আফ-পাক যুদ্ধ -পাকিস্তান শান্ত হবে না - এমবি নাকভি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, আফগানিস্তানে ইসলামি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করার কোনো চূড়ান্ত সময়সীমা নেই। আফগানিস্তানে মনমতো ও টেকসই কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকা এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। আপাতত মনে হয়, এই অঙ্গীকার অনির্দিষ্ট। আফগানিস্তানে কেবল আরও মানুষ ও সরঞ্জামই পাঠানো হবে না, যুদ্ধপ্রক্রিয়াকে সীমিত না করে আরো জোরদার করা হবে।
আফগানিস্তান বিষয়ে আমেরিকার ‘নতুন’ নীতি যুদ্ধের আওতাকে পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। এই যুদ্ধকে ওয়াশিংটন আখ্যা দিয়েছে আফ-পাক যুদ্ধ। পাকিস্তানে তালেবান ও অন্য ইসলামি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও কোনো সীমান্ত মানবে না। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তাই পাকিস্তানকেও সব কিছু মেনে নেওয়ার সীমাহীন অঙ্গীকার করতে হবে।
ইসলামি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের অর্থ কী? পাকিস্তানের সম্পদ যুদ্ধের কাজে কাজে ব্যয়িত হবে। আমেরিকা ও অন্যরা সহায়তা দেবে পাকিস্তানকে। তবে, সমগ্র অর্থনীতির অগ্রগতি ঘটানো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যুদ্ধ চালানোর দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। এই যুদ্ধের বিষয়ে মার্কিনরা সংশয় প্রকাশ করেছে। কোনো সময়সীমা ঘোষণা না করতে চাওয়ার কারণও আছে। পাকিস্তানও যুদ্ধ অবসানের কোনো সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে না। ফলাফল সম্পর্কে আমেরিকা সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলতে থাকবে।
কিছু বিষয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক হতে হবে। পাকিস্তানের জনগণ এ যুদ্ধকে কীভাবে দেখে, এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। তালেবান ও অন্য ইসলামি চরমপন্থীরা শয়তানের প্রতিভূ, অনেক পাকিস্তানি তা মনে করে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যত দিন পাকিস্তান ও পশ্চিমারা আফ-পাক মানুষের হূদয়-মন জয় না করতে পারবে, তত দিন এই যুদ্ধ শেষ হবে না। জনমতের অসন্তোষ যুদ্ধের ভবিষ্যতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
জনগণ যদি সরকারের সঙ্গে থাকে, আর তালেবান-শাসনের বিরোধী হয়, তবে খুব শিগগির যুদ্ধের অবসান ঘটার কথা। কিন্তু জনগণের আবেগ যদি ইসলামি চরমপন্থীদের পক্ষে যায়, তবে যুদ্ধ থামবে না। আফগানিস্তান বা পাকিস্তান সরকারের অর্জন যা-ই হোক না কেন, তা সমাজকে বিভক্ত করবে। ইসলামি চরমপন্থীরা সবকিছু ধ্বংসের চেষ্টা করবে, সরকারি সমর্থকদের হত্যা করবে। দেশটিতে তখন গৃহযুদ্ধাবস্থা বিরাজ করবে।
গত ৯০০ থেকে এক হাজার বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের যে বিকাশ ও বিস্তার, তা তালেবান বা তার আগের ১৯৮০-এর দশকে মুজাহিদীনদের ইসলাম থেকে অনেক আলাদা। এ উপমহাদেশের বহু ধর্ম-সংস্কৃতি-চিন্তার সমন্বয়ধর্মী, সহিষ্ণু ও শান্তিপূর্ণ এবং সংঘাতবিরোধী যে ইসলাম, তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে তালেবান ও অন্য চরমপন্থীরা। উপমহাদেশের ইসলামে সুফিবাদী চিন্তা ও চর্চার গভীর প্রভাব আছে।
অন্যান্য দেশে ইসলামের বিকাশ এভাবে হয়নি। সৌদি আরবের ইসলাম উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের ইসলামের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। সৌদি আরবের ইসলাম চিন্তায় ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদ প্রধান। এই সৌদি ইসলাম পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত প্রদেশ ও অন্য এলাকার দেওবন্দি ধারার মানুষকে এখন প্রভাবিত করছে।
এই ইসলামের বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। গত ২৫-৩০ বছরে এই মুসলমানদের মধ্যে অনেক নতুন চিন্তাধারা বিকশিত হয়েছে। জিহাদে সৌদির অংশগ্রহণ ও পরে তালেবান তৈরি ও বেড়ে ওঠায় সহায়তার ফলে এখনকার বহু মানুষ এখন তাদের সমর্থক। আইএসআই, সিআইএ এবং সৌদি সংস্থাগুলোর কল্যাণে বহু পাকিস্তানির ওপর ওয়াহাবি ও সালাফি মতাদর্শের প্রভাব পড়েছে। আরব চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবও এ অঞ্চলে পড়েছে।
এমন ঘটার বিশেষ কারণ আছে। উপমহাদেশের মুসলমানরা সৌদি আরবকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সৌদিদের বক্তব্য অন্য এলাকার তুলনায় পাকিস্তানি মুসলমানদের মধ্যে সহজে গ্রহণযোগ্যতা পায়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত প্রদেশের উপজাতীয় এলাকাসহ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ মূলত বেরেলভিপন্থী। কিন্তু আল-কায়েদা, ওসামা-বিন লাদেন ও অন্যদের প্রস্তাবিত নতুন মত তাদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। এর কারণ—ক. তাদের জঙ্গিপনা; খ. তাদের অবস্থান স্পষ্ট ও অসহিষ্ণু; গ. তারা সহিংস এবং ঘ. তালেবান ও অন্য চরমপন্থীদের ভাবমূর্তি। তাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালেবানরা রীতিনীতি কঠোরভাবে পালন করে। এখানকার মুসলমানদের মানসিক গড়ন এমন যে তারা ধার্মিকতার এমন রূপের প্রতি সাড়া দেয়। সাধারণ জীবন যাপন করে, ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত এবং পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আপনা থেকেই কাজ করে এখানে। এই শ্রদ্ধাই তাদের ভয় পাওয়ারও মূল কারণ। ভয়ের ফলেই তাদের মেনে চলে এসব মানুষ। ইসলামের সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসার দৃষ্টান্তের সাথে তালেবানী ধ্যান-ধারনা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, এ বিষয়ে উপমহাদেশের সব মুসলমানকে ঐকান্তিকভাবে ভেবে দেখা দরকার।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
এমবি নাকভি: পাকিস্তানি সাংবাদিক।
আফগানিস্তান বিষয়ে আমেরিকার ‘নতুন’ নীতি যুদ্ধের আওতাকে পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। এই যুদ্ধকে ওয়াশিংটন আখ্যা দিয়েছে আফ-পাক যুদ্ধ। পাকিস্তানে তালেবান ও অন্য ইসলামি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও কোনো সীমান্ত মানবে না। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তাই পাকিস্তানকেও সব কিছু মেনে নেওয়ার সীমাহীন অঙ্গীকার করতে হবে।
ইসলামি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের অর্থ কী? পাকিস্তানের সম্পদ যুদ্ধের কাজে কাজে ব্যয়িত হবে। আমেরিকা ও অন্যরা সহায়তা দেবে পাকিস্তানকে। তবে, সমগ্র অর্থনীতির অগ্রগতি ঘটানো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যুদ্ধ চালানোর দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। এই যুদ্ধের বিষয়ে মার্কিনরা সংশয় প্রকাশ করেছে। কোনো সময়সীমা ঘোষণা না করতে চাওয়ার কারণও আছে। পাকিস্তানও যুদ্ধ অবসানের কোনো সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে না। ফলাফল সম্পর্কে আমেরিকা সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলতে থাকবে।
কিছু বিষয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক হতে হবে। পাকিস্তানের জনগণ এ যুদ্ধকে কীভাবে দেখে, এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। তালেবান ও অন্য ইসলামি চরমপন্থীরা শয়তানের প্রতিভূ, অনেক পাকিস্তানি তা মনে করে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যত দিন পাকিস্তান ও পশ্চিমারা আফ-পাক মানুষের হূদয়-মন জয় না করতে পারবে, তত দিন এই যুদ্ধ শেষ হবে না। জনমতের অসন্তোষ যুদ্ধের ভবিষ্যতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
জনগণ যদি সরকারের সঙ্গে থাকে, আর তালেবান-শাসনের বিরোধী হয়, তবে খুব শিগগির যুদ্ধের অবসান ঘটার কথা। কিন্তু জনগণের আবেগ যদি ইসলামি চরমপন্থীদের পক্ষে যায়, তবে যুদ্ধ থামবে না। আফগানিস্তান বা পাকিস্তান সরকারের অর্জন যা-ই হোক না কেন, তা সমাজকে বিভক্ত করবে। ইসলামি চরমপন্থীরা সবকিছু ধ্বংসের চেষ্টা করবে, সরকারি সমর্থকদের হত্যা করবে। দেশটিতে তখন গৃহযুদ্ধাবস্থা বিরাজ করবে।
গত ৯০০ থেকে এক হাজার বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের যে বিকাশ ও বিস্তার, তা তালেবান বা তার আগের ১৯৮০-এর দশকে মুজাহিদীনদের ইসলাম থেকে অনেক আলাদা। এ উপমহাদেশের বহু ধর্ম-সংস্কৃতি-চিন্তার সমন্বয়ধর্মী, সহিষ্ণু ও শান্তিপূর্ণ এবং সংঘাতবিরোধী যে ইসলাম, তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে তালেবান ও অন্য চরমপন্থীরা। উপমহাদেশের ইসলামে সুফিবাদী চিন্তা ও চর্চার গভীর প্রভাব আছে।
অন্যান্য দেশে ইসলামের বিকাশ এভাবে হয়নি। সৌদি আরবের ইসলাম উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের ইসলামের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। সৌদি আরবের ইসলাম চিন্তায় ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদ প্রধান। এই সৌদি ইসলাম পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত প্রদেশ ও অন্য এলাকার দেওবন্দি ধারার মানুষকে এখন প্রভাবিত করছে।
এই ইসলামের বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। গত ২৫-৩০ বছরে এই মুসলমানদের মধ্যে অনেক নতুন চিন্তাধারা বিকশিত হয়েছে। জিহাদে সৌদির অংশগ্রহণ ও পরে তালেবান তৈরি ও বেড়ে ওঠায় সহায়তার ফলে এখনকার বহু মানুষ এখন তাদের সমর্থক। আইএসআই, সিআইএ এবং সৌদি সংস্থাগুলোর কল্যাণে বহু পাকিস্তানির ওপর ওয়াহাবি ও সালাফি মতাদর্শের প্রভাব পড়েছে। আরব চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবও এ অঞ্চলে পড়েছে।
এমন ঘটার বিশেষ কারণ আছে। উপমহাদেশের মুসলমানরা সৌদি আরবকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সৌদিদের বক্তব্য অন্য এলাকার তুলনায় পাকিস্তানি মুসলমানদের মধ্যে সহজে গ্রহণযোগ্যতা পায়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত প্রদেশের উপজাতীয় এলাকাসহ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ মূলত বেরেলভিপন্থী। কিন্তু আল-কায়েদা, ওসামা-বিন লাদেন ও অন্যদের প্রস্তাবিত নতুন মত তাদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। এর কারণ—ক. তাদের জঙ্গিপনা; খ. তাদের অবস্থান স্পষ্ট ও অসহিষ্ণু; গ. তারা সহিংস এবং ঘ. তালেবান ও অন্য চরমপন্থীদের ভাবমূর্তি। তাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালেবানরা রীতিনীতি কঠোরভাবে পালন করে। এখানকার মুসলমানদের মানসিক গড়ন এমন যে তারা ধার্মিকতার এমন রূপের প্রতি সাড়া দেয়। সাধারণ জীবন যাপন করে, ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত এবং পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আপনা থেকেই কাজ করে এখানে। এই শ্রদ্ধাই তাদের ভয় পাওয়ারও মূল কারণ। ভয়ের ফলেই তাদের মেনে চলে এসব মানুষ। ইসলামের সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসার দৃষ্টান্তের সাথে তালেবানী ধ্যান-ধারনা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, এ বিষয়ে উপমহাদেশের সব মুসলমানকে ঐকান্তিকভাবে ভেবে দেখা দরকার।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
এমবি নাকভি: পাকিস্তানি সাংবাদিক।
No comments