কানে মোবাইল ফোন ডেকে আনছে বিপদ by শুভ্র দেব
মোবাইল
ফোন এখন প্রায় সব মানুষের নিত্যসঙ্গী। এক মুহূর্তের জন্য ফোনটি না হলে যেন
চলেই না। অতি প্রয়োজনীয় মোবাইল ফোনটি আবার অনেকের জন্য ডেকে আনছে বড় বিপদ।
কানে ফোন নিয়ে রেললাইন বা রাস্তা পার হতে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। কানে
ফোন নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে অন্যের জীবন কেড়ে নিচ্ছে কেউ কেউ। অতি মাত্রায়
ফোন ব্যবহারে নিজের অজান্তেই ক্ষতি ডেকে আনছেন এর ব্যবহারকারী। বাংলাদেশ
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী সক্রিয়
সংযোগ বা সিমের সংখ্যা এখন ১৫ কোটির কাছাকাছি। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর
সংখ্যাও ৯ কোটি ছাড়িয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোবাইল ফোনে কথা বলে বা কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান অথবা কথা বলার জন্য যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই রেললাইনে। অসচেতনভাবে রেললাইন দিয়ে চলাফেরার জন্য এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকা রেলওয়ে থানার সূত্রে জানা গেছে, তাদের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত মোট ১৪২ কিমি রেলপথে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সালের ১৫ই মে পর্যন্ত কানে মোবাইল ফোন ও হেডফোন দিয়ে রেললাইন ধরে চলাচলের জন্য মৃত্যু হয়েছে ৪৮৪ জনের। মোবাইল ফোন ও কানে হেডফোন দিয়ে চলাচলে মৃত্যুতে নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষ ছিল। এর মধ্যে ২০১০ সালে কানে মোবাইল ফোন ও হেডফোনের কারণে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। ২০১১ সালে ২১, ২০১২ সালে ৫২, ২০১৩ সালে ৬৭, ২০১৪ সালে ১০৯, ২০১৫ সালে ১২০, ২০১৬ সালে ৩২, ২০১৭ সালে ৫৪ ও ২০১৮ সালের ১৫ই মে পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের।
গত সপ্তাহের সোমবারের ঘটনা। ঢাকার খিলক্ষেতের লা মেরিডিয়ানের সামনের রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে কথা বলছিলেন জুয়েল আখন্দ (২৫) নামের এক যুবক। তখন কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন জুয়েলের কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু সেদিকে তার কোনো লক্ষ্য ছিল না। আশেপাশের লোকজনের ডাকাডাকিতে সে সরে দাঁড়ায় ওই রেললাইন থেকে। গভীর কথা বলায় মগ্ন থাকায় সে পাশে থাকা আরেকটি রেললাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসা আরেকটি ট্রেন জুয়েলকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। জুয়েল স্যানেটারি কাজের জন্য কিছুদিন আগে ঢাকায় এসেছিল। তার বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন মাইন হাসান (১৬)। ঠিক তখনই ঢাকা-ঈশ্বরদী রেললাইন দিয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নীলসাগর ট্রেনটি মাইনকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। সে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ২রা জুলাই গাইবান্ধা উপজেলায় লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের হাজীরঘাট রেললাইন দিয়ে মোবাইলে কথা বলে যাচ্ছিলেন এক শিক্ষার্থী। কথা বলায় মনযোগ থাকায় পেছন থেকে আসা একটি ট্রেন মনিরা আক্তারকে কেটে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। সে লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের উপ- মহাপরিদর্শক মো. শামসুু উদ্দিন বলেন, রেললাইনে শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহার নয় আরো নানা কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। আমরা এসব দুর্ঘটনা এড়াতে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং, মাইকিং, রেললাইনের আশেপাশের এলাকায় সচেতনতামূলক সভা নিয়মিত করে থাকি। তিনি বলেন, আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে যারা রেললাইন দিয়ে চলাচল করে থাকেন তাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে এধরনের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না।
ইদানীং বাসার ছাদে উঠে মোবাইল ব্যবহার করায় বেশ কিছু দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। অসচেতনভাবে ছাদে উঠে কথা বলায় মগ্ন থাকায় ছাদ থেকে পড়ে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। চলতি বছরের ২৫শে এপ্রিল মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় একটি বাসার ছাদে মোবাইলে কথা বলতে বলতে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। তার নাম স্বপন সরদার (২৫)। ওই দিন সে ছাদের কিনারায় মোবাইলে কথা বলছিল। কথা বলার একপর্যায়ে সে তিন তলার উপরের ছাদ থেকে পড়ে যায়। ২রা জুলাই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী হলের দোতলার ছাদ থেকে পড়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম বায়োজিদ বোস্তামি (২২)। সে টাঙ্গাইলের সাইফুল ইসলামের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বায়োজিদ ওই দিন ছাদের রেলিং এ বসে কথা বলছিল। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে সে দোতলার ছাদ থেকে পড়ে যায়। মারাত্মকভাবে আহত হলে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আর বিভিন্ন যানবাহনের চালক চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার করায় অহরহ দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও চালকরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময় মোবাইলে কথা বলায় মনযোগ থাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। গত বছরের ২৬শে সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের নাগরকান্দা উপজেলায় এক হাতে মোবাইল ফোন কানে আরেক হাতে স্টিয়ারিং ধরে বাস চালাচ্ছিলেন এক চালক। এ সময় ওপর দিক থেকে আসা একটি বাসকে সাইড দিতে গিয়ে তোনারতরী নামের ওই বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তখন বাসটির ধাক্কায় তিনজন পথচারীর মৃত্যু হয়। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা জানিয়েছেন, বাস স্টার্ট করার পর থেকেই চালক মোবাইলে কথা বলছিলেন। যাত্রীরা একাধিকবার বাধা দিলেও চালক শুনেননি।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। ডিজিটাল দুনিয়ার মানুষ মোবাইল ছাড়া নিজেকে অচল ভাবে। রিকশাচালক, দিনমজুর থেকে শুরু করে অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়ছে। ইদানীং কম বয়সী ছেলে মেয়েদের মাঝেও মোবাইল ফোনের আসক্তি বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কম বয়সে মোবাইল ব্যবহার শিশুদের মানস গঠনের পাশাপাশি লেখাপড়া ও তার চিন্তা চেতনায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারে শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
মোবাইল ব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যে নানা জরিপ করেছে দেশি-বিদেশি নানা সংগঠন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস রিভিউ সাময়িকী থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ তরুণদের মোবাইল ফোনে আসক্তি ছিল। যা ২০১৪ সালে ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আর ২০১৮ সালে তা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে তরুণ পেশাজীবীরা সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করেন। যা কর্মক্ষেত্রে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে আরো ১০ ঘণ্টা বেশি ডুবে থাকেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে জানা যায়, ৪৬ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহারকারী ‘ফোন ছাড়া বাঁচবোই না’ বলে মনে করেন। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, তরুণেরা এখন মোবাইল ফোনকে তাদের শরীরের অঙ্গই মনে করেন।
ফ্লোরিডা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দেখেছেন, মুঠোফোনে আসক্ত ব্যক্তিদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। শতকরা ৬৩ শতাংশ মানুষ ঘুম থেকে উঠেই স্মার্টফোনে আগে চোখ রাখেন। মুঠোফোনে আসক্তিকে পিসিম্যাগ প্লেগ রোগের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বেশ কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৯ জন মা-বাবা এবং তাদের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী সন্তানদের মধ্যে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে দেখা গেছে, নানান প্রযুক্তি সন্তান ও অভিভাবকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। জরিপে দেখা যায়, শুধু খাবার টেবিল নয়, গাড়ি চালানোর সময় স্মার্টফোন ব্যবহারেও বিরক্ত হয় সন্তান। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিভাবকদের অতিরিক্ত সময় কাটানো এবং শেয়ারিংয়ের অভ্যাসগুলো একদমই পছন্দ করে না সন্তানেরা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্মাট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ব্যবহারকারী ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল ফোন হাতে নেন। ওই ব্যবহারকারীরাই আবার দিনে ১১০ বার মোবাইল চেক করেন। ৫৬ শতাংশ মানুষ ঘুমানোর আগেও চেক করেন। ৬১ শতাংশ মানুষ বালিশের নিচে বা পাশে রেখে রাতে ঘুমান। ভুল করে বাড়িতে ফোন রেখে বের হলে ৫০ শতাংশ ব্যবহারকারী বেশ অস্বস্তিবোধ করেন। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে ৫৬ শতাংশ চালক যানবাহন চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহার করেন। আর ৭৫ শতাংশ ব্যবহারকারী চলন্ত অবস্থায় এসএমএস আদান-প্রদান করেন। যার কারণে ২৬ শতাংশ গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য মোবাইল ফোনই দায়ী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, মোবাইল ফোনে কথা বলা গানশুনে যতগুলো মৃত্যু হচ্ছে তার অধিকাংশ টিনএজার। জীবনের প্রতি যাদের মায়া নাই শুধুই ফ্যান্টাসিতে ভোগে। কারণ এখনকার ছেলে মেয়েরা তাদের পরিবারের কাছে কোনো কিছুই শেয়ার করে না। সব কিছুই নিজের মধ্যে চেপে রাখে। এর কারণ হিসেবে এই মনোবিদ বলেন, এখনতো সেই পরিবেশ নাই। বাসা, স্কুল, কলেজে আমরা সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারি নাই। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোবাইল ফোনে কথা বলে বা কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান অথবা কথা বলার জন্য যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই রেললাইনে। অসচেতনভাবে রেললাইন দিয়ে চলাফেরার জন্য এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকা রেলওয়ে থানার সূত্রে জানা গেছে, তাদের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত মোট ১৪২ কিমি রেলপথে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সালের ১৫ই মে পর্যন্ত কানে মোবাইল ফোন ও হেডফোন দিয়ে রেললাইন ধরে চলাচলের জন্য মৃত্যু হয়েছে ৪৮৪ জনের। মোবাইল ফোন ও কানে হেডফোন দিয়ে চলাচলে মৃত্যুতে নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষ ছিল। এর মধ্যে ২০১০ সালে কানে মোবাইল ফোন ও হেডফোনের কারণে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। ২০১১ সালে ২১, ২০১২ সালে ৫২, ২০১৩ সালে ৬৭, ২০১৪ সালে ১০৯, ২০১৫ সালে ১২০, ২০১৬ সালে ৩২, ২০১৭ সালে ৫৪ ও ২০১৮ সালের ১৫ই মে পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের।
গত সপ্তাহের সোমবারের ঘটনা। ঢাকার খিলক্ষেতের লা মেরিডিয়ানের সামনের রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে কথা বলছিলেন জুয়েল আখন্দ (২৫) নামের এক যুবক। তখন কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন জুয়েলের কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু সেদিকে তার কোনো লক্ষ্য ছিল না। আশেপাশের লোকজনের ডাকাডাকিতে সে সরে দাঁড়ায় ওই রেললাইন থেকে। গভীর কথা বলায় মগ্ন থাকায় সে পাশে থাকা আরেকটি রেললাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসা আরেকটি ট্রেন জুয়েলকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। জুয়েল স্যানেটারি কাজের জন্য কিছুদিন আগে ঢাকায় এসেছিল। তার বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন মাইন হাসান (১৬)। ঠিক তখনই ঢাকা-ঈশ্বরদী রেললাইন দিয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নীলসাগর ট্রেনটি মাইনকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। সে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ২রা জুলাই গাইবান্ধা উপজেলায় লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের হাজীরঘাট রেললাইন দিয়ে মোবাইলে কথা বলে যাচ্ছিলেন এক শিক্ষার্থী। কথা বলায় মনযোগ থাকায় পেছন থেকে আসা একটি ট্রেন মনিরা আক্তারকে কেটে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। সে লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের উপ- মহাপরিদর্শক মো. শামসুু উদ্দিন বলেন, রেললাইনে শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহার নয় আরো নানা কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। আমরা এসব দুর্ঘটনা এড়াতে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং, মাইকিং, রেললাইনের আশেপাশের এলাকায় সচেতনতামূলক সভা নিয়মিত করে থাকি। তিনি বলেন, আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে যারা রেললাইন দিয়ে চলাচল করে থাকেন তাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে এধরনের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না।
ইদানীং বাসার ছাদে উঠে মোবাইল ব্যবহার করায় বেশ কিছু দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। অসচেতনভাবে ছাদে উঠে কথা বলায় মগ্ন থাকায় ছাদ থেকে পড়ে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। চলতি বছরের ২৫শে এপ্রিল মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় একটি বাসার ছাদে মোবাইলে কথা বলতে বলতে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। তার নাম স্বপন সরদার (২৫)। ওই দিন সে ছাদের কিনারায় মোবাইলে কথা বলছিল। কথা বলার একপর্যায়ে সে তিন তলার উপরের ছাদ থেকে পড়ে যায়। ২রা জুলাই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী হলের দোতলার ছাদ থেকে পড়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম বায়োজিদ বোস্তামি (২২)। সে টাঙ্গাইলের সাইফুল ইসলামের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বায়োজিদ ওই দিন ছাদের রেলিং এ বসে কথা বলছিল। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে সে দোতলার ছাদ থেকে পড়ে যায়। মারাত্মকভাবে আহত হলে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আর বিভিন্ন যানবাহনের চালক চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার করায় অহরহ দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও চালকরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময় মোবাইলে কথা বলায় মনযোগ থাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। গত বছরের ২৬শে সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের নাগরকান্দা উপজেলায় এক হাতে মোবাইল ফোন কানে আরেক হাতে স্টিয়ারিং ধরে বাস চালাচ্ছিলেন এক চালক। এ সময় ওপর দিক থেকে আসা একটি বাসকে সাইড দিতে গিয়ে তোনারতরী নামের ওই বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তখন বাসটির ধাক্কায় তিনজন পথচারীর মৃত্যু হয়। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা জানিয়েছেন, বাস স্টার্ট করার পর থেকেই চালক মোবাইলে কথা বলছিলেন। যাত্রীরা একাধিকবার বাধা দিলেও চালক শুনেননি।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। ডিজিটাল দুনিয়ার মানুষ মোবাইল ছাড়া নিজেকে অচল ভাবে। রিকশাচালক, দিনমজুর থেকে শুরু করে অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়ছে। ইদানীং কম বয়সী ছেলে মেয়েদের মাঝেও মোবাইল ফোনের আসক্তি বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কম বয়সে মোবাইল ব্যবহার শিশুদের মানস গঠনের পাশাপাশি লেখাপড়া ও তার চিন্তা চেতনায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারে শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
মোবাইল ব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যে নানা জরিপ করেছে দেশি-বিদেশি নানা সংগঠন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস রিভিউ সাময়িকী থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ তরুণদের মোবাইল ফোনে আসক্তি ছিল। যা ২০১৪ সালে ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আর ২০১৮ সালে তা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে তরুণ পেশাজীবীরা সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করেন। যা কর্মক্ষেত্রে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে আরো ১০ ঘণ্টা বেশি ডুবে থাকেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে জানা যায়, ৪৬ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহারকারী ‘ফোন ছাড়া বাঁচবোই না’ বলে মনে করেন। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, তরুণেরা এখন মোবাইল ফোনকে তাদের শরীরের অঙ্গই মনে করেন।
ফ্লোরিডা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দেখেছেন, মুঠোফোনে আসক্ত ব্যক্তিদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। শতকরা ৬৩ শতাংশ মানুষ ঘুম থেকে উঠেই স্মার্টফোনে আগে চোখ রাখেন। মুঠোফোনে আসক্তিকে পিসিম্যাগ প্লেগ রোগের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বেশ কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৯ জন মা-বাবা এবং তাদের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী সন্তানদের মধ্যে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে দেখা গেছে, নানান প্রযুক্তি সন্তান ও অভিভাবকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। জরিপে দেখা যায়, শুধু খাবার টেবিল নয়, গাড়ি চালানোর সময় স্মার্টফোন ব্যবহারেও বিরক্ত হয় সন্তান। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিভাবকদের অতিরিক্ত সময় কাটানো এবং শেয়ারিংয়ের অভ্যাসগুলো একদমই পছন্দ করে না সন্তানেরা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্মাট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ব্যবহারকারী ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল ফোন হাতে নেন। ওই ব্যবহারকারীরাই আবার দিনে ১১০ বার মোবাইল চেক করেন। ৫৬ শতাংশ মানুষ ঘুমানোর আগেও চেক করেন। ৬১ শতাংশ মানুষ বালিশের নিচে বা পাশে রেখে রাতে ঘুমান। ভুল করে বাড়িতে ফোন রেখে বের হলে ৫০ শতাংশ ব্যবহারকারী বেশ অস্বস্তিবোধ করেন। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে ৫৬ শতাংশ চালক যানবাহন চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহার করেন। আর ৭৫ শতাংশ ব্যবহারকারী চলন্ত অবস্থায় এসএমএস আদান-প্রদান করেন। যার কারণে ২৬ শতাংশ গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য মোবাইল ফোনই দায়ী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, মোবাইল ফোনে কথা বলা গানশুনে যতগুলো মৃত্যু হচ্ছে তার অধিকাংশ টিনএজার। জীবনের প্রতি যাদের মায়া নাই শুধুই ফ্যান্টাসিতে ভোগে। কারণ এখনকার ছেলে মেয়েরা তাদের পরিবারের কাছে কোনো কিছুই শেয়ার করে না। সব কিছুই নিজের মধ্যে চেপে রাখে। এর কারণ হিসেবে এই মনোবিদ বলেন, এখনতো সেই পরিবেশ নাই। বাসা, স্কুল, কলেজে আমরা সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারি নাই। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
No comments