টেকসই উন্নয়নের অন্তরায় তামাক by এবিএম জুবায়ের

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বৈশ্বিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশিকা এবং কার্যকর উন্নয়ন সুরক্ষা প্রদানের একটি সমন্বিত প্রয়াস। জাতিসংঘের ৭০তম সাধারণ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার ১৬৯টি প্রতিশ্রুতি পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে, যার মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল- এফসিটিসি বাস্তবায়ন (টার্গেট ৩-এ) ও অসংক্রামক রোগজনিত অকালমৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস (টার্গেট ৩.৪) অন্যতম। বাংলাদেশও এই সম্মিলিত উন্নয়ন পথযাত্রার বলিষ্ঠ সৈনিক। তবে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু, কয়েক লাখ মানুষের পঙ্গুত্ব এবং তামাকের অন্যান্য বহুমাত্রিক ক্ষয়ক্ষতি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে, এসডিজি’র তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রাসহ অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা কাঙ্ক্ষিত সময়ে অর্জন করা সম্ভব হবে না।

তামাক ব্যবহারজনিত ব্যাপক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি এসডিজি’র তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা- সুস্বাস্থ্য অর্জনের অন্যতম অন্তরায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারী পরিবারগুলোর মাসিক খরচের ৫ শতাংশ তামাক ব্যবহারে এবং  ১০ শতাংশ তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। তামাকজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ফলে বছরে আরও ৬৫২.৮৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয়। কাজেই তামাক ব্যবহারে দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হয় (লক্ষ্যমাত্রা-১)। ক্রমবর্ধমান তামাক চাষের কারণে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষি (লক্ষ্যমাত্রা-২) ক্রমশ হুমকির মুখে পড়ছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা (লক্ষ্যমাত্রা-৪) এবং লিঙ্গ সমতা (লক্ষ্যমাত্রা-৫) টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলেও বাংলাদেশের বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন চলছে মূলত শিশু ও নারী শ্রম ব্যবহার করে। কারখানার শিশু শ্রমিকরা পাচ্ছে না শিক্ষা লাভের সুযোগ। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার না করেও, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশু। এই ব্যাপক বৈষম্য টিকিয়ে রেখে, টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। এ ছাড়াও তামাক ব্যবহারের কারণে কর্মক্ষম মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণ করে, যা দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে (লক্ষ্যমাত্রা-৮) বাধাগ্রস্ত করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী তামাক ব্যবহারজনিত বৈশ্বিক মৃত্যুর পরিমাণ বছরে ৮০ লাখেরও বেশি এবং এই মৃত্যুভারের ৮০ ভাগই বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। এধরনের বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ বৈষম্য হ্রাস (লক্ষ্যমাত্রা-১০) ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভবপর নয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা শহরের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি হলেও পাবলিক প্লেস-এ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ার চিত্র ঠিক উল্টো। শহরের আবদ্ধ স্থানে বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ ধূমপান। যা টেকসই নগর ও তার অধিবাসীদের (লক্ষ্যমাত্রা-১১) নিরাপদ রাখার বড় অন্তরায়। তামাক চাষ সারা পৃথিবীর ২-৪ শতাংশ বন উজাড়ের জন্য দায়ী। বাংলাদেশে তামাকচুল্লিতে পাতা পোড়াতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে দেশের ৩০ শতাংশ বন। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের (লক্ষ্যমাত্রা-১৩) ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে। ২০২৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিন-আপ বাংলাদেশসহ ১২২টি দেশের সাগর থেকে যেসব বর্জ্য সংগ্রহ করে তার মধ্যে ১ম স্থানে ছিল সিগারেট ফিল্টার। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন সিগারেট ফিল্টার প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত সাগরে দূষণ সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, সিগারেট ফিল্টার প্রকৃতিতে মিশে যেতে ১২ বছর পর্যন্ত সময় নেয়। কাজেই সিগারেট সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থার (লক্ষ্যমাত্রা-১৪) অন্যতম অন্তরায়। সর্বোপরি, তামাকপণ্য উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতি সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, তামাক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তামাক নিয়ন্ত্রণ তথা এফসিটিসি-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন পূর্বশর্ত বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশে এফসিটিসি-এর কার্যকর বাস্তবায়ন মোটাদাগে দুটো কারণে অত্যন্ত জরুরি। এক: এফসিটিসি বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে এসডিজি’র তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা ‘স্বাস্থ্যসম্মত জীবনমান নিশ্চিতকরণ এবং সব বয়সের সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা’ অর্জন সম্ভব নয়। দুই: এসডিজি’র অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও তামাক একটা বড় ধরনের বাধা, যা এফসিটিসি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই অপসারণ করতে হবে।
উপরন্তু, এফসিটিসি’র আর্টিকেল ৬ অনুযায়ী তামাকপণ্যের উপর কার্যকরভাবে কর আরোপের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি করা গেলে একদিকে এর ব্যবহার কমবে অন্যদিকে রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। অতিরিক্ত এই অর্থ এফসিটিসি’র বাস্তবায়ন ও এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গৃহীত কর্মকাণ্ডের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্য অর্জনে বড় হুমকি তামাক। তবে এফসিটিসি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে তামাকজনিত বাধা অপসারণের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর এ লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি এফসিটিসি-এর আলোকে শক্তিশালীকরণ এবং এর কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
মনে রাখতে হবে তামাক কোম্পানি সর্বদা তৎপর থাকবে এফসিটিসি বাস্তবায়ন যেন কখনই সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় না আসে। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হবে কোম্পানির কূটকৌশলে বিভ্রান্ত না হয়ে এফসিটিসি’র বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে আসা এবং জনস্বাস্থ্যকে সবার উপরে রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা।
ইমেইল: basharzubair@hotmail.com

mzamin

No comments

Powered by Blogger.