গল্প- মোবাইল ফোনের রিচার্জ-সংক্রান্ত একটি সাদামাটা গল্প by শুভাশিস সিনহা
ফোনে
টাকা রিচার্জ করা আমার জন্য যে এমন সংকটের ব্যাপার হয়ে উঠবে, ভাবিনি।
এমনিতে আমার সংবেদনশীলতার জন্য ভোগান্তি জীবনে কম হয়নি। যাকে বলে নরম মন।
ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছে, কেউ এক গালে চড় দিলে অন্য গাল বাড়িয়ে দিতে। মা
বলেছে, কেউ ধমক দিলে মাথা নিচু করে ফিরে আসতে। ফলে মনটা নরম নরম হয়ে বেড়ে
উঠেছে। জানি না মন বাড়ে কি না। শরীর বাড়ে। মন কি আর বাড়ে? এই মন নিয়েই যত
সমস্যা।
যত দিন বিষয়টা একজনকে নিয়ে ছিল, সমস্যার তেমন কিছু ছিল না। যদিও ভুলেভালে হুটহাট করে ফোনে রিচার্জ করে ফেলতাম, যেকোনো দোকান থেকে। কিন্তু ব্যালেন্স শেষ হওয়ার অনুমান বা কোনো উপায়ে জেনে নিয়ে তমা যখন ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করত, ‘দাদা, আপনার কি রিচার্জ লাগবে না?’, মনটা খারাপ হয়ে যেত। এমনও হয়েছে বাধ্য হয়ে পরপর দুবার রিচার্জ করেছি। কখনোবা তমা বলে, ‘দাদা, আপনার এমবি কিন্তু শেষ।’ এই মেয়ে এত কিছু জানে কী করে! ফোন কোম্পানি আসলেই একটা গোয়েন্দা বিভাগের মতো কাজ করে মনে হয়। কে কখন কী করে, সব ওদের জানা। তবে সেটা হতে হবে ফোনবিষয়ক। বলা যায় না, কোনো দিন দৈনন্দিন সব বিষয়-আশয়ই ওদের জানা হতে থাকবে। দেখা গেল কোনো এক ভরদুপুরে তমা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, দাদা, আপনার কিন্তু পেটে খিদা লেগে গেছে, খাবেন না?
ওহ্, তমা বিষয়ে তো বলা হয়নি। তমা আমাদের কাছের বাজারে ফোনের কাস্টমার সার্ভিসে চাকরি করে। দেখতে খুব একটা সুন্দরী এটা বলা যাবে না, আবার অসুন্দরীও নয়। গায়ের রংটা একটু চাপা। চুল একটু কোঁকড়ানো। তমা সাধারণত সালোয়ার-কামিজই পরে। অকেশনালি শাড়িটাড়ি পরে। তবে ওকে শাড়ি পরে দেখেছি এক কি দুবার। তমা চশমা পরে। ‘পাওয়ার কত?’ না, জিরো। ‘তবে?’ ‘ভারিক্কি লাগে। লোকে একটু সমীহ করে।’ মেয়েটা ভালো। দোকানে গেলেই চা-টা খাওয়ায়। ‘থাক থাক।’ ‘আরে না। শিক্ষক মানুষ আপনি। আপনাকে সম্মান না করলে চলে!’ তমার ছোট বোনটা আমার স্কুলেই পড়ে। অঙ্কে মাথা আছে। ক্লাস থ্রিতেই ফাইভের অঙ্ক কষে দিতে পারে। তমা মেট্রিক পাস। কলেজে কিছুদিন পড়ে ক্ষান্ত দিয়েছে। ‘কেন?’ আসলে ওর বাবা বাজারের ছোট একটা দোকানের দরজি। তমারা তিন ভাইবোন। একদম অল্প বেতন হলেও চাকরির অফারটা পেলে আর অন্য কিছু ভাবার সুযোগই ছিল না।
পয়লা সে একজনের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ছিল। যাকে বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট কাস্টমার ম্যানেজার। তখন পেত দুই হাজার। সে সময় অবশ্য তমার সঙ্গে আমার তেমন কথাবার্তা হতো না। আমি কথা বলতাম সেলিনার সঙ্গে। সেলিনাই ছিল কাস্টমার ম্যানেজার। বিয়ে করার পর সেলিনা চলে গেলে তমা হলো ম্যানেজার। এখন সে পাঁচ হাজার পায়। চাকরির তিন বছর। কিন্তু তমা যে রকম অতিথিপরায়ণ মেয়ে, এই টাকার অনেক অংশই যায় কাস্টমারদের আদর-আপ্যায়নে। বিরক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে বলি, ‘এই জন্য তোমার এখানে আসার ইচ্ছা করে না, তমা। তুমি পাও দুই টাকা বেতন, তার মধ্যে চা-পানে খরচ করো পাঁচ টাকা। চলবে কী করে!’ তমা খালি হাসে। হাসলে তমার একটা ফোকলা দাঁত দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ বের হয়। তমা মুখে হাত চাপা দিয়ে সেটা ঢাকার চেষ্টা করে। তমার চোখের নিচে প্রায়ই কালি পড়ে থাকে। ক্লান্তির ছাপ। ঘেমে গেলে আরও স্পষ্ট হয়। পরিবারের দিকে চেয়ে বিয়েটাও করতে পারছে না। একবার দেখতে এসেছিল, গায়ের রং পছন্দ হয়নি পাত্রের। তার দরকার অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। স্মিতা পাতিল দিয়ে তার চলবে না। শালার পুতের নিজের গায়ের রং ছিল আলকাতরার মতো কুচকুচে। এ ঘটনা একদিন লজ্জায়-সংকোচে আমার কাছে বলেছে তমা। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
পেশায় সামান্য প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেও এলাকায় আমার একটু অন্য রকম নামডাক আছে, দু-চার কলম লিখতে পারি বলে। লোকাল পত্রপত্রিকায় দেশ-জাতি নিয়ে দু-চার পৃষ্ঠা লেখা ছাপা হয়েছে। ইদানীং গল্পটল্প লেখার চেষ্টা করি। এই যেমন তমার কথা নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। সামনে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের হবে। লেখা চেয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, তমাকে নিয়ে গল্পের শেষটা করব কীভাবে! কারণ, তমা আমার জীবনে আসলে কেউ না। একমাত্র ফোনে রিচার্জ করা দরকার পড়লে আমি ওকে ফোন দিই, আর আমার রিচার্জের কথা মনে করানোর দরকার পড়লে তমা আমাকে ফোন দেয়। কোনো কোনো সময় তমা আমার কাছ থেকে অ্যাডভান্স টাকা নিয়ে রাখে, যখন ওর টাকার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে, পরে হিসাব করে কেটেকুটে রাখি। আবার এমনও সময় যায়, আমি পুরো দু-তিন মাস টানা ওর কাছ থেকে রিচার্জ করিয়ে নিই, ও টাকা নেওয়ার নামও করে না। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘টাকার হিসাব জানাও। ক্লিয়ার করি।’ তমা জানায়ও না। মনে হয় টাকার দরকারই নাই। বলে, ‘দাদা, হিসাব পরে হবে। প্যাকেজ লাগলে বলেন, এমবি লাগবে?’
কখনো কখনো তমা খুব বিষণ্ন থাকে। আমি টের পাই। হয়তো অন্য কাস্টমাররাও টের পায়। আমার মতো অন্য অনেকেরই হয়তো তমার সঙ্গে এভাবেই ব্যবসাপাতির বাইরে গিয়ে এই সব জানাবোঝার সম্পর্ক থাকে। আমার মতো তারাও তমাকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, মন খারাপ? তমা কিছু বলে না। তার চোখের নিচে কালি আরও বেড়ে যায়। বৈশাখের দ্রুত ঘন হয়ে আসা কালো মেঘ। একদম নুয়ে পড়া। বৃষ্টি হবে হবে। কিন্তু ফোন যখন দেয়, তখন বোঝাই যায় না তমার চোখের নিচে কালি। ফোনে সে সব সময় উৎফুল্ল। কাস্টমারের সঙ্গে মনখারাপের কারবার করে লাভ নেই। ‘আবার বিয়া ভেঙে গেছে।’ এবার কী সমস্যা? ফোনের কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করে, এ কথা নাকি হবু বর জানত না। জানার পর নট করে দিয়েছে। এসব মেয়ের অনেক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ। কথাবার্তা। বর আবার এসব পছন্দ করে না। ‘হালার পুতরে ধইরা পিটন দেওয়া উচিত।’ তমা শুকনো হাসি হাসে।
আহা! হাসলে বড় সুন্দর লাগে মেয়েটাকে।¯স্নিগ্ধ। চোখের নিচে কালি মুছে যায় যেন। শরতের ধবধবে সাদা মেঘ।
------দুই.----
অ্যান্টাগনিস্ট ছাড়া জগৎ চলে না। জগতের নিয়ম হলো দ্বান্দ্বিক। তাই তমার সঙ্গে ফোন রিচার্জের এই মানবিক দায়ের সহজ সম্পর্ক আমার কঠিন পেরেশানিতে পড়ে গেল।
একদিন রাতের বেলা। বারোটার একটু ওপরে সময়। অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন। ‘হ্যালো। কেমন আছস?’ গলাটা খুবই পরিচিত। কিন্তু মনে করতে পারছি না। কে? ‘আরে ব্যাটা, এত তাড়াতাড়ি ভুইলা গেছস। গলা চিনতে পারস না?’ এ রকম অবস্থায় মহা পেরেশানিতে পড়ে যাই। কে! ‘ঠিক আছে, তোরে আর চিনতে হইব না। দুনিয়া বদল রাহি হে, আশু বাহানে ওয়ালে...’ গানের সুরে এবার চিনতে পারলাম। গানের গলা ওর ভালোই। হাসু।
‘হাসু!’
‘হ। ব্যাটা এ্যাদ্দিন ধইরা বাড়িতে আইসা পইড়া রইছি, খোঁজও নিলি না।’
‘আমি তো জানি না! তুই ঢাকায় আছস বইলাই তো জানি। তোর পায়ের অবস্থা এখন কী!’
‘পা তো একটা নাই বললেই চলে।’
‘কী বলিস!’
‘হ। পঙ্গু হাসপাতালে ছিলাম টানা ছয় মাস। একদিন দেখতে গেলি না!’
‘আসলে হাসু আমারও না, এর মধ্যে মরার কমপিটিশন লেগে ছিল রে। দাদি, নানি, কাকা কাকি...মরার সিরিয়াল...’
‘থাক থাক। তুই তো বাঁইচা আছস। তাইলেই চলব। শোন, দেখা তো হইবই। একটা দোকান দিছি। আর তো কিছু করতে পারুম না ব্যাটা। সওদাগিরি করি।’
‘কিসের দোকান?
‘ভুসি মালটাল কিছু আছে। আর ফ্লেক্সিলোড।’
‘বাহ্! ভালো তো!’
‘এখন তো বুঝসই, কোনো ব্যবসাতেই সুবিধা নাই। তোরা বন্ধুরা পাশে না দাঁড়াইলে হইব? শোন, আজ থিকা তোর ফোনে যত রিচার্জ লাগে, ধর ইন্টারনেট মিনিট প্যাকেজ আর আর যা যা লাগে, সব আমার এখান থিকা করবি। আমার কিন্তু দোস্ত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা। ধর রাইতের বেলা বউয়ের লগে আদর করাকরি চলতেছে, এর মইধ্যে ফোন দিয়া দিলি, লাত্থি মারি বউ। তোর কাম আগে হয়া যাইব। হা হা হা।’ হাসুর জন্য আমার দুঃখই হলো। কত টগবগে একটা ছেলে ছিল, বাইকের দ্বিগুণ স্পিডে বাইসাইকেল চালাত। ওর প্রতি অন্যায় করেছি। একবার গিয়ে ঢাকায় দেখা করে আসা উচিত ছিল।
যাক, বন্ধু হিসেবে খুব বেশি অভিযোগ না করে, এইটুকুর ওপর দিয়ে যে হাসু আমাকে মাফ করল, বেঁচে গেলাম। তখনো সেই সংকটের কথা আমার মাথায় আসেনি। সেদিন হাসু বলামাত্র আবেগে-অপরাধবোধে একসঙ্গে কলিং আর নেট ইউজিং দুইটা প্যাকেজ কিনে ফেলি। হাসু খুশি। আমি বলি, ‘হাসু, তুই আমার বন্ধু, তোর বিপদে যদি এক-আধটু কাজে লাগতে পারি, বড় ভালো লাগবে রে।’
হাসুর চোখের পানি যেন দূর থেকে আমার মোবাইল ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
------তিন.------
সব ঠিকই ছিল, কিন্তু সংকট টের পেলাম পরের দিন দুপুরবেলায়। যখন তমা ফোন দিল এবং যথারীতি ফোনে রিচার্জ করার কথা মনে করিয়ে দিল। তমাকে প্যাকেজ দেওয়ার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চমকে উঠলাম নিজের মনে নিজে।
হায় হায়, টাকা তো সব ভরিয়ে ফেলেছি। না বলে দিই। কিন্তু তমাকে না বলাটা এত আনইউজুয়াল যে রীতিমতো অসম্ভব মনে হলো। খুব অস্বাভাবিক লাগবে। কিছু না বলে বলে দিলাম, ‘দাও।’ অফারটা তমার জানাই আছে। তাই সে দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন করল না। কিন্তু আমি নিজেই আগবাড়িয়ে বললাম, ‘তমা, এবার একটু ছোট প্যাকেজ দাও।’ ‘কেন!’ ‘না এমনি। আসলে হয়েছে কী, এমবি শেষই করতে পারি না। আর কথা বলার লোকও কমে গেছে। কার সঙ্গে কথা বলব। সব ধান্দাবাজ।’ ‘না দাদা, এটা আর চেঞ্জ কইরেন না। অফারটা আপনার জন্য একদম ঠিক আছে। আমি তো খেয়াল করেছি, একদম টাইমে টাইমে কভার করে।’ আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। বলি, ‘আচ্ছা তমা, তোমার কি টার্গেট-টুর্গেট কিছু দেওয়া থাকে?’ ‘অবশ্যই থাকে, দাদা। টার্গেট তো ফিলাপ করতেই হয়!’ ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে।’
তমার সঙ্গে কথা শেষে একটু বিমর্ষ হয়ে রইলাম। তমাকে না বলে দিলে কী হতো! আমার ফোন রিচার্জের পেটেন্ট তো আর সে নিয়ে রাখেনি। কিন্তু কেন যে পারলাম না! কিন্তু আমি নিশ্চিত, এই সপ্তাহে আমার সবকিছুই আনইউজড থাকবে। এত কথা আমি কার সঙ্গে বলব। এত এমবি! বাড়িতে শুধু মা আর বোন। বোন তো আমার ফোন থেকে কল দেবেই না। ওর সিক্রেট নম্বরগুলো সব জানাজানি হবে যে! ওর আবার প্রায় নম্বরই সিক্রেট। আর মা তো ফোন হাতে নিয়ে ‘আমি ভালো আছি, তোমরা কেমন আছ’—এই দুই লাইন ছাড়া আর কথা খুঁজে পায় না। এদিকে এই মাসে বাড়ির টিন-টুন বদলাতে হচ্ছে। টাকার একটু বেশি টান। সমস্যায় পড়া গেল। এই সপ্তাহে না হয় ক্ষতিটা মেনে নিলাম। পরের সপ্তাহে?
স্কুলে যাই। এই চিন্তা আমাকে ছাড়ে না। কখন তমার ফোন আসে। কখন হাসুর। সেদিন হাসুর দোকানে গেলাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। যেন নতুন করে বেঁচে উঠছে বেচারা। হাসু সচরাচর চোখের পানি ফেলে না। এখন দেখি অল্পতেই চোখ টইটম্বুর। হাসু বলে, ‘কিছু মনে করিস না দোস্ত, থাকলে কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিস। পরে কাইটা রাখবনে। লোড নিতে হইব। ট্যাকা শর্ট।’ ‘কত লাগবে?’ ‘পারলে দুই হাজার দিস?’ ‘দুই হাজার? না রে...আচ্ছা হাজারখানেক দিতে পারব।’ হাসুর চোখের পানিতে আমি ফের পানসি ভাসালাম।
তমা একদিন ফোন দিয়ে বলে, ‘দাদা, বাজারের দিকে আসেন না? একেবারে যে দেখিই না!’ আমি থতমত খাই। ‘মিনিট লাগবে না? এমবি?’ মুসিবতে পড়ি। কিছু বলতে না পেরে লাইন কেটে দিই। পরক্ষণে ফোন অফ। পরে জিজ্ঞেস করলে বলব, চার্জ ছিল না মোবাইলে। গভীর রাতে হাসু ফোন করে, ‘কিরে দোস্ত, তোর নেটপ্যাকেজের মেয়াদ তো এক্সপায়ার হয়া যাইব। একদিন থাকতে রিচার্জ কইরা ফ্যাল, এমবি নষ্ট হইব না, জোড়া লাগব।’
ভেতরে-ভেতরে আমার রাগ চরমে ওঠে। মিনিট কল আর এমবির চাপে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এখন আর নেটও ঠিকঠাক ইউজ করতে পারি না। দুই পক্ষের চাপে প্যাকেজগুলো ব্যবহার করার দিকেই আর মন যাচ্ছে না।
এই যখন অবস্থা, একদিন স্কুল ফেরার পথে হঠাৎ তমার সঙ্গে দেখা। কল্পনাই করিনি ওর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। ‘তমা, তুমি? কই গেছিলা?’ ‘আপনাদের বাড়িতেই দাদা!’ ‘মানে! কেন? কী হয়েছে?’ তমার চোখেমুখে লজ্জা। আমার দিকে তাকাতে পারছিল না। ওর কপালে আজ একটা লাল রঙের বড় টিপ। ওই লাল টিপের আভা যেন ছড়িয়ে পড়ছে ওর গালজুড়ে। তাতে ওকে আজ অন্য রকম লাগছে। চুলও খোলা। তমাকে চুলখোলা অবস্থায় দেখিনি কোনো দিন। ‘আপনাকে আর জ্বালাব না দাদা। অনেক জ্বালিয়েছি।’ ‘মানে!’ তমা কিছুক্ষণ চুপচাপ। ঝিরঝিরে একটা বাতাস বইছে। গোধূলির আলো। দূরে কোথাও ধূলি উড়িয়ে উড়িয়ে গো-দল নিশ্চয়ই ঘরে ফিরছে। তমার এই লজ্জা-সংকোচ রহস্য আধেক বুঝি, আধেক বুঝি না।
--------চার.-------
এমন একটা পাগলা সংকট থেকে এত সহজে পার পাব, চিন্তাই করিনি। মেঘ না চাইতেই জল বোধ হয় একেই বলে। তমা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। এত খাটাখাটনি করে এত কম টাকা দিয়ে কী করবে? প্রমোশন-টমোশনের বালাই নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ওর হবু বর ভালো বেতনে চাকরি করে। তমাকে খাওয়ানো-পরানোর মুরোদ তার আছে। তমার আর রাতদুপুরে মিনিট আর এমবির অফার শুনিয়ে শুনিয়ে মুখে ফেনা তোলার কী দরকার। সেলিনার জায়গায় তমা এসেছিল, তমার জায়গায় আর কেউ আসবে। ব্যস।
তমার বিয়ে। আগামী মঙ্গলবার। কাস্টমার হিসেবে তমার কাছে আমি স্পেশাল। জানি না কী কারণ, তাই সে নিজ হাতে আমার বাসায় কার্ড দিতে গেছে।
হাসুর কাছে আমার এই দুই কূল রক্ষা প্রকল্পের গল্পটা হাসতে হাসতে করছিলাম। সে শুনে অবাক। ‘তুই তো ব্যাটা মহামানব। বড় কোমল হৃদয় রে তোর। সফট হার্ট।’ আর আমারও ফরমায়েশি গল্পটার একটা গতি হবে মনে হলো।
পর সমাচার: তমা আর আমাকে মিনিট কিংবা এমবির প্যাকেজ রিচার্জ করার অফার দিয়ে ফোন করে না। কিন্তু নতুন একটা সংকট হলো, আমি এখনো মাঝেমধ্যে একটা ভুতুড়ে কল পাই।
‘দাদা, মিনিট লাগবে, না এমবি?’
‘হ্যালো, তমা, তমা, তমা...’
তমা কোনো কথা বলে না। আমি জানি, ওপাশে তমা আর কোনো দিন ওভাবে কথা বলবে না। তবু ডাকি।
তবু মাঝেমধ্যেই সেই কল আসে, ‘দাদা, মিনিট লাগবে, না এমবি?’
যত দিন বিষয়টা একজনকে নিয়ে ছিল, সমস্যার তেমন কিছু ছিল না। যদিও ভুলেভালে হুটহাট করে ফোনে রিচার্জ করে ফেলতাম, যেকোনো দোকান থেকে। কিন্তু ব্যালেন্স শেষ হওয়ার অনুমান বা কোনো উপায়ে জেনে নিয়ে তমা যখন ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করত, ‘দাদা, আপনার কি রিচার্জ লাগবে না?’, মনটা খারাপ হয়ে যেত। এমনও হয়েছে বাধ্য হয়ে পরপর দুবার রিচার্জ করেছি। কখনোবা তমা বলে, ‘দাদা, আপনার এমবি কিন্তু শেষ।’ এই মেয়ে এত কিছু জানে কী করে! ফোন কোম্পানি আসলেই একটা গোয়েন্দা বিভাগের মতো কাজ করে মনে হয়। কে কখন কী করে, সব ওদের জানা। তবে সেটা হতে হবে ফোনবিষয়ক। বলা যায় না, কোনো দিন দৈনন্দিন সব বিষয়-আশয়ই ওদের জানা হতে থাকবে। দেখা গেল কোনো এক ভরদুপুরে তমা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, দাদা, আপনার কিন্তু পেটে খিদা লেগে গেছে, খাবেন না?
ওহ্, তমা বিষয়ে তো বলা হয়নি। তমা আমাদের কাছের বাজারে ফোনের কাস্টমার সার্ভিসে চাকরি করে। দেখতে খুব একটা সুন্দরী এটা বলা যাবে না, আবার অসুন্দরীও নয়। গায়ের রংটা একটু চাপা। চুল একটু কোঁকড়ানো। তমা সাধারণত সালোয়ার-কামিজই পরে। অকেশনালি শাড়িটাড়ি পরে। তবে ওকে শাড়ি পরে দেখেছি এক কি দুবার। তমা চশমা পরে। ‘পাওয়ার কত?’ না, জিরো। ‘তবে?’ ‘ভারিক্কি লাগে। লোকে একটু সমীহ করে।’ মেয়েটা ভালো। দোকানে গেলেই চা-টা খাওয়ায়। ‘থাক থাক।’ ‘আরে না। শিক্ষক মানুষ আপনি। আপনাকে সম্মান না করলে চলে!’ তমার ছোট বোনটা আমার স্কুলেই পড়ে। অঙ্কে মাথা আছে। ক্লাস থ্রিতেই ফাইভের অঙ্ক কষে দিতে পারে। তমা মেট্রিক পাস। কলেজে কিছুদিন পড়ে ক্ষান্ত দিয়েছে। ‘কেন?’ আসলে ওর বাবা বাজারের ছোট একটা দোকানের দরজি। তমারা তিন ভাইবোন। একদম অল্প বেতন হলেও চাকরির অফারটা পেলে আর অন্য কিছু ভাবার সুযোগই ছিল না।
পয়লা সে একজনের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ছিল। যাকে বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট কাস্টমার ম্যানেজার। তখন পেত দুই হাজার। সে সময় অবশ্য তমার সঙ্গে আমার তেমন কথাবার্তা হতো না। আমি কথা বলতাম সেলিনার সঙ্গে। সেলিনাই ছিল কাস্টমার ম্যানেজার। বিয়ে করার পর সেলিনা চলে গেলে তমা হলো ম্যানেজার। এখন সে পাঁচ হাজার পায়। চাকরির তিন বছর। কিন্তু তমা যে রকম অতিথিপরায়ণ মেয়ে, এই টাকার অনেক অংশই যায় কাস্টমারদের আদর-আপ্যায়নে। বিরক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে বলি, ‘এই জন্য তোমার এখানে আসার ইচ্ছা করে না, তমা। তুমি পাও দুই টাকা বেতন, তার মধ্যে চা-পানে খরচ করো পাঁচ টাকা। চলবে কী করে!’ তমা খালি হাসে। হাসলে তমার একটা ফোকলা দাঁত দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ বের হয়। তমা মুখে হাত চাপা দিয়ে সেটা ঢাকার চেষ্টা করে। তমার চোখের নিচে প্রায়ই কালি পড়ে থাকে। ক্লান্তির ছাপ। ঘেমে গেলে আরও স্পষ্ট হয়। পরিবারের দিকে চেয়ে বিয়েটাও করতে পারছে না। একবার দেখতে এসেছিল, গায়ের রং পছন্দ হয়নি পাত্রের। তার দরকার অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। স্মিতা পাতিল দিয়ে তার চলবে না। শালার পুতের নিজের গায়ের রং ছিল আলকাতরার মতো কুচকুচে। এ ঘটনা একদিন লজ্জায়-সংকোচে আমার কাছে বলেছে তমা। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
পেশায় সামান্য প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেও এলাকায় আমার একটু অন্য রকম নামডাক আছে, দু-চার কলম লিখতে পারি বলে। লোকাল পত্রপত্রিকায় দেশ-জাতি নিয়ে দু-চার পৃষ্ঠা লেখা ছাপা হয়েছে। ইদানীং গল্পটল্প লেখার চেষ্টা করি। এই যেমন তমার কথা নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। সামনে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের হবে। লেখা চেয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, তমাকে নিয়ে গল্পের শেষটা করব কীভাবে! কারণ, তমা আমার জীবনে আসলে কেউ না। একমাত্র ফোনে রিচার্জ করা দরকার পড়লে আমি ওকে ফোন দিই, আর আমার রিচার্জের কথা মনে করানোর দরকার পড়লে তমা আমাকে ফোন দেয়। কোনো কোনো সময় তমা আমার কাছ থেকে অ্যাডভান্স টাকা নিয়ে রাখে, যখন ওর টাকার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে, পরে হিসাব করে কেটেকুটে রাখি। আবার এমনও সময় যায়, আমি পুরো দু-তিন মাস টানা ওর কাছ থেকে রিচার্জ করিয়ে নিই, ও টাকা নেওয়ার নামও করে না। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘টাকার হিসাব জানাও। ক্লিয়ার করি।’ তমা জানায়ও না। মনে হয় টাকার দরকারই নাই। বলে, ‘দাদা, হিসাব পরে হবে। প্যাকেজ লাগলে বলেন, এমবি লাগবে?’
কখনো কখনো তমা খুব বিষণ্ন থাকে। আমি টের পাই। হয়তো অন্য কাস্টমাররাও টের পায়। আমার মতো অন্য অনেকেরই হয়তো তমার সঙ্গে এভাবেই ব্যবসাপাতির বাইরে গিয়ে এই সব জানাবোঝার সম্পর্ক থাকে। আমার মতো তারাও তমাকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, মন খারাপ? তমা কিছু বলে না। তার চোখের নিচে কালি আরও বেড়ে যায়। বৈশাখের দ্রুত ঘন হয়ে আসা কালো মেঘ। একদম নুয়ে পড়া। বৃষ্টি হবে হবে। কিন্তু ফোন যখন দেয়, তখন বোঝাই যায় না তমার চোখের নিচে কালি। ফোনে সে সব সময় উৎফুল্ল। কাস্টমারের সঙ্গে মনখারাপের কারবার করে লাভ নেই। ‘আবার বিয়া ভেঙে গেছে।’ এবার কী সমস্যা? ফোনের কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করে, এ কথা নাকি হবু বর জানত না। জানার পর নট করে দিয়েছে। এসব মেয়ের অনেক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ। কথাবার্তা। বর আবার এসব পছন্দ করে না। ‘হালার পুতরে ধইরা পিটন দেওয়া উচিত।’ তমা শুকনো হাসি হাসে।
আহা! হাসলে বড় সুন্দর লাগে মেয়েটাকে।¯স্নিগ্ধ। চোখের নিচে কালি মুছে যায় যেন। শরতের ধবধবে সাদা মেঘ।
------দুই.----
অ্যান্টাগনিস্ট ছাড়া জগৎ চলে না। জগতের নিয়ম হলো দ্বান্দ্বিক। তাই তমার সঙ্গে ফোন রিচার্জের এই মানবিক দায়ের সহজ সম্পর্ক আমার কঠিন পেরেশানিতে পড়ে গেল।
একদিন রাতের বেলা। বারোটার একটু ওপরে সময়। অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন। ‘হ্যালো। কেমন আছস?’ গলাটা খুবই পরিচিত। কিন্তু মনে করতে পারছি না। কে? ‘আরে ব্যাটা, এত তাড়াতাড়ি ভুইলা গেছস। গলা চিনতে পারস না?’ এ রকম অবস্থায় মহা পেরেশানিতে পড়ে যাই। কে! ‘ঠিক আছে, তোরে আর চিনতে হইব না। দুনিয়া বদল রাহি হে, আশু বাহানে ওয়ালে...’ গানের সুরে এবার চিনতে পারলাম। গানের গলা ওর ভালোই। হাসু।
‘হাসু!’
‘হ। ব্যাটা এ্যাদ্দিন ধইরা বাড়িতে আইসা পইড়া রইছি, খোঁজও নিলি না।’
‘আমি তো জানি না! তুই ঢাকায় আছস বইলাই তো জানি। তোর পায়ের অবস্থা এখন কী!’
‘পা তো একটা নাই বললেই চলে।’
‘কী বলিস!’
‘হ। পঙ্গু হাসপাতালে ছিলাম টানা ছয় মাস। একদিন দেখতে গেলি না!’
‘আসলে হাসু আমারও না, এর মধ্যে মরার কমপিটিশন লেগে ছিল রে। দাদি, নানি, কাকা কাকি...মরার সিরিয়াল...’
‘থাক থাক। তুই তো বাঁইচা আছস। তাইলেই চলব। শোন, দেখা তো হইবই। একটা দোকান দিছি। আর তো কিছু করতে পারুম না ব্যাটা। সওদাগিরি করি।’
‘কিসের দোকান?
‘ভুসি মালটাল কিছু আছে। আর ফ্লেক্সিলোড।’
‘বাহ্! ভালো তো!’
‘এখন তো বুঝসই, কোনো ব্যবসাতেই সুবিধা নাই। তোরা বন্ধুরা পাশে না দাঁড়াইলে হইব? শোন, আজ থিকা তোর ফোনে যত রিচার্জ লাগে, ধর ইন্টারনেট মিনিট প্যাকেজ আর আর যা যা লাগে, সব আমার এখান থিকা করবি। আমার কিন্তু দোস্ত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা। ধর রাইতের বেলা বউয়ের লগে আদর করাকরি চলতেছে, এর মইধ্যে ফোন দিয়া দিলি, লাত্থি মারি বউ। তোর কাম আগে হয়া যাইব। হা হা হা।’ হাসুর জন্য আমার দুঃখই হলো। কত টগবগে একটা ছেলে ছিল, বাইকের দ্বিগুণ স্পিডে বাইসাইকেল চালাত। ওর প্রতি অন্যায় করেছি। একবার গিয়ে ঢাকায় দেখা করে আসা উচিত ছিল।
যাক, বন্ধু হিসেবে খুব বেশি অভিযোগ না করে, এইটুকুর ওপর দিয়ে যে হাসু আমাকে মাফ করল, বেঁচে গেলাম। তখনো সেই সংকটের কথা আমার মাথায় আসেনি। সেদিন হাসু বলামাত্র আবেগে-অপরাধবোধে একসঙ্গে কলিং আর নেট ইউজিং দুইটা প্যাকেজ কিনে ফেলি। হাসু খুশি। আমি বলি, ‘হাসু, তুই আমার বন্ধু, তোর বিপদে যদি এক-আধটু কাজে লাগতে পারি, বড় ভালো লাগবে রে।’
হাসুর চোখের পানি যেন দূর থেকে আমার মোবাইল ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
------তিন.------
সব ঠিকই ছিল, কিন্তু সংকট টের পেলাম পরের দিন দুপুরবেলায়। যখন তমা ফোন দিল এবং যথারীতি ফোনে রিচার্জ করার কথা মনে করিয়ে দিল। তমাকে প্যাকেজ দেওয়ার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চমকে উঠলাম নিজের মনে নিজে।
হায় হায়, টাকা তো সব ভরিয়ে ফেলেছি। না বলে দিই। কিন্তু তমাকে না বলাটা এত আনইউজুয়াল যে রীতিমতো অসম্ভব মনে হলো। খুব অস্বাভাবিক লাগবে। কিছু না বলে বলে দিলাম, ‘দাও।’ অফারটা তমার জানাই আছে। তাই সে দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন করল না। কিন্তু আমি নিজেই আগবাড়িয়ে বললাম, ‘তমা, এবার একটু ছোট প্যাকেজ দাও।’ ‘কেন!’ ‘না এমনি। আসলে হয়েছে কী, এমবি শেষই করতে পারি না। আর কথা বলার লোকও কমে গেছে। কার সঙ্গে কথা বলব। সব ধান্দাবাজ।’ ‘না দাদা, এটা আর চেঞ্জ কইরেন না। অফারটা আপনার জন্য একদম ঠিক আছে। আমি তো খেয়াল করেছি, একদম টাইমে টাইমে কভার করে।’ আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। বলি, ‘আচ্ছা তমা, তোমার কি টার্গেট-টুর্গেট কিছু দেওয়া থাকে?’ ‘অবশ্যই থাকে, দাদা। টার্গেট তো ফিলাপ করতেই হয়!’ ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে।’
তমার সঙ্গে কথা শেষে একটু বিমর্ষ হয়ে রইলাম। তমাকে না বলে দিলে কী হতো! আমার ফোন রিচার্জের পেটেন্ট তো আর সে নিয়ে রাখেনি। কিন্তু কেন যে পারলাম না! কিন্তু আমি নিশ্চিত, এই সপ্তাহে আমার সবকিছুই আনইউজড থাকবে। এত কথা আমি কার সঙ্গে বলব। এত এমবি! বাড়িতে শুধু মা আর বোন। বোন তো আমার ফোন থেকে কল দেবেই না। ওর সিক্রেট নম্বরগুলো সব জানাজানি হবে যে! ওর আবার প্রায় নম্বরই সিক্রেট। আর মা তো ফোন হাতে নিয়ে ‘আমি ভালো আছি, তোমরা কেমন আছ’—এই দুই লাইন ছাড়া আর কথা খুঁজে পায় না। এদিকে এই মাসে বাড়ির টিন-টুন বদলাতে হচ্ছে। টাকার একটু বেশি টান। সমস্যায় পড়া গেল। এই সপ্তাহে না হয় ক্ষতিটা মেনে নিলাম। পরের সপ্তাহে?
স্কুলে যাই। এই চিন্তা আমাকে ছাড়ে না। কখন তমার ফোন আসে। কখন হাসুর। সেদিন হাসুর দোকানে গেলাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। যেন নতুন করে বেঁচে উঠছে বেচারা। হাসু সচরাচর চোখের পানি ফেলে না। এখন দেখি অল্পতেই চোখ টইটম্বুর। হাসু বলে, ‘কিছু মনে করিস না দোস্ত, থাকলে কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিস। পরে কাইটা রাখবনে। লোড নিতে হইব। ট্যাকা শর্ট।’ ‘কত লাগবে?’ ‘পারলে দুই হাজার দিস?’ ‘দুই হাজার? না রে...আচ্ছা হাজারখানেক দিতে পারব।’ হাসুর চোখের পানিতে আমি ফের পানসি ভাসালাম।
তমা একদিন ফোন দিয়ে বলে, ‘দাদা, বাজারের দিকে আসেন না? একেবারে যে দেখিই না!’ আমি থতমত খাই। ‘মিনিট লাগবে না? এমবি?’ মুসিবতে পড়ি। কিছু বলতে না পেরে লাইন কেটে দিই। পরক্ষণে ফোন অফ। পরে জিজ্ঞেস করলে বলব, চার্জ ছিল না মোবাইলে। গভীর রাতে হাসু ফোন করে, ‘কিরে দোস্ত, তোর নেটপ্যাকেজের মেয়াদ তো এক্সপায়ার হয়া যাইব। একদিন থাকতে রিচার্জ কইরা ফ্যাল, এমবি নষ্ট হইব না, জোড়া লাগব।’
ভেতরে-ভেতরে আমার রাগ চরমে ওঠে। মিনিট কল আর এমবির চাপে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এখন আর নেটও ঠিকঠাক ইউজ করতে পারি না। দুই পক্ষের চাপে প্যাকেজগুলো ব্যবহার করার দিকেই আর মন যাচ্ছে না।
এই যখন অবস্থা, একদিন স্কুল ফেরার পথে হঠাৎ তমার সঙ্গে দেখা। কল্পনাই করিনি ওর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। ‘তমা, তুমি? কই গেছিলা?’ ‘আপনাদের বাড়িতেই দাদা!’ ‘মানে! কেন? কী হয়েছে?’ তমার চোখেমুখে লজ্জা। আমার দিকে তাকাতে পারছিল না। ওর কপালে আজ একটা লাল রঙের বড় টিপ। ওই লাল টিপের আভা যেন ছড়িয়ে পড়ছে ওর গালজুড়ে। তাতে ওকে আজ অন্য রকম লাগছে। চুলও খোলা। তমাকে চুলখোলা অবস্থায় দেখিনি কোনো দিন। ‘আপনাকে আর জ্বালাব না দাদা। অনেক জ্বালিয়েছি।’ ‘মানে!’ তমা কিছুক্ষণ চুপচাপ। ঝিরঝিরে একটা বাতাস বইছে। গোধূলির আলো। দূরে কোথাও ধূলি উড়িয়ে উড়িয়ে গো-দল নিশ্চয়ই ঘরে ফিরছে। তমার এই লজ্জা-সংকোচ রহস্য আধেক বুঝি, আধেক বুঝি না।
--------চার.-------
এমন একটা পাগলা সংকট থেকে এত সহজে পার পাব, চিন্তাই করিনি। মেঘ না চাইতেই জল বোধ হয় একেই বলে। তমা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। এত খাটাখাটনি করে এত কম টাকা দিয়ে কী করবে? প্রমোশন-টমোশনের বালাই নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ওর হবু বর ভালো বেতনে চাকরি করে। তমাকে খাওয়ানো-পরানোর মুরোদ তার আছে। তমার আর রাতদুপুরে মিনিট আর এমবির অফার শুনিয়ে শুনিয়ে মুখে ফেনা তোলার কী দরকার। সেলিনার জায়গায় তমা এসেছিল, তমার জায়গায় আর কেউ আসবে। ব্যস।
তমার বিয়ে। আগামী মঙ্গলবার। কাস্টমার হিসেবে তমার কাছে আমি স্পেশাল। জানি না কী কারণ, তাই সে নিজ হাতে আমার বাসায় কার্ড দিতে গেছে।
হাসুর কাছে আমার এই দুই কূল রক্ষা প্রকল্পের গল্পটা হাসতে হাসতে করছিলাম। সে শুনে অবাক। ‘তুই তো ব্যাটা মহামানব। বড় কোমল হৃদয় রে তোর। সফট হার্ট।’ আর আমারও ফরমায়েশি গল্পটার একটা গতি হবে মনে হলো।
পর সমাচার: তমা আর আমাকে মিনিট কিংবা এমবির প্যাকেজ রিচার্জ করার অফার দিয়ে ফোন করে না। কিন্তু নতুন একটা সংকট হলো, আমি এখনো মাঝেমধ্যে একটা ভুতুড়ে কল পাই।
‘দাদা, মিনিট লাগবে, না এমবি?’
‘হ্যালো, তমা, তমা, তমা...’
তমা কোনো কথা বলে না। আমি জানি, ওপাশে তমা আর কোনো দিন ওভাবে কথা বলবে না। তবু ডাকি।
তবু মাঝেমধ্যেই সেই কল আসে, ‘দাদা, মিনিট লাগবে, না এমবি?’
No comments