নির্বাচনের আগে সোস্যাল মিডিয়ার ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’
জাতীয়
নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর ব্যপকহারে নজরদারি শুরু
করেছে বাংলাদেশ সরকার। ফলে বাকস্বাধীনতার ওপর শীতল প্রভাব পড়ার আশঙ্কা
বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ শুক্রবার এক বিবৃতিতে
এমন মন্তব্য করেছে।
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক, ইন্টারনেটে মন্তব্যকারী ও সম্প্রচার ব্যক্তিত্বদের টার্গেট করতে নিপীড়নমূলক আইন ও নীতিমালা ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। বিরোধী দলসমূহ ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ক্রমবর্ধমান এই দমনপীড়ন মূলত নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের সমালোচনা ও বাকস্বাধীনতা সীমিত করার চেষ্টা। সরকার দাবি করছে, ক্ষতিকর গুজব, মিথ্যা তথ্য অথবা আপত্তিকর বিষয়বস্তুর লাগাম টেনে ধরে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতেই এসব প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।
তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের স্তব্ধ করতে জননিরাপত্তার কারণকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের আগে আগে সরকারের নজরদারিমূলক চর্চা মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘণ করছে।’
বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশে ও বিক্ষোভ আয়োজনে সোস্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে পরিণত হওয়ার পর থেকেই, কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগের ওপর নজরদারি শুরু করেছে।
এর ফলে ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের সমালোচনা করার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বর্ধিত নজরদারি
২০১৮ সালের ৯ই অক্টোবর, সরকার ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গুজব সনাক্ত’ করতে নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি নজরদারি সেল গঠন করার ঘোষণা দেয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, যেসব বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে কিংবা রাষ্ট্রকে বিব্রত করে সেসবকে গুজব হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এবং, ফিল্টারিং কিংবা ব্লকিং-এর জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, শুধুমাত্র মানুষ যাতে ‘শুধু সঠিক তথ্য’ পায় তা নিশ্চিত করাই এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকেও অনলাইনে তাদের নজরদারি বৃদ্ধি করার আদেশ দিয়েছে। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এই প্যারামিলিটারি বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বলপূর্বক অন্তর্ধানসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট। র্যাবের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘দেশের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছাড়াও আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশুভ অপপ্রচার ও জঙ্গি তৎপরতা নজরদারি করা এবং নেপথ্যের ব্যক্তিদেরকে বিচারের আওতায় আনতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবো।’
সরকার ইতিপূর্বে ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্পের ঘোষণা দিয়ে বলেছিল, বাংলাদেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে গণনজরদারি যন্ত্রপাতি ইন্সটল করা হবে। এর মাধ্যমে ব্যপকহারে টেলিকম ও ইন্টারনেট নজরদারির সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। অপরাধ কর্মকান্ডের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে কর্তৃপক্ষকে সহায়তার জন্য এই প্রকল্পের নকশা করা হয়েছে। তবে এর মাধ্যমে মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নজরদারি করার বিপুল ক্ষমতা পেয়েছে সরকার। ফলে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা গণহারে লঙ্ঘণের আশঙ্কা বেড়েছে।
ভিন্নমতের ওপর দমনপীড়ন
টেলিভিশন নেটওয়ার্কসমূহ ইতিমধ্যেই সরকারের চাপে রয়েছে। প্রস্তাবিত জাতীয় সম্প্রচার আইন ২০১৮-এর অধীনে তারা বর্ধিত বিধিনিষেধের আওতায় পড়বে। এই আইন ১৫ই অক্টোবর মন্ত্রীসভা অনুমোদন দিয়েছে। আইনে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যাওয়া কিংবা বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
১১ই অক্টোবর, প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য অ্যাক্টিভিস্ট ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, যিনি বিরোধী রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত, তার বিরুদ্ধে টেলিভিশন টকশোতে সেনাপ্রধানের সমালোচনা করায় পুলিশি অভিযোগ (জিডি) দায়ের করা হয়েছে। গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।
১০ই অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নামে একটি আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারাকে প্রতিস্থাপন করেছে, যেই ধারায় শাস্তি আরও কঠোর ও যেটি বিভিন্ন দিক দিয়ে অনেক বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত। এই নতুন আইনানুযায়ী যেসব অনলাইন তথ্য ‘দেশ বা দেশের অংশবিশেষের ঐক্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জননিরাপত্তাকে বিনষ্ট করে কিংবা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার করে’ সেসব মুছে ফেলা বা ব্লক করতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যপক কিছু ক্ষমতা পাবে।
এই আইনের নয়টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সাংবাদিকরা। সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ৩রা অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘শুধুমাত্র যেসব সাংবাদিক আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করেছে এবং নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর একের পর এক আরও মিথ্যা সংবাদ ছড়াতে অপেক্ষা করছে, তাদেরই এই আইন নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিৎ।’
তবে সাংবাদিকদের চিন্তিত হওয়ার কারণ রয়েছে, কারণ রাষ্ট্রদ্রোহ ও ফৌজদারি মানহানি বিষয়ক বিদ্যমান আইনসমূহকে সাংবাদিকদের হুমকি দিতে বা আটক করতে ব্যবহার করা হয়েছে বাকস্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশ চর্চার কারণে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংবাদিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ‘দেশের ওপর ভয়ের আচ্ছাদন বিরাজ করছে। আমরা জানি না কখন আমরা মুক্তি পাব।’
আরও উদ্বেগ রয়েছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি, আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার মতোই, সোস্যাল মিডিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিষয়বস্তু দমনে ব্যবহৃত হবে।
৪ঠা আগস্ট রাতে পুলিশ নুসরাত জাহান সোনিয়া নামে ২৫ বছর বয়সী একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে পাটুয়াখালি জেলার প্রত্যন্ত এক অঞ্চল থেকে আটক করে। তিনি তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ৫৭ ধারার অধীনে তাকে ২ সপ্তাহ আটক রাখে পুলিশ। সোনিয়ার কথিত অভিযোগ ছিল গুজব ছড়ানো। তবে তার পরিবারের এক সদস্য বলেছেন, তিনি স্রেফ একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করেছিলেন যেখানে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে চলা ছাত্র আন্দোলনে সতর্ক ও শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই মামলার নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত তাকে সরকারী স্কুলের চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, যা হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
প্রায় একই ধরণের আরেক মামলায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে। তিনিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘মানহানিকর’ বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে ৫৭ ধারায় অভিযুক্ত।
৫ই আগস্ট আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে ঢাকায় আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রতিবাদকারী ও সাংবাদিকদের ওপর দমনপীড়নের সমালোচনা করে ফেসবুকে মন্তব্য করার মাধ্যমে অস্থিরতা ‘উস্কে’ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। তিনি এখনও কারাগারে। এক জামিন শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, ‘শহীদুল অনেকটা রাজনৈতিক নেতার মতো মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য ছিল মিথ্যা ও বিদ্বেষপূর্ণ। আগামী সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। শহীদুলের বক্তব্যে এমন অনেক উপাদান রয়েছে যা দেশকে অস্থির করে তুলতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদুলের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা সংবাদ’ প্রচার ও ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ হওয়ার অভিযোগ এনেছেন।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংবিধির অধীনে বাংলাদেশ বাছবিচারহীন গ্রেপ্তার থেকে, তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও যোগাযোগের ওপর বাছবিচারহীন বা অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে তাদেরকে এবং তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে বাধ্য। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও বাকস্বাধীনতার অধিকারের ওপর যেকোনো হস্তক্ষেপ স্পষ্ট আইনের মাধ্যমে যৌক্তিক কারণে করতে হবে। এবং, এটি অবশ্যই আনুপাতিক হতে হবে, অর্থাৎ যতটা কম হস্তক্ষেপ করা সম্ভব। সরকার ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের শান্তিপূর্ণ সমালোচনাকে সবসময়ই অনুমোদন দিতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নজরদারি করা ও সরকারকে বিব্রত করে এমন ব্যবহারকারীদের বিচারের আওতায় আনার যেসব নির্দেশনা নিরাপত্তা সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক বিধান উপর্যুক্ত অধিকারকে লঙ্ঘণ করে।
ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাংবাদিকতা ও বাক স্বাধীনতার জন্য শীতল পরিবেশ বিরাজ করছে। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অস্পষ্ট পোস্ট শেয়ার করছেন, তারাও এমনকি গ্রেপ্তার ও হয়রানির ঝুঁকিতে রয়েছেন। সরকারের উচিৎ এখনই মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারের ওপর এই আক্রমণ বন্ধ করা। বাংলাদেশীরা যাতে কোনো ভয় ছাড়াই তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারে সেজন্য উপযোগি পরিবেশ তৈরি করা।’
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক, ইন্টারনেটে মন্তব্যকারী ও সম্প্রচার ব্যক্তিত্বদের টার্গেট করতে নিপীড়নমূলক আইন ও নীতিমালা ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। বিরোধী দলসমূহ ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ক্রমবর্ধমান এই দমনপীড়ন মূলত নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের সমালোচনা ও বাকস্বাধীনতা সীমিত করার চেষ্টা। সরকার দাবি করছে, ক্ষতিকর গুজব, মিথ্যা তথ্য অথবা আপত্তিকর বিষয়বস্তুর লাগাম টেনে ধরে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতেই এসব প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।
তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের স্তব্ধ করতে জননিরাপত্তার কারণকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের আগে আগে সরকারের নজরদারিমূলক চর্চা মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘণ করছে।’
বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। ভিন্নমত প্রকাশে ও বিক্ষোভ আয়োজনে সোস্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে পরিণত হওয়ার পর থেকেই, কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগের ওপর নজরদারি শুরু করেছে।
এর ফলে ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের সমালোচনা করার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বর্ধিত নজরদারি
২০১৮ সালের ৯ই অক্টোবর, সরকার ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গুজব সনাক্ত’ করতে নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি নজরদারি সেল গঠন করার ঘোষণা দেয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, যেসব বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে কিংবা রাষ্ট্রকে বিব্রত করে সেসবকে গুজব হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এবং, ফিল্টারিং কিংবা ব্লকিং-এর জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, শুধুমাত্র মানুষ যাতে ‘শুধু সঠিক তথ্য’ পায় তা নিশ্চিত করাই এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকেও অনলাইনে তাদের নজরদারি বৃদ্ধি করার আদেশ দিয়েছে। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এই প্যারামিলিটারি বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বলপূর্বক অন্তর্ধানসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট। র্যাবের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘দেশের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছাড়াও আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশুভ অপপ্রচার ও জঙ্গি তৎপরতা নজরদারি করা এবং নেপথ্যের ব্যক্তিদেরকে বিচারের আওতায় আনতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবো।’
সরকার ইতিপূর্বে ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্পের ঘোষণা দিয়ে বলেছিল, বাংলাদেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে গণনজরদারি যন্ত্রপাতি ইন্সটল করা হবে। এর মাধ্যমে ব্যপকহারে টেলিকম ও ইন্টারনেট নজরদারির সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। অপরাধ কর্মকান্ডের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে কর্তৃপক্ষকে সহায়তার জন্য এই প্রকল্পের নকশা করা হয়েছে। তবে এর মাধ্যমে মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নজরদারি করার বিপুল ক্ষমতা পেয়েছে সরকার। ফলে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা গণহারে লঙ্ঘণের আশঙ্কা বেড়েছে।
ভিন্নমতের ওপর দমনপীড়ন
টেলিভিশন নেটওয়ার্কসমূহ ইতিমধ্যেই সরকারের চাপে রয়েছে। প্রস্তাবিত জাতীয় সম্প্রচার আইন ২০১৮-এর অধীনে তারা বর্ধিত বিধিনিষেধের আওতায় পড়বে। এই আইন ১৫ই অক্টোবর মন্ত্রীসভা অনুমোদন দিয়েছে। আইনে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যাওয়া কিংবা বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
১১ই অক্টোবর, প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য অ্যাক্টিভিস্ট ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, যিনি বিরোধী রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত, তার বিরুদ্ধে টেলিভিশন টকশোতে সেনাপ্রধানের সমালোচনা করায় পুলিশি অভিযোগ (জিডি) দায়ের করা হয়েছে। গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।
১০ই অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নামে একটি আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারাকে প্রতিস্থাপন করেছে, যেই ধারায় শাস্তি আরও কঠোর ও যেটি বিভিন্ন দিক দিয়ে অনেক বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত। এই নতুন আইনানুযায়ী যেসব অনলাইন তথ্য ‘দেশ বা দেশের অংশবিশেষের ঐক্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জননিরাপত্তাকে বিনষ্ট করে কিংবা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার করে’ সেসব মুছে ফেলা বা ব্লক করতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যপক কিছু ক্ষমতা পাবে।
এই আইনের নয়টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সাংবাদিকরা। সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ৩রা অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘শুধুমাত্র যেসব সাংবাদিক আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করেছে এবং নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর একের পর এক আরও মিথ্যা সংবাদ ছড়াতে অপেক্ষা করছে, তাদেরই এই আইন নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিৎ।’
তবে সাংবাদিকদের চিন্তিত হওয়ার কারণ রয়েছে, কারণ রাষ্ট্রদ্রোহ ও ফৌজদারি মানহানি বিষয়ক বিদ্যমান আইনসমূহকে সাংবাদিকদের হুমকি দিতে বা আটক করতে ব্যবহার করা হয়েছে বাকস্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশ চর্চার কারণে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংবাদিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ‘দেশের ওপর ভয়ের আচ্ছাদন বিরাজ করছে। আমরা জানি না কখন আমরা মুক্তি পাব।’
আরও উদ্বেগ রয়েছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি, আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার মতোই, সোস্যাল মিডিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিষয়বস্তু দমনে ব্যবহৃত হবে।
৪ঠা আগস্ট রাতে পুলিশ নুসরাত জাহান সোনিয়া নামে ২৫ বছর বয়সী একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে পাটুয়াখালি জেলার প্রত্যন্ত এক অঞ্চল থেকে আটক করে। তিনি তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ৫৭ ধারার অধীনে তাকে ২ সপ্তাহ আটক রাখে পুলিশ। সোনিয়ার কথিত অভিযোগ ছিল গুজব ছড়ানো। তবে তার পরিবারের এক সদস্য বলেছেন, তিনি স্রেফ একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করেছিলেন যেখানে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে চলা ছাত্র আন্দোলনে সতর্ক ও শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই মামলার নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত তাকে সরকারী স্কুলের চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, যা হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
প্রায় একই ধরণের আরেক মামলায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে। তিনিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘মানহানিকর’ বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে ৫৭ ধারায় অভিযুক্ত।
৫ই আগস্ট আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে ঢাকায় আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রতিবাদকারী ও সাংবাদিকদের ওপর দমনপীড়নের সমালোচনা করে ফেসবুকে মন্তব্য করার মাধ্যমে অস্থিরতা ‘উস্কে’ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। তিনি এখনও কারাগারে। এক জামিন শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, ‘শহীদুল অনেকটা রাজনৈতিক নেতার মতো মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য ছিল মিথ্যা ও বিদ্বেষপূর্ণ। আগামী সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। শহীদুলের বক্তব্যে এমন অনেক উপাদান রয়েছে যা দেশকে অস্থির করে তুলতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদুলের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা সংবাদ’ প্রচার ও ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ হওয়ার অভিযোগ এনেছেন।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংবিধির অধীনে বাংলাদেশ বাছবিচারহীন গ্রেপ্তার থেকে, তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও যোগাযোগের ওপর বাছবিচারহীন বা অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে তাদেরকে এবং তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে বাধ্য। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও বাকস্বাধীনতার অধিকারের ওপর যেকোনো হস্তক্ষেপ স্পষ্ট আইনের মাধ্যমে যৌক্তিক কারণে করতে হবে। এবং, এটি অবশ্যই আনুপাতিক হতে হবে, অর্থাৎ যতটা কম হস্তক্ষেপ করা সম্ভব। সরকার ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের শান্তিপূর্ণ সমালোচনাকে সবসময়ই অনুমোদন দিতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নজরদারি করা ও সরকারকে বিব্রত করে এমন ব্যবহারকারীদের বিচারের আওতায় আনার যেসব নির্দেশনা নিরাপত্তা সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক বিধান উপর্যুক্ত অধিকারকে লঙ্ঘণ করে।
ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাংবাদিকতা ও বাক স্বাধীনতার জন্য শীতল পরিবেশ বিরাজ করছে। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অস্পষ্ট পোস্ট শেয়ার করছেন, তারাও এমনকি গ্রেপ্তার ও হয়রানির ঝুঁকিতে রয়েছেন। সরকারের উচিৎ এখনই মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারের ওপর এই আক্রমণ বন্ধ করা। বাংলাদেশীরা যাতে কোনো ভয় ছাড়াই তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারে সেজন্য উপযোগি পরিবেশ তৈরি করা।’
No comments