যে কারণে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
অযাচিতভাবে
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বাড়ছে। এতে করে অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের
প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকিতে পড়ছে রোগীরা।
অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চিকিৎসকরা এ ধরনের
ওষুধ বেশি ব্যবহার করায় এবং রোগীরা ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়ায় জীবাণু হয়ে উঠেছে
ওষুধ প্রতিরোধী। বিভিন্ন অলিগলির দোকানিরাও এখন ডাক্তার! দোকানদাররা শুধু
অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই ক্ষতি করেন না, বেশির ভাগ সময় তারা
অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কোর্স না দিয়ে দুই-এক ডোজ প্রদান করেন। যেটা রোগীর
জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাইরের দুনিয়ায় রোগীকে
অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ তো দূরের কথা, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া
অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির কোনো নিয়ম নেই। অথচ দেশে এই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ
উদাসীন বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।
অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি ও খাওয়া উচিত নয়।
দোকানদাররা কেন প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করবেন? অযাচিতভাবে ছোট-খাটো রোগের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলেও বড় রোগে অ্যান্টিবায়োটিকে আর কাজ করবে না। কঠিন কোনো ব্যাধি সহজে সারবে না। বিষয়টি নিয়ে সত্যিকার অর্থে ভাববার সময় এসেছে। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার চলতে থাকলে একসময় অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাবে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য তা হবে মারাত্মক হুমকি। তিনি বলেন, দেশে বেশকিছু কারণে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে। গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার কর্তৃক অনুমাননির্ভর বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এবং ব্যবহার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের হাতে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সংক্রামক রোগ বেশি, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনও বেশি। কিন্তু বিশ্বে যত ওষুধ তৈরি হচ্ছে তার মাত্র নয় ভাগ কেনে উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি এখন অসংক্রামক ব্যাধির দিকে। উন্নত দেশগুলো নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। কাজেই বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, একদিকে যেমন আরও নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হওয়া প্রয়োজন তেমনি একই সঙ্গে সরকার ও সাধারণ মানুষের উচিত হবে অ্যান্টিবায়োটিকের সুচিন্তিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলেছে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী এবং ওষুধের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে অচিরেই খুব সাধারণ সংক্রমণ, সামান্য কাটাছেঁড়া থেকে মৃত্য হবে মানুষের। বিশ্বের ১১৪টি দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর প্রথম প্রতিবেদন দিয়েছে।
সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট, ভাইরাস অথবা ছত্রাকজনিত কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার ঝুঁকির বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাধারণ স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মকর্তা। বিশ্বব্যাপী অনেক সংক্রমণের ঘটনাই একটি নিত্যদিনের বিষয়। নিউমোনিয়ায় সংক্রমিত হয় ফুসফুস, মূত্রনালীতে, রক্তপ্রবাহে সংক্রমণ ঘটে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় ডায়রিয়ার সংক্রমণ এবং যৌনসংসর্গের কারণেও বিভিন্ন যৌনরোগ সংক্রমণের বিস্তার ঘটে। বিশ্বের সর্বত্রই নিয়মিতভাবে এসব সংক্রমণ ঘটছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেসব রোগের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে সেসব দেশে ওইসব রোগ মোকাবিলার ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও রক্তের সংক্রমণের জন্য দায়ী সাতটি আলাদা ধরনের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করা হয়। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের রোগীদের ওপর দু’টি প্রধান অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে দেখা গেছে, এগুলো আর কাজ করছে না। এদের একটি কার্বাপেনম। নিউমোনিয়া, রক্তে প্রদাহ ও নবজাতকদের দেহে প্রদাহের মতো রোগ নিরাময়ে এই অ্যান্টিবায়োটিকটি ব্যবহৃত হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চিকিৎসকরা এ ধরনের ওষুধ বেশি ব্যবহার করায় এবং রোগীরা ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়ায় জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। মূত্রতন্ত্রের প্রদাহে যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে গত শতকের আশির দশক থেকে তা খুব কম কাজ করছিল। বর্তমানে এ রোগের ওষুধ একেবারেই অকার্যকর হয়ে গেছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়।
দেশে জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণগুলোর একটি ওষুধের দোকানগুলোতে কোনো ধরনের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করা। অনেক সময় দেখা যায়, ওষুধ বিক্রেতারাই হয়ে ওঠেন ডাক্তার। সামান্য জ্বর সর্দিতেও বাছ-বিচার না করে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে বলেন, এটা খান ঠিক হয়ে যাবে। এটি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
ডাক্তারদের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে ত্রুটির বিষয়টি তুলে ধরে অনেক চিকিৎসকই বলেন, আমরা ডাক্তারদের একটি সমস্যা আছে। অনেক সময় দেখা যায়, যেখানে অল্প মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক বা পুরনো একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই কাজ হবে সেখানে রোগীকে দ্রুত আরোগ্য করার জন্য ডাক্তাররা সর্বশেষ জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেন। অথচ এ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের প্রিজার্ভ করার কথা বা নির্দিষ্ট কোনো রোগে ব্যবহার করার কথা। সামান্য রোগে দ্রুত আরোগ্যের জন্য এসব অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ক্ষতিকর। এভাবেও অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারায়। কোনোক্রমেই রেজিস্টার্ড ডাক্তার ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা যাবে না।
ডাক্তারদের সর্বশেষ জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ব্যাপারে আরও সংযমি হতে হবে। রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স পূর্ণ করার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। অসুখ ভালো হয়ে গেলেও অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স অবশ্যই পূরণ করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপত্রে লেখার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, চিকিৎসাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা যেমন- কী ধরনের ওষুধ পল্লী চিকিৎসক প্রেসক্রিপশন করতে পারবেন সে সম্পর্কে বিধিনিষেধের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো তাদের বর্ণিত মাত্রার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা দেয় না বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। অ্যান্টিবায়োটিক ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন্য ঘরে সংরক্ষণ করা যাবে না। এতে ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। অ্যান্টিবায়োটিক সিরাপ একবার ব্যবহারের পর কিছুদিন গ্যাপ হয়ে গেলে সেই সিরাপের মেয়াদ দীর্ঘদিন থাকলেও তা ব্যবহার করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বেশি হচ্ছে। এ কারণে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে রেজিস্ট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে। এর প্রভাবে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়বে। বাড়বে স্বাস্থ্যসেবা খরচ। তিনি বলেন, সাতদিনের কোর্স সাতদিনই খেতে হবে। কমও নয়, বেশিও নয়। না হলে রোগটি পুনরায় ফিরে আসতে পারে বা বিভিন্ন ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। নিজে নিজে চিন্তা করে খাওয়া যাবে না। তিনি আরো বলেন, ওষুধের দাম যাতে রোগীর ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ওষুধটা কার্যকরী ও নিরাপদ হতে হবে। অনেক সময় নেতিবাচক ট্রিটমেন্ট-এর কারণে রোগীকে বেশি হাসপাতালে থাকতে হয়। ফলে খরচ বেড়ে যায়। সেটাও দেখতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এটা একটা সমস্যা। এ বিষয়কে মাথায় রাখতে হবে, যদিও বাংলাদেশ একটু উন্নত হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মারাত্মক হচ্ছে বলে এই বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে আমাদের সচেতনতা নেই। শিক্ষিত-নিরক্ষর সবার মধ্যেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা বেশি। তাই সারা দেশের ফার্মেসিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে। এটা বাস্তবায়ন হলে অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহার বন্ধ হবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি ও খাওয়া উচিত নয়।
দোকানদাররা কেন প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করবেন? অযাচিতভাবে ছোট-খাটো রোগের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলেও বড় রোগে অ্যান্টিবায়োটিকে আর কাজ করবে না। কঠিন কোনো ব্যাধি সহজে সারবে না। বিষয়টি নিয়ে সত্যিকার অর্থে ভাববার সময় এসেছে। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার চলতে থাকলে একসময় অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাবে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য তা হবে মারাত্মক হুমকি। তিনি বলেন, দেশে বেশকিছু কারণে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে। গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার কর্তৃক অনুমাননির্ভর বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এবং ব্যবহার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের হাতে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সংক্রামক রোগ বেশি, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনও বেশি। কিন্তু বিশ্বে যত ওষুধ তৈরি হচ্ছে তার মাত্র নয় ভাগ কেনে উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি এখন অসংক্রামক ব্যাধির দিকে। উন্নত দেশগুলো নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। কাজেই বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, একদিকে যেমন আরও নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হওয়া প্রয়োজন তেমনি একই সঙ্গে সরকার ও সাধারণ মানুষের উচিত হবে অ্যান্টিবায়োটিকের সুচিন্তিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলেছে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী এবং ওষুধের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে অচিরেই খুব সাধারণ সংক্রমণ, সামান্য কাটাছেঁড়া থেকে মৃত্য হবে মানুষের। বিশ্বের ১১৪টি দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর প্রথম প্রতিবেদন দিয়েছে।
সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট, ভাইরাস অথবা ছত্রাকজনিত কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার ঝুঁকির বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাধারণ স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মকর্তা। বিশ্বব্যাপী অনেক সংক্রমণের ঘটনাই একটি নিত্যদিনের বিষয়। নিউমোনিয়ায় সংক্রমিত হয় ফুসফুস, মূত্রনালীতে, রক্তপ্রবাহে সংক্রমণ ঘটে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় ডায়রিয়ার সংক্রমণ এবং যৌনসংসর্গের কারণেও বিভিন্ন যৌনরোগ সংক্রমণের বিস্তার ঘটে। বিশ্বের সর্বত্রই নিয়মিতভাবে এসব সংক্রমণ ঘটছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেসব রোগের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে সেসব দেশে ওইসব রোগ মোকাবিলার ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও রক্তের সংক্রমণের জন্য দায়ী সাতটি আলাদা ধরনের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করা হয়। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের রোগীদের ওপর দু’টি প্রধান অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে দেখা গেছে, এগুলো আর কাজ করছে না। এদের একটি কার্বাপেনম। নিউমোনিয়া, রক্তে প্রদাহ ও নবজাতকদের দেহে প্রদাহের মতো রোগ নিরাময়ে এই অ্যান্টিবায়োটিকটি ব্যবহৃত হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চিকিৎসকরা এ ধরনের ওষুধ বেশি ব্যবহার করায় এবং রোগীরা ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়ায় জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। মূত্রতন্ত্রের প্রদাহে যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে গত শতকের আশির দশক থেকে তা খুব কম কাজ করছিল। বর্তমানে এ রোগের ওষুধ একেবারেই অকার্যকর হয়ে গেছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়।
দেশে জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণগুলোর একটি ওষুধের দোকানগুলোতে কোনো ধরনের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করা। অনেক সময় দেখা যায়, ওষুধ বিক্রেতারাই হয়ে ওঠেন ডাক্তার। সামান্য জ্বর সর্দিতেও বাছ-বিচার না করে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে বলেন, এটা খান ঠিক হয়ে যাবে। এটি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
ডাক্তারদের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে ত্রুটির বিষয়টি তুলে ধরে অনেক চিকিৎসকই বলেন, আমরা ডাক্তারদের একটি সমস্যা আছে। অনেক সময় দেখা যায়, যেখানে অল্প মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক বা পুরনো একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই কাজ হবে সেখানে রোগীকে দ্রুত আরোগ্য করার জন্য ডাক্তাররা সর্বশেষ জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেন। অথচ এ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের প্রিজার্ভ করার কথা বা নির্দিষ্ট কোনো রোগে ব্যবহার করার কথা। সামান্য রোগে দ্রুত আরোগ্যের জন্য এসব অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ক্ষতিকর। এভাবেও অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারায়। কোনোক্রমেই রেজিস্টার্ড ডাক্তার ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা যাবে না।
ডাক্তারদের সর্বশেষ জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ব্যাপারে আরও সংযমি হতে হবে। রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স পূর্ণ করার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। অসুখ ভালো হয়ে গেলেও অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স অবশ্যই পূরণ করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপত্রে লেখার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, চিকিৎসাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা যেমন- কী ধরনের ওষুধ পল্লী চিকিৎসক প্রেসক্রিপশন করতে পারবেন সে সম্পর্কে বিধিনিষেধের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো তাদের বর্ণিত মাত্রার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা দেয় না বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। অ্যান্টিবায়োটিক ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন্য ঘরে সংরক্ষণ করা যাবে না। এতে ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। অ্যান্টিবায়োটিক সিরাপ একবার ব্যবহারের পর কিছুদিন গ্যাপ হয়ে গেলে সেই সিরাপের মেয়াদ দীর্ঘদিন থাকলেও তা ব্যবহার করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বেশি হচ্ছে। এ কারণে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে রেজিস্ট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে। এর প্রভাবে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়বে। বাড়বে স্বাস্থ্যসেবা খরচ। তিনি বলেন, সাতদিনের কোর্স সাতদিনই খেতে হবে। কমও নয়, বেশিও নয়। না হলে রোগটি পুনরায় ফিরে আসতে পারে বা বিভিন্ন ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। নিজে নিজে চিন্তা করে খাওয়া যাবে না। তিনি আরো বলেন, ওষুধের দাম যাতে রোগীর ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ওষুধটা কার্যকরী ও নিরাপদ হতে হবে। অনেক সময় নেতিবাচক ট্রিটমেন্ট-এর কারণে রোগীকে বেশি হাসপাতালে থাকতে হয়। ফলে খরচ বেড়ে যায়। সেটাও দেখতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এটা একটা সমস্যা। এ বিষয়কে মাথায় রাখতে হবে, যদিও বাংলাদেশ একটু উন্নত হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মারাত্মক হচ্ছে বলে এই বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে আমাদের সচেতনতা নেই। শিক্ষিত-নিরক্ষর সবার মধ্যেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা বেশি। তাই সারা দেশের ফার্মেসিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে। এটা বাস্তবায়ন হলে অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহার বন্ধ হবে।
No comments