বাংলাদেশের কথাসাহিত্য : শওকত আলী by হাসান আজিজুল হক
খুব
ছোট্ট বৃত্তে ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে আধুনিকতার একটা সূচনা
আমরা সাধারণত উল্লেখ করে থাকি। কেন করি, জানি না। আধুনিকতার সংজ্ঞা কী, তাও
জানি না। আর রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীকালের সাহিত্যকে আধুনিক সময়ের লেখা বলে
আমরা চিহ্নিত করেছি। তিরিশের দশকের কবিদের কথা বলেছি। এদিক থেকে বাংলাদেশের
আধুনিক সাহিত্য কবে থেকে? আমরা আবার খতিয়ে বিচার করি – দশক ধরে। সেই
সূত্রে, পঞ্চাশের দশকের লেখকদের লেখা আর পড়ি না। মানিক-তারাশঙ্কররা তো আরো
আগের। সাহিত্য বিচার দশকওয়ারি হওয়া একেবারেই উচিত না। তাতে আত্মম্ভরী বেড়ে
যায় যে, আগের দশকের লেখকরা ডুবে গেছে, এই মুহূর্তের লেখাই জীবমত্ম। আমাদের
গ্রাম্য একটি প্রবাদ আছে, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,
সতীনাথ ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র, বিশেষ করে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্কর, এখনো কি আমরা এঁদেরকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি? তাহলে
পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক, সত্তরের দশক, আশির দশক, নববইয়ের দশক, শূন্যের
দশক, দ্বিতীয় দশক এভাবে ভাগ করা হচ্ছে কেন? আমাদের তরুণরা এসব ভাগাভাগি
নিয়ে বেশি মাতামাতি করছে। আমি এটা একদমই মেনে নিতে পারি না। এছাড়া
সাহিত্যের এই দশকওয়ারি বিচার করাটা একদিক থেকে আমাদের সাহিত্যিকদের নিজেরই
অপমান করা হয়। যখন বলা হয় ষাটের দশকের লেখা, তখন প্রচ্ছন্নভাবে হলেও বলা
হয়, লেখাটি অনেক পুরনো লেখা। এটা বললে পৃথিবীর বহু সাহিত্যকে বাতিল করে
দিতে হয়। ষাটের দশকের লেখা যদি বাতিলযোগ্য হয়, তাহলে সেটা তখন-ই বাতিলযোগ্য
ছিল, আর এখনো বাতিলযোগ্য। আর যদি তারা টিকে থাকে, চিরকালই টিকে থাকবে। এই
দৃষ্টিভঙ্গিটা আগে ঠিক করে নেওয়া উচিত। এটা কোন পদ্ধতিতে সাহিত্যের দিকে
তাকানো? এটা উচিত নয়। সাহিত্য টেকসই হয়। অনেকে মনে করেন যে, সাহিত্য
অজনপ্রিয় হলেই টেকসই হবে। কথাটা ঠিক নয়। জনপ্রিয় হয়েও সাহিত্য টেকসই হয়।
শরৎচন্দ্র টেকসই হয়েছেন। শরৎচন্দ্রের নাম উচ্চারিত হলেই আমরা বলে দিতে পারি
এই মাপের লেখক। আজ থেকে শত বছর পরে কী হবে তা আমি জানি না। মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায় এই মাপেরই লেখক। ঠিক তেমনিভাবে শওকত আলীকে বলা হয় পঞ্চাশের
দশকের একদম শেষভাগের লেখক। এবং পরের যে-দশক আমাদের সাহিত্যে আধুনিকতার
বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে ভাবা হচ্ছে, তার কিছু কিছু স্ফুলিঙ্গ শওকত আলী তাঁর
নিজের মধ্যে বহন করেছেন। পিঙ্গল আকাশ এমনি একটি লেখা। আমি এই রকম বিচারের
সম্পূর্ণ বিরোধী, যা টেকার তা টিকবেই। এই মুহূর্তে যিনি লিখছেন, তিনি যদি
একটি মুহূর্তকে চিহ্নিত করতে পারেন, আলাদা করে ফেলতে পারেন, সময় থেকে
বিচ্ছিন্ন করে আলাদা তারকার মতো চিহ্নিত করতে পারেন, তাহলে ওই তারা আর
নিভবে না। সেজন্যে অনেকে মনে করেন, শওকত আলী যখন পঁচাত্তর পেরিয়েছেন, আশি
ধরেছেন, লেখালেখি একদম ছেড়েই দিয়েছেন, এখন আর তিনি সেভাবে আলোচনায় আসছেন
না। অথবা আসার খুব প্রয়োজন আছে বলেও যেন মনে হচ্ছে না। তাহলে আমরা কি
বাতিলযোগ্য, আমাদের যাদের বয়স হয়েছে, স্মৃতিশক্তি তেমন নেই, হাঁটার
সামর্থ্য নেই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি? দেবেশ রায় একবার বলেছেন, ‘খেলতে যখন
নেমেছি, যতো খুশি ফউল করো, মাঠ কিন্তু ছাড়ছি না।’ কার ভাগ্যে কী আছে বলা
যায়? রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়স পর্যমত্ম তীক্ষন-ধীর ছিলেন। যেমন ছিলেন তেমনি
ছিলেন, বরং আরো তীক্ষনতর হয়েছিলেন। তা না হলে, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’, কিংবা
‘রূপ-নারানের কূলে’ কিংবা ‘শেষ প্রশ্ন’ মৃত্যুর এক সপ্তাহ-দুই সপ্তাহ আগের
লেখাগুলো লেখা সম্ভব হতো না। তাঁর লেখা এতটুকু স্মান হয়নি, পুরনো হয়নি,
ক্ষয়ে যায়নি। মাত্র ষাট-বাষট্টি বছর বয়সে হেমিংওয়ে নিজেই মনে করলেন, আমার
লেখা একরকম শেষ। আমার কোনো ক্ষমতাই নেই। নিজের মাথায় নিজেই গুলি করলেন। না
লেখার ক্ষমতা, না নারী ভোগের ক্ষমতা, কোনোটিই যখন নেই, তখন আর শারীরিকভাবে
বেঁচে থেকে কী লাভ। আবার বহু বৃদ্ধ লেখক সমানে লিখে চলেছেন। শওকত আলী
সম্পর্কে আমার মনে হয়, এই সময়ের পাঠক ও লেখকের চোখে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন।
যদিও তাঁর প্রদোষে প্রাকৃতজন নিয়ে বহু বিদগ্ধজন লিখেছেন, তারপরও আরো কিছু
সমৃদ্ধ লেখা লিখেছেন। অসাধারণ কিছু লিখে ফেলার পরে কেউ কেউ বাকি জীবনই টেনে
নিয়ে চলতে পারেন, কেউ ছাপিয়ে যান, কেউ পিছিয়ে পড়েন, কেউ মধ্যপথে হাঁপাতে
থাকেন। শওকত আলী বাষট্টি সালের দিকে তাঁর প্রথম উপন্যাস পিঙ্গল আকাশ
লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে একটির পর একটি অসাধারণ গল্প ও উপন্যাস লিখে গেছেন।
বিশেষ করে উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্র করে লেখা তাঁর গল্পগুলো সত্যিই সুখপাঠ্য।
প্রামত্মবর্গীয় জীবন, জোতদার, মহাজন, আদিবাসীদের নিয়ে লেখা কি কোনোদিন লয়
পাবে? বাংলা সাহিত্য থেকে হারিয়ে যাবে? আমি অমত্মত বিশ্বাস করি না। অসাধারণ
অনেক গল্প একমাত্র তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে। স্থানীয় যে ঝাঁঝালো গন্ধ,
স্থানীয় গন্ধ সবসময় মিষ্টিমধুর হয়, কোনো গাছে অত্যমত্ম ঝাঁঝালো, কোনো গাছকে
নিংড়ালে যে-গন্ধ পাওয়া যায় সেটা অন্য রকমের। সেই গন্ধ নিয়ে ওই এলাকার
মানুষের যে-গল্প তা অসাধারণ। তিনি যখন অভিনব একেকটি গল্প লিখে চলছেন, তখন
আমার মনে হয়েছিল, আচ্ছা, এমন গল্প সমরেশ বসু কি লিখেছেন, জ্যোতিরিন্দ্র
নন্দী কি লিখেছেন, কিংবা আমাদের জগদীশ গুপ্তের গল্পের কথাও ভেবেছি। খুঁজে
দেখিছি। কিন্তু না, শওকত আলী সকলের চেয়ে আলাদা। উনি ওনার মতো করে গল্প
লিখেছেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় উত্তরাঙ্গ নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু
শওকত আলী শওকত আলী-ই। তিনি তাঁর মতো করেই লিখছেন। শওকত আলীর এই সমসত্ম
খুবই জীবমত্ম গল্প। এই গল্পগুলো আমি মনে করি, এই ভূখণ্ডেরবাংলা ভাষার
মানুষদের চিরদিনের পাঠ্য অবশ্যই। আর অনুবাদের ভাগ্য খারাপ। বাংলার অনুবাদ
ইংরেজিতে কেন দাঁড়ায় না, আমি বুঝতে পারি না। দুই ভাষাতে কী যেন একটু তুমুল
কলহ আছে! ইংরেজিকে কিছুতেই উপনিবেশ স্থাপন করতে দেবে না। বাংলা থেকে ইংরেজি
অনুবাদ তেমন ভালো হলো না। পৃথিবীতে আমরা রাতকানা হয়েই কাটালাম। আমাদের আর
কিছুই হলো না। আমাদের সকলের ভাগ্যে যা আছে, শওকত আলীর ভাগ্যেও তাই ঘটছে।
প্রদোষে প্রাকৃতজন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে অনেকটা কেন্দ্র ছিল গৌড় এবং পু-্রবর্ধন ওই এলাকার পাল রাজা, সেন রাজাদের শাসনামলের কাহিনি। খুব প্রশংসিত হয়েছে উপন্যাসটি। যথেষ্ট পড়াশোনা করেছেন। যদিও আমি মনে করি, উপন্যাসটিতে কিছুটা ঝুঁকে পড়ার ব্যাপার আছে। মানুষ ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়ায় না। একটু বাঁয়ে কাত, একটু ডানে কাত, একটু সামনে ঝুঁকে পড়া। বাঙালি নারী তখন কী গহনা পরতেন, কী পোশাক পরতেন, দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল, এটা কিন্তু রোমান্সও বটে। অসিত্মত্বে ফেরা মানেই রোমান্স। পেছনের রহস্য মাখানো। যার মায়াটি একটি কুহকী, যে কুহকী মায়া আমি কোনোদিন অনুভব করব না। আমার নিজের জীবনেই এমনটা ঘটেছে। ১৭ বছর যে কুহকী মায়াতে আমি পড়েছিলাম রাঢ়ের মাটিতে, কী যে প্রেম আমার সেই মাটির সঙ্গে, এখনো সেই মায়া কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
কাজেই, শওকত আলী প্রদোষে প্রাকৃতজনে যে ফিরে গিয়েছিলেন, তখন খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। খুব সূক্ষ্মভাবে তাঁর একটা ঝুঁকে পড়ার জায়গায় আছে। এই জায়গাটাতেই আমার আপত্তি। আমি মনে করি, যে-কোনো সাহিত্যিকের জন্য ঝুঁকে পড়াটা এজন্যে অন্যায্য, ঝুঁকে পড়লেই তো ওই জায়গাটাতে আমি আর বিচার করছি না। মেনে নিচ্ছি। এতক্ষণ আমি ঝকঝকে চোখে দেখছিলাম, তখন আমার দৃষ্টির চশমাটা পালটে নিয়েছি। তারপরেই আবার শওকত আলী ফিরে গেছেন অন্য উপন্যাস লেখার দিকে। যে-উপন্যাসগুলো অনেকটা তারাশঙ্করীয়। যেমন দলিল, ওয়ারিশ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের এলাকা আমি চিনি, শওকত আলীর মধ্যে কাছাকাছি একটা জিনিস চলে আসে। উপন্যাসের ভালো মন্দ বিচার করা কঠিন। উপন্যাস কতটা ভালো হয়েছে, আমি এখানে বিচার করতে পারব না। আর করলেও মুহূর্তের মধ্যে আর একজন আমার বিপরীত কথা বলতে পারবেন। শওকত আলী কিছু উপন্যাস লিখেছেন যেগুলো বেশ সুখপাঠ্য, উঁচু শিল্পমানের। আমার কাছে তাঁর লেখার মূল্য অপরিসীম।
প্রদোষে প্রাকৃতজন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে অনেকটা কেন্দ্র ছিল গৌড় এবং পু-্রবর্ধন ওই এলাকার পাল রাজা, সেন রাজাদের শাসনামলের কাহিনি। খুব প্রশংসিত হয়েছে উপন্যাসটি। যথেষ্ট পড়াশোনা করেছেন। যদিও আমি মনে করি, উপন্যাসটিতে কিছুটা ঝুঁকে পড়ার ব্যাপার আছে। মানুষ ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়ায় না। একটু বাঁয়ে কাত, একটু ডানে কাত, একটু সামনে ঝুঁকে পড়া। বাঙালি নারী তখন কী গহনা পরতেন, কী পোশাক পরতেন, দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল, এটা কিন্তু রোমান্সও বটে। অসিত্মত্বে ফেরা মানেই রোমান্স। পেছনের রহস্য মাখানো। যার মায়াটি একটি কুহকী, যে কুহকী মায়া আমি কোনোদিন অনুভব করব না। আমার নিজের জীবনেই এমনটা ঘটেছে। ১৭ বছর যে কুহকী মায়াতে আমি পড়েছিলাম রাঢ়ের মাটিতে, কী যে প্রেম আমার সেই মাটির সঙ্গে, এখনো সেই মায়া কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
কাজেই, শওকত আলী প্রদোষে প্রাকৃতজনে যে ফিরে গিয়েছিলেন, তখন খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। খুব সূক্ষ্মভাবে তাঁর একটা ঝুঁকে পড়ার জায়গায় আছে। এই জায়গাটাতেই আমার আপত্তি। আমি মনে করি, যে-কোনো সাহিত্যিকের জন্য ঝুঁকে পড়াটা এজন্যে অন্যায্য, ঝুঁকে পড়লেই তো ওই জায়গাটাতে আমি আর বিচার করছি না। মেনে নিচ্ছি। এতক্ষণ আমি ঝকঝকে চোখে দেখছিলাম, তখন আমার দৃষ্টির চশমাটা পালটে নিয়েছি। তারপরেই আবার শওকত আলী ফিরে গেছেন অন্য উপন্যাস লেখার দিকে। যে-উপন্যাসগুলো অনেকটা তারাশঙ্করীয়। যেমন দলিল, ওয়ারিশ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের এলাকা আমি চিনি, শওকত আলীর মধ্যে কাছাকাছি একটা জিনিস চলে আসে। উপন্যাসের ভালো মন্দ বিচার করা কঠিন। উপন্যাস কতটা ভালো হয়েছে, আমি এখানে বিচার করতে পারব না। আর করলেও মুহূর্তের মধ্যে আর একজন আমার বিপরীত কথা বলতে পারবেন। শওকত আলী কিছু উপন্যাস লিখেছেন যেগুলো বেশ সুখপাঠ্য, উঁচু শিল্পমানের। আমার কাছে তাঁর লেখার মূল্য অপরিসীম।
No comments