গুলিতে হাবিবের মৃত্যু: অকূল পাথারে দুই সন্তান by ফাহিমা আক্তার সুমি
কথাগুলো বলছিলেন গত ২০শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে নিহত মো. হাবিবের মেয়ে ফাতেমা আক্তার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন পরিবারটি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী ও সন্তানরা। ফাতেমা বলেন, বাবার মৃত্যুর পর একমাত্র ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে। পরিবারের হাল ধরতে সে একটি কারখানায় চাকরি নিয়েছে। এ বছর আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছি। বাবাকে ছাড়া কোনোমতে ঢাকায় টিকে আছি। একমাত্র ভাইকে বাবা মাওলানা বানাতে চেয়েছিলেন সে যতদূর পড়াশোনা করবে ততদূর তাকে পড়াবে। আমাদের সবাইকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল বাবার। আমারও অনেক ইচ্ছা ছিল বাবার স্বপ্ন পূরণ করবো। এখন পড়াশোনাটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমি পরিবারের বড় সন্তান। ভাই ও আমাকে মিলে দু’জনে কিছু একটা করে সংসারের হাল ধরতে হবে। আমার ছয় ও দেড় বছরের দুইটা বোন আছে। ছয় বছরের বোনটা প্লে-তে পড়ে। পরিবারের বড় সন্তানের প্রতি একটা দায়িত্ব থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পড়ার স্বপ্ন ছিল আমার কিন্তু কতোটুকু পড়াশোনা করতে পারবো জানি না। ছোটবেলায় আমরা অনেক টানাটানির মধ্যে বড় হয়েছি। যত কষ্ট হোক বাবা আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল বড় হবো, নিজে কিছু করবো, বাবার পাশে দাঁড়াবো। এটা কখনো ভাবিনি যে বাবা এত আগে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমার বাবা অনেক প্রশংসা করতো সবসময় যে আমার মেয়েটা আমার পাশে থাকতে চায়। কীভাবে আমরা ভুলে থাকবো আমার বাবাকে।
তিনি বলেন, মা আমাদের নিয়ে চিন্তিত। সে পড়াশোনা খুব একটা জানে না। আমাদের জন্য কিছু একটা কাজ করতে চায় কিন্তু দুইবোনই আমার ছোট তাদের নিয়ে কীভাবে কি করবে। দুইবোন ও সংসার সামলাতে গিয়ে মায়ের সারাদিন চলে যায়। বর্তমানে শনির আখড়া পাটেরবাগে ভাড়া বাসায় থাকি। বাবা যা আয় করেছেন সব আমাদের পেছনে খরচ করতেন। আমার বাবা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন সেও ছোটবেলায় তার বাবাকে হারায়। আমাদের গ্রামের বাড়ি ভোলা লালমোহন থানায়। আমরা অনেক আগে ঢাকায় আসি। গ্রামেও আমাদের তেমন কিছু নেই। কমলাপুর শেরেবাংলা কলেজ থেকে এইবার মানবিক বিভাগ থেকে ৩.৫৮ পেয়ে এসএসসি পাস করেছি। আমার ছোট বোন বাবার ছবি হাতে নিয়ে বাবা বাবা করে ডাকতে থাকে। আর মেজো বোন বাবার স্মৃতিগুলো সবসময় বলতে থাকে।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফাতেমা বলেন, আমার বাবা গাড়িচালক ছিলেন। সিএনজি, বাস, প্রাইভেটকার যখন যেটা পেতেন সেটি চালাতেন। আন্দোলন যখন চলছিল তখন রাস্তা-ঘাট বন্ধ ছিল। বাবার হাতেও খুব একটা টাকা ছিল না। তবুও বাবা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেতো কিন্তু এটা বাসায় কাউকে বলতো না। সে আন্দোলনে গিয়ে ছাত্রদের পানি, খাবার দিতো। ২০শে জুলাই আড়াইটার দিকে আমার বাবা আন্দোলনকারীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছিলেন। শনির আখড়ায় খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করছিল। এ অবস্থায় পুলিশের গুলিতে আমার বাবা গুলিবিদ্ধ হয়। তার বুকে গুলি লাগে। দুজন পথচারী কিছুক্ষণ পর বাবাকে ধরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়। সেখানে কোনমতে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায় চিকিৎসার জন্য। ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর তিনি বিকালের দিকে মারা যান। খবর পেয়ে আমি আর আমার ভাই সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বাবা শুয়ে আছেন তখন বাবাকে ডাকি কিন্তু ওঠে না। পাশে থাকা একজন চিকিৎসক বলেন উনি মারা গেছেন এটি শুনেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। বাবার লাশ আনতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। প্রায় দুইদিন পর আমরা মরদেহ বুঝে পাই। তখন গ্রামে নেয়ার পরিস্থিতি ছিল না সেজন্য বাবাকে দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার বাবা অনেক ভালো মনের মানুষ ছিলেন। কখনো কারও বিপদে ঘরে বসে থাকতেন না। বাইরে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে বাবাকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম বাবা আমাদের আর কে আছে, তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে? বাবা বলেন, ‘তোর বাবার বুকে অনেক সাহস আছে, কিছু হবে না, আমি একজন মানুষ হয়ে এভাবে ঘরে বসে থাকতে পারি না।’ বাবার মৃত্যুতে ছোট ভাই একটি কারখানায় চাকরি নিয়েছে পরিবারের হাল ধরতে। কারণ আমাদের তো চলতে হবে, কে দেখবে আমাদের। আমার ভাইয়ের ইনকামে কিছু হয় না আমাদের। কীভাবে যে আমাদের দিন যাচ্ছে সেটি আমরা জানি। তিনি আরও বলেন, আমরা কোথাও থেকে এখনো তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। কিছুদিন আগে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে কল করে তথ্য নিয়েছে কিন্তু এখনো আমরা কোনো খবর পাইনি। আমরা কার কাছে যাবো, কোথায় যাবো? কোনো কিছুই চিনি না। এখন আমাদের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত আছি। পড়াশোনা তো আমার ভাই বন্ধ করেছে এখন আমিও কি পড়তে পারবো। আমার বাবা আমাকে কম্পিউটারের কাজও শিখিয়েছিলেন। আমার ইচ্ছা আছে পড়াশোনা করার। আমি নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমার ছোট ভাইবোনগুলোকে দেখে রাখতে চাই।
No comments