ভোলা গ্রাম টু গুলশান by জিয়া চৌধুরী
একটু নিরিবিলি বসবাসের জন্য এই ভোলা গ্রামকেই বেছে নেয়া হয়। কিন্তু এরতো সুন্দর নাম প্রয়োজন।
কি আর করা- পাকিস্তানের করাচির অভিজাত এলাকা গুলশানকে টেনে আনা হয় এখানে। নাম দেয়া হয় গুলশান। করাচির গুলশানের মতোই ভোলা গ্রামকে বদলে দেয়ার চেষ্টা চলে। এগুতে থাকে গুলশান। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তখনকার অভিজাত শ্রেণির মানুষজন এখানে জমি কিনতে থাকে। নিজের মনের মতো করে বানাতে থাকে বাড়ি। কিছু দিনের মধ্যেই বদলে যায় চিত্র। একতলা-দোতলা বাড়ির সারি। চওড়া রাস্তা। বাড়ির উঠোনে বসে গল্প ও খেলা করার মতো সাজিয়ে নেয় কেউ কেউ। কেউ আবার বাড়ির সামনে গড়ে তুলে ফুলের বাগান। দেশ স্বাধীনের পর ভোলা নামটি একেবারে হারিয়ে যায়। গুলশান দৃষ্টি কাড়ে সবার।
একের পর এক দূতাবাসগুলোও গুলশানকে বেছে নেয়। আশির দশক পর্যন্ত গুলশান ছিল ছিমছাম আবাসিক এলাকা। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লেক এ গুলশানকে করে তুলে আরও আকর্ষণীয়। কিন্তু নব্বই দশকে এসে সেই আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক বিশাল অট্টালিকা। যে চিন্তা নিয়ে গুলশানের সৃষ্টি তা এখন যেন অনেকটাই মিইয়ে গেছে। বিভিন্ন ডেভলপার কোম্পানির চোখ পড়ে গুলশানে। অন্যদিকে ঢাকার বিস্তৃতি আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এর রেশ পড়ে সেখানে। অন্য এলাকার মতো গুলশানও হয়ে উঠে ব্যস্ততম এক এলাকা।
পাকিস্তান আমলের সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নবী। বড় শখ করে গুলশান প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন বছর পর ১৯৬৪ সালে তিনি স্ত্রী বেলা নবী ও দুই ছেলেকে নিয়ে গুলশানে বসবাস শুরু করেন। গুলশানের প্রবীণ এই বাসিন্দার মুখেই শোনা যাক এখানকার কথা। মোহাম্মদ নবী বলেন, বন-জঙ্গলে ঘেরা অন্যরকম এক গুলশান ছিল তখন। ভোলা গ্রাম থেকে গুলশান হওয়ার বর্ণনাও তিনি দিলেন। বলেন, ঢাকার কাছের এই জায়গায় ভোলা দ্বীপ থেকে মানুষ এসে চাষবাস করত বলেই ঢাকার লোকজন একে ভোলা গ্রাম নাম দিয়েছিল। সরকার যখন এর দিকে নজর দেয় তখন ওয়াপদার প্রকৌশলী মোহাম্মদ নবী এখানে জমি কেনেন। তখন জমির দামও ছিল খুব কম। হাজার টাকায় মিলতো এক কাঠা জমি। পুরো গুলশানে তখন ছিল মাত্র একটি মসজিদ। তাও ছিল মাটির।
যা পরে গুলশান অ্যাভিনিউ মসজিদ নামে পরিচিতি পায়। গুলশান ক্লাবের একটি প্রকাশনায় মোহাম্মদ নবীর একটি লেখা প্রকাশ পায়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন ১৯৬৪ সালের দিকে ছোট বাঘ বা মেছো বাঘের দেখা মিলত গুলশানের ঘন বন-জঙ্গলে। ষাটের দশকের আদি গুলশানে পাখির কলকাকলি আর রাত হলেই পুরো এলাকা ঘোর অন্ধকারের স্মৃতি আছে মোহাম্মদ নবীর। আজ যে জায়গায় নিকেতন আবাসিক এলাকার বিস্তৃতি সেটা ছিল দ্বীপের মতো। ছিল বৃহৎ জলাশয়। এখানে ঢাকার আশপাশের মানুষজন গরু চরাতে আসতো। পরে ধনকুবের জহুরুল ইসলাম জায়গাটিকে ভরাট করে আবাসিক এলাকায় রূপ দেন। গুলশানে শুরুর দিকে প্রায় ১ হাজার তিনশো প্লট ছিল বলেও স্মরণ করেন মোহাম্মদ নবী। অধিবাসীদের মধ্যে শতকরা মাত্র দশ ভাগ লোক ছিলেন বাঙালি।
মোহাম্মদ নবীর ভাষ্য মতে, তৎকালীন সময়ে ডিআইটি’র চেয়ারম্যান মাদানি সাহেব পুরো ভোলা গ্রাম অধিগ্রহণ করেন। এর নাম দেন গুলশান। সেখানে একটি মসজিদ ও খেলার মাঠ করেন তিনি। পুরো গুলশান এলাকার আশেপাশের লেকগুলোকে খনন করে মাঝে রেস্তরাঁ ও রিংরোড বানানোর ইচ্ছা ছিল ডিআইটি চেয়ারম্যানের। সে সময়কার গুলশান সম্বন্ধে মোহাম্মদ নবী বলেন, লোকজন মহাখালী থেকে গুলশানে হেঁটে আসতো। কোন ব্রিজ ছিল না। সেই সময়ে মাত্র গুলশানের দুটি বাজারের কাঠামো নির্মাণ শুরু করা হয়, যা আরো পরে চালু হয়। ডিআইটি চেয়ারম্যান মাদানি সাহেবের সঙ্গে গুলশানের গোড়াপত্তনের বিষয়ে আলাপনের স্মৃতি হাতড়ে মোহাম্মদ নবী বলেন, গুলশান হলো ঠিকই কিন্তু কোনো লোকজন আসতো না। বাস, সেতু, সড়কবাতি, থানা-পুলিশ, নিরাপত্তা, স্কুল-কলেজ, বাজার কোনো কিছুই ছিল না ষাটের দশকের গুলশানে।
ডিআইটি চেয়ারম্যান একে একে গুলশানে সেতু, বাজার, সড়কবাতি সবই করেন। থানা না হলেও পুলিশ আর্ম ফোর্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গুলশান অ্যাভিনিউ জামে মসজিদ ও বাড্ডার ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখনো সেই ভোলা গ্রামের স্মৃতি আঁকড়ে আছে। গ্রামটিতে প্রথম বানানো মসজিদটি এখন গুলশান অ্যাভিনিউতে ঠাঁই পেয়েছে। আর ওই সময়ে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে বাড্ডায়। জনশ্রুতি আছে, কৃষিপ্রধান এলাকা ছিল পুরনো ভোলা গ্রাম। জমি চাষাবাদ, অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে কিংবা গরু চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন ভোলা গ্রামের বাসিন্দারা। এদের মধ্যে লেখাপড়া করতেন নিতান্তই কয়েকজন।
এসব কারণে গুলশানে শতবর্ষী কোনো স্কুল-কলেজের সন্ধান মিলে না। মূলত ১৯৬১ সালে ভোলা গ্রামকে অধিগ্রহণ করা হলে এখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগ পাশের বাঁশতলা, নতুন বাজার ও বাড্ডা এলাকায় বসতি গড়েন। এর মধ্যে একটি বড় অংশ চলে যান গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধারমানিক নামের একটি গ্রামে। ভোলা গ্রামটি অধিগ্রহণ করে ১৯৬১ সালের দিকে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ‘গুলশান’ গড়ে তোলেন ডিআইটির প্রথম চেয়ারম্যান পাকিস্তানি আমলা জি এ মাদানি। গুলশান একসময় একটি ইউনিয়ন ও পরে পৌরসভায় পরিণত হয়। ১৯৭২ সালের দিকে গুলশানসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত হয় গুলশান থানা। ১৯৮২ সালে গুলশান পৌরসভাকে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তখন থেকে গুলশান ঢাকা পৌরসভার একটি ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে ওঠে। তিলে তিলে রূপ পায় আজকের গুলশান।
গুলশান দুই নম্বর এলাকায় গাছের নার্সারির ব্যবসা করেন লক্ষ্মীপুরের কামাল উদ্দিন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে আছেন গুলশানে। গুলশানের পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে কামাল জানান ১৯৮৮ সালে বন্যায় পুরো গুলশান এলাকা প্রায় হাঁটু পানিতে ডুবে যায়। তবে সে সময় আশপাশের লেকের পানির প্রবাহ ঠিক থাকায় দ্রুতই সরে যায় বন্যার পানি। ১৯৬৯ সালের দিকে গুলশানে একটি দূতাবাসে চাকরি শুরু করেন সেকান্দার। তিনি এখন ব্যবসা করেন গুলশানেই। ওই সময় গুলশানে টিলার মতো উঁচু উঁচু জায়গায় মানুষ ঘরবাড়ি করতো বলে দাবি তার। সবমিলিয়ে তখন শ’দুয়েক বাড়ি ছিল বলেও জানান ষাটোর্ধ্ব এই প্রবীণ।
জানান, গুলশান এলাকায় বেশ কিছু রাস্তা তখন ইট দিয়ে তৈরি করা শুরু হয়। গুলশান লেকের পাড়েই থাকতেন সেকান্দার। সত্তরের দশকে গুলশান লেক আরো গতিময় আর সুজলা ছিল। সে সময় লেকে বিশাল সাইজের সিলভার কার্প ও চাপিলা মাছ ধরা পড়তো। ১৯৯১ সালে গুলশান এক নম্বর এলাকার সমুদ্র নামে একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আসিফ আলতাফ। পুরনো গুলশানের কথা জিজ্ঞেস করতেই আদি গুলশানের দোতলা বাড়ি, নদীর মতো স্বচ্ছ লেক আর পরিবেশের সৌন্দর্য্যের কথা স্মরণ করেন। নব্বইয়ের দশকের স্মৃতি হাতড়ে আলতাফ বলেন, গুলশানের বনানী লেকের পাড়ে ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা শাবানার বাড়ি। অসম্ভব সুন্দর ওই বাড়িটির পাড়ের লেকে ছিল স্পিডবোট।
অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বোটে চড়তেন শাবানা। ১৯৯৯ সালের দিকে নিজের দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি ভেঙ্গে বহুতল ভবনে রূপ দেন। তারও তিন বছর আগে গুলশানে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন শুরু বলে জানান আলতাফ। গুলশান এক নম্বর লেকের পাড়ে গড়ে তোলা হয় মরিয়ম টাওয়ার নামে একটি ভবন। ২০০১ সালে জলাধার আইন হলে কিছুটা বন্ধ হয় দখলের থাবা। তবে ভেতরে চলতে থাকে বাণিজ্যিক ভবনের আগ্রাসন। আর এ আগ্রাসনে গুলশানের অভিজাত, বনেদি চেহারা পাল্টে যায়। গুলশান এক নম্বর এলাকার আরেক বাসিন্দা ইফতেখার ইসলাম অনুভব করেন সাইকেলে চেপে গুলশান মাঠে খেলতে যাওয়ার সময়গুলোকে। গুলশানের এখনকার চেহারায় অনেকটাই হতাশ তিনি। বলেন, পুরান ঢাকার চকবাজারের চেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে বনেদি গুলশানের। শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান এক নম্বর মোড়ে যেতেই আধা ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। শব্দদূষণ আর বহুতল ভবনের চাপে তাদের শৈশবও হারিয়ে গেছে বলে মনে করেন এই ব্যক্তি। এত গেল, গুলশানের ইতিহাস আর বেদনার গল্প।
এর উল্টো পিঠেও আছে নানা রংয়ের গল্প। অভিজাত আবাসিক এলাকাটি ব্যবসা-অফিসের ভারে নুয়ে গেলেও তরুণ প্রজন্মের এসব বিষয়ে খুব একটা রাঁ নেই। গুলশানের শুটিং ক্লাব থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল এলাকা পর্যন্ত পুরো গুলশান অ্যাভিনিউটি রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা যেন জেগে থাকে। বহুতল ভবন, ব্যবসায়িক কেন্দ্র আর রেস্তরাঁ বিনোদনের পসরা ভিআইপি সড়কটির আশেপাশে। গড়ে উঠেছে বিনোদনের ক্লাব আর সৌন্দর্য সেবাকেন্দ্র। গুলশান এলাকায় প্রায় ২৫ বছর ধরে থাকেন শাহানা আলম নির্ঝর। পৈত্রিক সূত্রে বারিধারায় ফ্ল্যাট পেলেও গুলশানে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন শাহানা আলম নির্জর। কেনাকাটা, বিভিন্ন অফিস আর নাগরিক সুবিধার বিবেচনায় তিনি গুলশান ছেড়ে যাননি। তবে, শিক্ষাজীবনে রিকশায় করে কলেজে যাবার সুযোগ এখন আর নেই বলেও জানান।
পুরো গুলশানকে এখন তার যানজট আর শব্দদূষণের এলাকাই মনে হয়। শাহানা আলমের মতো লাল-নীল বাতির গুলশানকে পছন্দ করেন শিক্ষার্থী অধরা আঞ্জুমান প্রথা। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মগেট এলাকায় হলেও গুলশানে থাকছেন গত চার বছর ধরে। তার মতে, তরুণ প্রজন্মের জীবনাচরণের সব উপাদান আছে গুলশানে। যানজট আর হাঁকডাককে উতরে এসবকেই বড় করে দেখেন তিনি। প্রথার ভাষায়, গুলশান একটি নিরাপদ, শান্ত ও ভদ্র এলাকার নাম। এই তরুণের সঙ্গে গলা মেলালেন এক বিদেশিও। একটি বহুজাতিক তৈরিপোশাক উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত রাশিয়ান নাগরিক সার্গেই কোনেরেঙ্ক। নিজ শহর ফেলে হাজার মাইল দূরের ঢাকায় এসে গুলশানের প্রেমে পড়েছেন এই বিদেশি। গুলশান এলাকার খাবার-দাবার, রেস্তরাঁ আর জীবনাচরণে মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। তবে, নিরাপত্তাজনিত কারণে অফিসের অনুমতি ছাড়া অফিস ও বাসার বাইরে যাবার সুযোগ কম তার মতো অনেক বিদেশির। তবে আদি গুলশানের যে গল্প প্রতিনিয়ত শুনতে হয় তার কিছুটা এখানো আঁকড়ে ধরে আছেন গুলশান দুই নম্বর এলাকা থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল পর্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা।
এদের বেশির ভাগই গুলশান গোড়াপত্তনের শুরুর দিক থেকে বসবাস করছেন। গুলশান দুইয়ের ৮০ নম্বর সড়কের কমপক্ষে দশটি বাড়ি এখনও গুলশানের ঐতিহ্য ধরে আছে। দোতলা বাড়ি, সামনে খোলা লন বা বাগান কিংবা বাড়ির ভেতরে থাকা বড়োসড়ো গাছ জানান দেয় সেই গুলশানকে। বেশির ভাগ বাড়িগুলোই উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাইরে থেকে খুব একটা বোঝার জো নেই ভেতরে কি আছে। ভেতরে গেলেই নজর কাড়ে পরিবেশশৈলী আর বাড়ির নকশা। বেশিরভাগ বাড়িতেই প্রাণী পোষা হয়। বিকালের পর থেকে এলসেশিয়ান কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণীদের নিয়ে গলির সড়কে বের হয়ে আসেন তরুণরা।
এরকম এক বিকালে ৮০ নম্বর সড়কে দেখা মিলে একটি নজরকাড়া ঘোড়া। সুঠাম দেহ আর চিকচিক করা গড়নে যে কেউ মুগ্ধ হবেই। হালকা গতিতে ধাবমান ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘোড়াটিকে পালেন এখানকারই এক বাসিন্দা। দৌড়ের গতি পরখ করে নিতেই রাস্তায় বের হয়েছেন সওয়ার। এই এলাকায় সাধারণ প্রাইভেট কার খুব একটা চোখে পড়ে না, যা দেখা যায় সবই বিলাসবহুল দামি গাড়ি। মার্সিডিজ বেঞ্জ, হ্যামার, রেঞ্জ রোভার, ঘোস্ট মডেলের রোলস রয়েস, টয়োটা প্রিমিও কিংবা বিএমডব্লিউ’র মতো গাড়ি। পুরো গুলশান এলাকা যখন দিনের বেলায় নানা ব্যবসা আর দাপ্তরিক কাজে ধাবমান থাকে তখন তেমন একটা বের হতে দেখা যায়না বাসিন্দাদের। গুলশানের তরুণ থেকে মাঝারি বয়সের মানুষদের পছন্দের সময় রাত।
দল বেঁধে বন্ধু কিংবা পরিজনের সাথে আড্ডা দেন, বিনোদনে মেতে ওঠেন তারা। বিলাসবহুল গাড়িতে দেখা মেলে সন্ধ্যার পর থেকে। গুলশান অ্যাভিনিউর ফাঁকা রাস্তায় নামেন রেসিংয়ে। গুলশানের রেস্তরাঁ, ক্লাবগুলোতে আনাগোনা বাড়ে তাদের। এখানকার বেশিরভাগ তরুণের মুখে শোনা যায় ইংরেজি-বাংলার মিশেল। খাঁটি বাংলা বলেন এরকম তরুণদের দেখা মেলাই ভার এসব এলাকায়। গুলশান এক নম্বরে থাকা এই এলাকার একমাত্র ৫ তারকা হোটেল ওয়েস্টিনকে ঘিরেও চলে এক শ্রেণির আড্ডা। হোটেলটির সামনের ধানসিঁড়ি রেস্তরাঁ অতিথিদের জন্য জেগে থাকে সারা রাত। রাতের বেলা দামি রেস্টুরেন্ট ছাড়া বাংলা খাবারের ব্যবস্থা শুধু এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক তরুণ জানান, বিনোদনের সব আঁধারই আছে এই গুলশানে। যার যা প্রয়োজন সব। কে কেমন বিনোদন নিবে সে আগ্রহই ঠিক করবে আপনি কোথায় যাবেন? এতো গেল তরুণ প্রজন্মের কথা। মাঝবয়সী আর বয়োজ্যেষ্ঠদের আনাগোনা গুলশানের দুই পার্ক আর অভিজাত ক্লাবগুলোতে।
দিনের বেলা পার্কে প্রাতঃভ্রমণ আর রাতে ক্লাবের আড্ডা এই হলো বেশিরভাগের জীবন। নারীদের সৌন্দর্য চর্চা আর যত্নআত্তির জন্য আছে বিউটি পার্লার ও স্পা সেন্টার। গুলশানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত ক্লাব গড়ে উঠলেও সবচেয়ে অভিজাত হলো ‘গুলশান ক্লাব’। জিমনেসিয়াম, লাইব্রেরি, সিনেমা হল, সুইমিং পুল অথবা বার কি নেই এতে। দিনের বেলা সকাল থেকে শারীরিক কসরত আর ব্যায়ামে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে আসেন জ্যেষ্ঠরা। আর মূলত বিকালের পর থেকে শুরু হয় মাঝ বয়সীদের আনাগোনা। কেতাদুরস্ত পোশাক আর দামি গাড়ি থেকে নামেন ক্লাবের সদস্যরা। রাত অবধি থাকেন ক্লাবে, আড্ডা আর আনন্দে সময় কাটে তাদের। গুলশান ক্লাবের সদস্য হতে আজকাল ১ কোটি থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করার কথা মুখে মুখে। আজকের অভিজাত গুলশান ক্লাবের কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ নবী জানান, গুলশান ক্লাবের জায়গায় ছিল বস্তির মতো এলাকা। মানুষজন গরু রাখতো সেখানে, ছিল বিশাল কাঁঠাল বাগানও। বস্তির ফাঁকা জায়গায় চাষ হতো হলুদের। ঢাকার মনিপুরিপাড়া থেকে কলাম তৈরি করা আনা হয়েছিল গুলশান ক্লাব বানানোর জন্য।
নুরু মিস্ত্রিসহ প্রায় ৫০-৬০জন লোক প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে কলাম পুঁতলেন। এরপর দেয়া হয় ছাউনি। গুলশান ক্লাব প্রতিষ্ঠার সময় একটি গাছ কাটতে গিয়ে ভূত বিষয়ক বিড়ম্বনা শুরু হয়। গাছটি কাটতে গেলে সেখানকার বস্তির লোকজন বলাবলি শুরু করলো গাছের ফোঁকরে একজন সাদা দাঁড়িওয়ালা হুজুরের যাতায়াত ছিল। এসব শুনে কাঠুরিয়ারা গাছ কাটতে রাজি না হওয়ায় নামাজ পড়ে দোয়া-দুরুদেরও ব্যবস্থা করা হয়। গাছটি কাটতেও অনেক দিন সময় লাগে। বস্তিবাসীরা এতে অবাক হলেও পরে আর কোন জিন-ভূতের উপদ্রব দেখা যায়নি। ক্লাবের বিষয়ে আব্দুল জব্বার মেহমান বলেন, সবে ধানমন্ডি থেকে গুলশান এসেছি। বেশিরভাগ প্লটই খালি। সেসময় আমরা সকলে একত্র হতে আরম্ভ করলাম। পুকুর পাড়, লেডিস পার্ক ও বিচারপতি সাহাবুদ্দিন পার্কে হাঁটতাম ও একত্র হতাম। সপ্তাহে একবার না হলেও মাসে একবার কোথাও আমরা বসবার চেষ্টা করতাম। এভাবেই গুলশান ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। প্রায় তিন লাখ লোকের বসবাস গুলশানে।
এখানে জমি বিক্রি করতে চাওয়া মানুষের চেয়ে জমি কেনায় আগ্রহী মানুষের সংখ্যাই বেশি। গুলশানে জমি কিনতে চেয়ে পত্রিকায় দেয়া বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে প্রায়শই। কিন্তু বিজ্ঞাপনেও কাজ হয়না তেমন একটা। জমি বিক্রিতে অনাগ্রহী হলেও বেচাকেনার সাইটগুলোতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির বিজ্ঞাপনের সংখ্যা বেশ চোখে পড়ার মতো। কারণ একটাই, দোতলা ঐতিহ্যবাহী ভবন ভেঙ্গে বহুতল ভবন উঠছে হু হু করে। ফ্ল্যাট কিনতে গেলে প্রতি স্কয়ার ফিটে কোথাও কোথাও খরচ করতে হয় সত্তর হাজার টাকা। আর প্রতি কাঠা জমির দাম গুলশানে অন্তত তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা। জমি কিনতে রেজিস্ট্রি করতে হলে গুনতে হয় কাঠা প্রতি ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো। তেজগাঁও রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জানা গেছে এমন তথ্য।
সিটি করপোরেশন বলছে, গুলশান এলাকায় আছে, দুটি পার্ক ও অন্তত ৩৮টি দূতাবাস। হলি আর্টিজান হামলার পর থেকেই গুলশানের অলি-গলি ও মোড়ে মোড়ে নজরদারি আর গোয়েন্দা তৎপরতা বেড়েছে। এখনো বন্ধ করে রাখা হয়েছে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ সংলগ্ন লেকপাড়ের সড়কটি। নজরকাড়া বিলাসী জীবনযাপনের আড়ালেও আছে ভিন্ন গল্প। গুলশানে কাজ করেন এমন অনেকেই থাকেন গুলশানের আশপাশের এলাকায়। এখানকার জীবনযাত্রায় ব্যয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেন না অনেকে। গুদারাঘাট, নিকেতন ও মহাখালী এলাকা থেকে অফিস করেন এসব মানুষ। আবার অনেকে গুলশানে অফিস করলেও খাবার নিয়ে আসেন কিংবা গুলশানের বাইরে গিয়ে দুপুরের খাবার সারেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন বুয়েট থেকে পাস করা ইকবাল মাহমুদ। থাকেন গুলশানের বাইরে। এমনকি দুপুরের খাবার খান গুলশানের এলাকার বাইরে গুদারাঘাটে নয়ন বিরিয়ানি হাউজ নামে একটি হোটেলে। এক দুপুরে গিয়ে দেখা গেল দোকনটিতে বেশ ভিড়। এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানকার বিরিয়ানি স্বাদ আর দামের কারণেই নিয়মিত আসেন তারা।
গুলশান এলাকায় রিকশা চালান মফিজ মিয়া। বাড়ি উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে। অভিজাত এলাকায় রিকশা চালিয়ে উপার্জন বেশ হলেও বেশিরভাগই খরচ হয়ে যায় বলে মত তার। মফিজ মিয়া বলেন, এলাকাটা ভালোই, ঝামেলা কম, তয় ইনকাম খুব একটা থাকে না। কোন রকমে দুপুরের খাবার খেতেই এই এলাকায় একশো টাকার বেশি খরচ হয়। তাই চিন্তা করছি অন্য এলাকায় রিকশা চালামু। গুলশান এলাকার বেশিরভাগ গৃহকর্মী ও শ্রমিকরাও থাকেন গুলশান এলাকার বাইরে। ভাটারা, বাড্ডা ও বাঁশতলা এলাকায় থেকে যাওয়া আসা করে কাজ করেন তারা। শফিক এরকমই একজন। গুলশান এলাকার ব্যস্ততা, আভিজাত্য তার নজর কাড়ে না। তবে বাড়ি ফেরার সময় একটা জায়গায় প্রতিদিন মিনিট পাঁচেক দাঁড়ান শফিক। গুলশান দুই নম্বর গোলচত্বরে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা শত-শত চড়ুই পাখি জড়ো হয়। অপলক নয়নে এসব পাখির দিকে চেয়ে থাকেন তিনি। আর ভাবেন, আহা জীবনটা যদি পাখির মতো হতো!
No comments