একজন ‘বিদ্রোহী’ মুসলিম প্রিন্সেসের কাহিনী: স্বামীকে বললেন- আমাকে গুলি করো, না হয় আমিই করবো

আবিদা সুলতানা। ভারতের ‘বিদ্রোহী’ মুসলিম প্রিন্সেস। তিনি কোনো নিয়মনীতি মানতেন না। ইচ্ছে হলেই গুলি করে হত্যা করতেন বাঘ। খেলতে চলে যেতেন পোলো। মাথায় রাখতেন শর্ট চুল। চালাতেন বিমান। এমনকি মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই তিনি রোলস-রয়েস চালাতেন। ১৯১৩ সালে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য ভুপালে সাহসী বেগমদের এক পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। সে এখন থেকে এক শতাব্দীরও অনেক আগের কথা। ভারত তখন ছিল ইংরেজদের অধীনে। তা সত্ত্বেও আবিদা প্রথাগত সাধারণ মুসলিম নারীদের রীতি অনুসরণ করতেন না। মুসলিম নারী আবার কিছু হিন্দু নারীদের আচরিত পর্দা প্রথার বিরোধী ছিলেন তিনি। নারীরা পুরুষদের থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্য এসব প্রথা ব্যবহার করতেন। কিন্তু সেই যুগে তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। কমপক্ষে এক দশক ধরে তিনি তার পিতার মন্ত্রিপরিষদ পরিচালনা করেন। ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে থাকেন। ওই সময় ভুপালের শাসক ছিলেন তার দাদী সুলতান জেজান। তার তত্ত্বাবধানে তার শাসনের শিখাকে প্রজ্বলিত রাখার জন্য তিনিই আবিদাকে অল্প বয়স থেকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে থাকেন। আবিদা সুলতানা ২০০৪ সালে লেখা তার জীবনী ‘মোমোইরস অব এ রিবেল প্রিন্সেস’। এতে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে ওই সময় ভোর চারটার সময় তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হতো পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের জন্য। এরপরই শুরু হতো সারাদিনের কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে আছে খেলাধুলা, গান, ঘোড়া চালানো ও শিক্ষাগ্রহণ। এর মধ্যে ছিল ঘরের মেঝে ধৌত করা এবং বাথরুম পরিষ্কার করা। তার শৈশব নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে আবিদা সুলতানা বলেছেন, আমাদের লিঙ্গগত কোনো কারণে মেয়েদেরকে হীনমন্যতায় ভুগতে দেয়া হয়নি। সব কিছুতেই ছিল সমতা। একজন ছেলের যেসব স্বাধীনতা থাকে, আমাদেরও ছিল তেমন। আমরা পছন্দমতো যেকোনো খেলা খেলতে পারতাম। গাছে চড়তে পারতাম। কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।

শৈশব থেকেই আবিদা সুলতানার মধ্যে ছিল তীব্র স্বাধীনচেতা মনোভাব। ১৩ বছর বয়সে দাদী যখন তাকে পর্দায় ঢাকতে চেষ্টা করেন, তখন তিনি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তার পিতার বিশাল মানসিকতা ও নিজের আত্মবিশ্বাস তাকে বাকি জীবনে নিজে কি করবেন সেই স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেছে। ইতিমধ্যেই ভুপালের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছেন আবিদা। তা সত্ত্বেও মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রতিবেশী কুরাওয়েই রাজ্যে রাজপরিবারের সদস্য হওয়ার সুযোগ আসে তার জীবনে। তার বাল্যবন্ধু ও কুরাওয়েইয়ের শাসক সারওয়ার আলি খানকে বিয়ে করেন।  বিবাহ সম্পর্কে বলেছেন এতে কোনো ক্লু ছিল না। একদিন তার কাজিনদের সঙ্গে বালিশযুদ্ধে মত্ত ছিলেন। আবিদা লিখেছেন, এমনই একদিন তার দাদী ওই রুমে প্রবেশ করেন এবং তাকে বিয়ের পোশাক পরতে বলেন। কিন্তু কেউই বলেননি যে- তিনি বিয়ের পাত্রী। আবিদা লিখেছেন- ‘কীভাবে আমাকে প্রস্তুত করতে হবে তা কেউ বলেনি। কেউ নির্দেশনাও দেয়নি। ফলে আমি বিয়ের আসরে হেঁটে উপস্থিত হই। আমার পথে ভিড় করা নারীদের সরিয়ে দিয়ে উন্মুক্ত মুখে এগিয়ে যাই। নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হলো।
এই বিয়েটা আবিদার মতোই স্বল্প স্থায়ী ছিল। টিকে ছিল এক দশকেরও কম সময়। বিবাহিত জীবন ছিল তার কাছে বেশ কঠিন। শুধু যে তার বয়স অল্প এ জন্য সমস্যা ছিল এমন নয়। এর কারণ ছিল কঠোর ধর্মীয়ভাবে লালনপালনের কারণে। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যৌনতার বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা এবং অস্বস্তি তার বিয়েতে কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল। আবিদা সুলতানা লিখেছেন- আমার বিয়ের পরপরই আমি বিবাহিত জীবনে এক ট্রমা অবস্থায় প্রবেশ করি। আমি বুঝতে পারিনি যে, এরপর যা আসবে আমার জীবনে তা এতটা ভীতিকর, অসাড় এবং অস্বস্তিকর হবে। এর ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক যে সম্পর্ক তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। এ জন্যই তার বিয়ে ভেঙে যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম নারীদের আত্মজীবনীতে অন্তরঙ্গতা ও যৌনতার বিষয়ে গবেষণা করেন ইতিহাসবিদ সিওভান ল্যাম্বার্ট-হার্লি। তিনি তার গবেষণায় তুলে ধরেছেন, কীভাবে আবিদার সৎ স্বীকারোক্তি মুসলিম নারীদের তাদের স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটায়। এসব বিষয়ে মুসলিম নারীরা লিখতে চান না।  

বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আবিদা কুরওয়াইয়ে তার শ্বশুরালয় ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান ভুপালে। কিন্তু তাদের একমাত্র ছেলে শাহরিয়ার মোহাম্মদ খানকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে কাস্টডিয়ান বিরোধ সৃষ্টি হয়। দিনমান লড়াইয়ে হতাশ হয়ে এবং ছেলেকে আলাদা করতে না চেয়ে আবিদা বিরাট এক পদক্ষেপ নেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন স্বামীর গৃহে ফিরে যাবেন। ১৯৩৫ সালের মার্চের এক উষ্ণ রাতে টানা তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আবিদা সুলতানা ছুটে যান তার স্বামীর কুরওয়াইয়ের বাড়িতে। তার বেডরুমে প্রবেশ করেন আবিদা। একটি রিভলবার বের করেন। তা তার স্বামীর দিকে ছুড়ে দিয়ে সাহসী উচ্চারণে বলেন- ‘আমাকে গুলি করো, না হয় আমি তোমাকে গুলি করবো’। এই ঘটনায় এই দম্পতির মধ্যে শারীরিক সংঘাত পর্যন্ত হয়। তাতে আবিদা বিজয়ী হন। তাতে সন্তানের কাস্টডি কার কাছে থাকবে সেই বিরোধের অবসান হয়। একজন সিঙ্গেল মা হিসেবে ছেলেকে বড় করতে থাকেন। একই সঙ্গে সিংহাসনের দায়িত্বও পালন করতে থাকেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি নিজের রাজ্যের মন্ত্রিপরিষদ পরিচালনা করেন। তারপর ভুপাল যুক্ত হয় মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে।
ভারত সরকারের ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে সে বিষয়ে বৃটিশ সরকারের ডাকা এক গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন আবিদা সুলতানা। এ সময়ই ভারতের মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরু তার ছেলে জওয়াহেরলাল নেহরুর মতো নেতাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জওয়াহেরলাল নেহরু।  হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্কের যে অবনতি যাচ্ছিল, তিনি সে বিষয়েও কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর যে সহিংসতা সৃষ্টি হয় তা দমনেও তিনি ভূমিকা রাখেন। আবিদা তার স্মৃতিকথায় ভুপালে যে বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন তারও বর্ণনা করেছেন। এতে আছে তার পরিবারকে কীভাবে বহিরাগত হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছিল। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে সহিংসতা দেখা দিয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি স্মৃতিকথায় বিরক্তিকর বর্ণনা দিয়েছেন।
একদিন ভারত সরকার তাকে জানায় যে, মুসলিম শরণার্থীদের নিয়ে একটি ট্রেন পৌঁছাবে ভুপালে। তিনি সেখানে যে তাদেরকে তত্ত্বাবধান করতে উপস্থিত থাকেন। আবিদা সুলতানা লিখেছেন- ‘যখন (ট্রেনের) কম্পার্টমেন্ট খোলা হলো, দেখা গেল তার ভেতরে সবাই মৃত’। আবিদা বলেন, এই সহিংসতা ও অবিশ্বাস তাকে ১৯৫০ সালে পাকিস্তান চলে যেতে বাধ্য করেছিল। তারপর থেকে তিনি তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় একেবারে নীরব ছিলেন। পাকিস্তানে তিনি গণতন্ত্রের পক্ষের একজন চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নারীদের অধিকারের পক্ষে লড়াই করেছেন। ২০০২ সালে করাচিতে তিনি মারা যান। তিনি পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর ভারত সরকার তার বোনকে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু ভুপালে আবিদা এখনো সর্বজন পরিচিত। সেখানে জনগণ তাকে ‘বিয়া হুজুর’ ডাক নামে চেনেন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.