ঢাকা শহরে বস্তিবাসী: সংখ্যা কত, কেমন তাদের জীবন?
সকল বস্তির মোটামুটি একই রকম চেহারা। |
মিরপুরে চলন্তিকা নামের যে বস্তিটি
শুক্রবার সন্ধ্যায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার পাশেই রাস্তায় মুখ ভার করে
দাঁড়িয়েছিলেন পারুল বেগম।
তিনি বলছেন, "ময়মনসিংহ থেকে মাস চারেক
আগে আসছি। আমার স্বামীর অসুখ। কাজ করতে পারে না। তাই কাজের খোঁজে আসছি।
এইখানে ২৮শত টাকা ভাড়ায় উঠছিলাম। আগুনে একটা কিছুও বাঁচাইতে পারি নাই।"
তিনি বলছেন, "মনে হচ্ছে সব হারাইতেই যেন ঢাকায় আসছিলাম।"
বাংলাদেশে বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা নতুন নয়। পারুল বেগমের মতো সব হারানো বস্তিবাসীর সংখ্যাও ঢাকা জুড়ে অনেক।
বস্তিবাসীদের জীবন কেমন?
ঢাকার অনেক সম্পদশালী পরিবারের বাস বনানী বা গুলশান এলাকায়। সেখান থেকে খুব বেশি দুরে নয় কড়াইল বস্তি।
সুউচ্চ অনেক ভবন থেকেই টিনের চাল আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘিঞ্জি ছোট ছোট খুপরিগুলো চোখে পড়ে।
বাংলাদেশের সবচাইতে বড় বস্তিগুলোর একটি হল এই কড়াইল বস্তি। ঢাকার সকল বস্তির মোটামুটি একই রকম চেহারা।
সরু
ঢোকার পথ, অসংখ্য অলি-গলি, অন্ধকার খুপরি, নোংরা গোসলখানা ও টয়লেট, এখানে
সেখানে জমে আছে আবর্জনা। কোনরকমে একটা খাট বসালেই ঘরের জায়গা শেষ।
এরই মধ্যে অর্ধ নগ্ন শিশুরা খেলা করছে।
হাসনা ও মনোয়ারা বেগমের গল্প
কড়াইল বস্তিতে ৩০ বছর ধরে বাস করছেন নরসিংদীর হাসনা বেগম।
বলছিলেন এই দীর্ঘ দিনে বহুবার বস্তি ভেঙে দিতে দেখেছেন।
প্রতিবারই ঘুরে ফিরে আবার একই এলাকায় গজিয়ে গেছে নতুন বস্তি।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি কোন জমির উপরে স্থানীয় প্রভাবশালীরা যায়গা দখল করে ঘর তুলে সেগুলো ভাড়া দিয়ে থাকেন।
এখানে এমন জায়গাতেও হাসনা বেগমকে ঘর ভাড়া দিতে হয় ৪ হাজার টাকা।
এই এলাকায় ঘর ভাড়া কিছুটা বেশি। তিনি বলছেন মাসে ৫০০ টাকা দিতে হয় পানির বিল আর গ্যাস বিল ৩০০ টাকা।বিদ্যুতের বিলও দিতে হয়।
হাসনা বেগম জীবনে বহুবার বস্তি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। |
তবে মূলত সেগুলো সংগ্রহ করেন খুপরির মালিক।
অনেকে
নিজের খুপরি নিজেই তৈরি করে নেন। হাসনা বেগম বলছেন, "আপনারা যা দেন আমরাও
তো সব কিছুর জন্য টাকা দেই। কিন্তু এই বস্তিতে আসার পর এই পর্যন্ত তিনবার
উঠাইয়া দিছে। বস্তি ভাইঙ্গা দিছে।"
হাসনা বেগম পেশায় গৃহকর্মী।
এসব
বস্তিতে মূলত যারা বাস করেন তারা পেশায় বেশিরভাগই পোশাক কর্মী, গৃহকর্মী,
দিনমজুর, রিকশা চালক অথবা কেউ হয়ত কোন খুচরা ব্যবসার সাথে জড়িত।
এই
বস্তির আর এক বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলছেন, "সারাক্ষণ ভয় ধইরা থাকে। কবে
জানি সরকারে উঠাইয়া দিবো। না জানি আবার আগুন লাগে। আমরা না থাকলে বাসায়
কাজ করার লোক কই পাইবেন? আমরা আপনাগো কাজই তো করি। থাকার জায়গা দিবেন না
কেন?" বেশ জোরালো গলায় কথাগুলো বলছিলেন এই নারী।
ঢাকায় বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা ঠিক কত?
বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৪ সালে বস্তি শুমারি করেছিলো পরিসংখ্যান ব্যুরো। এরপর সেনিয়ে আর কোন তথ্য পাওয়া যায়না।
প্রতিবছর নদী ভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা শুধু কাজের খোঁজেই হাজার হাজার মানুষ ঢাকা আসছেন।
২০১৪ সালে বস্তি শুমারি অনুযায়ী ঢাকা শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি রয়েছে।
সেখানে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজারের মতো।
মনোয়ারা বেগম বলছেন, সারাক্ষণ উচ্ছেদের ভয় কাজ করে। |
এই জরীপ অনুযায়ী সেসময় সাড়ে ৬ লাখের মতো লোক এসব বস্তিতে বসবাস করেন। পাঁচ বছর পর সেটা কত হয়েছে তা নিশ্চিত নয়।
অর্ধেকের বেশি বস্তি সরকারি জমিতে তৈরি। ৬৫ শতাংশ বস্তিবাসী ভাড়া থাকেন।
২০১৪ সালের শুমারি অনুযায়ী সারা দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২২ লক্ষ।
তবে এসব সংখ্যা ও তথ্য উপাত্ত নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে।
২০১৪ সালের পর এখন বস্তি বা বস্তিবাসীর সংখ্যা কত তার কোন হিসেব কারো জানা নেই।
দু:স্থ লোকের আবাসন নিয়ে কেউ ভাবছে না
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ
মঈনুল ইসলাম বলছেন, তিনি সরকারি উপাত্তগুলোর উপরে ঠিক আস্থা রাখতে পারছেন
না।
তিনি বলছেন, "বস্তিবাসীর সংখ্যা বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
১৯৯৭ সালের এর পর বস্তি শুমারি হয়েছে ২০১৪ সালে। সরকারি হিসেবেই এই সময়ের
মধ্যে বস্তির সংখ্যা ছয়গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে কোন পরিকল্পনা যখন করা হয়
তখন এই বিশাল জনসংখ্যার কথা খুব একটা মাথায় রাখা হয়না।"
তিনি
বলছেন, "বিভিন্ন মন্ত্রণালয় রয়েছে কিন্তু তাদের কাজে সমন্বয়হীনতার
রয়েছে। বস্তির মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে দায়িত্ব কার, কাজগুলো কিভাবে
হবে? উন্নয়ন পরিকল্পনায় এদের ধরা হয়না। তাদের সেবা নিশ্চিত করবে কে?"
তিনি বলছেন, "বস্তিতে বিভিন্ন সেবা পেতে তারাও কিন্তু অর্থ খরচ করে। কিন্তু সেটি সরকারের খাতায় হিসেব হয়না।"
তিনি প্রশ্ন তুলছেন, শুমারি করার সময় বস্তির সংজ্ঞা কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?
এই সংজ্ঞার কারণে সংখ্যায় হেরফের হবে বলে তিনি মনে করেন।
ঘিঞ্জি ছোট খুপরিতে বাস করেন বস্তিবাসীরা। |
No comments