যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে বিজয়ী হচ্ছে বাংলাদেশ? by অনু আনোয়ার
যুক্তরাষ্ট্র
ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে, প্রশান্ত
মহাসাগরের উভয়পাড়ে এবং অন্য যেকোনো স্থানের বিজ্ঞজনরা হিসাব কষা শুরু
করেছেন। তারা হিসাব কষছেন- প্রকৃত বিজয়ী কে হবে? প্রকৃতপক্ষে, চীন বা
যুক্তরাষ্ট্র কেউই বিজয়ী হবে না। বিজয়ী হবে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও চিলির মতো
দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যবিরোধের
ব্যাপকতা থেকে সুবিধা পাবে এসব দেশ। বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে সরবরাহ চেইনে যে
প্রভাব পড়বে সহসাই এসব দেশে তা হবে গতিশীল এবং বিনিয়োগের ধরন এসব দেশকে এই
সংঘাতের বড় বিজয়ী হিসেবে উঠে আসতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘদিন
ধরে টেকসই বাণিজ্যিক অংশীদার হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের সঙ্গেই
বাণিজ্যের আয়তন ও পরিমাণ যথেষ্ট উল্লেখ করার মতো। তবে দুই দেশের সঙ্গে
বাণিজ্যের ধরন আলাদা আলাদা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ হলো চীন। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১৫০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশি পণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিবাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৫৮০ কোটিরও বেশি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর জার্মানি ছিল সবচেয়ে বড় রপ্তানিবাজার। সেখানে রপ্তানি হয়েছে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়াসুয়িকি সাওয়াদার যুক্তি, বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের সামনে অতিরিক্ত ৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশে থেকে মোট যে পরিমাণ অর্থের রপ্তানি হয় তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ হলো গার্মেন্ট। বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে এই খাতটি সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা ক্রেতারা অধিক হারে কাজের অর্ডার দিচ্ছেন বাংলাদেশকে। চীনে প্রস্তুতকৃত পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কহার আরোপ করার জন্য তারা এক্ষেত্রে বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের মতে, ২০১৮ সালের প্রথম তিন কোয়ার্টারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৬.৪৬ ভাগ।
২০১২ সালে ম্যাকিনসে’র একটি রিপোর্টে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে, চীন থেকে তৈরি পোশাক আমদানি কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এক্ষেত্রে একটি হটস্পট এবং ২০২০ সাল নাগাদ এর বাজার তিনগুণ হয়ে উঠবে। ২০১০ সালে এই বাজার ছিল ১৫০০ কোটি ডলারের। তা থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে বাজার। এমনকি এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল চীনের শ্রমনির্ভর শিল্প থেকে উচ্চমূল্যের পণ্যে, হাইটেক, পুঁজিনির্ভর কারখানা খাতে। বলা হয়েছিল, এসব খাত আস্তে আস্তে অবনতির দিকে যাবে। এখন দৃশ্যত বাণিজ্য যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়ে ওঠার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে।
উচ্চ মাত্রার শুল্ক এড়ানোর জন্য চীন থেকে কারখানাগুলো এশিয়ার অন্যান্য স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগীদের তুলনায় প্রতিযোগিতায় অধিক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
কম্বোডিয়ায় রয়েছে শক্তিশালী শ্রম ইউনিয়ন। এর ফলে সেখানে কারখানা স্থাপন করা অধিকতর চ্যালেঞ্জিং। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে রয়েছে ১৬ কোটি মানুষ। আর কম্বোডিয়ার জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি ৬০ লাখ। ফলে এত মানুষ বেশি থাকায় কম্বোডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ বেশি শ্রমনির্ভর শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতার সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। উচ্চ বেতন ও উৎপাদন খরচ বেশি পড়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ভিয়েতনাম। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিমাসে সর্বনিম্ন বেতন হলো ৯৫ ডলার, যা কম্বোডিয়ায় প্রতি মাসে বেতন ১৮২ ডলারের অর্ধেক। হ্যানয় এবং হো চি মিন সিটিতে প্রতি মাসে এই বেতন ১৮০ ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়েও সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ। ইউএস ফার্ম ব্যুুরোর মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সয়াবিনের ওপর চীন শুল্কহার বাড়িয়েছে। ফলে এই বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে সয়াবিন রপ্তানি কমে গেছে শতকরা ৯৭ ভাগ। একই সময়ে, বাংলাদেশ আমদানি করে ২০ লাখ টন অশোধিত ভেজিটেবল অয়েল। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ বা ৬ লাখ টন হলো সয়াবিন। এই সয়াবিনের শতকরা ৯৮ ভাগ আসে আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিল থেকে। যদি লাতিন আমেরিকার এসব দেশ থেকে বাংলাদেশ তার সরবরাহ লাইন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করতে পারে, তাহলে কমমূলে ক্রেতাদের কাছে তেল সরবরাহ দেয়া সহজ হবে বাংলাদেশের জন্য। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে লভ্যাংশ হারাতে হবে না।
উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। এখানে উদ্বৃত্ত বাণিজ্য ৪০০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শখের ঘোড়া ছুটছে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দেশগুলোর দিকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করে বাংলাদেশ দুই দিকেই সুবিধা পেতে পারে। তা হলো, তারা সস্তায় পণ্য পাবে এবং তাতে কমে আসবে বাণিজ্য ঘাটতি। পাশাপাশি এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে অবদান রাখবে। উপরন্তু বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ওপর শতকরা ১৫.২ ভাগ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে। চীনের সঙ্গে সৃষ্ট গ্যাপ বা ফারাক সর্বনিম্ন অবস্থায় নামিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব দেশ থেকে আমদানি বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে এই অবস্থা অনেকটা শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইস্পাত শিল্পের বড় চাহিদা পূরণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা স্ক্র্যাপ লোহা ও দেশের ভেতর জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। ২০১৮ সালের মার্চে সব রকম ইস্পাত আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য, অবনতিশীল ইস্পাত শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা। এই উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্র্যাপ আয়রন সরবরাহকারীরা তাদের মজুত গড়ে তুলছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে বহু অবকাঠামো বিষয়ক প্রকল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রডের দাম বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
বিশ্বে যে পরিমাণ জাহাজ ভাঙা হয়েছে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ তার মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ ভেঙেছে। ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন প্রকল্পের আলোকে, বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা শিল্পের উন্নয়নে একটি শিল্পনীতি গ্রহণ করতে পারে এবং আশা করতে পারে দেশের ভেতর থেকেই সস্তায় বৃহৎ আকারে ইস্পাতের কাঁচামাল পেতে পারে, যা এরই মধ্যে দেশের ইস্পাত চাহিদার অর্ধেকের বেশি সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, চীনের মুদ্রা ইয়েনের দর পতনের আশঙ্কায় চীনের নীতিনির্ধারকরা পুঁজির প্রবাহকে কঠোর করার পথ খুঁজছেন যদিও, তথাপি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ক্রমবর্ধমান হারে যুক্ত হচ্ছে চীন। এর অর্থ, সীমাবদ্ধতা বা কড়াকড়ি কার্যকর হবে না। অধিকন্তু, যেমনটা পূর্বাভাস করা হয়েছিল তার চেয়ে চীন থেকে অনেক বেশি সরাসরি বিনিয়োগ পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে কারখানা স্থানান্তর, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে তা ঘটছে।
এ ছাড়া বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি সদস্য বাংলাদেশ। তাই বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে চীন যেসব খাতে আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেই সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা চীনের কাছে অধিক অর্থপূর্ণ। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ২৭টি বিনিয়োগ ও ঋণ সংক্রান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে বেইজিংয়ের সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছে। এর পরিমাণ ২৪০০ কোটি ডলার। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেন তখন এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার ওই সফরের পর চীন থেকে বাংলাদেশে নেট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র অবমুক্ত হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার থেকে তা বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫০ কোটি ৬০ লাখ ডলার দাঁড়ায়।
এই সবকিছু এক সূত্রে মিলিয়ে, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। তবে এই সুবিধা বাংলাদেশ ঘরে তুলতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে কতগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। এগুলো হলো- বাংলাদেশ অবনতিশীল অবকাঠামো নিয়ে লড়াই। এখানে রয়েছে আইনের শাসনের দুর্বল অবস্থা এবং দুর্বল বাণিজ্যিক পরিবেশ। চীনের কাছ থেকে অতিমাত্রায় ও বেপরোয়াভাবে ঋণ নেয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক। তারা আশঙ্কা করেছেন, এতে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণের ফাঁদে আটকা পড়তে পারে।
তাই এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে আসন্ন নতুন সুবিধাকে লুফে নিতে অনুকূল নীতি বিষয়ে বাংলাদেশের কাজ করা অত্যন্ত জরুরি এবং তার মধ্য দিয়ে অধিক বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ দিতে হবে। এক্ষেত্রে এড়িয়ে চলতে হবে অনিচ্ছাকৃত ঝুঁকি ও পরিণতি।
(লেখক: ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের অ্যাফিলিয়েট স্কলার এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে প্যাসিফিক ফোরাম ইয়াং লিডারস প্রোগ্রামের একজন ফেলো। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে)
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ হলো চীন। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১৫০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশি পণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিবাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৫৮০ কোটিরও বেশি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর জার্মানি ছিল সবচেয়ে বড় রপ্তানিবাজার। সেখানে রপ্তানি হয়েছে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়াসুয়িকি সাওয়াদার যুক্তি, বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের সামনে অতিরিক্ত ৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশে থেকে মোট যে পরিমাণ অর্থের রপ্তানি হয় তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ হলো গার্মেন্ট। বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে এই খাতটি সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা ক্রেতারা অধিক হারে কাজের অর্ডার দিচ্ছেন বাংলাদেশকে। চীনে প্রস্তুতকৃত পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কহার আরোপ করার জন্য তারা এক্ষেত্রে বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের মতে, ২০১৮ সালের প্রথম তিন কোয়ার্টারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৬.৪৬ ভাগ।
২০১২ সালে ম্যাকিনসে’র একটি রিপোর্টে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে, চীন থেকে তৈরি পোশাক আমদানি কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এক্ষেত্রে একটি হটস্পট এবং ২০২০ সাল নাগাদ এর বাজার তিনগুণ হয়ে উঠবে। ২০১০ সালে এই বাজার ছিল ১৫০০ কোটি ডলারের। তা থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে বাজার। এমনকি এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল চীনের শ্রমনির্ভর শিল্প থেকে উচ্চমূল্যের পণ্যে, হাইটেক, পুঁজিনির্ভর কারখানা খাতে। বলা হয়েছিল, এসব খাত আস্তে আস্তে অবনতির দিকে যাবে। এখন দৃশ্যত বাণিজ্য যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়ে ওঠার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে।
উচ্চ মাত্রার শুল্ক এড়ানোর জন্য চীন থেকে কারখানাগুলো এশিয়ার অন্যান্য স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগীদের তুলনায় প্রতিযোগিতায় অধিক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
কম্বোডিয়ায় রয়েছে শক্তিশালী শ্রম ইউনিয়ন। এর ফলে সেখানে কারখানা স্থাপন করা অধিকতর চ্যালেঞ্জিং। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে রয়েছে ১৬ কোটি মানুষ। আর কম্বোডিয়ার জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি ৬০ লাখ। ফলে এত মানুষ বেশি থাকায় কম্বোডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ বেশি শ্রমনির্ভর শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতার সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। উচ্চ বেতন ও উৎপাদন খরচ বেশি পড়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ভিয়েতনাম। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিমাসে সর্বনিম্ন বেতন হলো ৯৫ ডলার, যা কম্বোডিয়ায় প্রতি মাসে বেতন ১৮২ ডলারের অর্ধেক। হ্যানয় এবং হো চি মিন সিটিতে প্রতি মাসে এই বেতন ১৮০ ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়েও সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ। ইউএস ফার্ম ব্যুুরোর মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সয়াবিনের ওপর চীন শুল্কহার বাড়িয়েছে। ফলে এই বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে সয়াবিন রপ্তানি কমে গেছে শতকরা ৯৭ ভাগ। একই সময়ে, বাংলাদেশ আমদানি করে ২০ লাখ টন অশোধিত ভেজিটেবল অয়েল। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ বা ৬ লাখ টন হলো সয়াবিন। এই সয়াবিনের শতকরা ৯৮ ভাগ আসে আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিল থেকে। যদি লাতিন আমেরিকার এসব দেশ থেকে বাংলাদেশ তার সরবরাহ লাইন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করতে পারে, তাহলে কমমূলে ক্রেতাদের কাছে তেল সরবরাহ দেয়া সহজ হবে বাংলাদেশের জন্য। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে লভ্যাংশ হারাতে হবে না।
উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। এখানে উদ্বৃত্ত বাণিজ্য ৪০০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শখের ঘোড়া ছুটছে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দেশগুলোর দিকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করে বাংলাদেশ দুই দিকেই সুবিধা পেতে পারে। তা হলো, তারা সস্তায় পণ্য পাবে এবং তাতে কমে আসবে বাণিজ্য ঘাটতি। পাশাপাশি এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে অবদান রাখবে। উপরন্তু বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ওপর শতকরা ১৫.২ ভাগ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে। চীনের সঙ্গে সৃষ্ট গ্যাপ বা ফারাক সর্বনিম্ন অবস্থায় নামিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব দেশ থেকে আমদানি বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে এই অবস্থা অনেকটা শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইস্পাত শিল্পের বড় চাহিদা পূরণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা স্ক্র্যাপ লোহা ও দেশের ভেতর জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। ২০১৮ সালের মার্চে সব রকম ইস্পাত আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য, অবনতিশীল ইস্পাত শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা। এই উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্র্যাপ আয়রন সরবরাহকারীরা তাদের মজুত গড়ে তুলছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে বহু অবকাঠামো বিষয়ক প্রকল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রডের দাম বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
বিশ্বে যে পরিমাণ জাহাজ ভাঙা হয়েছে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ তার মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ ভেঙেছে। ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন প্রকল্পের আলোকে, বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা শিল্পের উন্নয়নে একটি শিল্পনীতি গ্রহণ করতে পারে এবং আশা করতে পারে দেশের ভেতর থেকেই সস্তায় বৃহৎ আকারে ইস্পাতের কাঁচামাল পেতে পারে, যা এরই মধ্যে দেশের ইস্পাত চাহিদার অর্ধেকের বেশি সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, চীনের মুদ্রা ইয়েনের দর পতনের আশঙ্কায় চীনের নীতিনির্ধারকরা পুঁজির প্রবাহকে কঠোর করার পথ খুঁজছেন যদিও, তথাপি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ক্রমবর্ধমান হারে যুক্ত হচ্ছে চীন। এর অর্থ, সীমাবদ্ধতা বা কড়াকড়ি কার্যকর হবে না। অধিকন্তু, যেমনটা পূর্বাভাস করা হয়েছিল তার চেয়ে চীন থেকে অনেক বেশি সরাসরি বিনিয়োগ পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে কারখানা স্থানান্তর, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে তা ঘটছে।
এ ছাড়া বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি সদস্য বাংলাদেশ। তাই বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে চীন যেসব খাতে আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেই সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা চীনের কাছে অধিক অর্থপূর্ণ। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ২৭টি বিনিয়োগ ও ঋণ সংক্রান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে বেইজিংয়ের সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছে। এর পরিমাণ ২৪০০ কোটি ডলার। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেন তখন এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার ওই সফরের পর চীন থেকে বাংলাদেশে নেট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র অবমুক্ত হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার থেকে তা বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫০ কোটি ৬০ লাখ ডলার দাঁড়ায়।
এই সবকিছু এক সূত্রে মিলিয়ে, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। তবে এই সুবিধা বাংলাদেশ ঘরে তুলতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে কতগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। এগুলো হলো- বাংলাদেশ অবনতিশীল অবকাঠামো নিয়ে লড়াই। এখানে রয়েছে আইনের শাসনের দুর্বল অবস্থা এবং দুর্বল বাণিজ্যিক পরিবেশ। চীনের কাছ থেকে অতিমাত্রায় ও বেপরোয়াভাবে ঋণ নেয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক। তারা আশঙ্কা করেছেন, এতে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণের ফাঁদে আটকা পড়তে পারে।
তাই এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে আসন্ন নতুন সুবিধাকে লুফে নিতে অনুকূল নীতি বিষয়ে বাংলাদেশের কাজ করা অত্যন্ত জরুরি এবং তার মধ্য দিয়ে অধিক বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ দিতে হবে। এক্ষেত্রে এড়িয়ে চলতে হবে অনিচ্ছাকৃত ঝুঁকি ও পরিণতি।
(লেখক: ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের অ্যাফিলিয়েট স্কলার এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে প্যাসিফিক ফোরাম ইয়াং লিডারস প্রোগ্রামের একজন ফেলো। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে)
No comments