গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যা: বিচার চেয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের ফরিয়াদ

জুলাই বিপ্লবসহ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। তাদের দাবি-গত ১৬ বছরে যারাই মুক্তিকামী মানুষের হয়ে কথা বলেছে তাদেরকেই গুম করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর কোনোদিনও ফিরে আসেনি পরিবারের সেই সদস্যগুলো। গতকাল এক অনুষ্ঠানে পিতাহারা কন্যা, স্বামীহারা স্ত্রী, সন্তানহারা বাবা-মা, গুমের শিকার, অত্যাচারের শিকার ভুক্তভোগী ও জুলাই বিপ্লবে আহতরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবি জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর আয়োজনে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদী জুলুমের ভুক্তভোগী গণজমায়েত’ শীর্ষক সমাবেশে এসব কথা বলেন তারা।

আয়োজিত সমাবেশে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের পক্ষে গুমের শিকার পারভেজ হোসেনের মেয়ে রিধি অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেন, আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি বাবার আদর ছাড়া। বাবার হাতটা পর্যন্ত ধরতে পারেনি। পরীক্ষা শেষে সবাই সবার বাবার সঙ্গে ঘুরতে যায় আর আজকে আমি আমার বাবার ছবি নিয়ে বাবাকে খুঁজতে এসেছি। আমার বাবার দোষটা কী ছিল যে, তাকে এভাবে গুম করা হয়েছে। বছরের পর বছর তাকে নিজের পরিবারের থেকে দূরে রাখা হয়েছে। আমাদের এমন কী দোষ ছিল যে, আমরা আমাদের বাবাকে দেখতে পারিনি। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন। অনেক কান্না করেছি। আর কিচ্ছু চাই না। আমি শুধু আমার বাবাকে চাই। বাবার হাতটা ধরতে চাই। বাবাকে দেখতে কেমন লাগবে- এটাও আমরা কেউ জানি না। আমার বাবার সঙ্গে আর আমাদের সঙ্গে কেন এমন করা হলো তার বিচার চাই আমি।

অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, মজলুমের কোনো দল নেই। আজকে আমরা যারা নিপীড়িত হয়েছি এই মানুষগুলোকে সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের দল, মত, আদর্শ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু এই নিপীড়িত পরিবারগুলোকে, মানুষগুলোকে এক থাকতে হবে। সেই এক থাকার জন্য একটি জাতীয় মঞ্চ থাকা প্রয়োজন। বিগত সময়গুলোতে আমাদের মানবাধিকার হরণ করা হয়েছিল, গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল এবং যত দুঃশাসন, লুটপাট, দুর্নীতি হয়েছিল তার তালিকা করলে শেষ হবে না। আর এসবের পেছনে কে এবং কারা দায়ী তা আমরা সকলেই জানি। এই শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও তাদের মুজিববাদী রাজনীতির ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে তারা এসব করেছে। তারা একটা মানবতাবিরোধী দল। পুরো বিশ্বকে আমাদের এটা বলতে হবে। এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার হাতে রক্তের দাগ সব সময়ই ছিল। যেমনটা তার বাবার হাতে ছিল। আমরা দেখেছি পিলখানা হত্যাকাণ্ড হয়েছে, শাপলা চত্বরে কী নির্মম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সর্বশেষ জুলাইয়ে কীভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছে। আমরা দেখেছি বাকশাল কায়েম করে শেখ মুজিব ক্ষমতায় ছিলেন। ঠিক একইভাবে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে মানবাধিকার হরণ করেছেন। আওয়ামী লীগ বিদায় হয়ে  গেছে। এখন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন কারা কারা করতে চান সেটা হচ্ছে আলোচনার বিষয়। যারা করতে চান জনগণ তাদেরকেও গণশত্রু হিসেবে গণ্য করবে এই বাংলাদেশে। তিনি বলেন, যারা নিপীড়িত হয়েছে তাদের ন্যায়বিচারে আমরা কাজ করবো। আর যারা এইসব শহীদকে নিয়ে মামলা বাণিজ্য করছে তাদের বিষয়েও সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে ভারত সরকারকে উদ্দেশ্য করে নাহিদ বলেন, সীমান্তে হত্যা করে আমাদের ভয় দেখানো যাবে না। এখন আর আগের বাংলাদেশ নেই। এখন যা হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে।

সমাবেশে অংশ নিয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, একটি স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করার জন্য এতগুলো মানুষকে গুম করা হয়েছে। আজ জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে আবার স্বাধীন করেছে। মানুষের অধিকারের জন্য তারা জীবন দিয়েছে। আসুন আমরা সকলে দেশটাকে ভালোবাসি। আর এই সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। আগে আমাদের নিজেদেরকে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম  পরওয়ার বলেন, এই গুম-খুন, হত্যার সব কিছুর জন্য দায়ী শেখ হাসিনা। তার হাতে রক্তের কালো ছোপ এখনো আছে। এখন সে ভারতে বসে সন্ত্রাসের নতুন ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করছে। তার এসব কর্মকাণ্ডের বিচার না হলে আমাদের নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ১৬টা বছর আওয়ামী লীগ গোটা রাষ্ট্রকে সন্ত্রাসের একটা অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল। এই আওয়ামী লীগ সরকার গত সময়ে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ করেছে। এসব ঠাণ্ডা মাথার অপরাধের বিচার হওয়া দরকার। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পরে যেমন বিডিআরের পোশাক পরিবর্তন করা হয়েছে তেমনই অতিসত্বর র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যদের পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। কারণ তাদের দেখলেই সেই হামলাকারী মনে হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, গত ১৬ বছর যারা এই সব হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এবং যারা মদত দিয়েছে তাদের সকলেরই বিচার করতে হবে। এখনো যারা ঘাপটি মেরে এদেশের বিভিন্ন দপ্তরে বসে আসে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। আর যারা ওই আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার চিন্তা করছে তাদেরকেও বিচার করবে এই দেশের মানুষ। ওই ফ্যাসিস্টদের ফিরিয়ে আনতে হলে আবারো রাস্তায় রক্ত দিবে এদেশের সাধারণ জনগণ।

মায়ের ডাক-এর প্রধান সমন্বয়ক সানজিদা খানম তুলির সঞ্চালনায় আয়োজিত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল প্রমুখ। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.