিত সাম্য ও ঐক্যের প্রতীক নয়। সেখানে সুষম সমাজের একটি আন্তরিক কামনা ও বাসনা বিমূর্ত হয়ে ওঠে।
আজকালকার বস্তুবাদী সমাজে ভাববাদী আনন্দের বিষয়টি অনেক সময়ই উপেক্ষার বিষয় হয়। তবে স্মরণ রাখতে হবে, ভাববাদী আনন্দেরও একটি বস্তুগত ভিত্তি থাকতে হয়। সেই বস্তুগত ভিত্তি তৈরি হতে হয় সামাজিক প্রক্রিয়ায়, যেখানে বিত্ত এক মানুষের পরিচয় নয়, তার চিত্তের সম্পদ তাকে বিশিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেয়। আজকের পৃথিবীতে আমরা উন্নয়নের মাপকাঠিতে বিভাজিত নানা স্তরে দেশগুলোকে দেখি। আমরা এও দেখি যে, নানা দেশের মধ্যে যে আন্তসম্পর্ক সেখানে নৈতিকতা ও নীতিমান্যতা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়। যার প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা যত বেশি, পৃথিবীর নানা সম্পর্কীয় রঙ্গমঞ্চে সে তত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। নিজের ভোগবাদিতার মাধ্যমে ও ক্ষমতা সংরক্ষণের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংঘাতের মধ্য দিয়ে আজ পৃথিবীর পরিবেশ এক সংকটময় অবস্থানে এসে উপনীত। এই অতিভোগবাদিতা ও ক্ষমতালিপ্সা আমাদের সভ্যতাকেই বিপন্ন করে তুলেছে। সেখানেও আমরা দেখতে পাই শক্তিধরের ভোগবাদী জীবনের আকাঙ্ক্ষা। পৃথিবীর শতকোটি বঞ্চিত মানুষের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করার এক মানসিকতা যেটা শিক্ষিত মনন ও সুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে না। আমাদের সমাজেও এই দুষ্ট ক্ষতের নানা পরিচয় নানাভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করি। এখানে যার অনেক আছে সে আরও অনেক চায়। যার ক্ষমতা আছে সে মঙ্গলের জন্য নিজেকে নিবিষ্ট না করে অন্যের অমঙ্গলের মাধ্যমে নিজের স্ফীত ভোগবাদী মানসিকতার পরিচয় রাখে। সে কারণে যখন আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও তীব্র দুঃখ-কষ্টের যাতনায় পিষ্ট হয়, তখন নানা রকম বাণিজ্যিক বিপণন ও ভোগবাদী নানা পণ্যের বিভিন্ন রকম প্রসার এই কষ্ট ও দুঃখকে আরও তীব্র করে তোলে।
সবার জন্য আনন্দ নিশ্চিত করতে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে দান ও খয়রাত যথেষ্ট নয়। এই আনন্দ সর্বজনীন হয়ে উঠতে সমাজব্যবস্থাকেই পরিবর্তনের প্রয়োজন। সে সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও পরিবর্তন আবশ্যক। রাষ্ট্রকে হতে হবে সর্ব মানুষের কল্যাণে নিরত একটি সেবাধর্মী ও মাঙ্গলিক ব্যবস্থা, যেখানে সবার অধিকার সমান হতে হবে, সবার কণ্ঠের উচ্চারণ শ্রুত হতে হবে, সবার মন ও মানসিকতা এমন হতে হবে যেখানে অন্যের বঞ্চনা নিজের বঞ্চনা বলে মনে হবে এবং সে কারণে বঞ্চনা বিদূরণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব লাভকারী প্রতিনিধিরা প্রথমে অন্যের মঙ্গলে নিজেকে সঁপে দেবেন। যেমনটি—আমাদের কাছে এখন রূপকথার মতো শোনায়—সেই প্রজাহিতৈষী মানবতাবাদী খলিফা ও শাসকদের মধ্যে দেখেছি এবং যেটা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ক্ষমতা যে দায়িত্বের অন্যরূপ এবং ক্ষমতার ব্যবহার যে দায়বদ্ধরূপে করতে হয় এবং ক্ষমতা ব্যবহার যে জবাবদিহির জন্ম দেয়, এ চেতনা আজ সমুন্নত নয় বলেই রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার হয় এমনভাবে যেখানে ক্ষুদ্রস্বার্থ বৃহত্ স্বার্থকে দলিত করে, গোষ্ঠীস্বার্থ বা দলগত স্বার্থ মানবতাকে নিপিষ্ট করে। এই রাষ্ট্রযন্ত্র পরিবর্তনে প্রয়োজন হয় সমাজের স্তরীকরণকে ভেঙে মানুষকে এবং সে সঙ্গে নানা জীব ও সৃষ্টির অন্য সম্পদকে এমনভাবে বিবেচনায় আনা, যেখানে অন্যের প্রয়োজন অনেক বেশি গুরুত্ব পায়, নিজের প্রয়োজন, স্বার্থ ও নিরাপত্তার চেয়ে।
এই সমাজ বিনির্মাণে আমাদের সকল কর্মে মানবিক নীতিমান্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আজকালকার পৃথিবীতে নানাভাবে মানবতা লাঞ্ছিত হয়, অন্যের অধিকার অস্বীকৃত থেকে যায় এবং বৈষম্যকে আমরা অগ্রগমনের মাপকাঠি বলে ধরে নিই। এ কারণে নানাভাবে আমাদের সমাজে ঢুকে পড়ে তথাকথিত উন্নয়ন সংস্থা, যারা আত্মশক্তি সৃষ্টি না করে একটি পরনির্ভরশীল অবস্থা ও মানসিকতার জন্ম দেয়। এই পৃথিবীতে নানাভাবে আমরা একে অন্যের সাহায্য গ্রহণ করি, একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকি। কিন্তু সে সম্পর্কের ভিত্তি হলো সমদর্শিতা এবং সমসক্ষমতা। যেখানেই এর ব্যত্যয় ঘটে, সেখানেই আসে এর বিভাজন, বিভাজন থেকে বৈষম্য, বৈষম্য থেকে নিরানন্দ অবস্থান।
আমরা যখন যান্ত্রিকভাবে ঈদের উত্সব পালন করি, তখন সবার জন্য আনন্দ এই ভাবনা আমাদের ভেতরে থাকে না। আমরা আমাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি। নিকটজনের আনন্দকেই প্রাধান্য দিই এবং এই বাণিজ্যিকায়নকৃত প্রতিযোগী সমাজে কারণে-অকারণে বঞ্চিত হওয়ার বেদনা অনুভব করি। যদি আমরা এই বিষম পৃথিবীর বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ও সমাজিকভাবে স্তরীকৃত মানুষের মধ্যে আমাদের চেয়ে নিচে যাদের অবস্থান, তাদের কথা ভাবতে পারতাম, তাদের কাছে যেতে পারতাম এবং তাদের আনন্দিত করে আনন্দ উপভোগের চেতনা সৃষ্টি করতে পারতাম, তাহলে ঈদের আনন্দ এক ভিন্ন মাত্রা পেতে পারত।
সবার জন্য আনন্দ বাস্তবায়িত করতে হলে অন্যের আনন্দকে অগ্রাধিকার দিতে হয় এবং সে স্বীকৃতি কেবল একটি উচ্চারণ হলে হবে না। এর স্বীকৃতির জন্য যে মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজন, সেটি অনেক সময়ই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পাওয়া যায় না। সে কারণে আমরা অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক সফল ব্যক্তিত্বকে বিচরণ করতে দেখি আমাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যে, নানাবিধ কর্মে, রাজনীতিতে ও নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মন ও মননে প্রাপ্তির যে হিসাব আছে, সে হিসাবে অন্যের কাছে নিজের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বের কোনো স্থিতিপত্র থাকে না। একজনকে বস্তুগতভাবে সফল হতে যেমন কর্মদক্ষতার প্রয়োজন হয়, তেমনি আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এমন এক অবস্থার উপস্থিতি থাকে, যেখানে অন্যের প্রতি দায়িত্ব একটা সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয়। দান ও অনুদানে এই দায়বদ্ধতার নিরসন হয় বলে একটি মানসিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়।
এ সমাজব্যবস্থায় কীর্তিমান মানুষ অনেক সময়ই ভুলে যান যে, অন্যের নানা অবদানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর জীবন সমৃদ্ধ হয়েছে। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম তাঁকে খাদ্য জুগিয়েছে অথচ সেই প্রান্তিক কৃষক অনেক সময় কাটিয়েছেন অনাহারে বা অর্ধাহারে। যেহেতু এই বাস্তবতা প্রত্যক্ষ নয়, সে কারণে জীবনে সফল অনেকেই এই কৃষকের কাছে ঋণকে হূদয়ে অনুভব করেন না। যে শ্রমিক বা তন্তুবায়ী তাঁর শখের বস্ত্র জুগিয়েছেন, তাঁর কথাও কি তাঁর মনে থাকে? হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যারা যোগাযোগের রাস্তা তৈরি করেছে, সেই রাস্তায় যান্ত্রিক যানে পরিভ্রমণের সময় আমাদের কারও তার কাছে ঋণ স্বীকার করার মানসিকতা থাকে না। আমাদের জীবন এমন বস্তুতান্ত্রিক ও যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে যে, উত্পাদন সম্পর্কের নানা স্তরে নানা মানুষের এই শ্রমঘন অবস্থান আমরা নিজেদের আনন্দ-অনুভবে কখনোই স্মৃতিতে আনি না। এর ফলে সবার জন্য আনন্দ বাস্তব হয়ে ওঠে না। বরং এমন এক ধারণার মধ্যে আমরা বাস করি যে, নানাভাবে বঞ্চনার হাতিয়ার যে বাজারব্যবস্থা সে ব্যবস্থাই ওই বঞ্চিতদের যথার্থ মূল্য দিয়েছে, এমনি একটা ভাবনা আমাদের তুষ্ট রাখে।
এই বিষম অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের যেসব মানুষ আজ নিচে পড়ে আছে, যারা সুযোগের অভাবে এই ত্রুটিযুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমসুযোগের অধিকার হারিয়েছে, তাদের কাছে যেতে হবে। তাদের বেদনা অনুভব করতে হবে। তাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে এবং আর্থসামাজিকভাবে তার ভেতরে যে সম্ভাবনা আছে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের পথ সৃষ্টি করে দিতে হবে। ঈদের জামাতে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যখন মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীন অবস্থানের প্রতীকী চিত্র আমরা আঁকি তখন যেন আমরা আমাদের এই সামাজিক দায়িত্ব স্মরণ রাখি। ক্ষণিকের এক সারিতে দাঁড়ানো কিন্তু সমাজের সবার জন্য সুষম অবস্থানের বাস্তব চিত্রের পরিচিতি নয়। সবার জন্য আনন্দ বাস্তব হতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রক্ষমতায় এই সমতা ও ঐক্যের সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে ক্ষণিকের দয়া-দাক্ষিণ্য সবার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের ঐকতান সৃষ্টি করবে না। সেই ঐকতানের মূর্ছনা সৃষ্টিই হোক আজকের দিনের প্রত্যয়, আমাদের অঙ্গীকার।
মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ।
সবার জন্য স্বাস্থ্য এমনি আরেকটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রক্রিয়া। সুস্বাস্থ্য কেবল সুন্দর জীবনের ভিত রচনা করে না, এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নীরব, মঙ্গলদায়ী ও কর্মক্ষম সমাজের অবস্থা নির্ণয় করে। এ কাজও অনেক কঠিন। আমরা জানি যে অনেক উন্নত দেশে আজও সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিষম সমাজ অনেককে সক্ষমতার গণ্ডিতে প্রবেশই করতে দেয় না। দুস্থ ও বঞ্চিত মানুষ সমাজের নানা স্তরে নানাভাবে ছড়িয়ে থাকে। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে নানা কারণে নানা সময়ে বিভিন্ন জন অসুস্থ থেকে সমাজের অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এর ফলে আত্মহনন থেকে অন্যের অধিকার হরণের বিচিত্র মানসিকতা আমরা বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসের নানা বাঁকে, সমাজের নানা স্তরে বিচিত্ররূপে দেখতে পেয়েছি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সবার জন্য আনন্দ—আমাদের আদর্শই স্মরণ করিয়ে দেয়—এটি নিশ্চিত করতে হলে সমাজকে প্রস্তুত হতে হয়। অন্যভাবে বললে, সমাজকে প্রস্তুত করতে হয়। যে সমাজ মানুষের একত্ম এবং বহুবিধ বিভিন্নতাকে গ্রহণ করে এর মনুষ্যত্ববিনাশী মননকে ত্যাগ করতে পারে, সে সমাজেই বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও একে অন্যের জন্য সংবেদী মন সৃষ্টি হয়। যখন আমরা অন্যকে কাছে টানতে ব্যর্থ হই, বিভেদ যেখানে বড় হয়ে ওঠে, সেখানে সুন্দরকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না, সেখানে এই আনন্দের সমদর্শিতা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই আনন্দের একটি ভিত হলো অন্যের জন্য অনুভব করা এবং অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া। আজকালকার ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজে প্রতিযোগিতার নামে আমরা মানুষকে কাছে না টেনে অনেক সময়ই দূরে ঠেলে দিই। আমরা এগিয়ে যেতে চাই, তাই অন্যকে পেছনে ফেলে দিই। সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়ার যে আনন্দ সেটা আমাদের হূদয়ে অনুভবও করি না। মানুষ যখন সৃষ্টিকর্তার নামে এক সারিতে দাঁড়ায়, সেটা কেবল তথাকথিত সাম্য ও ঐক্যের প্রতীক নয়। সেখানে সুষম সমাজের একটি আন্তরিক কামনা ও বাসনা বিমূর্ত হয়ে ওঠে।
আজকালকার বস্তুবাদী সমাজে ভাববাদী আনন্দের বিষয়টি অনেক সময়ই উপেক্ষার বিষয় হয়। তবে স্মরণ রাখতে হবে, ভাববাদী আনন্দেরও একটি বস্তুগত ভিত্তি থাকতে হয়। সেই বস্তুগত ভিত্তি তৈরি হতে হয় সামাজিক প্রক্রিয়ায়, যেখানে বিত্ত এক মানুষের পরিচয় নয়, তার চিত্তের সম্পদ তাকে বিশিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেয়। আজকের পৃথিবীতে আমরা উন্নয়নের মাপকাঠিতে বিভাজিত নানা স্তরে দেশগুলোকে দেখি। আমরা এও দেখি যে, নানা দেশের মধ্যে যে আন্তসম্পর্ক সেখানে নৈতিকতা ও নীতিমান্যতা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়। যার প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা যত বেশি, পৃথিবীর নানা সম্পর্কীয় রঙ্গমঞ্চে সে তত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। নিজের ভোগবাদিতার মাধ্যমে ও ক্ষমতা সংরক্ষণের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংঘাতের মধ্য দিয়ে আজ পৃথিবীর পরিবেশ এক সংকটময় অবস্থানে এসে উপনীত। এই অতিভোগবাদিতা ও ক্ষমতালিপ্সা আমাদের সভ্যতাকেই বিপন্ন করে তুলেছে। সেখানেও আমরা দেখতে পাই শক্তিধরের ভোগবাদী জীবনের আকাঙ্ক্ষা। পৃথিবীর শতকোটি বঞ্চিত মানুষের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করার এক মানসিকতা যেটা শিক্ষিত মনন ও সুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে না। আমাদের সমাজেও এই দুষ্ট ক্ষতের নানা পরিচয় নানাভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করি। এখানে যার অনেক আছে সে আরও অনেক চায়। যার ক্ষমতা আছে সে মঙ্গলের জন্য নিজেকে নিবিষ্ট না করে অন্যের অমঙ্গলের মাধ্যমে নিজের স্ফীত ভোগবাদী মানসিকতার পরিচয় রাখে। সে কারণে যখন আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও তীব্র দুঃখ-কষ্টের যাতনায় পিষ্ট হয়, তখন নানা রকম বাণিজ্যিক বিপণন ও ভোগবাদী নানা পণ্যের বিভিন্ন রকম প্রসার এই কষ্ট ও দুঃখকে আরও তীব্র করে তোলে।
সবার জন্য আনন্দ নিশ্চিত করতে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে দান ও খয়রাত যথেষ্ট নয়। এই আনন্দ সর্বজনীন হয়ে উঠতে সমাজব্যবস্থাকেই পরিবর্তনের প্রয়োজন। সে সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও পরিবর্তন আবশ্যক। রাষ্ট্রকে হতে হবে সর্ব মানুষের কল্যাণে নিরত একটি সেবাধর্মী ও মাঙ্গলিক ব্যবস্থা, যেখানে সবার অধিকার সমান হতে হবে, সবার কণ্ঠের উচ্চারণ শ্রুত হতে হবে, সবার মন ও মানসিকতা এমন হতে হবে যেখানে অন্যের বঞ্চনা নিজের বঞ্চনা বলে মনে হবে এবং সে কারণে বঞ্চনা বিদূরণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব লাভকারী প্রতিনিধিরা প্রথমে অন্যের মঙ্গলে নিজেকে সঁপে দেবেন। যেমনটি—আমাদের কাছে এখন রূপকথার মতো শোনায়—সেই প্রজাহিতৈষী মানবতাবাদী খলিফা ও শাসকদের মধ্যে দেখেছি এবং যেটা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ক্ষমতা যে দায়িত্বের অন্যরূপ এবং ক্ষমতার ব্যবহার যে দায়বদ্ধরূপে করতে হয় এবং ক্ষমতা ব্যবহার যে জবাবদিহির জন্ম দেয়, এ চেতনা আজ সমুন্নত নয় বলেই রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার হয় এমনভাবে যেখানে ক্ষুদ্রস্বার্থ বৃহত্ স্বার্থকে দলিত করে, গোষ্ঠীস্বার্থ বা দলগত স্বার্থ মানবতাকে নিপিষ্ট করে। এই রাষ্ট্রযন্ত্র পরিবর্তনে প্রয়োজন হয় সমাজের স্তরীকরণকে ভেঙে মানুষকে এবং সে সঙ্গে নানা জীব ও সৃষ্টির অন্য সম্পদকে এমনভাবে বিবেচনায় আনা, যেখানে অন্যের প্রয়োজন অনেক বেশি গুরুত্ব পায়, নিজের প্রয়োজন, স্বার্থ ও নিরাপত্তার চেয়ে।
এই সমাজ বিনির্মাণে আমাদের সকল কর্মে মানবিক নীতিমান্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আজকালকার পৃথিবীতে নানাভাবে মানবতা লাঞ্ছিত হয়, অন্যের অধিকার অস্বীকৃত থেকে যায় এবং বৈষম্যকে আমরা অগ্রগমনের মাপকাঠি বলে ধরে নিই। এ কারণে নানাভাবে আমাদের সমাজে ঢুকে পড়ে তথাকথিত উন্নয়ন সংস্থা, যারা আত্মশক্তি সৃষ্টি না করে একটি পরনির্ভরশীল অবস্থা ও মানসিকতার জন্ম দেয়। এই পৃথিবীতে নানাভাবে আমরা একে অন্যের সাহায্য গ্রহণ করি, একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকি। কিন্তু সে সম্পর্কের ভিত্তি হলো সমদর্শিতা এবং সমসক্ষমতা। যেখানেই এর ব্যত্যয় ঘটে, সেখানেই আসে এর বিভাজন, বিভাজন থেকে বৈষম্য, বৈষম্য থেকে নিরানন্দ অবস্থান।
আমরা যখন যান্ত্রিকভাবে ঈদের উত্সব পালন করি, তখন সবার জন্য আনন্দ এই ভাবনা আমাদের ভেতরে থাকে না। আমরা আমাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি। নিকটজনের আনন্দকেই প্রাধান্য দিই এবং এই বাণিজ্যিকায়নকৃত প্রতিযোগী সমাজে কারণে-অকারণে বঞ্চিত হওয়ার বেদনা অনুভব করি। যদি আমরা এই বিষম পৃথিবীর বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ও সমাজিকভাবে স্তরীকৃত মানুষের মধ্যে আমাদের চেয়ে নিচে যাদের অবস্থান, তাদের কথা ভাবতে পারতাম, তাদের কাছে যেতে পারতাম এবং তাদের আনন্দিত করে আনন্দ উপভোগের চেতনা সৃষ্টি করতে পারতাম, তাহলে ঈদের আনন্দ এক ভিন্ন মাত্রা পেতে পারত।
সবার জন্য আনন্দ বাস্তবায়িত করতে হলে অন্যের আনন্দকে অগ্রাধিকার দিতে হয় এবং সে স্বীকৃতি কেবল একটি উচ্চারণ হলে হবে না। এর স্বীকৃতির জন্য যে মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজন, সেটি অনেক সময়ই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পাওয়া যায় না। সে কারণে আমরা অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক সফল ব্যক্তিত্বকে বিচরণ করতে দেখি আমাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যে, নানাবিধ কর্মে, রাজনীতিতে ও নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মন ও মননে প্রাপ্তির যে হিসাব আছে, সে হিসাবে অন্যের কাছে নিজের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বের কোনো স্থিতিপত্র থাকে না। একজনকে বস্তুগতভাবে সফল হতে যেমন কর্মদক্ষতার প্রয়োজন হয়, তেমনি আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এমন এক অবস্থার উপস্থিতি থাকে, যেখানে অন্যের প্রতি দায়িত্ব একটা সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয়। দান ও অনুদানে এই দায়বদ্ধতার নিরসন হয় বলে একটি মানসিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়।
এ সমাজব্যবস্থায় কীর্তিমান মানুষ অনেক সময়ই ভুলে যান যে, অন্যের নানা অবদানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর জীবন সমৃদ্ধ হয়েছে। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম তাঁকে খাদ্য জুগিয়েছে অথচ সেই প্রান্তিক কৃষক অনেক সময় কাটিয়েছেন অনাহারে বা অর্ধাহারে। যেহেতু এই বাস্তবতা প্রত্যক্ষ নয়, সে কারণে জীবনে সফল অনেকেই এই কৃষকের কাছে ঋণকে হূদয়ে অনুভব করেন না। যে শ্রমিক বা তন্তুবায়ী তাঁর শখের বস্ত্র জুগিয়েছেন, তাঁর কথাও কি তাঁর মনে থাকে? হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যারা যোগাযোগের রাস্তা তৈরি করেছে, সেই রাস্তায় যান্ত্রিক যানে পরিভ্রমণের সময় আমাদের কারও তার কাছে ঋণ স্বীকার করার মানসিকতা থাকে না। আমাদের জীবন এমন বস্তুতান্ত্রিক ও যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে যে, উত্পাদন সম্পর্কের নানা স্তরে নানা মানুষের এই শ্রমঘন অবস্থান আমরা নিজেদের আনন্দ-অনুভবে কখনোই স্মৃতিতে আনি না। এর ফলে সবার জন্য আনন্দ বাস্তব হয়ে ওঠে না। বরং এমন এক ধারণার মধ্যে আমরা বাস করি যে, নানাভাবে বঞ্চনার হাতিয়ার যে বাজারব্যবস্থা সে ব্যবস্থাই ওই বঞ্চিতদের যথার্থ মূল্য দিয়েছে, এমনি একটা ভাবনা আমাদের তুষ্ট রাখে।
এই বিষম অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের যেসব মানুষ আজ নিচে পড়ে আছে, যারা সুযোগের অভাবে এই ত্রুটিযুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমসুযোগের অধিকার হারিয়েছে, তাদের কাছে যেতে হবে। তাদের বেদনা অনুভব করতে হবে। তাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে এবং আর্থসামাজিকভাবে তার ভেতরে যে সম্ভাবনা আছে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের পথ সৃষ্টি করে দিতে হবে। ঈদের জামাতে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যখন মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীন অবস্থানের প্রতীকী চিত্র আমরা আঁকি তখন যেন আমরা আমাদের এই সামাজিক দায়িত্ব স্মরণ রাখি। ক্ষণিকের এক সারিতে দাঁড়ানো কিন্তু সমাজের সবার জন্য সুষম অবস্থানের বাস্তব চিত্রের পরিচিতি নয়। সবার জন্য আনন্দ বাস্তব হতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রক্ষমতায় এই সমতা ও ঐক্যের সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে ক্ষণিকের দয়া-দাক্ষিণ্য সবার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের ঐকতান সৃষ্টি করবে না। সেই ঐকতানের মূর্ছনা সৃষ্টিই হোক আজকের দিনের প্রত্যয়, আমাদের অঙ্গীকার।
মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ।
No comments