থেমে নেই ৫৭ ধারায় মামলা by মহিউদ্দিন অদুল
মত
প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থি হিসেবে ব্যাপক বিতর্কিত বিধান তথ্য ও
যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন-২০০৬ এর ৫৭ ধারা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে
চলতি বছরের ২৯শে জানুয়ারি আইনটির ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্তির
বিধান রেখেই মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয়া
হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে তখন তা অনুমোদন দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপন বা পাস হয়নি। এ ছাড়া নানাভাবে আইনটির অপপ্রয়োগ ঠেকানোর কথা বলা হলেও থামেনি ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের। পুলিশ সদরদপ্তরের অনুমতি ছাড়া মামলা না নিতে বলা হলেও প্রায় প্রতি মাসে একাধিক মামলা হচ্ছে বিভিন্ন থানা ও আদালতে। এর মধ্যে বেশির ভাগ মামলাই হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এর বেশির ভাগই ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ বিভিন্নজনকে অবমাননার’ অভিযোগে। ফলে বিলুপ্ত হওয়ার আগে এই মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে যেখানে আলোচনা হচ্ছে সেখানে দ্বৈতনীতিতে বিতর্কিত বিধানটিতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হয়রানি অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভিকটিমরা।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সদ্য নির্বাচিত সভাপতি মোল্লা জালাল মানবজমিনকে বলেন, আমরা পুরো সাংবাদিক সমাজই মত প্রকাশের পরিপন্থি ৫৭ ধারার বিপক্ষে। ইতিপূর্বে বিএফইউজের বিগত কমিটির নেতৃবৃন্দ আইনটি বাতিলের জন্য সরকারকে নানাভাবে জানিয়েছে। আইনটি নিয়ে এখন স্ববিরোধী দ্বৈতনীতি কাজ করছে। একদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমতি ছাড়া মামলা না নিতে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে আদালতে গেলে তদন্তের ভার পড়ছে পুলিশের উপর। তারপর মামলা হচ্ছে। একদিকে মন্ত্রিপরিষদ সভায় নতুন আইনের খসড়া অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ওই আইনের ৫ ধারাটি বিলুপ্তির অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। তাতে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমরা তা আর চাই না। আইনটি বিলুপ্ত হলে ওই আইনে দায়ের করা সাংবাদিকদের সব মামলাও বিলুপ্ত বা তামাদি করতে হবে।
জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড :৫৭। (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সমপ্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
এই আইনটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে উল্লেখ করে সাংবাদিকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ তা বিলুপ্ত করার জন্য সোচ্চার হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ওই আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা পুরোপুরি বিলুপ্তির বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। চলতি বছরের ২৯শে জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভায় নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বহুল আলোচিত কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করা হলেও ৫৭ ধারায় বর্ণিত অপরাধ ও শাস্তির বিধান পুনর্বিন্যাস করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া, ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
অপর দিকে আইনটি অপপ্রয়োগ ঠেকানোর কথা বলা হলেও চলতি মাসেই ৫৭ ধারায় অন্তত ডজন খানেক মামলা হয়েছে। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটূক্তি করার অভিযোগে গত ২৩শে জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন এক ছাত্রলীগ নেতা। হাটহাজারি থানায় মামলাটি করেন চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সদস্য ইফতেখার উদ্দিন। ২০ জুলাই কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাংবাদিক ইউনিয়ন কুষ্টিয়ার সভাপতি ও বিএফইউজের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব বাদী হয়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক জাফর ওয়াজেদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন।
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নির্বাচন নিয়ে জাফর ওয়াজেদ নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘মৃত ব্যক্তির ভোট দান’ শিরোনামে একটি লেখার জন্য মামলাটি করা হয়। বাদী এতে বিএফইউজের নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ কয়েকজনের সম্মানহানি ও কটূক্তির অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ১লা জুলাই কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের বিরুদ্ধে একই ধারায় মামলার পর তাকে দীর্ঘ রিমান্ডে নেয়া হয়। ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন। অবশ্য অন্যদের বিরুদ্ধে এই ধারায় না হলেও অন্য ধারায় মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, রাশেদ খান ফেসবুক লাইভে মিথ্যা, মানহানিকর ও নাশকতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। কিছু বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রীর মানহানিকর ছিল।
এর আগে ৪ঠা জুলাই দিনাজপুরের হাকিমপুর থানায় পৌর ছাত্রলীগ সভাপতি মো. তরিকুল সরকার বাদী হয়ে ৫৭ ধারায় সাকিল ইসলাম (২০) নামে অপর এক যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মান ক্ষুণ্নের লক্ষ্যে ফেসবুকে বিকৃত ছবি পোস্ট করার অভিযোগে মামলাটি (মামলা নং-০৮) করা হয়। এ মামলায় সে দিনই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার আগে ৬ই মে জামালপুর সদর থানায় উপজেলা সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা শবনম মোস্তারী ও দৈনিক ইত্তেফাকের জামালপুর প্রতিনিধি হালিম দুলালকে আসামি করে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে। শবনম এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখার পর ওই দু’জনকে আসামি করে সদর উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
সম্মানহানির অভিযোগে গত ১৬ই মার্চ রাজধানীর আদাবর থানায় এক তরুণীর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা (মামলা নং-১৮) করেন চলচ্চিত্র পরিচালক গাজী রাকায়েত। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম ও তার ব্যক্তিগত সহকারী রাশেদুল কায়ছার ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে ফেসবুকে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে গত ১৬ই মে গ্রেপ্তার হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান লিটন। ৫৭ ধারায় মামলাটি করেন কুটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমান স্বপন। একই সময় পুলিশ সদরদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে ৭টি মামলা করা হয়। চলতি বছরের ২২শে এপ্রিল বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) পরিচালক লুনা শামসুদ্দোহার মামলায় একই সংগঠনের সদস্য বেঙ্গল ক্রিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর আগে ১০ই এপ্রিল তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গুলশান থানায় মামলাটি করেন লুনা। ২২শে এপ্রিল দেশের জনপ্রিয় চাকরির অনলাইন পোর্টাল বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী একেএম ফাহিম মাসরুর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ছবির ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আপলোড ও অপমানমূলক স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর কাফরুল থানায় ৫৭ ধারায় মামলা করেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাবেক গণশিক্ষা সম্পাদক মো. আল সাদিক। এই মামলায় গত ২৫শে এপ্রিল পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের সদস্যরা গ্রেপ্তারের পর আবার ছেড়ে দেয়।
সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের হয় ৭৪০টি মামলা। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা হয়েছে ৫৭ ধারায়। ২০১৩ সালে প্রথম তিনটি মামলা হয়। এরপর প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে সারা দেশে ৩৩টি মামলা হলেও ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২টিতে। ২০১৬ সালে ৫৭ ধারায় মামলা হয় ২৩৩টি, আর ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই ধারায় মামলা হয়েছে ৩২৩টি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে তখন তা অনুমোদন দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপন বা পাস হয়নি। এ ছাড়া নানাভাবে আইনটির অপপ্রয়োগ ঠেকানোর কথা বলা হলেও থামেনি ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের। পুলিশ সদরদপ্তরের অনুমতি ছাড়া মামলা না নিতে বলা হলেও প্রায় প্রতি মাসে একাধিক মামলা হচ্ছে বিভিন্ন থানা ও আদালতে। এর মধ্যে বেশির ভাগ মামলাই হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এর বেশির ভাগই ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ বিভিন্নজনকে অবমাননার’ অভিযোগে। ফলে বিলুপ্ত হওয়ার আগে এই মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে যেখানে আলোচনা হচ্ছে সেখানে দ্বৈতনীতিতে বিতর্কিত বিধানটিতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হয়রানি অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভিকটিমরা।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সদ্য নির্বাচিত সভাপতি মোল্লা জালাল মানবজমিনকে বলেন, আমরা পুরো সাংবাদিক সমাজই মত প্রকাশের পরিপন্থি ৫৭ ধারার বিপক্ষে। ইতিপূর্বে বিএফইউজের বিগত কমিটির নেতৃবৃন্দ আইনটি বাতিলের জন্য সরকারকে নানাভাবে জানিয়েছে। আইনটি নিয়ে এখন স্ববিরোধী দ্বৈতনীতি কাজ করছে। একদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমতি ছাড়া মামলা না নিতে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে আদালতে গেলে তদন্তের ভার পড়ছে পুলিশের উপর। তারপর মামলা হচ্ছে। একদিকে মন্ত্রিপরিষদ সভায় নতুন আইনের খসড়া অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ওই আইনের ৫ ধারাটি বিলুপ্তির অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। তাতে সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমরা তা আর চাই না। আইনটি বিলুপ্ত হলে ওই আইনে দায়ের করা সাংবাদিকদের সব মামলাও বিলুপ্ত বা তামাদি করতে হবে।
জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড :৫৭। (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সমপ্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
এই আইনটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে উল্লেখ করে সাংবাদিকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ তা বিলুপ্ত করার জন্য সোচ্চার হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ওই আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা পুরোপুরি বিলুপ্তির বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। চলতি বছরের ২৯শে জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভায় নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বহুল আলোচিত কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করা হলেও ৫৭ ধারায় বর্ণিত অপরাধ ও শাস্তির বিধান পুনর্বিন্যাস করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া, ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
অপর দিকে আইনটি অপপ্রয়োগ ঠেকানোর কথা বলা হলেও চলতি মাসেই ৫৭ ধারায় অন্তত ডজন খানেক মামলা হয়েছে। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটূক্তি করার অভিযোগে গত ২৩শে জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন এক ছাত্রলীগ নেতা। হাটহাজারি থানায় মামলাটি করেন চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সদস্য ইফতেখার উদ্দিন। ২০ জুলাই কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাংবাদিক ইউনিয়ন কুষ্টিয়ার সভাপতি ও বিএফইউজের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব বাদী হয়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক জাফর ওয়াজেদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন।
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নির্বাচন নিয়ে জাফর ওয়াজেদ নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘মৃত ব্যক্তির ভোট দান’ শিরোনামে একটি লেখার জন্য মামলাটি করা হয়। বাদী এতে বিএফইউজের নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ কয়েকজনের সম্মানহানি ও কটূক্তির অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ১লা জুলাই কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের বিরুদ্ধে একই ধারায় মামলার পর তাকে দীর্ঘ রিমান্ডে নেয়া হয়। ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন। অবশ্য অন্যদের বিরুদ্ধে এই ধারায় না হলেও অন্য ধারায় মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, রাশেদ খান ফেসবুক লাইভে মিথ্যা, মানহানিকর ও নাশকতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। কিছু বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রীর মানহানিকর ছিল।
এর আগে ৪ঠা জুলাই দিনাজপুরের হাকিমপুর থানায় পৌর ছাত্রলীগ সভাপতি মো. তরিকুল সরকার বাদী হয়ে ৫৭ ধারায় সাকিল ইসলাম (২০) নামে অপর এক যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মান ক্ষুণ্নের লক্ষ্যে ফেসবুকে বিকৃত ছবি পোস্ট করার অভিযোগে মামলাটি (মামলা নং-০৮) করা হয়। এ মামলায় সে দিনই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার আগে ৬ই মে জামালপুর সদর থানায় উপজেলা সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা শবনম মোস্তারী ও দৈনিক ইত্তেফাকের জামালপুর প্রতিনিধি হালিম দুলালকে আসামি করে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে। শবনম এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখার পর ওই দু’জনকে আসামি করে সদর উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
সম্মানহানির অভিযোগে গত ১৬ই মার্চ রাজধানীর আদাবর থানায় এক তরুণীর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা (মামলা নং-১৮) করেন চলচ্চিত্র পরিচালক গাজী রাকায়েত। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম ও তার ব্যক্তিগত সহকারী রাশেদুল কায়ছার ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে ফেসবুকে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে গত ১৬ই মে গ্রেপ্তার হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান লিটন। ৫৭ ধারায় মামলাটি করেন কুটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমান স্বপন। একই সময় পুলিশ সদরদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে ৭টি মামলা করা হয়। চলতি বছরের ২২শে এপ্রিল বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) পরিচালক লুনা শামসুদ্দোহার মামলায় একই সংগঠনের সদস্য বেঙ্গল ক্রিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর আগে ১০ই এপ্রিল তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গুলশান থানায় মামলাটি করেন লুনা। ২২শে এপ্রিল দেশের জনপ্রিয় চাকরির অনলাইন পোর্টাল বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী একেএম ফাহিম মাসরুর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ছবির ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আপলোড ও অপমানমূলক স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর কাফরুল থানায় ৫৭ ধারায় মামলা করেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাবেক গণশিক্ষা সম্পাদক মো. আল সাদিক। এই মামলায় গত ২৫শে এপ্রিল পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের সদস্যরা গ্রেপ্তারের পর আবার ছেড়ে দেয়।
সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের হয় ৭৪০টি মামলা। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা হয়েছে ৫৭ ধারায়। ২০১৩ সালে প্রথম তিনটি মামলা হয়। এরপর প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে সারা দেশে ৩৩টি মামলা হলেও ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২টিতে। ২০১৬ সালে ৫৭ ধারায় মামলা হয় ২৩৩টি, আর ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই ধারায় মামলা হয়েছে ৩২৩টি।
No comments