বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলার রফতানি, কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ভারতের শিল্প মহলে by শুভজ্যোতি ঘোষ
এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে ভারতে বার্ষিক রফতানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।
ভারত
সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে
বাংলাদেশ থেকে ভারত ১০৪ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, যা
একটি রেকর্ড।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটিকে একটি
গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে মনে করা হলেও ভারতের বিশেষত গার্মেন্ট শিল্প এই
প্রবণতায় খুবই উদ্বিগ্ন।
বিপুল রফতানি বৃদ্ধির পেছনে কৃতিত্ব মূলত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতেরই |
বাংলাদেশ থেকে রফতানিতে রাশ টানার জন্য তারা সরকারের কাছে জোরালো দরবার করছেন।
কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রফতানি সে দেশে কেন আর কী ধরনের 'ব্যাকল্যাশ' তৈরি করছে?
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আছে দুনিয়ার প্রায় ৬৭টি এলডিসি বা
স্বল্পোন্নত দেশের, তার মধ্যে অ্যাঙ্গোলা বা মোজাম্বিক ছাড়া কখনও কোনও দেশ
থেকে বার্ষিক রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি।
বাংলাদেশ সেই বিরল তালিকায় ঢুকে পড়েছে মূলত তৈরি পোশাক রফতানিতে ভর করেই, গত অর্থ বছরে যার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮২ শতাংশ।
উদ্বিগ্ন ভারতীয় গার্মেন্ট নির্মাতারা এখন বাংলাদেশী পণ্যের ডিউটি-ফ্রি অ্যাক্সেস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
যদিও
দিল্লির গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইকরিয়েরে'র (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ
অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস) অধ্যাপক অর্পিতা মুখার্জি বলছেন, শুধু
শুল্কে ছাড় পাওয়াটাই বাংলাদেশের একমাত্র অ্যাডভান্টেজ নয়।
দক্ষিণ ভারতের তিরুপুরে ভারতের একটি গার্মেন্ট কারখানা |
তিনি
বিবিসিকে বলছিলেন, "গার্মেন্ট খাতে ভারত কিন্তু আর বাংলাদেশের সঙ্গে
প্রতিযোগিতার জায়গাতেই নেই। থ্রিডি প্রিন্টারে ডিজাইনিং থেকে শুরু করে
নানা প্রযুক্তিতে তারা ওখানে প্রচুর বিনিয়োগও করেছে, তার সুফলও পাচ্ছে।"
"একটা তুলনামূলকভাবে ধনী দেশ হয়েও আপনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, আর বলবেন বাংলাদেশের রফতানি কীভাবে বাড়ছে - তা তো হয় না।"
"আমাদের
শ্রমশক্তিও আর শস্তা থাকছে না। বাংলাদেশ এসিইজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের
ফায়দা তুলছে, ওদিকে আমাদের এসিইজেড-কে আমেরিকা চ্যালেঞ্জ করে বসে আছে!"
"সুতরাং
আমাদের কোনও পলিসিরই ঠিকঠাক নেই। ফলে দোষটা তো পলিসির, বাংলাদেশের
এক্সপোর্টের তো আর দোষ হতে পারে না", বলছেন ড: মুখার্জি।
প্রেমাল উদানি ভারতের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্ট শিল্পপতি, অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
ভারতে বাংলাদেশ থেকে রফতানির পরিসংখ্যান |
বিবিসিকে তিনি আবার বলছিলেন, "বাংলাদেশ থেকে ভারতে তৈরি পোশাক রফতানি এখন খুব তীব্র গতিতে বাড়ছে - বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ হারে।"
"কিন্তু আমাদের মূল অভিযোগ হল, সার্টিফিকেট অব অরিজেনের নিয়মকানুন কিন্তু বাংলাদেশ মানছে না!"
"মানে চীন বা অন্য কোনও জায়গা থেকে ফেব্রিক কিনে নিজের দেশে সেলাই করে সেটাই তারা ভারতে ডিউটি-ফ্রি রফতানি করছে।"
"বাজার এগুলোতে ছেয়ে যাচ্ছে, জিনস-বেসিক শার্ট-বা চিনো প্যান্টের মতো কোর প্রোডাক্টে দেশী নির্মাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ন।"
"আমাদের
বক্তব্য হল, বাংলাদেশকে শুল্ক ছাড় দেওয়ার নামে আমরা তো চীনা পণ্যকে
পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে দিতে পারি না - একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো থাকা
উচিত", বলছেন মি উদানি।
প্রেমাল উদানি কেটি কর্পোরেশন নামে যে অ্যাপারেল সংস্থার মালিক, তাদের মূল কারখানা তামিলনাডুর তিরুপুরে।
তামিলনাডুর ওই শহরকে ঘিরে অজস্র গার্মেন্ট কারখানা আছে, এই শিল্পমালিকদের সংগঠনও খুব শক্তিশালী।
বাংলাদেশ থেকে যেসব তৈরি পোশাক ভারতে আসছে, বাজারে সেগুলোর সরাসরি প্রতিযোগিতা এই শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গেই।
বাংলাদেশে তৈরি জিনস ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলছে বলে ভারতীয় শিল্প মালিকদের বক্তব্য |
দিল্লির
থিঙ্কট্যাঙ্ক রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন সিস্টেমে অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে
কিন্তু মনে করছেন, ভারতের গার্মেন্ট শিল্পে শক্তিশালী দক্ষিণ ভারতীয় লবি
চাইলেও বাংলাদেশী পণ্যে নতুন করে শুল্ক বসানো সম্ভবই নয়।
তার কথায়,
"ভারতে আনব্র্যান্ডেড গার্মেন্টের মূল হাবটাই হল এই তিরুপুর। কিন্তু তারা
এখন বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছে না।"
"এখন তিরুপুর লবি বাংলাদেশের ডিউটি ফ্রি অ্যাকসেস বন্ধ করতে চাইলেও সেটা
তো করা যাবে না। অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে ওরা আমাদের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব
আরবিট্রেশনেও টেনে নিয়ে যেতে পারে।"
"ভারতীয়রা যেটা করতে পারেন তা
হল নিজেদের প্রোডাক্টে আরও ভ্যালু অ্যডিশন করে সেটাকে আরও আকর্ষণীয় করে
তুলতে পারেন, কম্পিটিটিভিনেস বাড়াতে পারেন কিংবা প্রোডাকশনের খরচ কমাতে
পারেন।"
"পাশাপাশি নতুন একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছে, বেশ কিছু ভারতীয়
টেক্সটাইল সংস্থা আফ্রিকাতে গিয়েও কারখানা গড়ছেন। আফ্রিকাতে ওয়েজ
আরবিট্রেজের (কম পারিশ্রমিক) সুবিধা নিয়ে উৎপাদন করে সেটাই আবার ভারতে
রফতানি করছেন।"
ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল |
"একইভাবে ভারতের কোম্পানি অরবিন্দ মিলস বাংলাদেশে গিয়ে কারখানা তৈরি করে ওখান থেকে ব্যবসা করছেন", জানাচ্ছেন ড: দে।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে হলে এগুলোই এখন ভারতীয় শিল্পপতিদের জন্য একমাত্র রাস্তা বলে মনে করছেন তিনি।
অধ্যাপক অর্পিতা মুখার্জিও তার সঙ্গে একমত -ডিউটি-ফ্রি অ্যাকসেসের সুবিধা ভারত নানা কারণে প্রত্যাহার করতে পারবে না।
অর্থনীতিবিদ ড: প্রবীর দে |
তিনি
বলছিলেন, "ডিউটি বাড়িয়ে ইমপোর্ট বন্ধ করা যায় না। সাময়িকভাবে গেলেও
পাকাপাকিভাবে যায় না। বিদেশি মোবাইল ফোনে বিপুল ডিউটি বসিয়েও ভারতে
কিন্তু মোবাইল ফোনের বিক্রিবাটা কমানো যায়নি।"
"আসলে সমস্যাটা
আমাদের নিজস্ব - আমাদের ইন্ডাস্ট্রি খুব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
এখন কি বাংলাদেশের ওপর ডিউটি বসিয়ে আর চীনকে জিরো ডিউটি দিয়ে আমাদের
সমস্যার কোনও সমাধান হবে?
"বাংলাদেশ আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী। দক্ষিণ
এশিয়ায় যে ভারত নিজেকে নেতার ভূমিকায় দেখতে চায় সত্যিই কি তারা সেখানে
বাংলাদেশকে ট্যাক্স করতে পারবে?", প্রশ্ন ড: মুখার্জির।
ফলে অদূর
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রফতানি, বিশেষ করে গার্মেন্ট, আরও বাড়বে এটা ধরে
নিয়েই ভারতীয় নির্মাতাদের নিজেদের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করতে হবে বলে
বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
আর সেখানে সম্ভবত ভারত সরকারের বিশেষ কিছু করণীয়ও নেই।
অরবিন্দ মিলসের কর্ণধার সঞ্জয় লালভাই, যিনি বাংলাদেশে কারখানা চালু করেছেন |
No comments