বাবরি মসজিদ রায়: একেই কি বিচার বলে? by সৈয়দা হামিদ
প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈই |
মনে
হয় এইতো কালকের ঘটনা। জামিয়ায় আমার ঘর থেকে দেখলাম মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলা
হলো। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেখলেন রেস কোর্সের ৭ নম্বর বাসা থেকে। ২৭ বছর
পর অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির সর্বসম্মত রায়ে অবসান হলো এই
অধ্যায়ের।
রায় অনুযায়ী ভারতীয় ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি ৩ মাসের মধ্যেই বুঝে পাবে সরকারের তৈরি করে দেওয়া একটি ট্রাস্ট। অয্যোধ্যায় অন্য কোথাও ৫ একর পাবে মুসলিমরা। এটাই কি বিচার? আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখলাম, আদালত বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে অবৈধ বলে বর্ণনা দিয়েছেন। সম্মানিত বিচারকদের কাছে আমার ছোট একটি প্রশ্ন: যদি মসজিদ ভাঙ্গা অবৈধ হয়ে থাকে, তাহলে ২.৭৭ একর জমি কেন সেই পক্ষকেই উপহার দেওয়া হলো যারা এই অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল? এই প্রশ্নের পর আরও কিছু চিন্তা মাথায় আসলো।
এই মামলায় হিন্দু পক্ষ ছিল দু’টি। একটি নির্মোহি আখাড়া ও রাম লালা ভিরাজমান।
এরপর রাম জন্মভূমি ন্যাস নামে আরেক পক্ষ অন্তর্ভুক্ত হলো। এই তৃতীয় পক্ষই এখন বিজয়ী হলো। এটি এখন ট্রাস্টে আধিপত্য ফলাবে? কিংবা ভারত ও বিশ্বজুড়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য আদায় করা বিপুল অর্থও কি তারা পাবে?
ভারতের প্রত্নত্ব বিভাগের প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, মসজিদের নিচে কোনো মন্দির ছিল না। এই প্রতিবেদনের শেষে একটি অংশ ছিল যেখানে কেউ স্বাক্ষর করেনি। এতে বলা হয়, মাটির নিচে যে কাঠামো পাওয়া গেছে, তা ইসলামি ঘরানার নয়। আদালত কি তাহলে স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনের বদলে অস্বাক্ষরিত অংশবিশেষকে আমলে নিয়েছে?
এই রায় কীভাবে প্রতিভাত হবে তা কি ভেবে দেখা হয়েছে? এমনটা কি মনে হচ্ছে না যে, সংখ্যাগুরুকে তুষ্ট করতে সংখ্যাগুরুর ধ্যানধারণার প্রভাবে একটি সংখ্যাগুরুকেন্দ্রিক রায় দেওয়া হলো? এর মাধ্যমে কি একটি নজির সৃষ্টি হয়ে গেলো না? আমাদের ইতিহাস প্রাচীন। কালে কালে পুরোনো শহরের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত হয়েছে নতুন নতুন শহর। এক দিল্লি শহরই ৭ বার ধ্বংস হয়েছে, আবার গড়ে উঠেছে। কাশী? মাথুরা? আরও কত হাজার হাজার ধর্মীয় স্থাপনা আছে এই ভাংচুরের তালিকায়?
এই রায় থেকে কি মুসলমানদের স্বস্তি পাওয়া উচিৎ? নাকি উল্টোটা? এমনটা কি বলা যায় না যে, আদালত যে কাজকে অবৈধ বলে বর্ণনা করেছে, সেই অবৈধ কাজ যারা করেছে তারাই যা চেয়েছে তা পেল?
মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে উদ্ধৃত করে বলতে হয়, যা হওয়ার ছিল, তা হয়ে গেছে। এখন মুসলিম হিসেবে নিজেকে আমি আল্লামা ইকবালের ভাষায় প্রশ্ন করতে চাই: আমাদের এখন কী করা উচিৎ? আমাদের এখন কী করা উচিৎ নয়?
দেশজুড়ে নজিরবিহীন নিরাপত্তা আনা হয়েছে। অনেকটা যেন এমন যে, মুসলিমরা দেশের প্রত্যেক গলি আর মহল্লা থেকে বিক্ষোভ নিয়ে বের হবে। কিংবা হিন্দুরা সব জায়গা থেকে আনন্দ মিছিল নিয়ে বের হবে। এমনটা হওয়ার কথা নয়। ঘটা উচিতও নয়। আমি হিন্দুদের কথা বলতে পারি না, তবে মুসলিমদের কথা বলতে পারি। আমি আমার সহ-ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই, কোনো এজেন্সি নেই, বিক্ষোভের কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। যারা এই ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতিবাদ করতে চায় তাদের জন্য সমস্ত কিছু মিইয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। আমি চাই না রাজপথে নির্দোষদের প্রাণহানি হোক, রক্ত ঝরুক। কারণ, হতদরিদ্রদেরই ক্ষমতাধররা ব্যবহার করে সহিংসতা আর বিভাজনের জন্য।
মুসলিমদের জন্য এখন কেবল একটিই রক্ষাকবচ আছে, যা তারা পেয়েছে পবিত্র কোরআন ও নবী (স.)-এর কাছ থেকে। তাদের উচিৎ স্পষ্ট, দ্বিধাহীন কিন্তু ভদ্রভাবে অয্যোধ্যায় ৫ একর জমির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। এরপর ক্ষমতার লোকদের বলা উচিৎ: ‘আপনারা যেহেতু ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছেন যে, মসজিদ ভাঙ্গা ও মূর্তি রাখার কাজ অবৈধ ছিল, সুতরাং আমাদের বিকল্প একখ- জমি দেবেন না। আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। আপনাদের রায়ের আলোকে আমাদের শুধু একটি নিশ্চয়তা দিন যে, এমনটা আর কখনই হবে না।’
(সৈয়দা হামিদ একজন লেখিকা ও মুসলিম ওমেনস ফোরামের প্রেসিডেন্ট। তার এই নিবন্ধ ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস থেকে নেওয়া হয়েছে।)
রায় অনুযায়ী ভারতীয় ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি ৩ মাসের মধ্যেই বুঝে পাবে সরকারের তৈরি করে দেওয়া একটি ট্রাস্ট। অয্যোধ্যায় অন্য কোথাও ৫ একর পাবে মুসলিমরা। এটাই কি বিচার? আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখলাম, আদালত বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে অবৈধ বলে বর্ণনা দিয়েছেন। সম্মানিত বিচারকদের কাছে আমার ছোট একটি প্রশ্ন: যদি মসজিদ ভাঙ্গা অবৈধ হয়ে থাকে, তাহলে ২.৭৭ একর জমি কেন সেই পক্ষকেই উপহার দেওয়া হলো যারা এই অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল? এই প্রশ্নের পর আরও কিছু চিন্তা মাথায় আসলো।
এই মামলায় হিন্দু পক্ষ ছিল দু’টি। একটি নির্মোহি আখাড়া ও রাম লালা ভিরাজমান।
এরপর রাম জন্মভূমি ন্যাস নামে আরেক পক্ষ অন্তর্ভুক্ত হলো। এই তৃতীয় পক্ষই এখন বিজয়ী হলো। এটি এখন ট্রাস্টে আধিপত্য ফলাবে? কিংবা ভারত ও বিশ্বজুড়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য আদায় করা বিপুল অর্থও কি তারা পাবে?
ভারতের প্রত্নত্ব বিভাগের প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, মসজিদের নিচে কোনো মন্দির ছিল না। এই প্রতিবেদনের শেষে একটি অংশ ছিল যেখানে কেউ স্বাক্ষর করেনি। এতে বলা হয়, মাটির নিচে যে কাঠামো পাওয়া গেছে, তা ইসলামি ঘরানার নয়। আদালত কি তাহলে স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনের বদলে অস্বাক্ষরিত অংশবিশেষকে আমলে নিয়েছে?
এই রায় কীভাবে প্রতিভাত হবে তা কি ভেবে দেখা হয়েছে? এমনটা কি মনে হচ্ছে না যে, সংখ্যাগুরুকে তুষ্ট করতে সংখ্যাগুরুর ধ্যানধারণার প্রভাবে একটি সংখ্যাগুরুকেন্দ্রিক রায় দেওয়া হলো? এর মাধ্যমে কি একটি নজির সৃষ্টি হয়ে গেলো না? আমাদের ইতিহাস প্রাচীন। কালে কালে পুরোনো শহরের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত হয়েছে নতুন নতুন শহর। এক দিল্লি শহরই ৭ বার ধ্বংস হয়েছে, আবার গড়ে উঠেছে। কাশী? মাথুরা? আরও কত হাজার হাজার ধর্মীয় স্থাপনা আছে এই ভাংচুরের তালিকায়?
এই রায় থেকে কি মুসলমানদের স্বস্তি পাওয়া উচিৎ? নাকি উল্টোটা? এমনটা কি বলা যায় না যে, আদালত যে কাজকে অবৈধ বলে বর্ণনা করেছে, সেই অবৈধ কাজ যারা করেছে তারাই যা চেয়েছে তা পেল?
মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে উদ্ধৃত করে বলতে হয়, যা হওয়ার ছিল, তা হয়ে গেছে। এখন মুসলিম হিসেবে নিজেকে আমি আল্লামা ইকবালের ভাষায় প্রশ্ন করতে চাই: আমাদের এখন কী করা উচিৎ? আমাদের এখন কী করা উচিৎ নয়?
দেশজুড়ে নজিরবিহীন নিরাপত্তা আনা হয়েছে। অনেকটা যেন এমন যে, মুসলিমরা দেশের প্রত্যেক গলি আর মহল্লা থেকে বিক্ষোভ নিয়ে বের হবে। কিংবা হিন্দুরা সব জায়গা থেকে আনন্দ মিছিল নিয়ে বের হবে। এমনটা হওয়ার কথা নয়। ঘটা উচিতও নয়। আমি হিন্দুদের কথা বলতে পারি না, তবে মুসলিমদের কথা বলতে পারি। আমি আমার সহ-ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই, কোনো এজেন্সি নেই, বিক্ষোভের কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। যারা এই ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতিবাদ করতে চায় তাদের জন্য সমস্ত কিছু মিইয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। আমি চাই না রাজপথে নির্দোষদের প্রাণহানি হোক, রক্ত ঝরুক। কারণ, হতদরিদ্রদেরই ক্ষমতাধররা ব্যবহার করে সহিংসতা আর বিভাজনের জন্য।
মুসলিমদের জন্য এখন কেবল একটিই রক্ষাকবচ আছে, যা তারা পেয়েছে পবিত্র কোরআন ও নবী (স.)-এর কাছ থেকে। তাদের উচিৎ স্পষ্ট, দ্বিধাহীন কিন্তু ভদ্রভাবে অয্যোধ্যায় ৫ একর জমির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। এরপর ক্ষমতার লোকদের বলা উচিৎ: ‘আপনারা যেহেতু ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছেন যে, মসজিদ ভাঙ্গা ও মূর্তি রাখার কাজ অবৈধ ছিল, সুতরাং আমাদের বিকল্প একখ- জমি দেবেন না। আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। আপনাদের রায়ের আলোকে আমাদের শুধু একটি নিশ্চয়তা দিন যে, এমনটা আর কখনই হবে না।’
(সৈয়দা হামিদ একজন লেখিকা ও মুসলিম ওমেনস ফোরামের প্রেসিডেন্ট। তার এই নিবন্ধ ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস থেকে নেওয়া হয়েছে।)
No comments