বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের আদৌ কতোটা সেবা দেয় by সানজানা চৌধুরী
ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভেতরে
এক ব্যক্তিকে মারধর করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার
ঘটনায় বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাদের প্রবাসীদের
প্রতি আচরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
মধ্যপ্রাচ্যসহ যেসব দেশে
বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করতে যান তাদের বেশিরভাগেরই অভিযোগ থাকে যে, তারা
সেখানকার দূতাবাস থেকে ন্যূনতম সহায়তাটুকু পান না।
"যে কাজ একবারে করা যায়, ওইটা ঘুরায় ঘুরায় করবে"
পাঁচ মাস আগে সৌদি আরবে কাজ করতে গেলেও দেশটির আবহাওয়া এবং কাজের চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না রানী দাস।
নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসা এক প্রবাসী নারী শ্রমিক |
এমন অবস্থায় তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইলেও দূতাবাস থেকে তাকে কোন ধরণের সহায়তা করা হয়নি।
তার মতো এমন ছয়জন নারীকে এখন ভিক্ষাবৃত্তি করে খেতে হচ্ছে বলে জানান রানী দাস।
দেশে
ফিরতে পারলেও কাজের পুরো পারিশ্রমিক ছাড়াই ফিরতে হয়েছে দিনাজপুরের
মোর্শেদা বেগমকে। প্রায় দেড় বছর সৌদি আরবে কাজ করলেও বেতনের মাত্র অর্ধেক
তুলতে পেরেছেন তিনি।
"অ্যাম্বাসিওয়ালা মনে করেন জেলখানা থেকেও বেশি
কষ্ট দেয়। যে কাজ একবারে করা যায়, ওইটা ঘুরায় ঘুরায় করবে। আমাদের টাকা
কেমনে পাব, কোন খোঁজ নেয়না, আমরা কী খাই, কেমনে আছি। বাংলাদেশে তো কল করা
যায়না। আমি বাঁইচা আছি না মারা গেছি এইটা বাংলাদেশের কেউ জানেনাই
এতদিন।"- বলেন মোর্শেদা বেগম।
দূতাবাসের ভেতরে মারধর
ব্রুনেই
দূতাবাসে নির্যাতনের সর্বশেষ যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে দেখা যায়,
এক প্রবাসী ব্যক্তিকে দূতাবাস কর্মকর্তার সামনেই একে একে কয়েকজন মারধর
করছে।
মারধরের শিকার ওই ব্যক্তি একজন দালাল এবং তাকে ক্ষুব্ধ
শ্রমিকরাই পেটাচ্ছিলেন বলে দাবি করেছেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি জিলাল
হোসেইন।
প্রবাসে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হন। |
ব্রুনেই লেবর উইং-এর ফেসবুক পেইজেও দেখা যায় বাংলাদেশের
শ্রমিকদের কাজ দেয়ার নামে যে দালাল চক্র বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়
তাদেরই এক সদস্যের প্রতি উদ্ধত হয়েছিল শ্রমিকরা।
কিন্তু প্রশ্ন রাখা হয় একটি দূতাবাসের ভেতরে এ ধরণের ঘটনাকে প্রশ্রয় দেয়া হল কেন।
এ ব্যাপারে মি. হোসেইন জানান, দূতাবাসে এ ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা তারাও প্রত্যাশা করেন না।
"ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। যেটুকু জানি যে, আমাদের কোন কর্মকর্তা কারও
গায়ে হাত তোলেনি। যারা পিটিয়েছে তারা হল ক্ষুব্ধ শ্রমিক। কারণ তারা এই
দালালদের মাধ্যমে এসেও দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে কোন কাজ পাচ্ছেনা।"
ব্রুনেই সরকারকে এই দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেও কোন ফল যায়নি বলে তিনি জানান।
মধ্যপ্রাচ্যে নির্মাণ শ্রমিকদের একটি বড় অংশই বাংলাদেশি। |
"আমরা
এই শ্রমিকদের মতোই হেল্পলেস। আমাদের এখানে ম্যাজিটেরিয়াল পাওয়ার আছে,
পুলিশি পাওয়ার নেই। আমরা শুধু এই দেশের সরকারকে রেফার করতে পারবো।
দালালদের চিহ্নিত করে দিতে পারবো। অনেক সুপারিশও করেছি। কিন্তু তারা কোন
ব্যবস্থা নেয়নি।"
কী বলছে সরকার?
ব্রুনেইয়ের এই
ঘটনাটিকে নজরে এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা গতকাল গণমাধ্যমকে
জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেন।
বিষয়টি নিয়ে
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করা হবে বলেও বিবিসি বাংলাকে জানান
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফারুক খান ।
শ্রমিকরা দূতাবাসে যে নিগ্রহের শিকার হন সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বৈঠকে আলোচনা করার কথাও জানান তিনি।
যেখানে দূতাবাসের কাজ প্রবাসীদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় সেবা দেয়া, সেখানে তাদের কার্যক্রম এবং আচার আচরণ কতোটা নজরদারি করা হয়।
এ
বিষয়ে মি. খান বলেন, "বাংলাদেশের দূতাবাসে যে সরকারি কর্মকর্তারা কাজ
করেন, তারা যেই মন্ত্রণালয়েরই হোক না কেন, প্রবাসীদের যথাযথ সাহায্য করাই
তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। কেউ যদি এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকে। তাহলে অবশ্যই এর
তদন্ত হবে এবং প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী শ্রমিক। |
প্রতিটি
দূতাবাসের সেবা আরও জোরদার করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া
হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে আধুনিক
প্রযুক্তির সহায়তায় প্রবাসীদের দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
দূতাবাসগুলোয় সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা কেন
দূতাবাসে
জনবল নিয়োগে যে মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব
সেইসঙ্গে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে
যথাযথ সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির।
এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে নজর দেয়ার কথা জানান তিনি।
প্রথমত, যে মন্ত্রণালয়গুলো এই দূতাবাসগুলোয় লোক পাঠায়, ঢাকায় তাদের মধ্যে একটা সমন্বয় করা।
বাংলাদেশে এই সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, যারা দূতাবাসে কাজ করতে যাবেন, তাদের জন্য যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
যেন তারা নতুন দেশের, নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও কাজের ধরণের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
প্রবাসে শ্রমিকদের মানবেতন জীবন যাপন। |
যারা
এই প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হবেন, শুধুমাত্র তাদেরকেই মিশনে পাঠানোর পরামর্শ
দেন তিনি। না হলে এ ধরণের অবাঞ্ছিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলে তিনি আশঙ্কা
করেন।
ব্রুনেইতে যে ঘটনা ঘটে গেল এজন্য সেই দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের পুরো
বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন মি. কবির।
"দূতাবাসের
প্রধান যিনি আছেন তিনি এই ব্যাপারটা বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবেন
যে কি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কিন্তু এই ধরণের ঘটনা এক মিশনে বা বিভিন্ন
মিশনে যদি বার বার ঘটতে থাকে, তাহলে মন্ত্রণালয়ের বিষয়টা দেখা উচিত। এবং এ
ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দিয়ে দেয়া উচিত যে প্রবাসীদের সঙ্গে আচরণ
কিভাবে করতে হবে। তাদেরকে কিভাবে সেবাগুলো দিতে হবে।"
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকরা একটি বড় ভূমিকা রাখলেও প্রবাসে দূতাবাসগুলোতে তাদের বঞ্চনার খবরই বার বার উঠে আসে।
এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাসের বাণী এলেও বাস্তবে কোন প্রতিফলন দেখা যায়না।
No comments