মুঘল সাম্রাজ্যের আসল কোহ-ই-নূর… by সাবিহা নাহলা
ঘোড়া ছুটিয়ে সম্রাট বাবুরের তাঁবুর সামনে এসে থামলেন এক যুবক। তাঁবুতে প্রবেশ করে সম্রাট বাবরের হাতে একটি উজ্জ্বল পাথর দিয়ে বললেন,
- *“আব্বাজান এত বড় হীরকখণ্ড আগে দেখি নি। গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের রত্নাকর একবার এর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিল যে পুরো পৃথিবীর অর্ধদিনের ব্যয় নির্বাহ করা যাবে এটা দিয়ে।”
কথাগুলো যিনি বলছিলেন, তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট বাবুরের পুত্র মির্জা
হুমায়ূন; আর এই হীরকখণ্ডটি ছিল জগদ্বিখ্যাত হীরা কোহ-ই-নূর। মোঘল
সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন ১৫৩০ সালে
দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার জন্ম ৬ই মার্চ ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু
২২শে ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ। ১৫ বছর তিনি রাজ্যহারা অবস্থায় থেকে
১৫৫৫ সালে পুনরায় সাম্রাজ্য ফিরে পান।
সম্রাট হুমায়ুন ছিলেন এমন এক পরিচ্ছন্ন, শোভাময় পদ্ম, যার পঙ্কেই জন্ম
আর পঙ্কেই বাস। ইতিহাস অথবা ইতিহাসবিদেরা তাকে অযোগ্য, অকর্মণ্য হিসেবে
ইঙ্গিত করতে বড় ভালবাসেন। যুগের হিসেবে যে মানদন্ডে তাকে উত্তীর্ণ করা হয়
না, বোধকরি সে মানদণ্ড ছিল নিজেই ক্রুটিযুক্ত। ভাইদের প্রতি কঠোর না হওয়ার
যে নির্দেশ তাঁর পিতা তাঁকে করেছিলেন, তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
তিনি তাঁর ভাই, চাচা ও চাচাতো ভাইয়ের মধ্যে উদারভাবে সমগ্র রাজ্য বন্টন করে
দেন, যে দৃষ্টান্ত কেবল বিরলই ছিল না, মহাদূর্যোগের নামান্তরও ছিল। তিনি
তাঁর ভাই মীর্জা কামরানকে কাবুল ও কান্দাহারের দায়িত্বে, মীর্জা আসকারিকে
সম্বলের, মীর্জা হিন্দালকে আলওয়ার ও মেওয়াতের এবং পিতৃব্য মীর্জা হায়দারকে
কাশ্মীরের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন। মোঘলদের কোনো নির্দিষ্ট
উত্তরাধিকার আইন ছিল না। আব্দুল করিমের মতে,
- *“সুতরাং, প্রায়ক্ষেত্রে তরবারিই উত্তরাধিকার প্রশ্নের মীমাংসা করিত।”
ফলে সেটাই ঘটল যেটা সহজে অনুমেয় ছিল। প্রত্যেকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও
বিদ্রোহে লিপ্ত হল। তারা প্রত্যেকে দিল্লীর সিংহাসন চায়। বিভিন্ন জায়গায়
বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও মীর্জা কামরানই প্রথম শত্রুতা আরম্ভ করে এবং
লাহোরসহ পুরো পাঞ্জাব দখল করে নেয়। জানতে পেরে হুমায়ুন তা প্রসন্নচিত্তেই
মেনে নিলেন। এভাবে বারংবার তাঁর ভ্রাতৃত্রয়ের বিরোধী আচরণ তিনি ক্ষমা করে
দেন এবং কাছে টেনে নেন। প্রত্যেককেই তিনি স্নেহের নজরে দেখেন। ক্ষমা
মহৎগুণ। একজন শাসকের ক্ষমা তার রাজ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ হতে পারে, কিন্তু
তাতে ‘ক্ষমা’ গুণের মাহাত্ম্য কমে না। তিনি ছিলেন আবেগী, সৎ, ক্ষমাশীল,
নির্লোভ, দয়ালু, ন্যায়পরায়ণ এবং খেয়ালী। পিতার চরিত্রের কঠোরতা, ক্রুদ্ধতা,
দূরদর্শীতা এবং লেগে থাকার স্পৃহা তাঁর মধ্যে ছিল না।
আমি ঐতিহাসিক নই বলেই হয়তো একথা বলতে বেশি ভালবাসব যে, তাঁর সময়কার
পরিপার্শ্ব এবং তাঁর অকৃতজ্ঞ স্বজনরা বরং একজন হৃদয়বান শাসকের অযোগ্য ছিল।
তাঁর পরম শত্রু শেরশাহ স্বয়ং তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করতেন। তিনি উদ্যমী
ও সাহসী ছিলেন বলে বারবার যুদ্ধ জয় করে হৃতরাজ্য ফিরে পেয়েছেন। তাঁর
সমরকুশলতা ও লেগে থাকার অভাবের কারণে তিনি চৌসার যুদ্ধ, কনৌজের যুদ্ধসহ বেশ
কিছু যুদ্ধে হেরে রাজ্যহারা হয়েছেন। তাঁকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে
বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা গেলেও, একথা অনস্বীকার্য যে তিনি ছিলেন এক
আকর্ষনীয় চরিত্র।
সবশেষে, সম্রাট হুমায়ূন কেমন মানুষ ছিলেন তা শেষ করি একটা ছোট্ট গল্প দিয়েই।
নৌকায় করে সিন্ধুনদ পার হচ্ছেন মীর্জা হুমায়ুন। সামনের নৌকায় তার প্রধান
সেনাপতি বৈরাম খাঁ। এই নৌকায় উঠে পড়েছেন রত্নাকর মহাবীরও। উদ্দেশ্য,
একটিবার কোহিনুর হীরা স্বচক্ষে দেখবে। বৈরাম খাঁ তার আগ্রহের কথা জানতে
পেরে বললেন, “আপনাকে কোহিনুর দেখতে দেয়া হবে। তবে কোহিনুর সামান্য পাথর
মাত্র। পেছনের নৌকার দিকে তাকান। রাজ্যহারা হুমায়ুন তার স্ত্রীর হাত ধরে
বসে আছেন। উনিই সত্যিকারের কোহিনুর। দেখেছেন?”
No comments