দরিদ্র কমলেও বৈষম্য বেড়েছে

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মনে করে, বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু বৈষম্য বেড়েছে। দারিদ্র্যটা এমন অবস্থায় আছে যদি হঠাৎ করে একটা ধাক্কা আসে, তখন অনেক মানুষ আবার দরিদ্র হয়ে যাবে। সামাজিক নিরাপত্তায় অনেক দুর্বলতা আছে। ভাতা অনেকেই পায় না। আবার দীর্ঘদিন ধরে ভাতার পরিমাণ না বাড়ায় এর কার্যকারিতা হারাচ্ছে। কারণ দেশের আর্থিক সক্ষমতা খুব একটা ভালো না। ট্যাক্স জিডিপি রেশিও অনেক কম। রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের (ইউবিআই) কার্যকারিতা মূল্যায়ন’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তুলে ধরে সিপিডি। সভাপতি হিসেবে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সিপিডি’র বিশেষ ফেলো এবং শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বক্তব্য রাখেন সিপিডি’র ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি উপস্থিত ছিলেন। এতে ইউবিআইয়ের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডি’র জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আয় বৈষম্যে সাধারণ জীবনযাপন বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের বড় জনগোষ্ঠীর। কল্যাণ রাষ্ট্রের ভাবনা থেকে এসব মানুষের ন্যূনতম আয় নিশ্চিতের তাগিদ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। এক্ষেত্রে কর্মসূচির ব্যাপ্তি অনুযায়ী বছরে ১৫ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা সরকারি নগদ সহায়তা দরকার। এমন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতি, অপচয়রোধ করা গেলে দারিদ্র্যবিমোচন টেকসই হবে বলে মনে করেন বক্তারা।

সিপিডি’র গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সবার জন্য ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করা যায় এজন্য ইউবিআই করা হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রোগ্রাম হাতে নেয়ার কী ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে, তা এই গবেষণার উদ্দেশ্য। এই ইউবিআই শুধু উন্নত দেশেই নয়, নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ এবং নিম্নআয়ের দেশেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সবাইকে ন্যূনতম আয় দেয়া হলে এটায় কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু এখানে বড় চিন্তার জায়গা হলো আর্থিক সক্ষমতা হবে কীভাবে।

বর্তমানে দেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে ২০ শতাংশের মতো মানুষ। এর বাইরে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে আরও অনেকেই। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘদিনের অপশাসনে বেড়েছে আয় বৈষম্য, নিত্যপণ্যের চড়া দামে নাজুক এসব নিম্নআয়ের মানুষের যাপিত জীবন।

আয় বৈষম্য কমিয়ে দারিদ্র্যের হার কমানো এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও উৎপাদন গতিশীল করতে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় প্রস্তাব করেছে সিপিডি। প্রস্তাবে বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এক কোটি ৪৭ লাখ ২৫ হাজার পরিবারের জন্য ৮০ হাজার ২১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা দরকার হবে। এই অর্থ চলতি মূল্যে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি’র ১.৩৫ শতাংশ অর্থের সমান। এর ফলে দারিদ্র্য কমবে জাতীয় পর্যায়ে ৬.১৩ শতাংশ, দারিদ্র্যপীড়িত ৩৬ জেলায় ৩.৭২ শতাংশ, জলবায়ুর প্রভাবজনিত ৩৪ জেলায় ৩.০৭ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যপীড়িত ১১ জেলায় ১.৪৬ শতাংশ।
সিপিডি’র গবেষণা বলছে, সারা দেশে প্রায় ৩৬ ভাগ পরিবার খেয়ে পরে বাঁচার লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ছে। ন্যূনতম নিশ্চিত আয়ে পরিবারপ্রতি ৪ হাজার ৫৪০ টাকা মাসিক সহায়তা করতে সরকারি বাজেট বরাদ্দ দরকার ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অতি দরিদ্রপ্রবণ এলাকায় এমন কর্মসূচিতে খরচ হবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।

বক্তারা বলেন, গত ৫ই আগস্ট পরিবর্তনের মূল চেতনা ছিল দেশে বৈষম্যমুক্ত একটি কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। এখন আয় বৈষম্য কমানোর সময় এসেছে। তাই সর্বজনীন ন্যূনতম আয় একটি সময়োপযোগী প্রস্তাবনা। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি নির্ধারকরা এটি আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তবায়ন করতে চাইলে আসছে জানুয়ারি থেকেই কাজ শুরু করতে পারেন।

ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ইউবিআই যেসব দেশে আছে সেখানে ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও অন্তত ১০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে উন্নতি হওয়ার পরে মাত্র ১.২ শতাংশ ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বেড়েছে। এই রেশিও দিয়ে অর্থায়ন সম্ভব কিনা, সেটার পাশাপাশি অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তিনি বলেন, এটা যেহেতু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে, এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটার একটা রোডম্যাপ তৈরি করতে পারে।

কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে সার্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র্যবিমোচনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন এই রাজনীতিবিদ। যেখানে বিতরণের দুর্বলতা এড়ানো সহজ। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ১০ হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট ৩০ হাজার কোটি টাকার না করলে তো প্রবলেম হয় না। এটা তো আমরা দেখেছি বাংলাদেশে। আপনি যদি দেশের মানুষকে সার্ভিস দিতে পারেন সত্যিকার অর্থে, তখন আপনি ক্লেইম করতে পারবেন, ট্যাক্স কালেকশনটা আপনার জন্য তখন অনেক সহজ হয়ে যাবে।

জোনায়েদ সাকি বলেন, ২৪ লাখ মানুষ কর দেন অথচ ১ কোটিরও বেশি মানুষের ক্রেডিট কার্ড আছে। বিরাট একটা অংশের মানুষ কর দিচ্ছেন না, এটা বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলেন, পাচার ও দুর্নীতি মোকাবিলা করতে পারবো কিনা, এটাই প্রধান সমস্যা। এটা মোকাবিলা করা গেলে ন্যূনতম মজুরি ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

সিপিডি’র বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন যে সরকার গঠিত হয়েছে তাদের প্রতি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা বেশি। সরকারও মানুষের এ আশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল। আমি এই মুহূর্তটাকে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের সন্ধিক্ষণ হিসেবে আখ্যায়িত করছি। এরকম সন্ধিক্ষণে আমাদের যত ধরনের স্বপ্ন, যত ধরনের আকাঙ্ক্ষা আছে সব তুলে ধরতে হবে। এটিই সঠিক সময়।

No comments

Powered by Blogger.