৫০ আসনের ৪৭টিতে অনিয়ম রাতে সিল মারা হয় ৩৩টিতে -টিআইবির রিপোর্ট
একাদশ
সংসদ নির্বাচনে ৫০টি আসনে গবেষণা চালিয়ে ৪৭টি আসনেই অনিয়ম পেয়েছে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এসব অনিয়মের ব্যাপারে
বিচারবিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। গতকাল ধানমণ্ডির মাইডাস
সেন্টারে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক
প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি এই তথ্য
তুলে ধরে।
অনুষ্ঠানে টিআইবি’র গবেষণা দলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম লিখিত প্রতিবেদনে বলেন, সংস্থাটি দৈবচয়নের মাধ্যমে ৩০০টি আসনের মধ্যে ৫০টিতে গবেষণা করে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৪৭টি আসনে দেখা যায়, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া, অনেক কেন্দ্রে ভোটারকে ভোট দিতে না দেয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, বেশির ভাগ কেন্দ্র আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতা-কর্মীদের দখলে থাকার অভিযোগ, বেশির ভাগ কেন্দ্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট না থাকার তথ্য এসেছে প্রতিবেদনে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০টি আসনের মধ্যে ৪২টি আসনের এক বা একাধিক কেন্দ্রে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল নীরব। ৪১টি আসনে জালভোট দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে সিল মেরে রাখার তথ্য মিলেছে ৩৩ আসনে।
বুথ দখল ও জালভোট পড়ে ৩০ আসনে। পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে বাধা ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয় ২৯ আসনে। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা ও জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করার তথ্য মিলেছে ২৬ আসনে। ভোট শেষ হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায় ২২টি আসনের এক বা একাধিক কেন্দ্রে। আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো হয় ২১ আসনে, ব্যালট বাক্স আগে থেকে ভরে রাখা হয় ২০ আসনে এবং প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মারধর করা হয় ১১টি আসনে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত সবগুলো আসনে প্রচারণার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকে এককভাবে সক্রিয় দেখা গেছে; কোনো কোনো আসনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সরাসরি প্রচারণার জন্য সুবিধা আদায়, প্রশাসন/ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মচারী কর্তৃক প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ, সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে প্রচারণা করেছে।
টিআইবি সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলেছে, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন- সরকারে থাকার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়-বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদন। নির্বাচনের প্রায় একবছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচার চলছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণায়-মন্ত্রিসভার সদস্যদের অংশগ্রহণে সরকারি কার্যক্রমে দলীয় নির্বাচনী প্রচারণা অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ ছিল। বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান বা স্পট সম্প্রচার হয়েছে নির্বাচনের আগে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের দশটি বিষয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার-২৭টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কেবল ডিসেম্বর মাসে মোট এক লাখ ৫৯ হাজার ২৪১ সেকেন্ড সময় ধরে প্রচারিত হয়, যার প্রাক্কলিত আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩০ টাকা। ‘থ্যাংক ইউ পিএম’ নামে একটি টিভি স্পট অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ১৩টি চ্যানেলে প্রচারিত হয়, যার প্রাক্কলতি আর্থিক মূল্য ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৭০ টাকা। ‘আমরা বাংলাদেশের পক্ষে’ নামে ৫৫টি টিভি স্পট ডিসেম্বর মাসে ২৫টি চ্যানেলে এক লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৫ সেকেন্ড প্রচারিত হয়, যার প্রাক্কলতি আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ৯৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৪৫ টাকা। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) প্রচারিত সংবাদে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের একচ্ছত্র আধিপত্য, বিরোধী দল/জোটের অনুপস্থিতি; বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বিটিভির সংবাদ প্রচারের ফলে কেবল ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রচারণা করার সুযোগ পায়।
পর্যবেক্ষণে- সার্বিকভাবে বলা হয়- সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা গেলেও তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারেনি।
নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে কিনা তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ। নির্বাচনের সময়ে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পর্যবেক্ষক ও সংবাদ মাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; ইন্টারনেটের গতি হ্রাস; মোবাইলের জন্য ফোর-জি- থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ; জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোটরচালিত যানবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা।
গবেষণা প্রতিবেদনে ৬টি সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি। এতে বলা হয়েছে- সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ হতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগসহ নির্বাচনী আচরণ বিধির বহুমুখী লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে ও তার ওপর ভিত্তি করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ব্যর্থতা নিরূপণ করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। অন্যদিকে কমিশনের নেয়া পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ ডিজিটালাইজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রার্থীর মনোনয়ন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। একইসঙ্গে এসব অনিয়মের ব্যাপারে বিচারবিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছেন তিনি। বলেছেন, এ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে, সেই আলোকে আমরা বলছি, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত হয়েছে। তবে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, কী গ্রহণযোগ্য নয়- এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
তিনি বলেন, এটাকে আংশিক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যেতে পারে, কারণ সবদলের প্রার্থী অংশ নিলেও সবার সমান প্রচারণার সুযোগ ছিল না। বিশেষ করে ভোটারদেরও তাদের অধিকার অনুযায়ী, পছন্দ অনুযায়ী ভোট দেয়ার সমান সুযোগ ছিল না। কোনো কোনো কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, অনেক কেন্দ্রে ভোটারকে ভোট দিতে না দেয়া, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, তাদের প্রত্যাশিত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা দেখা গেছে। বিশেষ করে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তার যথেষ্ট তথ্য রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। প্রতিপক্ষকে দমনে সরকারি দলের সহায়ক অবস্থানে দেখা গেছে কমিশনকে। সবদলের প্রার্থীদের সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি তারা। আচরণবিধি পালনের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা গেছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে ব্যাপক ব্যর্থতা দেখা গেছে এবং এ ব্যাপারে কমিশনের ভেতরে মতদ্বৈধতা লক্ষ্য করা গেছে- এটা অভূতপূর্ব বিষয়। গণতন্ত্রের জন্য এ ধরনের নির্বাচন ইতিবাচক নয়। এটাও ঠিক যে একটা নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র আসে না আবার ধ্বংসও হয় না।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি এডভোকেট সুলতানা কামাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, নির্বাচনে যদি সমান সুযোগ দেয়া না হয় তবে গণতন্ত্রের জন্য এটা ভালো নয়। সেই কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলা হচ্ছে। নির্বাচনে সবাই সমান সুযোগ পাবে এটাই বাঞ্ছিত। সবাই সমান সুযোগ না পেলে সংশয় থেকেই যায়। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো উদাহরণ রাখে না। নির্বাচন পরিচালনায় প্রচুর ত্রুটি ছিল। এজন্য আমরা বলছি, ত্রুটিগুলো সংশোধন করে সামনের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু করবেন।
টিআইবি জানায়, নভেম্বর ২০১৮ থেকে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে বর্তমান প্রতিবেদনটি তফসিল পূর্ব থেকে শুরু করে ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এই গবেষণা গুণবাচক গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। মোট ১০৭ জন প্রার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে গবেষণায়। চট্টগ্রাম বিভাগে-৯টি আসন, ঢাকা বিভাগে ১১টি, রাজশাহী বিভাগে ৬টি, খুলনা বিভাগে ৬টি, বরিশাল বিভাগে ৪টি, রংপুর বিভাগে ৬টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪টি ও সিলেট বিভাগে ৪টি আসন বেছে নেয়া হয় গবেষণার জন্য।
অনুষ্ঠানে টিআইবি’র গবেষণা দলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম লিখিত প্রতিবেদনে বলেন, সংস্থাটি দৈবচয়নের মাধ্যমে ৩০০টি আসনের মধ্যে ৫০টিতে গবেষণা করে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৪৭টি আসনে দেখা যায়, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া, অনেক কেন্দ্রে ভোটারকে ভোট দিতে না দেয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, বেশির ভাগ কেন্দ্র আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতা-কর্মীদের দখলে থাকার অভিযোগ, বেশির ভাগ কেন্দ্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট না থাকার তথ্য এসেছে প্রতিবেদনে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০টি আসনের মধ্যে ৪২টি আসনের এক বা একাধিক কেন্দ্রে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল নীরব। ৪১টি আসনে জালভোট দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে সিল মেরে রাখার তথ্য মিলেছে ৩৩ আসনে।
বুথ দখল ও জালভোট পড়ে ৩০ আসনে। পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে বাধা ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয় ২৯ আসনে। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা ও জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করার তথ্য মিলেছে ২৬ আসনে। ভোট শেষ হওয়ার আগেই ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায় ২২টি আসনের এক বা একাধিক কেন্দ্রে। আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো হয় ২১ আসনে, ব্যালট বাক্স আগে থেকে ভরে রাখা হয় ২০ আসনে এবং প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মারধর করা হয় ১১টি আসনে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত সবগুলো আসনে প্রচারণার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকে এককভাবে সক্রিয় দেখা গেছে; কোনো কোনো আসনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সরাসরি প্রচারণার জন্য সুবিধা আদায়, প্রশাসন/ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মচারী কর্তৃক প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ, সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে প্রচারণা করেছে।
টিআইবি সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলেছে, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন- সরকারে থাকার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়-বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদন। নির্বাচনের প্রায় একবছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচার চলছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণায়-মন্ত্রিসভার সদস্যদের অংশগ্রহণে সরকারি কার্যক্রমে দলীয় নির্বাচনী প্রচারণা অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ ছিল। বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান বা স্পট সম্প্রচার হয়েছে নির্বাচনের আগে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের দশটি বিষয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার-২৭টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কেবল ডিসেম্বর মাসে মোট এক লাখ ৫৯ হাজার ২৪১ সেকেন্ড সময় ধরে প্রচারিত হয়, যার প্রাক্কলিত আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩০ টাকা। ‘থ্যাংক ইউ পিএম’ নামে একটি টিভি স্পট অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ১৩টি চ্যানেলে প্রচারিত হয়, যার প্রাক্কলতি আর্থিক মূল্য ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৭০ টাকা। ‘আমরা বাংলাদেশের পক্ষে’ নামে ৫৫টি টিভি স্পট ডিসেম্বর মাসে ২৫টি চ্যানেলে এক লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৫ সেকেন্ড প্রচারিত হয়, যার প্রাক্কলতি আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ৯৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৪৫ টাকা। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) প্রচারিত সংবাদে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের একচ্ছত্র আধিপত্য, বিরোধী দল/জোটের অনুপস্থিতি; বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বিটিভির সংবাদ প্রচারের ফলে কেবল ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রচারণা করার সুযোগ পায়।
পর্যবেক্ষণে- সার্বিকভাবে বলা হয়- সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা গেলেও তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারেনি।
নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে কিনা তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ। নির্বাচনের সময়ে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পর্যবেক্ষক ও সংবাদ মাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; ইন্টারনেটের গতি হ্রাস; মোবাইলের জন্য ফোর-জি- থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ; জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোটরচালিত যানবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা।
গবেষণা প্রতিবেদনে ৬টি সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি। এতে বলা হয়েছে- সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ হতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগসহ নির্বাচনী আচরণ বিধির বহুমুখী লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে ও তার ওপর ভিত্তি করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ব্যর্থতা নিরূপণ করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। অন্যদিকে কমিশনের নেয়া পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ ডিজিটালাইজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রার্থীর মনোনয়ন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। একইসঙ্গে এসব অনিয়মের ব্যাপারে বিচারবিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছেন তিনি। বলেছেন, এ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে, সেই আলোকে আমরা বলছি, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত হয়েছে। তবে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, কী গ্রহণযোগ্য নয়- এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
তিনি বলেন, এটাকে আংশিক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যেতে পারে, কারণ সবদলের প্রার্থী অংশ নিলেও সবার সমান প্রচারণার সুযোগ ছিল না। বিশেষ করে ভোটারদেরও তাদের অধিকার অনুযায়ী, পছন্দ অনুযায়ী ভোট দেয়ার সমান সুযোগ ছিল না। কোনো কোনো কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, অনেক কেন্দ্রে ভোটারকে ভোট দিতে না দেয়া, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, তাদের প্রত্যাশিত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা দেখা গেছে। বিশেষ করে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তার যথেষ্ট তথ্য রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। প্রতিপক্ষকে দমনে সরকারি দলের সহায়ক অবস্থানে দেখা গেছে কমিশনকে। সবদলের প্রার্থীদের সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি তারা। আচরণবিধি পালনের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা গেছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে ব্যাপক ব্যর্থতা দেখা গেছে এবং এ ব্যাপারে কমিশনের ভেতরে মতদ্বৈধতা লক্ষ্য করা গেছে- এটা অভূতপূর্ব বিষয়। গণতন্ত্রের জন্য এ ধরনের নির্বাচন ইতিবাচক নয়। এটাও ঠিক যে একটা নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র আসে না আবার ধ্বংসও হয় না।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি এডভোকেট সুলতানা কামাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, নির্বাচনে যদি সমান সুযোগ দেয়া না হয় তবে গণতন্ত্রের জন্য এটা ভালো নয়। সেই কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলা হচ্ছে। নির্বাচনে সবাই সমান সুযোগ পাবে এটাই বাঞ্ছিত। সবাই সমান সুযোগ না পেলে সংশয় থেকেই যায়। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো উদাহরণ রাখে না। নির্বাচন পরিচালনায় প্রচুর ত্রুটি ছিল। এজন্য আমরা বলছি, ত্রুটিগুলো সংশোধন করে সামনের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু করবেন।
টিআইবি জানায়, নভেম্বর ২০১৮ থেকে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে বর্তমান প্রতিবেদনটি তফসিল পূর্ব থেকে শুরু করে ১০ই জানুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এই গবেষণা গুণবাচক গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। মোট ১০৭ জন প্রার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে গবেষণায়। চট্টগ্রাম বিভাগে-৯টি আসন, ঢাকা বিভাগে ১১টি, রাজশাহী বিভাগে ৬টি, খুলনা বিভাগে ৬টি, বরিশাল বিভাগে ৪টি, রংপুর বিভাগে ৬টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪টি ও সিলেট বিভাগে ৪টি আসন বেছে নেয়া হয় গবেষণার জন্য।
No comments