একজন আনু মুহাম্মদের চোখে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র by মরিয়ম চম্পা
মা।
মানুষের জীবনে শৃঙ্খলার প্রতীক। খুব অল্প বয়সে মা’কে হারান। এই দুর্ভাগ্য
তাকে তাড়া করে ফিরেছে বহুদিন। মুক্তিযুদ্ধ তাকে আলোড়িত করেছিল ভীষণভাবে।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে যোগ দেন মিছিলে। স্কুলপড়ুয়া
ছেলেটি চেষ্টা করে যুদ্ধে যোগ দেয়ার। ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে। বেঁচে যান
অলৌকিকভাবে। সেই যে যুদ্ধ শুরু তা আর থামেনি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ থেকে সুন্দরবন। দেশের সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। আক্রান্তও হয়েছেন। চিরকালের লড়াকু আনু মুহাম্মদ। তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব। ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক। পেশা শিক্ষকতা। বাংলাদেশের প্রচলিত উন্নয়ন আর গণতন্ত্র নিয়ে রয়েছে তার নিজস্ব ভাবনা। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কথা বলেছেন, জীবনের প্রায় সব অধ্যায় নিয়েই।
আনু মুহাম্মদ বলেন, আমার জন্ম নানা বাড়ি। ১৯৫৬ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর। বাংলায় আশ্বিন মাস। সময়টা ছিল অভাবের। দুই বছরের মধ্যেই ঢাকায় আসা। আমরা থাকতাম কমলাপুর। বাবা ছিলেন কলেজ শিক্ষক। একপর্যায়ে চলে আসি খিলগাঁও আবাসিক এলাকায়। সেখানে থাকতেই আমি স্কুলে ভর্তি হই। প্রথম স্কুল সিদ্ধেশ্বরী প্রাথমিক স্কুল। ওখানে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার পর খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় নিউ মার্কেটের কাছে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে কয়েকটি সিট খালির বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এই স্কুল ছিল তখন দেশ সেরা। আব্বা আমাকে ওখানে ভর্তি করার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ওখানে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হই। এর আগে আমার জীবনে বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা দেয়ার পরে আমার মা মারা যান। তখন আমার বয়স মাত্র ১১ বছর। আমরা ৭ ভাই-বোন। আমি তৃতীয়। সবার ছোট বোনের বয়স ছিল তখন মাত্র দুই বছর। মাকে হারিয়ে আমরা ৭ ভাইবোনসহ পরিবারের সবাই একটি দুর্যোগের মধ্যে পড়ে যাই।
মা না থাকার কারণে পড়ালেখা ও স্কুলের তদারকির বিষয়টি কিছুটা কমে যায়। তাই আমি যখন ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হই তখন আমার বাউণ্ডুলে অবস্থা। এর ফলে স্কুলে আমার অনিয়ম হতো অনেক। বাসে করে স্কুলে একা একাই যেতাম। তবে বই পড়ার অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে অনিয়মিত হলেও বইপড়া বাড়তে থাকে। অনিয়মিত হবার কারণে ক্লাসে আমার নাম কাটা যায়। তখন হেড স্যার ছিলেন খুব বিখ্যাত লোক খান মোহাম্মদ সালেক। অনুরোধ করলে ক্ষমা চাইলে হয়তো কাজ হতো। কিন্তু তখন অনুরোধ করতে ইচ্ছা করলো না। এরপর ১৯৭০ সালে ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে এসে অতো বেশি ভালো লাগেনি। ওখানেও অনিয়ম হতে লাগলো। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চে একটি বড় ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেলাম। সেসময় আমি স্কুলে যাচ্ছিলাম। তখন রামপুরা থেকে সদরঘাটগামী একটি বাসে করে স্টেডিয়ামের সামনে গেলে দেখি ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। বাস থেকে নেমে গিয়ে দেখি ওখানে পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ডের খেলা হচ্ছে। পুরো স্টেডিয়ামের দর্শকরা তখন পাকিস্তানের পক্ষে।
ওইদিন দুপুর ১২টায় ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত’। কয়েক মিনিটের মধ্যে স্টেডিয়ামের পরিবেশ বদলে গেলো। যে পাকিস্তান টিমের পক্ষে পুরো স্টেডিয়ামের মানুষের সাপোর্ট ছিল সেই পুরো স্টেডিয়াম দেখা গেলো পাকিস্তানের বিপক্ষে চলে গেছে। তখন পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের পেছনে বাঁশ-আগুন ইত্যাদি নিয়ে দৌড়াচ্ছে মানুষ। ওখান থেকেই প্রথম মিছিল বের হয়। আমিও মিছিলের সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম।
কোথায় কোথায় গেলাম মনে নেই। সারা দিন মিছিলে মিছিলে ছিলাম। ওইদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চলল। ২৫শে মার্চ এলাকার বড় ভাইদের সঙ্গে মিলে আমরা ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করলাম। অনেক রাতে যখন প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হলো তখন আমরা বাসায় গেলাম। তারপরতো ৭১ সালে অনেক ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। রাজাকারদের হাতে বন্দি হলাম। মার খেলাম। এরপর একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। রাজাকাররা যে ঘরে আমাদের বন্দি করে রাখে সেই বাড়ির এক মহিলা রাতের বেলা আমাদের দুজনকে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। অথচ দুদিন আটকে রেখে পরের দিন খুব সকালে আমাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে হস্তান্তরের কথাবার্তা শুনেছি। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলাম।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে মেট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। নকলে পরিপূর্ণ খুবই খারাপ একটি পরীক্ষা ছিল সেটা। ’৭৩ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। সেসময় আমার একটি সাইকেল ছিল যেটা দিয়ে ঢাকা কলেজে যেতাম, শহরে ঘোরার একটি স্বাধীনতা ছিল। সাইকেলে করে অনেক সেমিনারে যেতাম, লাইব্রেরিতে যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের কারণে অনেকের মতো আমারও মানসিক বয়স বেড়ে গিয়েছিল। অনেক বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় তখন। যেটা ওই বয়সে হওয়ার কথা না। রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ পরিবর্তন ইত্যাদি। বিভিন্ন দলের অফিসে যেতাম। স্টাডি সার্কেলে যেতাম। লেখালেখি করতাম। লেখালেখির সূত্রে বিচিত্রার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ১৯৭৩ সাল থেকে বিচিত্রায় আমি নিয়মিত লেখালেখি করি। ৭৪ সালে দেশে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় তখন সাইকেল দিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরতাম আর দুর্ভিক্ষের ওপর বিচিত্রায় সিরিজ লিখতাম। সিরিজের নাম ছিল ‘আপনারা কেমন আছেন।’
১৯৭৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। জাহাঙ্গীরনগরে যাওয়াটা আমার পরিকল্পিত ছিল না। আম্মা আব্বার ইচ্ছা অনুযায়ী আমার ভর্তি হওয়ার কথা মেডিকেল কলেজে। ডাক্তার হওয়ার কথা ছিল। মেডিকেল কলেজে গিয়ে মনে হলো আমি এটার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারব না। দ্বিতীয়বার ভর্তি নোটিশ পেয়ে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হই। কারণ আমার হলে থাকার ইচ্ছা। তারপর বিভিন্ন লেখালেখি, সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। ৮১ সালে মাস্টার্স পাস করি। এরপরতো শিক্ষকতা শুরু হয়।
যৌবনে রোমান্টিকতা প্রসঙ্গে বলেন, রোমান্টিক সময়তো মানুষের সবসময়ই থাকে। রোমান্টিকতার কি কোনো বয়স লাগে না কী। এটা সবসময় সব বয়সেই থাকে। স্কুল জীবনে দু-একজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগটা বেশি হয়। মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর আমার বর্তমান জীবনসঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এবং আমরা ১৯৮৫ সালে বিয়ে করি। বর্তমান ও আগের সময়ের সম্পর্কের সঙ্গে পার্থক্য হচ্ছে টেকনোলজির কারণে এখনকার ছেলে মেয়েদের সম্পর্কগুলো অনেকটা পজেটিভ। কারও জন্য কোনো বিরতি বা সময় থাকে না। সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময়ও নেই। আগে যেটা ছিল একজন আরেকজনকে চিঠি দিতে গিয়ে একবার লিখলো দুইবার তিনবার। চিঠিটা পাঠালো।
এর মাঝে একবার ভাবার সময় পেলো। এরপর দু-জনের দেখা হলো। সম্পর্কটা টিকে থাকা না থাকার জন্য যে সময়গুলো দরকার সে সময়গুলো উভয়পক্ষই পেতো। এখনকার সময়ে মোবাইলে ফেসবুকে একটি মেসেজ লিখে সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছে। রিভাইজ বা চিন্তা করারও সময় নেই। সারাক্ষণই কথা বলছে। সম্পর্কেও ভাঙন সবসময় খারাপ নয়। জোর করে বা সমাজের ভয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। এ ছাড়া ছেলেদের পাশাপাশি এখনকার মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। তার ফলে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা বেড়েছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমান সময়ে সারা দুনিয়াতে বেকারত্ব বিশেষ করে স্থিতিশীল কাজের সংকট অনেক বেড়েছে। অনেকরকম কাজ আছে ঠিকই কিন্তু গুণগত দিক থেকে ভালো নয়। আমাদের সমাজে এখন যাদের হাতে ক্ষমতা বা প্রচুর টাকা আছে তাদের জমি দখল করতে হয়। বন দখল করতে হয়। এই ক্ষমতাবানদের জন্য দরকার হয় বড় বাহিনী। যারা তাদের কাজের সাহায্য করবে। এভাবে কিন্তু সন্ত্রাসী তৈরি হয়। তরুণদের যে মাস্তানি ও সন্ত্রাস আমরা দেখি এর বড় পৃষ্ঠপোষক থাকে ক্ষমতাবান লোকেরা। থানার সোর্স, ডেসটিনির মতো জালিয়াতি ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, নারী শিশু পাচার ইত্যাদিতে কর্মসংস্থান তো বেকারত্বেও সমাধান বলা যায় না। কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ, অনিশ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সম্মানজনক নিরাপদ কাজের অভাব অনেক বেশি। লেখাপড়া শিখেও একটি টেকসই, স্থিতিশীল ও সম্মানজনক কাজের বড় সংকটের জায়গা তৈরি হয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরে যে কাজগুলো তৈরি হচ্ছে এসব কাজের কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। যেকোনো সময় কাজ চলে যেতে পারে। সেখানে কাজের চাপ অনেক বেশি।
সম্মানজনক বেতন নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। এর ফলে একজনকে দুই থেকে তিনটি কাজ খুঁজতে হয়। অথচ একটি চাকরি করে পুরো একটি পরিবার চালানোর কথা। কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। বাঁচার মতো বেতন মজুরি কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে সমাজের মধ্যে বড় একটি টেনশন তৈরি হয়েছে। এর ওপর নিয়োগ বাণিজ্য গত কয়েক বছরে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে।
দেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার যেগুলোকে উন্নয়ন বলছে সেগুলোকে আমি উন্নয়ন বলতে রাজি না। সরকার এখন উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, সেতু এগুলোকেই বোঝায়। কোনো চিন্তা ভাবনা না করে খরচ, পরিবেশগত চিন্তাভাবনা, যে টাকায় করা হচ্ছে সে টাকায় এরচেয়ে ভালো কাজ করা যেত কিনা এসব কিছুই ভাবা হচ্ছে না। শিক্ষা চিকিৎসার বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, সর্বজনের সম্পদ নদীনালাখালবিল বন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে স্থানান্তরই উন্নয়ন হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। নির্মাণকেন্দ্রিক উন্নয়নের ব্যাপারে সরকারের যে আগ্রহ এর একটি বড় কারণই হচ্ছে এই প্রকল্প নিয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই। যে কাজ ১শ’ টাকায় করা যায় সেটা ৫শ’ টাকায় করা হচ্ছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীনের থেকে ৩ থেকে ৫ গুণ বেশি খরচে প্রকল্প ব্যয় হচ্ছে। এক পদ্মা সেতুর বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পুরো দেশের প্রচুর ভাঙ্গাচুরা রাস্তাঘাট আর সেতু। এটাকে উন্নয়ন প্রকল্প না বলে বিজ্ঞাপন প্রকল্প বলাই সঙ্গত। যেসব ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে সেগুলো আরো কম খরচে আরো ভালোভাবে করা যেত। চট্টগ্রামে এমন ফ্লইওভার আছে যেটা ব্যবহারই হচ্ছে না।
সুন্দরবন শেষ হয়ে যাবে এমন প্রকল্প করা হচ্ছে রামপালে। যেটা নিয়ে গত ৭ থেকে ৮ বছরে অনেক আন্দোলন হয়েছে। দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এটা দেশের জন্য ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক। এটার সঙ্গে ভারতের অনেকগুলো কোম্পানি জড়িত। এ ছাড়া সুন্দরবন এলাকায় যারা জমি ও বন দখল করে তারা বন দখল করার প্রকল্প নিয়েছে। পুরো সুন্দরবনটি দেশি বিদেশি দস্যুতার শিকার হচ্ছে। রূপপুরে পারমাণবিক প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। সেটা এখন চলে গেছে ১ লাখ কোটি টাকায়। কেন বেড়েছে এটা নিয়ে জনগণের কাছে সরকারের কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই প্রকল্প নিয়ে সরকার গৌরবের গাঁথা তৈরি করছে। অথচ এটি বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ প্রকল্প। সড়ক সেতু যোগাযোগ সেগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে যেখানে ভারতের ট্রানজিট সম্পর্কিত। ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজিক স্বার্থ আর দেশি বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ব্যবসাই বিভিন্ন প্রকল্পের পেছনের শক্তি। এরজন্য দেশ বেশি বেশি ঋণ আর পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় বিপদে।
যেগুলোকে উন্নয়ন প্রকল্প বলা হচ্ছে সেগুলো স্বল্প মেয়াদেই দেশের জন্য অনেকগুলো বোঝা হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি আর্থিক বিপদ ও পরিবেশগত মহাবিপদ তৈরি হবে। এখনই বায়ুদূষণ পানিদূষণ জীবনমানে বাংলাদেশ বিশ্বেও একেবারে নিচের সারিতে। একে কীভাবে উন্নয়ন বলবো? প্রকল্পগুলো যারা তৈরি করছে তারা লাভবান হবে। দেশি বিদেশি অনেক গোষ্ঠি এর থেকে অনেক মুনাফা লাভ করবে। পক্ষান্তরে দেশের মানুষ দীর্ঘ মেয়াদের বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হবে। এই ধরনের উন্নয়নের সুবিধাভোগী ও সহযোগীরাই ব্যাংক লুট করছে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ৫০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। আমাদের শিক্ষা খাতে বা চিকিৎসা খাতে যে ব্যয় ধরা হয় তার থেকে কয়েকগুণ বেশি অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় প্রতিবছর।
তিনি বলেন, গত নির্বাচন কোনো নির্বাচন ছিল না। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হবে যে কিভাবে নির্বাচনের নামে কতো ভয়াবহ তামাশা করা যায়। এই ধারা বিশ্লেষণ করেই এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটি তত্ত্ব আলোচনা হচ্ছে- ‘নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ’। নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেখে পুরো ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচন, পুলিশ, আইন-আদালত, আমলাতন্ত্র কোনোটারই কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। সবগুলোই হচ্ছে সরকারের কর্তৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান। যার ফলে একটি একচেটিয়া কর্তৃত্ববাদ জন্ম নিয়েছে যা এই মাত্রায় বাংলাদেশে এর আগে দেখা যায়নি।
দীর্ঘ ৪৭ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাংলাদেশে ঠিকমত দাঁড়াতেই পারেনি। কিন্তু এখন একচেটিয়া কর্তৃত্ববাদ যে মাত্রায় দেখা যাচ্ছে তার কোনো পূর্বদৃষ্টান্ত নেই। সেটারই ধারাবাহিকতায় এখন যে উপজেলা নির্বাচন এবং ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে সেটার যে ভিন্ন ফল হবে না তা বোঝার জন্য খুব বড় ব্যাখ্যার দরকার হয় না। সরকার অতুলনীয় দক্ষতা দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে তামাশায় পরিণত করেছে। এরকম দক্ষতা যদি তারা অন্য কোনো কাজে লাগাতো তাহলে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থায় থাকতে পারতো। নদী বন শিক্ষা চিকিৎসা সন্ত্রাস মাদক সড়ক দুর্ঘটনা এসব ক্ষেত্রে তো কোনো দক্ষতা দেখা যায় না।
তিনি বলেন, আমার লেখা প্রথম বই হচ্ছে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ। এ পর্যন্ত আমার লেখা প্রায় ৩৫টি বই বেরিয়েছে। পুরো নাম আনু মুহাম্মদ আনিসুর রহমান হলেও আনু মুহাম্মদ নামেই অধিক পরিচিত তিনি। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। ঢাকায় লেখাপড়া শেষ করে ১৯৮২ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদান করেন। এছাড়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্য বিরোধী তত্ত্বচর্চ?া ও লড়াইয়ে সক্রিয় অংশ নেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ যেকোনো প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ থেকে সুন্দরবন। দেশের সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। আক্রান্তও হয়েছেন। চিরকালের লড়াকু আনু মুহাম্মদ। তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব। ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক। পেশা শিক্ষকতা। বাংলাদেশের প্রচলিত উন্নয়ন আর গণতন্ত্র নিয়ে রয়েছে তার নিজস্ব ভাবনা। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কথা বলেছেন, জীবনের প্রায় সব অধ্যায় নিয়েই।
আনু মুহাম্মদ বলেন, আমার জন্ম নানা বাড়ি। ১৯৫৬ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর। বাংলায় আশ্বিন মাস। সময়টা ছিল অভাবের। দুই বছরের মধ্যেই ঢাকায় আসা। আমরা থাকতাম কমলাপুর। বাবা ছিলেন কলেজ শিক্ষক। একপর্যায়ে চলে আসি খিলগাঁও আবাসিক এলাকায়। সেখানে থাকতেই আমি স্কুলে ভর্তি হই। প্রথম স্কুল সিদ্ধেশ্বরী প্রাথমিক স্কুল। ওখানে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার পর খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় নিউ মার্কেটের কাছে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে কয়েকটি সিট খালির বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এই স্কুল ছিল তখন দেশ সেরা। আব্বা আমাকে ওখানে ভর্তি করার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ওখানে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হই। এর আগে আমার জীবনে বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা দেয়ার পরে আমার মা মারা যান। তখন আমার বয়স মাত্র ১১ বছর। আমরা ৭ ভাই-বোন। আমি তৃতীয়। সবার ছোট বোনের বয়স ছিল তখন মাত্র দুই বছর। মাকে হারিয়ে আমরা ৭ ভাইবোনসহ পরিবারের সবাই একটি দুর্যোগের মধ্যে পড়ে যাই।
মা না থাকার কারণে পড়ালেখা ও স্কুলের তদারকির বিষয়টি কিছুটা কমে যায়। তাই আমি যখন ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হই তখন আমার বাউণ্ডুলে অবস্থা। এর ফলে স্কুলে আমার অনিয়ম হতো অনেক। বাসে করে স্কুলে একা একাই যেতাম। তবে বই পড়ার অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে অনিয়মিত হলেও বইপড়া বাড়তে থাকে। অনিয়মিত হবার কারণে ক্লাসে আমার নাম কাটা যায়। তখন হেড স্যার ছিলেন খুব বিখ্যাত লোক খান মোহাম্মদ সালেক। অনুরোধ করলে ক্ষমা চাইলে হয়তো কাজ হতো। কিন্তু তখন অনুরোধ করতে ইচ্ছা করলো না। এরপর ১৯৭০ সালে ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে এসে অতো বেশি ভালো লাগেনি। ওখানেও অনিয়ম হতে লাগলো। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চে একটি বড় ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেলাম। সেসময় আমি স্কুলে যাচ্ছিলাম। তখন রামপুরা থেকে সদরঘাটগামী একটি বাসে করে স্টেডিয়ামের সামনে গেলে দেখি ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। বাস থেকে নেমে গিয়ে দেখি ওখানে পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ডের খেলা হচ্ছে। পুরো স্টেডিয়ামের দর্শকরা তখন পাকিস্তানের পক্ষে।
ওইদিন দুপুর ১২টায় ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত’। কয়েক মিনিটের মধ্যে স্টেডিয়ামের পরিবেশ বদলে গেলো। যে পাকিস্তান টিমের পক্ষে পুরো স্টেডিয়ামের মানুষের সাপোর্ট ছিল সেই পুরো স্টেডিয়াম দেখা গেলো পাকিস্তানের বিপক্ষে চলে গেছে। তখন পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের পেছনে বাঁশ-আগুন ইত্যাদি নিয়ে দৌড়াচ্ছে মানুষ। ওখান থেকেই প্রথম মিছিল বের হয়। আমিও মিছিলের সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম।
কোথায় কোথায় গেলাম মনে নেই। সারা দিন মিছিলে মিছিলে ছিলাম। ওইদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চলল। ২৫শে মার্চ এলাকার বড় ভাইদের সঙ্গে মিলে আমরা ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করলাম। অনেক রাতে যখন প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হলো তখন আমরা বাসায় গেলাম। তারপরতো ৭১ সালে অনেক ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। রাজাকারদের হাতে বন্দি হলাম। মার খেলাম। এরপর একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। রাজাকাররা যে ঘরে আমাদের বন্দি করে রাখে সেই বাড়ির এক মহিলা রাতের বেলা আমাদের দুজনকে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। অথচ দুদিন আটকে রেখে পরের দিন খুব সকালে আমাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে হস্তান্তরের কথাবার্তা শুনেছি। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলাম।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে মেট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। নকলে পরিপূর্ণ খুবই খারাপ একটি পরীক্ষা ছিল সেটা। ’৭৩ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। সেসময় আমার একটি সাইকেল ছিল যেটা দিয়ে ঢাকা কলেজে যেতাম, শহরে ঘোরার একটি স্বাধীনতা ছিল। সাইকেলে করে অনেক সেমিনারে যেতাম, লাইব্রেরিতে যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের কারণে অনেকের মতো আমারও মানসিক বয়স বেড়ে গিয়েছিল। অনেক বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় তখন। যেটা ওই বয়সে হওয়ার কথা না। রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ পরিবর্তন ইত্যাদি। বিভিন্ন দলের অফিসে যেতাম। স্টাডি সার্কেলে যেতাম। লেখালেখি করতাম। লেখালেখির সূত্রে বিচিত্রার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ১৯৭৩ সাল থেকে বিচিত্রায় আমি নিয়মিত লেখালেখি করি। ৭৪ সালে দেশে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় তখন সাইকেল দিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরতাম আর দুর্ভিক্ষের ওপর বিচিত্রায় সিরিজ লিখতাম। সিরিজের নাম ছিল ‘আপনারা কেমন আছেন।’
১৯৭৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। জাহাঙ্গীরনগরে যাওয়াটা আমার পরিকল্পিত ছিল না। আম্মা আব্বার ইচ্ছা অনুযায়ী আমার ভর্তি হওয়ার কথা মেডিকেল কলেজে। ডাক্তার হওয়ার কথা ছিল। মেডিকেল কলেজে গিয়ে মনে হলো আমি এটার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারব না। দ্বিতীয়বার ভর্তি নোটিশ পেয়ে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হই। কারণ আমার হলে থাকার ইচ্ছা। তারপর বিভিন্ন লেখালেখি, সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। ৮১ সালে মাস্টার্স পাস করি। এরপরতো শিক্ষকতা শুরু হয়।
যৌবনে রোমান্টিকতা প্রসঙ্গে বলেন, রোমান্টিক সময়তো মানুষের সবসময়ই থাকে। রোমান্টিকতার কি কোনো বয়স লাগে না কী। এটা সবসময় সব বয়সেই থাকে। স্কুল জীবনে দু-একজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগটা বেশি হয়। মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর আমার বর্তমান জীবনসঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এবং আমরা ১৯৮৫ সালে বিয়ে করি। বর্তমান ও আগের সময়ের সম্পর্কের সঙ্গে পার্থক্য হচ্ছে টেকনোলজির কারণে এখনকার ছেলে মেয়েদের সম্পর্কগুলো অনেকটা পজেটিভ। কারও জন্য কোনো বিরতি বা সময় থাকে না। সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময়ও নেই। আগে যেটা ছিল একজন আরেকজনকে চিঠি দিতে গিয়ে একবার লিখলো দুইবার তিনবার। চিঠিটা পাঠালো।
এর মাঝে একবার ভাবার সময় পেলো। এরপর দু-জনের দেখা হলো। সম্পর্কটা টিকে থাকা না থাকার জন্য যে সময়গুলো দরকার সে সময়গুলো উভয়পক্ষই পেতো। এখনকার সময়ে মোবাইলে ফেসবুকে একটি মেসেজ লিখে সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছে। রিভাইজ বা চিন্তা করারও সময় নেই। সারাক্ষণই কথা বলছে। সম্পর্কেও ভাঙন সবসময় খারাপ নয়। জোর করে বা সমাজের ভয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। এ ছাড়া ছেলেদের পাশাপাশি এখনকার মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। তার ফলে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা বেড়েছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমান সময়ে সারা দুনিয়াতে বেকারত্ব বিশেষ করে স্থিতিশীল কাজের সংকট অনেক বেড়েছে। অনেকরকম কাজ আছে ঠিকই কিন্তু গুণগত দিক থেকে ভালো নয়। আমাদের সমাজে এখন যাদের হাতে ক্ষমতা বা প্রচুর টাকা আছে তাদের জমি দখল করতে হয়। বন দখল করতে হয়। এই ক্ষমতাবানদের জন্য দরকার হয় বড় বাহিনী। যারা তাদের কাজের সাহায্য করবে। এভাবে কিন্তু সন্ত্রাসী তৈরি হয়। তরুণদের যে মাস্তানি ও সন্ত্রাস আমরা দেখি এর বড় পৃষ্ঠপোষক থাকে ক্ষমতাবান লোকেরা। থানার সোর্স, ডেসটিনির মতো জালিয়াতি ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, নারী শিশু পাচার ইত্যাদিতে কর্মসংস্থান তো বেকারত্বেও সমাধান বলা যায় না। কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ, অনিশ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সম্মানজনক নিরাপদ কাজের অভাব অনেক বেশি। লেখাপড়া শিখেও একটি টেকসই, স্থিতিশীল ও সম্মানজনক কাজের বড় সংকটের জায়গা তৈরি হয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরে যে কাজগুলো তৈরি হচ্ছে এসব কাজের কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। যেকোনো সময় কাজ চলে যেতে পারে। সেখানে কাজের চাপ অনেক বেশি।
সম্মানজনক বেতন নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। এর ফলে একজনকে দুই থেকে তিনটি কাজ খুঁজতে হয়। অথচ একটি চাকরি করে পুরো একটি পরিবার চালানোর কথা। কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। বাঁচার মতো বেতন মজুরি কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে সমাজের মধ্যে বড় একটি টেনশন তৈরি হয়েছে। এর ওপর নিয়োগ বাণিজ্য গত কয়েক বছরে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে।
দেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার যেগুলোকে উন্নয়ন বলছে সেগুলোকে আমি উন্নয়ন বলতে রাজি না। সরকার এখন উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, সেতু এগুলোকেই বোঝায়। কোনো চিন্তা ভাবনা না করে খরচ, পরিবেশগত চিন্তাভাবনা, যে টাকায় করা হচ্ছে সে টাকায় এরচেয়ে ভালো কাজ করা যেত কিনা এসব কিছুই ভাবা হচ্ছে না। শিক্ষা চিকিৎসার বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, সর্বজনের সম্পদ নদীনালাখালবিল বন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে স্থানান্তরই উন্নয়ন হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। নির্মাণকেন্দ্রিক উন্নয়নের ব্যাপারে সরকারের যে আগ্রহ এর একটি বড় কারণই হচ্ছে এই প্রকল্প নিয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই। যে কাজ ১শ’ টাকায় করা যায় সেটা ৫শ’ টাকায় করা হচ্ছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীনের থেকে ৩ থেকে ৫ গুণ বেশি খরচে প্রকল্প ব্যয় হচ্ছে। এক পদ্মা সেতুর বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পুরো দেশের প্রচুর ভাঙ্গাচুরা রাস্তাঘাট আর সেতু। এটাকে উন্নয়ন প্রকল্প না বলে বিজ্ঞাপন প্রকল্প বলাই সঙ্গত। যেসব ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে সেগুলো আরো কম খরচে আরো ভালোভাবে করা যেত। চট্টগ্রামে এমন ফ্লইওভার আছে যেটা ব্যবহারই হচ্ছে না।
সুন্দরবন শেষ হয়ে যাবে এমন প্রকল্প করা হচ্ছে রামপালে। যেটা নিয়ে গত ৭ থেকে ৮ বছরে অনেক আন্দোলন হয়েছে। দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এটা দেশের জন্য ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক। এটার সঙ্গে ভারতের অনেকগুলো কোম্পানি জড়িত। এ ছাড়া সুন্দরবন এলাকায় যারা জমি ও বন দখল করে তারা বন দখল করার প্রকল্প নিয়েছে। পুরো সুন্দরবনটি দেশি বিদেশি দস্যুতার শিকার হচ্ছে। রূপপুরে পারমাণবিক প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। সেটা এখন চলে গেছে ১ লাখ কোটি টাকায়। কেন বেড়েছে এটা নিয়ে জনগণের কাছে সরকারের কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই প্রকল্প নিয়ে সরকার গৌরবের গাঁথা তৈরি করছে। অথচ এটি বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ প্রকল্প। সড়ক সেতু যোগাযোগ সেগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে যেখানে ভারতের ট্রানজিট সম্পর্কিত। ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজিক স্বার্থ আর দেশি বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ব্যবসাই বিভিন্ন প্রকল্পের পেছনের শক্তি। এরজন্য দেশ বেশি বেশি ঋণ আর পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় বিপদে।
যেগুলোকে উন্নয়ন প্রকল্প বলা হচ্ছে সেগুলো স্বল্প মেয়াদেই দেশের জন্য অনেকগুলো বোঝা হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি আর্থিক বিপদ ও পরিবেশগত মহাবিপদ তৈরি হবে। এখনই বায়ুদূষণ পানিদূষণ জীবনমানে বাংলাদেশ বিশ্বেও একেবারে নিচের সারিতে। একে কীভাবে উন্নয়ন বলবো? প্রকল্পগুলো যারা তৈরি করছে তারা লাভবান হবে। দেশি বিদেশি অনেক গোষ্ঠি এর থেকে অনেক মুনাফা লাভ করবে। পক্ষান্তরে দেশের মানুষ দীর্ঘ মেয়াদের বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হবে। এই ধরনের উন্নয়নের সুবিধাভোগী ও সহযোগীরাই ব্যাংক লুট করছে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ৫০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। আমাদের শিক্ষা খাতে বা চিকিৎসা খাতে যে ব্যয় ধরা হয় তার থেকে কয়েকগুণ বেশি অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় প্রতিবছর।
তিনি বলেন, গত নির্বাচন কোনো নির্বাচন ছিল না। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হবে যে কিভাবে নির্বাচনের নামে কতো ভয়াবহ তামাশা করা যায়। এই ধারা বিশ্লেষণ করেই এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটি তত্ত্ব আলোচনা হচ্ছে- ‘নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ’। নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেখে পুরো ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচন, পুলিশ, আইন-আদালত, আমলাতন্ত্র কোনোটারই কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। সবগুলোই হচ্ছে সরকারের কর্তৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান। যার ফলে একটি একচেটিয়া কর্তৃত্ববাদ জন্ম নিয়েছে যা এই মাত্রায় বাংলাদেশে এর আগে দেখা যায়নি।
দীর্ঘ ৪৭ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাংলাদেশে ঠিকমত দাঁড়াতেই পারেনি। কিন্তু এখন একচেটিয়া কর্তৃত্ববাদ যে মাত্রায় দেখা যাচ্ছে তার কোনো পূর্বদৃষ্টান্ত নেই। সেটারই ধারাবাহিকতায় এখন যে উপজেলা নির্বাচন এবং ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে সেটার যে ভিন্ন ফল হবে না তা বোঝার জন্য খুব বড় ব্যাখ্যার দরকার হয় না। সরকার অতুলনীয় দক্ষতা দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে তামাশায় পরিণত করেছে। এরকম দক্ষতা যদি তারা অন্য কোনো কাজে লাগাতো তাহলে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থায় থাকতে পারতো। নদী বন শিক্ষা চিকিৎসা সন্ত্রাস মাদক সড়ক দুর্ঘটনা এসব ক্ষেত্রে তো কোনো দক্ষতা দেখা যায় না।
তিনি বলেন, আমার লেখা প্রথম বই হচ্ছে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ। এ পর্যন্ত আমার লেখা প্রায় ৩৫টি বই বেরিয়েছে। পুরো নাম আনু মুহাম্মদ আনিসুর রহমান হলেও আনু মুহাম্মদ নামেই অধিক পরিচিত তিনি। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। ঢাকায় লেখাপড়া শেষ করে ১৯৮২ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদান করেন। এছাড়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্য বিরোধী তত্ত্বচর্চ?া ও লড়াইয়ে সক্রিয় অংশ নেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ যেকোনো প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব।
No comments