অসহায় প্রাণিদের ভালোবেসেই কাটে তার দিন by নওরিন আক্তার
রাজধানীর শেখেরটেকে অবস্থিত ফার্মেসিটি অন্যান্য ফার্মেসি থেকে একেবারেই
আলাদা। কারণ এখানে দোকানের দেখভালকারীদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি
গুরুগম্ভীর বিড়াল! কখনও তারা ওষুধের তাকের মাঝেই ঘুমিয়ে থাকে নিশ্চিন্তে,
কখনওবা মালিকের সঙ্গে একই চেয়ারে বসে তদারকি করে দোকানের। মালিক বুঝি শখ
করে দুয়েকটি বিড়াল পালে, এমনটা ভাবতে ভাবতে ফার্মেসির সঙ্গে লাগানো ঘরের
খোলা মাত্র আপনার মনে হবে এতক্ষণ যা ভেবেছিলেন সবই ভুল। মালিকের ঘরে বিড়াল
থাকে না, বিড়ালদের ঘরেই বুঝি মালিক থাকেন!
ফার্মেসির মালিক রফিকুল ইসলাম ও সাবিনা রহমান দম্পতি ৩৯টি বিড়াল ও ৯টি কুকুর পালেন তাদের নিজেদের বাসায়। এদের মধ্যে মানুষের নির্দয় আঘাতে কেউ হয়তো হারিয়ে ফেলেছে চলনশক্তি। কেউ আবার জন্ম থেকেই ত্রুটি নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তাদের সবারই রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। নাম ধরে ডাকলেই ছুটে আসে পোষা প্রাণীগুলো।
সাবিনার বাবা-মা পুষতেন বিভিন্ন প্রাণী। সেই তালিকায় ছিল বানর ও হরিণের মতো প্রাণিও। বাবা-মায়ের কাছ থেকেই প্রাণিদের ভালোবাসার প্রথম পাঠ পেয়েছিলেন সাবিনা। এরপর সেই ভালোবাসা শুধু বেড়েছেই। ২০১০ সালে যশোর থেকে চলে আসেন ঢাকার শেখেরটেকে। নিজের সংসারে আশ্রয় দিতে থাকেন অসহায় ও অবলা প্রাণিগুলোকে। সেই সংখ্যা দিনের সঙ্গে সঙ্গে শুধু বেড়েছেই। মেয়ে কিংবা মেয়ের বন্ধুরা মানুষের তাড়িয়ে দেওয়া বা রাস্তায় জন্ম নেওয়া অসহায় এসব প্রাণিকে উঠিয়ে আনে, সাবিনা তাদের আশ্রয় দেন নিঃস্বার্থভাবে। একবার টিনের চালা থেকে এক অসহায় বিড়ালছানাকে উদ্ধার করতে গিয়ে পড়ে পিঠের হাড় ভেঙে ফেলেছিলেন সাবিনা। কিন্তু কখনওই তাদের প্রতি ভালোবাসা কমেনি একবিন্দু।
প্রায় আঠারো বছর চাকরি করার পর বছর দেড়েক আগে সাবিনা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন পুরো সময়টুকু দেন আদরের প্রাণিগুলোর দেখভালে। পাশাপাশি ফার্মেসির কাজও সামলান। একমাত্র মেয়ে শ্রেয়সী পড়ছে চিকিৎসাশাস্ত্রে। ছুটিতে বাড়ি আসলে সে সাহায্য করে মাকে।
দেখালেন বড় বড় হাঁড়ি ভর্তি মাছ, ভাত ও মুরগির মাংস-পা। কুকুর-বিড়ালের
সারাদিনের খাবার এগুলো। একদিন পর পর রাস্তায় থাকা এলাকার প্রাণীগুলোকেও
খাওয়ান সাবিনা। জানালেন শুধু মাছ-ভাতের পেছনের মাসে ৩০ হাজার টাকার বেশি
খরচ হয়। এরপর রয়েছে ক্যাট ফুড কেনার খরচ।
প্রতিটি প্রাণিকেই ভ্যাকসিন দেওয়া এবং নিউটার ও স্পে করানো বলে জানালেন সাবিনা। কুকুরগুলো সবই দেশি। বিড়ালগুলোর মধ্যে উপহার হিসেবে পাওয়া দুটি বিদেশি বিড়াল রয়েছে। এদের সবার জন্য রান্না করা, নিয়মিত গোসল করানোর কাজটি স্ত্রী নিজেই করেন বলে জানান রফিকুল ইসলাম।
সাবিনা জানালেন, তার বাবা ছিলেন খুবই সাহসী। আমেরিকায় পড়াশোনা করেছিলেন
সেই আমলে। নিজের বাসায় প্রাণি পালতেন, কাউকে কটাক্ষ করার সুযোগ দিতেন না
একেবারেই। তবে বাবার মতো অতোটা সাহসী হতে পারেননি তিনি। অনেক আত্মীয়-স্বজনই
সাবিনাদের বাসা এড়িয়ে চলে। সুযোগ পেলে কথা শোনাতেও ছাড়েন না তারা। সবচাইতে
বেশি শুনতে হয় প্রাণিদের পালার খরচ নিয়ে। মানুষকে সাহায্যের বদলে কেন
বিড়াল-কুকুরকে খাওয়ানো হচ্ছে- এটা নিয়ে প্রায়ই কটু কথা শুনতে হয় এই
পরিবারকে।
‘যে প্রাণিকে ভালোবাসে না, সে কখনও মানুষকেও ভালোবাসতে পারে না। অবলা
প্রাণিগুলো নিজেদের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারে না। না খেয়ে দিনের পর দিন
পথশিশুদের অত্যাচার সহ্য করে। এসব অসহায় প্রাণিদের নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা
করতে পারলে এক ধরনের প্রশান্তি পাওয়া যায়। মানুষের মতো এরা কখনও
বিশ্বাসঘাতকতা করে না। ভালোবাসার বদলে তারা শুধু ফিরিয়ে দেয় ভালোবাসাই’-
বলেন এই প্রাণিপ্রেমী।
এদের দেখাশোনা করতে গিয়ে আর্থিক অনটনের সঙ্গেও সমঝোতা করতে হয়ে এই পরিবারকে। এখন পর্যন্ত কারোর সহায়তা না নিলেও সাবিনা জানান ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আরেকটু বড় তার। সবার সহযোগিতা নিয়ে এদের জন্য বাসস্থান তৈরি করতে চান তিনি। সেটা বড় পরিসরে, খোলা জায়গা নিয়ে।
No comments