গল্প: অসেতুসম্ভব by জাকির তালুকদার
পোশাক
অর্থনীতির কাছে বইয়ের বাজার মার খাওয়ার পর শাহবাগের আজিজ মার্কেট থেকে
বইগুলো বহিষ্কৃত হয়ে নিজেদের জায়গা খুঁজে নিতে চেষ্টা করছে কাঁটাবনের
কনকর্ড এম্পোরিয়ামে। সেতুকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম যে বিকেলে কনকর্ডে গেলাম,
আড্ডার সবাই খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছিল আমাদের সেই যাওয়াটিকে। এটুকু
উন্নতি আমাদের হয়েছে। একটা আনকোরা নতুন মেয়েকে দেখে সবাই হামলে পড়বে, সেই
অবস্থা আর নেই। আর সেতু খুবই স্মার্ট মেয়ে। নারীবাদী। তবে উগ্রতা নেই। আসলে
উগ্রতা তো স্মার্টনেসের ঘাটতি থেকেই আসে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার
পরে আমি নিজে খুব কমই কথা বললাম তার সঙ্গে। আমাকে তো সে কিছুটা হলেও
চেনে-জানে। অন্যদের সঙ্গে কথা হোক তার। চিনপরিচয় হোক। আমার আড্ডাসঙ্গীদের
দেখে সে আমাকে আরও ভালোভাবে চিনতে পারবে। দুই দফা লাল চা খাওয়া আর ঘণ্টা
তিনেকের গল্পগুজবের পর আমি সেতুকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে
এলাম আবার আড্ডায়। তখন শুরু হলো কৌতূহলের বর্ষণ।
সেতু কি আপনার নতুন গার্লফ্রেন্ড, ওস্তাদ?
না।
বন্ধু?
না।
তাহলে জাস্ট পরিচিত?
আমি একটু ভেবে বললাম, তার চাইতে একটু বেশি।
অবধারিত প্রতিক্রিয়া, বুঝলাম না।
জাস্ট পরিচিতির চাইতে একটু বেশি। তবে বন্ধুত্বের চাইতে কম। প্রেম-ট্রেমের তো প্রশ্নই ওঠে না।
এই রকম সম্পর্কের নাম তো শুনিনি! পরিচিতের চাইতে বেশি, আবার বন্ধুত্বের চেয়ে কম! কেমন কুয়াশা কুয়াশা লাগে।
নাম তো নেই। শুনব কোত্থেকে?
তখন তত্ত্ব চলে আসে। আসলেই তো অনেক কিছুই অদ্যাবধি হয়নি সংজ্ঞায়িত। আমাদের মনের মধ্যে কত রকমের অনুভূতি আছে। কিন্তু কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য, ভালোবাসা-ঘৃণা, বিষণ্নতা-আনন্দ—এই রকম কয়েকটা নাম দিয়ে তো আমরা জীবন কাটিয়ে দিই। কিন্তু অনুভূতি এবং বোধ তো আরও অনেক আছে। সেই যে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, কোনো এক বোধ কাজ করে!
ঠিক। সমাজ যেসব সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তার বাইরেও তো অনেক রকম সম্পর্ক আছে। সেগুলোর নাম দেওয়ার গরজ কারও নেই। নাম নেই। কিন্তু তারা আছে। সেই সব নাম না দেওয়া সম্পর্ক আছে।
আচ্ছা যাউকগা। আপনাগোর সম্পর্ক একদিন একটা নাম পরিগ্রহণ করব, ইনশা আল্লাহ! সেই খুশিতে আইসেন আমরা ধূম্রসহকারে আরেক পেয়ালা চা অগ্রিম পান কইরা লই!
তেমন কোনো সম্ভাবনা বা আশঙ্কা যে আদৌ নেই, সে কথা বলে আর জটিলতা বাড়াতে চাইলাম না।
অন্যরা তখন সমস্বরে বলে উঠেছে, আমেন!
দুই
সেতুর সঙ্গে আমার পরবর্তী দেখা প্রায় এক বছর পর। অবাক হয়ে খেয়াল করি, সেতু হুবহু সেই আগের মতোই আছে। আমি কুশল বিনিময়ের আগেই প্রশ্ন করি, এখনো বিয়ে করোনি কেন?
সাহস হয় না। সেতু উত্তর দেয়, পুরুষ মানুষকে তো আমি তেমনভাবে চিনি না। একসঙ্গে একজীবন কাটানো কি সহজ ব্যাপার হবে মনে করেন?
কোনো মধ্যপন্থা না নিয়ে আমি সরাসরিই বলি, না। মোটেই সহজ হবে না। সহজ হয় না। কোনো দিনই সহজ ছিল না।
পুরুষতন্ত্র খুবই খারাপ।
আমি বলি, শুধু যে পুরুষতন্ত্রই দায়ী তা নয়, অসংখ্য জিনিস আছে যেগুলো দুইজন মানুষের সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
টিএসসির বহির্দেয়াল ঘেঁষে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানগুলোর একটার বেঞ্চিতে বসি আমরা। চারপাশে শব্দ। মানুষ কথা বলছে অবিরাম। আমি একটু হাসি। সেতু জিজ্ঞেস করে, আপনি হাসলেন কী দেখে?
চারপাশে কত রকমের শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
এত শব্দের মধ্যে আমাদের তো বেশ জোরে জোরে কথা বলতে হবে। তা না হলে পাশাপাশি বসেও আমরা পরস্পরের কথা ভালো করে শুনতে পাব না।
সেতু বলে, তা ঠিক। অস্বস্তিকর। অন্যদের কানেও কথাগুলো চলে যাবে।
আমি বলি, না, যাবে না। সবাই নিজের নিজের সঙ্গীকে শোনানোর জন্য উচ্চ শব্দ দিয়ে কথা বলছে। আর বাড়তি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে। তাই এই ভিড়ের মধ্যেও আমাদের শব্দের প্রাইভেসি বজায় থাকবে। সেই কথাটা মনে করেই হেসেছিলাম।
চায়ে চুমুক দিয়ে সেতু বলে, পুরুষেরা কোনো দিন বোধ হয় বউদের নিজেদের সমান করে ভাবতে পারে না, তাই না?
এ কথা কেন মনে হলো?
যতজন বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই এই কথাটাই বলেছে। স্বামীর মন রাখার জন্য প্রত্যেক মেয়েকেই তার নিজের ইগো বিসর্জন দিতে হয়। তা ছাড়া নিজের মা-বাবাকে তো দেখেছি। বাবা তো আমার চোখে বাবা। আমার নির্ভরতা। আমার আশ্রয়। কিন্তু যখন মায়ের সঙ্গে তার আচরণগুলো বিশ্লেষণ করতে বসি, তখন দেখি একজন পুরুষ তার সিদ্ধান্তগুলো চাপিয়ে দিচ্ছে নারীর ওপর।
আমি বলি, পুরোপুরি বেঠিক বলা যাবে না তোমার কথা।
সেতু জোর দিয়ে বলে, বেঠিক কেন হবে? বরং পুরোপুরিই সঠিক।
তোমার মা-ও কিছু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় বাবার ওপর। সেগুলো হয়তো তুমি খেয়াল করোনি।
সেতু যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারে। পুরোপুরি অস্বীকার করে না আমার কথা। বলে, হতে পারে। তবে খুব সাদাচোখে যা দেখা যায়, আমি সেটাই বললাম।
চা শেষ করে আমরা উঠে পড়ি। পাবলিক লাইব্রেরির দিকে হাঁটি। এই অঞ্চলটুকু সব সময় প্রাণবন্ত থাকে। কোনো না কোনো প্রদর্শনী চলে, ফিল্ম শো হয়, নাটক হয়, সেমিনার হয়, মানববন্ধন হয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের শিল্পচিন্তা আর দেশভাবনার মধ্যবিত্ত এখানে এলে বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়।
পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়ির একটা কোণ ঘেঁষে বসি আমরা। সেতু আগের কথারই খেই ধরে, বাঙালি পুরুষ কি কখনো তার বউয়ের সত্তাকে নিজের সত্তার সমান মর্যাদা দেয়?
মর্যাদা দিচ্ছে কি না, সেটি বুঝবে কীভাবে?
এই ধরুন দুজনেই বাড়ির কাজগুলো সমানভাবে ভাগ করে করল।
একটা গল্পের কথা মনে করে আমি একটু জোরেই হেসে ফেলি।
সেতু প্রশ্নবোধক তাকায়।
একটা গল্প বলি, শোনো।
নববিবাহিত দম্পতির গল্প।
বাসর রাত। ভোরের দিকে ঘুম এসে গিয়েছিল বধূটির। সকাল সাতটায় তার কপালে মোলায়েম হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাকায়। দেখল তার স্বামী ট্রেতে করে পানি, ধূমায়িত খশবুদার চা আর খবরের কাগজ সাজিয়ে রেখেছে পাশের টিপয়ে। বউকে তাকাতে দেখে মধুর হাসল স্বামী। বলল, সাতটা বাজে। ওঠো। তোমার জন্য বেড টি এনেছি।
নববধূ মুগ্ধ।
মৃদুমন্দ গল্পের সঙ্গে চা খাওয়া হলো। স্বামী বলল, ওয়াশরুমে বাথটাবে গরম আর ঠান্ডা পানি মিশিয়ে রেখেছি তোমার জন্য। সাবান, তোয়ালে, শ্যাম্পু, ব্রাশ—সব ঠিকমতো রেখেছি।
সদ্যস্নাতা স্নিগ্ধ বধূ বাইরে বেরিয়ে দেখল নাশতার টেবিল নিখুঁতভাবে সাজানো। শুধু চেয়ার টেনে বসা আর খেতে শুরু করা। আহ্, কত চমৎকার স্বামী জুটেছে তার কপালে!
দুপুরেও একই ব্যাপার। সব রেডি করে রেখেছে স্বামী।
দুপুরের পর একটু গড়াগড়ি। কথা বলতে বলতে চোখ বুজে আসা। সন্ধ্যার মুখে চোখ খুলে বউটি দেখল তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে স্বামীর হাসিমুখ। সে চোখ মেলতেই স্বামী বলল, চলো। সান্ধ্য চা-জলখাবার তৈরি হয়ে গেছে।
সুখের আবেশে শরীর-মন আরও স্নিগ্ধ হয়ে গেল নববধূর।
রাত দশটা বাজতেই দেখা গেল ডিনার তৈরি।
রাতে শুয়ে শুয়ে নববধূ মন খুলে শোকরগোজারি করল আল্লাহর কাছে। কত ভাগ্য তার, এমন একটা স্বামী পেয়েছে। আগে যেসব মেয়ের কাছে স্বামীদের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শুনেছে সে, তাদের সবাইকে, এমনকি পুরো নারী জাতিকে মিথ্যেবাদী মনে হলো তার।
পরদিনও একই আনন্দে কাটল।
তার পরের দিনও।
এইভাবে পুরো এক সপ্তাহ। নববধূ তখন সুখের সাগরে ভাসছে।
সপ্তম রাতে স্বামী জিজ্ঞেস করল, এই কয় দিনে নিশ্চয়ই তোমার মুখস্থ হয়ে গেছে আমাদের রুটিন?
মাথা পুরো একদিকে হেলিয়ে সহাস্য বধূ জানাল, হ্যাঁ।
স্বামী বলল, গুড। আমার টিচিং তাহলে পারফেক্ট হয়েছে। কাল থেকে তুমি এই রুটিন মেনে সবকিছু করবে। কোনো কিছু যেন নড়চড় না হয়।
শব্দ করে হেসে ফেলল সেতু। হাসতে হাসতে বলল, পুরুষ মানুষ মানেই শয়তানের ডিব্বা।
কথাটা শুনে আমার মনে হলো, এ শুধু রাগের কথাই নয়, শয়তানের ডিব্বার প্রতি একটু প্রশ্রয়ও বটে। এই রকম প্রশ্রয়েই শয়তানের ডিব্বারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে। সেই কারণেই জীবনটা সহনযোগ্য হয়ে ওঠে।
সেতুকে দেখে মনে হলো কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু বলবে কি না, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আমি তাকে উৎসাহ জোগাই, কিছু একটা বলতে চাইছ মনে হচ্ছে?
না, মানে, ইয়ে আরকি! মানে আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে ঠিক কী বলা যাবে?
আমি হেসে উঠি শব্দ করে। উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি, তুমি জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ো?
পড়ি মানে? জীবনানন্দের কবিতা বাদ দিয়ে মানুষ থাকতে পারে? রোজ রোজ না পড়লেও পড়তে তো হবেই! কিন্তু আমার প্রশ্নের সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার কী সম্পর্ক?
আছে। সেটা পরে বলছি। এখন বলো, জীবনানন্দের কবিতা পড়ে তোমার কেমন অনুভূতি হয়?
কষ্ট হয় মাঝেমধ্যে।
শুধু কষ্ট?
না, মানে একধরনের বিষাদও।
আর?
সেতুকে বিভ্রান্ত দেখায়। বলে, আসলে কষ্ট, বিষাদ মিলিয়ে এমন একটা অনুভূতি হয়, যা ঠিক বলে বোঝানো যায় না। সেতু যেন লজ্জা পেয়েই বলে, আমি বোধ হয় জীবনানন্দ ঠিকমতো বুঝি না।
আমি তাকে আশ্বস্ত করি, তুমি ঠিকই বুঝেছ জীবনানন্দকে।
সেতুর বোধ হয় বিশ্বাস হয় না আমার কথা। প্রশ্ন করে, সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ। ঠিক বলছি।
সেতু অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, কী জানি! ঠিক বুঝি বলে মনে হয় না।
আমার মনে হয়েছে জীবনবাবুর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য পাঠকেরা খেয়াল করে না।
কী?
মানুষের অনুভূতিগুলোর নাম তো আমরা জানি। মনোবিজ্ঞানী, শরীরবিজ্ঞানী, আচরণবিজ্ঞানীরা মানুষের অনেকগুলো অনুভূতির নাম দিয়েছেন।
সেতু কথা বলে না। চোখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। বলি, কিন্তু এত দিনেও নিজেদের সব অনুভূতির নাম দিতে পারেনি মানুষ। আনন্দ, বেদনা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, বিষাদ, স্নেহ, ভালোবাসা, ঘৃণা, শোক, বিহ্বলতা—এই রকম কিছু শব্দ দিয়েই তো মানুষের রিপু আর অনুভূতিগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে। তাই না?
হুম।
কিন্তু আমরা জানি যে এই কয়েকটি নাম দিয়ে আমরা আমাদের মনের সব অনুভূতিকে ছকে ফেলতে পারি না। এমন সব অনুভূতি আমাদের মধ্যে যখন-তখন সক্রিয় ওঠে, যেগুলোর নাম আমরা জানি না। কোনো মানুষই জানে না। এই যে তুমি একটু আগে বললে যে কবিতা পড়ে কেমন যে লাগে, তা তুমি ঠিক শব্দ দিয়ে বোঝাতে পারছ না।
ঠিক বলেছেন।
জীবনানন্দ তাঁর কবিতাগুলোতে সেই সব অনুভূতিকে তুলে এনেছেন, এখনো যেগুলোর নাম দেওয়া হয়নি।
চকচক করে ওঠে সেতুর চোখ, ঠিক বলেছেন।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলি, সেই রকম মানুষে মানুষে কত রকমের সম্পর্ক যে হতে পারে, সেগুলোকেও মানুষ এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সেই রকমই একটা কিছু।
সেতুও উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটির পরিমিতিবোধ অসাধারণ। সে আমাকে আরেকটু বসার জন্য একবারও অনুরোধ করবে না।
আমরা দুজন একসঙ্গে হেঁটে যাই শাহবাগ মোড় পর্যন্ত। এবার সে চলে যাবে মিরপুরের দিকে। আর আমি মোহাম্মদপুরের দিকে। বিদায় নেওয়ার সময় সেতু অনুচ্চ কণ্ঠে জানতে চায়, আপনাকে আমি কী বলে ডাকব?
আমি বলি, সেটাও এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
সেতু কি আপনার নতুন গার্লফ্রেন্ড, ওস্তাদ?
না।
বন্ধু?
না।
তাহলে জাস্ট পরিচিত?
আমি একটু ভেবে বললাম, তার চাইতে একটু বেশি।
অবধারিত প্রতিক্রিয়া, বুঝলাম না।
জাস্ট পরিচিতির চাইতে একটু বেশি। তবে বন্ধুত্বের চাইতে কম। প্রেম-ট্রেমের তো প্রশ্নই ওঠে না।
এই রকম সম্পর্কের নাম তো শুনিনি! পরিচিতের চাইতে বেশি, আবার বন্ধুত্বের চেয়ে কম! কেমন কুয়াশা কুয়াশা লাগে।
নাম তো নেই। শুনব কোত্থেকে?
তখন তত্ত্ব চলে আসে। আসলেই তো অনেক কিছুই অদ্যাবধি হয়নি সংজ্ঞায়িত। আমাদের মনের মধ্যে কত রকমের অনুভূতি আছে। কিন্তু কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য, ভালোবাসা-ঘৃণা, বিষণ্নতা-আনন্দ—এই রকম কয়েকটা নাম দিয়ে তো আমরা জীবন কাটিয়ে দিই। কিন্তু অনুভূতি এবং বোধ তো আরও অনেক আছে। সেই যে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, কোনো এক বোধ কাজ করে!
ঠিক। সমাজ যেসব সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তার বাইরেও তো অনেক রকম সম্পর্ক আছে। সেগুলোর নাম দেওয়ার গরজ কারও নেই। নাম নেই। কিন্তু তারা আছে। সেই সব নাম না দেওয়া সম্পর্ক আছে।
আচ্ছা যাউকগা। আপনাগোর সম্পর্ক একদিন একটা নাম পরিগ্রহণ করব, ইনশা আল্লাহ! সেই খুশিতে আইসেন আমরা ধূম্রসহকারে আরেক পেয়ালা চা অগ্রিম পান কইরা লই!
তেমন কোনো সম্ভাবনা বা আশঙ্কা যে আদৌ নেই, সে কথা বলে আর জটিলতা বাড়াতে চাইলাম না।
অন্যরা তখন সমস্বরে বলে উঠেছে, আমেন!
দুই
সেতুর সঙ্গে আমার পরবর্তী দেখা প্রায় এক বছর পর। অবাক হয়ে খেয়াল করি, সেতু হুবহু সেই আগের মতোই আছে। আমি কুশল বিনিময়ের আগেই প্রশ্ন করি, এখনো বিয়ে করোনি কেন?
সাহস হয় না। সেতু উত্তর দেয়, পুরুষ মানুষকে তো আমি তেমনভাবে চিনি না। একসঙ্গে একজীবন কাটানো কি সহজ ব্যাপার হবে মনে করেন?
কোনো মধ্যপন্থা না নিয়ে আমি সরাসরিই বলি, না। মোটেই সহজ হবে না। সহজ হয় না। কোনো দিনই সহজ ছিল না।
পুরুষতন্ত্র খুবই খারাপ।
আমি বলি, শুধু যে পুরুষতন্ত্রই দায়ী তা নয়, অসংখ্য জিনিস আছে যেগুলো দুইজন মানুষের সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
টিএসসির বহির্দেয়াল ঘেঁষে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানগুলোর একটার বেঞ্চিতে বসি আমরা। চারপাশে শব্দ। মানুষ কথা বলছে অবিরাম। আমি একটু হাসি। সেতু জিজ্ঞেস করে, আপনি হাসলেন কী দেখে?
চারপাশে কত রকমের শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
এত শব্দের মধ্যে আমাদের তো বেশ জোরে জোরে কথা বলতে হবে। তা না হলে পাশাপাশি বসেও আমরা পরস্পরের কথা ভালো করে শুনতে পাব না।
সেতু বলে, তা ঠিক। অস্বস্তিকর। অন্যদের কানেও কথাগুলো চলে যাবে।
আমি বলি, না, যাবে না। সবাই নিজের নিজের সঙ্গীকে শোনানোর জন্য উচ্চ শব্দ দিয়ে কথা বলছে। আর বাড়তি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে। তাই এই ভিড়ের মধ্যেও আমাদের শব্দের প্রাইভেসি বজায় থাকবে। সেই কথাটা মনে করেই হেসেছিলাম।
চায়ে চুমুক দিয়ে সেতু বলে, পুরুষেরা কোনো দিন বোধ হয় বউদের নিজেদের সমান করে ভাবতে পারে না, তাই না?
এ কথা কেন মনে হলো?
যতজন বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই এই কথাটাই বলেছে। স্বামীর মন রাখার জন্য প্রত্যেক মেয়েকেই তার নিজের ইগো বিসর্জন দিতে হয়। তা ছাড়া নিজের মা-বাবাকে তো দেখেছি। বাবা তো আমার চোখে বাবা। আমার নির্ভরতা। আমার আশ্রয়। কিন্তু যখন মায়ের সঙ্গে তার আচরণগুলো বিশ্লেষণ করতে বসি, তখন দেখি একজন পুরুষ তার সিদ্ধান্তগুলো চাপিয়ে দিচ্ছে নারীর ওপর।
আমি বলি, পুরোপুরি বেঠিক বলা যাবে না তোমার কথা।
সেতু জোর দিয়ে বলে, বেঠিক কেন হবে? বরং পুরোপুরিই সঠিক।
তোমার মা-ও কিছু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় বাবার ওপর। সেগুলো হয়তো তুমি খেয়াল করোনি।
সেতু যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারে। পুরোপুরি অস্বীকার করে না আমার কথা। বলে, হতে পারে। তবে খুব সাদাচোখে যা দেখা যায়, আমি সেটাই বললাম।
চা শেষ করে আমরা উঠে পড়ি। পাবলিক লাইব্রেরির দিকে হাঁটি। এই অঞ্চলটুকু সব সময় প্রাণবন্ত থাকে। কোনো না কোনো প্রদর্শনী চলে, ফিল্ম শো হয়, নাটক হয়, সেমিনার হয়, মানববন্ধন হয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের শিল্পচিন্তা আর দেশভাবনার মধ্যবিত্ত এখানে এলে বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়।
পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়ির একটা কোণ ঘেঁষে বসি আমরা। সেতু আগের কথারই খেই ধরে, বাঙালি পুরুষ কি কখনো তার বউয়ের সত্তাকে নিজের সত্তার সমান মর্যাদা দেয়?
মর্যাদা দিচ্ছে কি না, সেটি বুঝবে কীভাবে?
এই ধরুন দুজনেই বাড়ির কাজগুলো সমানভাবে ভাগ করে করল।
একটা গল্পের কথা মনে করে আমি একটু জোরেই হেসে ফেলি।
সেতু প্রশ্নবোধক তাকায়।
একটা গল্প বলি, শোনো।
নববিবাহিত দম্পতির গল্প।
বাসর রাত। ভোরের দিকে ঘুম এসে গিয়েছিল বধূটির। সকাল সাতটায় তার কপালে মোলায়েম হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাকায়। দেখল তার স্বামী ট্রেতে করে পানি, ধূমায়িত খশবুদার চা আর খবরের কাগজ সাজিয়ে রেখেছে পাশের টিপয়ে। বউকে তাকাতে দেখে মধুর হাসল স্বামী। বলল, সাতটা বাজে। ওঠো। তোমার জন্য বেড টি এনেছি।
নববধূ মুগ্ধ।
মৃদুমন্দ গল্পের সঙ্গে চা খাওয়া হলো। স্বামী বলল, ওয়াশরুমে বাথটাবে গরম আর ঠান্ডা পানি মিশিয়ে রেখেছি তোমার জন্য। সাবান, তোয়ালে, শ্যাম্পু, ব্রাশ—সব ঠিকমতো রেখেছি।
সদ্যস্নাতা স্নিগ্ধ বধূ বাইরে বেরিয়ে দেখল নাশতার টেবিল নিখুঁতভাবে সাজানো। শুধু চেয়ার টেনে বসা আর খেতে শুরু করা। আহ্, কত চমৎকার স্বামী জুটেছে তার কপালে!
দুপুরেও একই ব্যাপার। সব রেডি করে রেখেছে স্বামী।
দুপুরের পর একটু গড়াগড়ি। কথা বলতে বলতে চোখ বুজে আসা। সন্ধ্যার মুখে চোখ খুলে বউটি দেখল তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে স্বামীর হাসিমুখ। সে চোখ মেলতেই স্বামী বলল, চলো। সান্ধ্য চা-জলখাবার তৈরি হয়ে গেছে।
সুখের আবেশে শরীর-মন আরও স্নিগ্ধ হয়ে গেল নববধূর।
রাত দশটা বাজতেই দেখা গেল ডিনার তৈরি।
রাতে শুয়ে শুয়ে নববধূ মন খুলে শোকরগোজারি করল আল্লাহর কাছে। কত ভাগ্য তার, এমন একটা স্বামী পেয়েছে। আগে যেসব মেয়ের কাছে স্বামীদের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শুনেছে সে, তাদের সবাইকে, এমনকি পুরো নারী জাতিকে মিথ্যেবাদী মনে হলো তার।
পরদিনও একই আনন্দে কাটল।
তার পরের দিনও।
এইভাবে পুরো এক সপ্তাহ। নববধূ তখন সুখের সাগরে ভাসছে।
সপ্তম রাতে স্বামী জিজ্ঞেস করল, এই কয় দিনে নিশ্চয়ই তোমার মুখস্থ হয়ে গেছে আমাদের রুটিন?
মাথা পুরো একদিকে হেলিয়ে সহাস্য বধূ জানাল, হ্যাঁ।
স্বামী বলল, গুড। আমার টিচিং তাহলে পারফেক্ট হয়েছে। কাল থেকে তুমি এই রুটিন মেনে সবকিছু করবে। কোনো কিছু যেন নড়চড় না হয়।
শব্দ করে হেসে ফেলল সেতু। হাসতে হাসতে বলল, পুরুষ মানুষ মানেই শয়তানের ডিব্বা।
কথাটা শুনে আমার মনে হলো, এ শুধু রাগের কথাই নয়, শয়তানের ডিব্বার প্রতি একটু প্রশ্রয়ও বটে। এই রকম প্রশ্রয়েই শয়তানের ডিব্বারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে। সেই কারণেই জীবনটা সহনযোগ্য হয়ে ওঠে।
সেতুকে দেখে মনে হলো কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু বলবে কি না, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আমি তাকে উৎসাহ জোগাই, কিছু একটা বলতে চাইছ মনে হচ্ছে?
না, মানে, ইয়ে আরকি! মানে আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে ঠিক কী বলা যাবে?
আমি হেসে উঠি শব্দ করে। উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি, তুমি জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ো?
পড়ি মানে? জীবনানন্দের কবিতা বাদ দিয়ে মানুষ থাকতে পারে? রোজ রোজ না পড়লেও পড়তে তো হবেই! কিন্তু আমার প্রশ্নের সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার কী সম্পর্ক?
আছে। সেটা পরে বলছি। এখন বলো, জীবনানন্দের কবিতা পড়ে তোমার কেমন অনুভূতি হয়?
কষ্ট হয় মাঝেমধ্যে।
শুধু কষ্ট?
না, মানে একধরনের বিষাদও।
আর?
সেতুকে বিভ্রান্ত দেখায়। বলে, আসলে কষ্ট, বিষাদ মিলিয়ে এমন একটা অনুভূতি হয়, যা ঠিক বলে বোঝানো যায় না। সেতু যেন লজ্জা পেয়েই বলে, আমি বোধ হয় জীবনানন্দ ঠিকমতো বুঝি না।
আমি তাকে আশ্বস্ত করি, তুমি ঠিকই বুঝেছ জীবনানন্দকে।
সেতুর বোধ হয় বিশ্বাস হয় না আমার কথা। প্রশ্ন করে, সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ। ঠিক বলছি।
সেতু অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, কী জানি! ঠিক বুঝি বলে মনে হয় না।
আমার মনে হয়েছে জীবনবাবুর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য পাঠকেরা খেয়াল করে না।
কী?
মানুষের অনুভূতিগুলোর নাম তো আমরা জানি। মনোবিজ্ঞানী, শরীরবিজ্ঞানী, আচরণবিজ্ঞানীরা মানুষের অনেকগুলো অনুভূতির নাম দিয়েছেন।
সেতু কথা বলে না। চোখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। বলি, কিন্তু এত দিনেও নিজেদের সব অনুভূতির নাম দিতে পারেনি মানুষ। আনন্দ, বেদনা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, বিষাদ, স্নেহ, ভালোবাসা, ঘৃণা, শোক, বিহ্বলতা—এই রকম কিছু শব্দ দিয়েই তো মানুষের রিপু আর অনুভূতিগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে। তাই না?
হুম।
কিন্তু আমরা জানি যে এই কয়েকটি নাম দিয়ে আমরা আমাদের মনের সব অনুভূতিকে ছকে ফেলতে পারি না। এমন সব অনুভূতি আমাদের মধ্যে যখন-তখন সক্রিয় ওঠে, যেগুলোর নাম আমরা জানি না। কোনো মানুষই জানে না। এই যে তুমি একটু আগে বললে যে কবিতা পড়ে কেমন যে লাগে, তা তুমি ঠিক শব্দ দিয়ে বোঝাতে পারছ না।
ঠিক বলেছেন।
জীবনানন্দ তাঁর কবিতাগুলোতে সেই সব অনুভূতিকে তুলে এনেছেন, এখনো যেগুলোর নাম দেওয়া হয়নি।
চকচক করে ওঠে সেতুর চোখ, ঠিক বলেছেন।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলি, সেই রকম মানুষে মানুষে কত রকমের সম্পর্ক যে হতে পারে, সেগুলোকেও মানুষ এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সেই রকমই একটা কিছু।
সেতুও উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটির পরিমিতিবোধ অসাধারণ। সে আমাকে আরেকটু বসার জন্য একবারও অনুরোধ করবে না।
আমরা দুজন একসঙ্গে হেঁটে যাই শাহবাগ মোড় পর্যন্ত। এবার সে চলে যাবে মিরপুরের দিকে। আর আমি মোহাম্মদপুরের দিকে। বিদায় নেওয়ার সময় সেতু অনুচ্চ কণ্ঠে জানতে চায়, আপনাকে আমি কী বলে ডাকব?
আমি বলি, সেটাও এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
No comments