আমি বারে বারে ইনসিস্ট করলাম, তারপর সেনাপ্রধানকে নক করলাম by মহিউদ্দিন আহমদকে সাক্ষাতকারে ব্রিগেডিয়ার বারী
এক-এগারোর
ঘটনাটি যখন ঘটে, ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক মে. জেনারেল সাদেক হাসান রুমি
দেশে ছিলেন না। তাঁর অনুপস্থিতিতে পরিচালকদের একজন ব্রি. জে. চৌধুরী ফজলুল
বারী ডিজিএফআইয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেদিন
তিনিও বঙ্গভবনে সেনাপ্রধান মইনের সঙ্গে গিয়েছিলেন। ওই দিনের ক্ষমতার
পালাবদলে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। লেখককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি
খোলামেলাভাবে অনেক কথা বলেন। তাঁর অনেক কথা সেনাপ্রধানের কথার সঙ্গে মিলে
যায়।
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ১/১১ শীর্ষক লেখায় এসব কথা লিখেছেন। প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের সঙ্গে তাঁর (চৌধুরী ফজলুল বারী) কথোপকথন এখানে তুলে ধারা হলো:
মহিউদ্দিন আহমদ: এক-এগারোর সময় এবং তার পরের দিনগুলোতে আপনার নাম অনেকবার শোনা গেছে। কোন পটভূমিতে এই পালাবাদল ঘটল? কী ছিল আপনার ভূমিকা? আপনি অনেক দিন ধরে জন-আলোচনায় আছেন। একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
চৌধুরী ফজলুল বারী: এক কথায়, দেশটা অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। ইলেকশন হলেও অস্থিতিশীল, না হলেও অস্থিতিশীল। এখন কী করণীয়? আমি কারও বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই না। নরমাল ইয়ের বাইরে আর্মি কেন আসবে? সবাই ঠিকমতো বেতন-ভাতা পাইতেছে! দেশ গোল্লায় যাক, নিজের বাচ্চা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পড়তেছে। আর কী লাগে? আমি বারে বারে ইনসিস্ট করলাম। তারপর সেনাপ্রধানকে নক করলাম। নক করলাম জেনারেল মাসুদকে। জেনারেল মাসুদকে কেন নক করলাম? কারণ, উনি বেগম জিয়ার আত্মীয়। দেখি ওনার মনোভাবটা কী।
মহি: উনি সাঈদ এস্কান্দারের ভায়রা।
বারী: লেট আস কাম ব্যাক টু দ্য ইমার্জেন্সি। সিচুয়েশন তো ভোলাটাইল হয়ে গেছে। ইমার্জেন্সি হয়ে গেছে। ইমার্জেন্সি দেওয়ার জন্য আমি জেনারেল মাসুদকে জিজ্ঞেস করলাম। বলে, আসলেই তো, দেশের যে অবস্থা হয়েছে, কিছু একটা করা দরকার। আমি বললাম, মইনের কাছে একটু খোঁজখবর নেন। আমি জানি না উনি খোঁজখবর নিয়েছেন কি না। আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।
ওনাকে কয়েক দিন পরপরই আমি বলি, স্যার, চিফের কাছে যান, আলাপ-টালাপ করেন। এভাবে তো একটা দেশ চলতে পারে না। বলেন, হ্যাঁ, চিফের কাছে গেছিলাম, একটু হালকা উঠাইছি, উনি তো এদিকে যায় না। মানে ডরায়, কথা বলতে চায় না। মাসুদ হইল বেগম জিয়ার আত্মীয়। এ জন্য উনি হয়তো শেয়ার করেন না কিছু।
তারপর আমি চিফের ভাইকে নক করলাম। আমি যখন র্যাবে ছিলাম, উনি একবার আমার কাছে গিয়েছিলেন। টিপু ভাই। ওনাকে বললাম, ভাই, এই অবস্থা। ওনাদের বলেন। প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে কিছুদিনের জন্য ইমার্জেন্সি দিলে সবারই মুখরক্ষা হবে। আর বিএনপি যদি ইলেকশন করে-আমি এভাবেই বলেছিলামÑদেশে একটা কালো তিলক পড়বে, এ রকম জোর করে একটা ইলেকশন করালে। এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে (১৯৯৬) একটা হয়েছে না? আরও একটা হবে? এগুলো বলে-টলে আমি ওনারে রিকোয়েস্ট করে পাঠালাম। উনি বললেন যে, না, সময় হয় নাই এখনো। এত তাড়াতাড়ি এগুলো করা ঠিক না। বুঝলাম, ওনার ইচ্ছা আছে, কিন্তু টাইম হ্যাজ বিকাম আ ফ্যাক্টর।
কিছুদিন পরে আমার ডিজি গেলেন ইউকে। সিচুয়েশন একদম পিকে। আমি অ্যাকটিং ডিজি। আমি গিয়া ওনাকে সিচুয়েশন ন্যারেট করলাম। তারপর উনি নিজে থেকেই বললেন যে, দেশের কী অবস্থা? বললাম, স্যার, দেশের অবস্থা এখন তো আর লুকানো নাই।
মহি: এটা চিফকে বললেন?
বারী: চিফকে, চিফের অফিসে। দেশের অবস্থা তো লুকানো নাই। মিডিয়া তো সব পাবলিশ করে। কোনো কিছু তো গোপন থাকে না। দেখছেন তো আপনি, প্রতিদিন কি হচ্ছে না হচ্ছে।
তোমার কী অভিমত?
এটা থেকে নরমালসি আনতে হলে প্রেসিডেন্টকে ইমার্জেন্সির জন্য বলতে হবে।
অন্যরা কী বলে? আর্মির অ্যাটিচ্যুড কী?
আর্মির অ্যাটিচ্যুড হলো, সেনাপ্রদান যা করবে, তারা তো তার বাইরে থাকবে না। সেনাপ্রধানের চিন্তাটা তো আসবে ওখান থেকেই, দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা থেকে।
তুমি আর্মির কাছে গিয়ে খোঁজ নাও।
আই টকড টু অল কমান্ডারস, জিওসিস, দু-একজন ছাড়া যাদের সঙ্গে আমার ভালো ইয়ে নাই। কারণ, এগুলি তো সাংঘাতিক কঠিন প্রশ্ন। আমি কথা বললাম। সবাই ওপিনিয়ন দিলেন যে, কিছু একটা করা উচিত। বাট নো মার্শাল ল। চিফও বলেছেন, আই অ্যাম দ্য লাস্ট ম্যান টু ডিক্লেয়ার মার্শাল ল।
ঠিক আছে। তাহলে হু উইল বি দ্য কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট? কেয়ারটেকার চিফ হওয়ার জন্য আমরা ড. ইউনূসকে বললাম। উনি বললেন যে, না।
মহি: কে কে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে?
বারী: জেনারেল মাসুদ আর আমি। না না, তার আগে তো ইমার্জেন্সি দেওয়া হলো। এর মধ্যে আমি অনেকগুলো গ্রাউন্ডওয়ার্ক করেছি। ইমার্জেন্সি প্রক্লেমেশনের জন্য যে একটা গেজেট বের করতে হবে, গেজেটে কী লেখা থাকবে? আমি দেখলাম বঙ্গবন্ধুর আমলে ইমার্জেন্সির গেজেট আছে, এরশাদ সাহেবের আমলের একটা গেজেট আছে। দুইটা এনে দেখলামÑএকটা মডারেট ভার্সন তৈরি করলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, দেশে নরমালসি আসবে। তারপর ছোটখাটো কিছু ডিজনিস আছেÑবড় আঙ্গিকের ছোটখাটো জিনিস, দলীয়করণ-টরন বাদ দিয়ে মেধাবী লোকজনকে বসানোÑএটা বোধ হয় এভাবেই করা হয়েছিল। আমি জানি না, বিচার করবেন আপনারা। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের যে সদস্যরা ছিলেন, অ্যাডভাইজাররা ছিলেন, এটা আপনারা বিচার করবেন, এরা ভালো ছিল না খারাপ ছিল। হিউম্যান এরর তো থাকবেই।
ইমার্জেন্সি হলো ১১ তারিখ। ১০ তারিখ রাতে চিফের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়। চিফ ১০ তারিখ রাতে আমাকে ফোন করলেন যে, বারী, একটা জিনিস তো পাওয়া গেছেÑইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করার পক্ষে একটা শক্ত ডকুমেন্টÑইউএন মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈনিকদের আর নিবে না। এটা তো একটা বড় প্লি আমাদের জন্য। এইমটা তো ইমার্জেন্সি না, এইম হলো পিস রি-এস্টাবলিশ করা। এটা করতে গেলে, আমরা মনে করি যে, ইমার্জেন্সিক দিতে হবে। ইমার্জেন্সি করতে গেলে এটারও তো একটা সাপোর্টিং ইয়ে লাগবে। এটা আমি দেখিও নাই কোনো দিন। উনি বলছেন। আর্মিতে তো ওরাল অর্ডার বলে একটা কথা আছে। মৌখিক অর্ডার। এটা আইনসম্মত।
এটা সিওর যে উনি আমাকে রাতে ফোন করেছিলেন। আমি জেনারেল মাসুদকে বললাম, স্যার, চিফ তো বলছেন, স্যার আপনি তাড়াতাড়ি আসেন। উনি তখন সাভারে।
উনি রওনা করলেন। আসলেন আমার অফিসে। এটা ঐতিহাসিক একটা ঘটনা। বললেন, আমিনকে (ডিজিএফআইয়ের আরেকজন পরিচালক ব্রি. জে. এ টি এম আমিন) ডাকো। আমিন-এর মধ্যে ছিল না। দেশের মধ্যে একটা মোড় নিয়া নিল আমিনকে ডাইকা। এই সব লোকÑআমিন, মইন-সাধারণ মানুষের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এরা পড়াশোনা করছে আইসোলেটেড স্কুলে। আমিনের ফাদার সম্ভবত ফরেন মিনিস্ট্রতে ছিল, বিদেশ ঘুইরা বেড়াইছে। সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে বসে যে ক্লাস করা, পালস বোঝা, গ্রামে কাদার মধ্যে লুঙ্গি উঠায়া আসাÑএ রকম তো দেখে নাই। এদের কাছে চিত্র এক রকম। আমাদের কাছে চিত্র এক রকম। যার ফলে তারা ফুটপাতে বাড়ি দিয়া উঠায়া দাও, মার্শাল ল কইরা ফেল, ভাইঙ্গা ফেলÑএই টাইপের অ্যাটিচ্যুড। টক শো বন্ধ কইরা দাও। আমি বললাম, আরে নরমালসি আনতে চাই আমরা। যখন ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হলো, সব টক শো বন্ধ। আমাকে তৃতীয় মাত্রার জিল্লুর সাহেব ফোন করলেন, ভাই আমি কি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করব? আমি তখনো বঙ্গভবনে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেনাপ্রধানকে ফোন করলাম। স্যার, এগুলা বন্ধ করবেন না। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। আমরা যদি খারাপ করি, বলুক। আমাদের বক্তব্য আমরা দিব। ভালো করলে সেটা বলবে। মানুষ তো খারাপ বলে নাই প্রথম দিকে।
যা হোক, আমিনকে আনল জেনারেল মাসুদ। তার সঙ্গে নাইন ডিভে কাজ করেছে, নাইন ডিভের আর্টিলারি কমান্ডার ছিল আমিন। আরও আগে থেকেই হয়তো পরিচয়-টরিচয় আছে। আমিনরে লাগানো হলো। আমি আমার কাজ করতে থাকলাম।
পরের দিন ১১ তারিখ মিটিং। প্রেসিডেন্টের সবাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং, ইলেকশন উপলক্ষে। ইলেকশন তো ২২ জানুয়ারি। মিটিং শুরু হলো। মিটিংয়ের মধ্যে চিফ আমাকে ফোন করে বললেন, আমি আসতেছি। তুমি থাইকো। প্রেসিডেন্টকে সব কিছু বুঝায়া বলব। সিচুয়েশন রিপোর্টটা তুমি বলবা, ফ্রম ইন্সেলিজেন্স পয়েন্ট অব ভিউ।
এর মধ্যে গোছগাছ করে আমি রেডি হয়ে গেলাম। চিফ আসরেন, বাহিনী প্রধানরা আসলেন। রাষ্ট্রপতির কাছে সময় নেওয়া হলো। উনি সময় দিলেন, লাঞ্চের পরে। তারপর ওনারা ওনাদের বক্তব্য দিলেন। সেনাপ্রধান তার বক্তব্য দিলেন। রাষ্ট্রপতি বললেন, কী করা? উনি বললেন, ইমার্জেন্সি দেওয়া।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি একটু আলাপ-আলোচনা করে দেখি।
কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে।
আমাকে পদত্যাগ করতে হবে নাকি?
না, আপনাকে প্রেসিডেন্টশিপ থেকে পদত্যাগ করতে হবে না। বাট অ্যাজ কেয়ারটেকার চিফ ইউ হ্যাভ টু রিজাইন।
তো মেকানিজম যা করার করা হইল। জেনারেল মাসুদ ওই দিকে থাকলেন, নাইন ডিভ নিয়া। ওনাকে রেডি রাখা হইল। এটা স্বাভাবিক। এখানে তো পিজিআর আছে, এসএসএফ আছে। তবে কেউ ইয়া করে নাই। সিচুয়েশন যা হইছিল, এ ছাড়া বিকল্প ছিল না। পলিটিশিয়ানস হ্যাভ ফেইলড। আই ডু নট হ্যাভ ডিসরেসপেক্ট।
তারা যেভাবে আগাইতেছিলেন-দেশের মানুষের দুই দিন পরে পরে পাছার মধ্যে লাথি দিয়া, সরি মহিউদ্দিন ভাই, আমি এ রকম দু-একটা শব্দ অতি ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করছি। দেশের মানুষের কী হলো না হলো এটা নয়, হিটলারের মতো কমান্ড পোস্ট বানাইয়া ওনারা কমান্ড দিতে থাকলেন আর মানুষ মরতে থাকল। ৬৮ জন মারা গেছে। হু রিমেম্বারস দেম? হুইচ পলিটিশিয়ান ইজ রিমেম্বারিং দেম?
ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হইল। বক্তৃতা আমরাই লেখায়া দিলাম। উনি কিছু কাটছাঁট করলেন। কট্টরপন্থী কোনো কিছু করা হয় নাইÑরাষ্ট্রপতি, আপনাকে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। বাইরে তো নানান ধরনের গুজব, সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্টের ইয়েকে চড় মারছেন, মুখলেছ সাহেবকে। অল বানোয়াট, বাখোয়াজ। উনিও দেখলাম লেখলেন বিশাল বড় এক পত্রিকার মধ্যে যে, আমি ট্রাক-ট্রুক নিয়া রেডি হইয়া আছি। আমি ট্রাক কই পাব? আমার ঢাল-তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার, আমি অ্যাকটিং ডিজি-জিজিএফআই। আমি এখানে আছি সেনাপ্রধানের সঙ্গে, প্রেসিডেন্টর সঙ্গে, কী হচ্ছে না হচ্ছে এগুলো নিয়ে।
যা হোক, ওনাদেরও পদত্যাগ করানো হলো। পদত্যাগ করানোর সঙ্গে সঙ্গেÑহু উইল বি দ্য কেয়ারটেকার চিফ? নাম আসল ড. ইউনূসের। তখন জেনারেল মাসুদকে বলা হলো, আমিনকে নিয়ে উনি গেলেন ওনার কাছে। ওনার প্রথম কথা হলো টাইম ফ্রেম কত দিনের জন্য?
তা তো আমরা বলতে পারি না?
কেউই বলতে পারে না মইনুদ্দিনও জানে না, কত দিন।
উনি বললেন, কম সময় যদি হয়, কোনো পরিবর্তন আনা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।
তারপর কাকে করা যায়? আমি সার্চ লাগাইলাম। আমার অপিসাররা বলল, স্যার, আরেকজন আছে, ফখরুদ্দীন সাহেব। আমি কল দিলাম ফখরুদ্দীন সাহেবকে।
মহি: ফখরুদ্দীন সাহেবের নাম কি ড. ইউনূস সাজেস্ট করেছিলেন, না-কি এটা আপনার চয়েস?
বারী: এটা একদম আমাদের সার্চ। আমরা তো দীর্ঘদিন ধরেই কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের নামধাম চর্চা করতেছি। আমি তখন ওনাকে ফোন করলাম। দেখেন, আগে থেকে কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা নাই। এগুলি ইনস্টেন্টলি আসতেছে, একটার পর একটা।
যদি ক্যু করার চিন্তা, ক্ষমতার চিন্তা থাকত, তাহলে তো জেনারেল এরশাদের মতো ছক কইরা ফেলতাম, দুই বছর কী করব, তিন বছর কী করব, চার বছর কী করব? এক্সপার্ট লাগাইতাম। এগুলো তো আমরা নিজেরা নিজেররাÑনরমালসি আনার জন্য, সবই বহাল থাকবে, সবাই যার যার জায়গায় থাকবে।
ফখরুদ্দীনের বাসায় ফোন করলাম। ড. ইউনূসের বাসা থেকেই তারা সোজা চলে গেলেন। উনি বললেন, আমাকে একটু সময় দেন। উনি ওনার ওয়াইফের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে।
মহি: একটা গসিপ শুনেছি, আপনারা যখন প্রফেসর ইউনূসকে অ্যাপ্রোচ করলেন, উনি টাইম ফ্রেমের ব্যাপারে অ্যাগ্রি না করায় উনি নাকি ফখরুদ্দীন সাহেবের নাম প্রস্তাব করেছেন?
বারী: না। আমার নোটবইটা আনতে পারলে দেখাইতে পারতাম, এখন পর্যন্ত নামটা লেখা আছে। ফরিদ আর মশিউর সাহেব ছিল আবার অফিসার। ফরিদ ছিল জি-ওয়ান, আর মশিউর ছিল সিভিল। এদেরকে বললাম, নাম বাইর কর। ওরা ওনার নাম প্রপোজ করল।
মহি: ফরিদ কি আর্মির লোক?
বারী: আর্মির, মশিউর সিভিলিয়ান। আমাকে কোনো কাজ দিলে আমি তো ভিশনটা এদের দিয়া দিইÑআমার এই এই দরকার, এটা বাইর কর।
মহি: ফরিদের পুরো নাম কী।
বারী: ফরিদুল ইসলাম বোধ হয়।
মহি: উনি কি ওই সময় মেজর ছিলেন?
বারী: না, লে. কর্নেল। তো এরা বাইর করল ওনার নাম। ফোন নম্বর ছিল। ওই নম্বরেই যোগাযোগ করি।
মহি: তাহলে বলছেন, এটা আপনার ইনিশিয়েটিভে হয়েছে?
বারী: কোনটা?
মহি: ফখরুদ্দীন সাহেবেরটা।
বারী: না। এরপর যখন প্যানেল করা হইল, প্যানেলের মধ্যে আমরা ২০-২৫ জনের নাম নিয়া আসছি। তারপর চিফের কাছে গিয়া সবাই মিলে আলোচনা কইরা-ওনাকে দেখ, ওনাকে নক কর।
ইভেন আমি শাইখ সিরাজকে-আমি চাইছি একটা ইয়ং অ্যাডভাইজার গ্রুপ, ডাইনামিক, পরীক্ষিত কাজের লোক। চিন্তাধারা-মতাদর্শ যা-ই হোক। হোসেন জিল্লুর রহমান-এগুলি এন্টায়ারলি আমি করছি। ইভেন আনিসুল হকের কথা আমি বলছিলাম।
মহি: ইফতেখারুজ্জামানের কথা কি আপনি বলেছিলেন?
বারী: হ্যাঁ, ইফতেখারুজ্জামান আমার লিস্টে ছিলেন। নন-মুসলিম হিসেবে নাম দরকার ছিল। তারপর তপন বাবুর নাম ছিল। তারপর আরও একজন ‘হিন্দু’ ছিল। নামটা ভুলে গেছি। মহিলা ছিলেন একজন, সিলেটের। উনি তখন ইন্ডিয়ায় ছিলেন। ইন্ডিয়ায় আমি ফোন করছি। ফোন কইরা বলছি, আপনি চইলা আসেন তাড়াতাড়ি।
মহি: এ রকম কেউ ছিল লিস্টে, আপনি চাচ্ছিলেন কিন্তু উনি রিফিউজ করেছে?
বারী: শাইখ সিরাজ।
মহি: ইফতেখারুজ্জামানও আসেন নাই।
বারী: উনি আসেন নাই বা কেউ একজন চায় নাই-এই দুইটার একটা হবে।
মহি: মইনুল হোসেনকে পরে বাদ দেওয়া হলো কেন?
বারী: ওনার কথাবার্তা একটু...। মানুষ তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেক্ট পাওয়া মুশকিল। ওনার মতো স্ট্রেচারের লোক দরকার ছিল।
মহি: ফাইনাল সিলেকশন তো চিফ করেছেন?
বারী: চিফই করেছেন, তবে অন্যদের সঙ্গে কনসাল্ট করে। আমরা লিস্ট দিছি।
মহি: একাডেমিক কাউকে পান নাই? ঢাকা ইউনিভার্সিটির?
বারী: একজনের নাম ছিল, জেনারেল মাসুদের ভায়রা। এ কারণেই ওনাকে আর করা হয় নাই। যেহেতু হি ইজ আ রিলেটিভ অব দ্য সিনিয়র মিলিটারি অফিসার।
মহি: ওই ক্যাবিনেটে ফখরুদ্দীন সাহেবের তো দুই জন রিলেটিভ ছিল?
বারী: কিন্তু এরাতো নিজস্ব গুনে এসেছিল। ফখরুদ্দীনের আত্মীয় বলেতো বাদ দিয়ে দেয়া যায় না। ফখরুদ্দীনের নিজের আত্মীয় না, ওনার ওয়াইফের দিক দিয়া আত্মীয়।
মহি: এখানে ফখরুদ্দীন সাহেবের কোন চয়েস ছিল না?
বারী: না। ফখরুদ্দীন সাহেব তো নিজেই পিকড আপ। হি নেভার নিউ অ্যাবাউট দ্য ইমার্জেন্সি।
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ১/১১ শীর্ষক লেখায় এসব কথা লিখেছেন। প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের সঙ্গে তাঁর (চৌধুরী ফজলুল বারী) কথোপকথন এখানে তুলে ধারা হলো:
মহিউদ্দিন আহমদ: এক-এগারোর সময় এবং তার পরের দিনগুলোতে আপনার নাম অনেকবার শোনা গেছে। কোন পটভূমিতে এই পালাবাদল ঘটল? কী ছিল আপনার ভূমিকা? আপনি অনেক দিন ধরে জন-আলোচনায় আছেন। একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
চৌধুরী ফজলুল বারী: এক কথায়, দেশটা অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। ইলেকশন হলেও অস্থিতিশীল, না হলেও অস্থিতিশীল। এখন কী করণীয়? আমি কারও বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই না। নরমাল ইয়ের বাইরে আর্মি কেন আসবে? সবাই ঠিকমতো বেতন-ভাতা পাইতেছে! দেশ গোল্লায় যাক, নিজের বাচ্চা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পড়তেছে। আর কী লাগে? আমি বারে বারে ইনসিস্ট করলাম। তারপর সেনাপ্রধানকে নক করলাম। নক করলাম জেনারেল মাসুদকে। জেনারেল মাসুদকে কেন নক করলাম? কারণ, উনি বেগম জিয়ার আত্মীয়। দেখি ওনার মনোভাবটা কী।
মহি: উনি সাঈদ এস্কান্দারের ভায়রা।
বারী: লেট আস কাম ব্যাক টু দ্য ইমার্জেন্সি। সিচুয়েশন তো ভোলাটাইল হয়ে গেছে। ইমার্জেন্সি হয়ে গেছে। ইমার্জেন্সি দেওয়ার জন্য আমি জেনারেল মাসুদকে জিজ্ঞেস করলাম। বলে, আসলেই তো, দেশের যে অবস্থা হয়েছে, কিছু একটা করা দরকার। আমি বললাম, মইনের কাছে একটু খোঁজখবর নেন। আমি জানি না উনি খোঁজখবর নিয়েছেন কি না। আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।
ওনাকে কয়েক দিন পরপরই আমি বলি, স্যার, চিফের কাছে যান, আলাপ-টালাপ করেন। এভাবে তো একটা দেশ চলতে পারে না। বলেন, হ্যাঁ, চিফের কাছে গেছিলাম, একটু হালকা উঠাইছি, উনি তো এদিকে যায় না। মানে ডরায়, কথা বলতে চায় না। মাসুদ হইল বেগম জিয়ার আত্মীয়। এ জন্য উনি হয়তো শেয়ার করেন না কিছু।
তারপর আমি চিফের ভাইকে নক করলাম। আমি যখন র্যাবে ছিলাম, উনি একবার আমার কাছে গিয়েছিলেন। টিপু ভাই। ওনাকে বললাম, ভাই, এই অবস্থা। ওনাদের বলেন। প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে কিছুদিনের জন্য ইমার্জেন্সি দিলে সবারই মুখরক্ষা হবে। আর বিএনপি যদি ইলেকশন করে-আমি এভাবেই বলেছিলামÑদেশে একটা কালো তিলক পড়বে, এ রকম জোর করে একটা ইলেকশন করালে। এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে (১৯৯৬) একটা হয়েছে না? আরও একটা হবে? এগুলো বলে-টলে আমি ওনারে রিকোয়েস্ট করে পাঠালাম। উনি বললেন যে, না, সময় হয় নাই এখনো। এত তাড়াতাড়ি এগুলো করা ঠিক না। বুঝলাম, ওনার ইচ্ছা আছে, কিন্তু টাইম হ্যাজ বিকাম আ ফ্যাক্টর।
কিছুদিন পরে আমার ডিজি গেলেন ইউকে। সিচুয়েশন একদম পিকে। আমি অ্যাকটিং ডিজি। আমি গিয়া ওনাকে সিচুয়েশন ন্যারেট করলাম। তারপর উনি নিজে থেকেই বললেন যে, দেশের কী অবস্থা? বললাম, স্যার, দেশের অবস্থা এখন তো আর লুকানো নাই।
মহি: এটা চিফকে বললেন?
বারী: চিফকে, চিফের অফিসে। দেশের অবস্থা তো লুকানো নাই। মিডিয়া তো সব পাবলিশ করে। কোনো কিছু তো গোপন থাকে না। দেখছেন তো আপনি, প্রতিদিন কি হচ্ছে না হচ্ছে।
তোমার কী অভিমত?
এটা থেকে নরমালসি আনতে হলে প্রেসিডেন্টকে ইমার্জেন্সির জন্য বলতে হবে।
অন্যরা কী বলে? আর্মির অ্যাটিচ্যুড কী?
আর্মির অ্যাটিচ্যুড হলো, সেনাপ্রদান যা করবে, তারা তো তার বাইরে থাকবে না। সেনাপ্রধানের চিন্তাটা তো আসবে ওখান থেকেই, দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা থেকে।
তুমি আর্মির কাছে গিয়ে খোঁজ নাও।
আই টকড টু অল কমান্ডারস, জিওসিস, দু-একজন ছাড়া যাদের সঙ্গে আমার ভালো ইয়ে নাই। কারণ, এগুলি তো সাংঘাতিক কঠিন প্রশ্ন। আমি কথা বললাম। সবাই ওপিনিয়ন দিলেন যে, কিছু একটা করা উচিত। বাট নো মার্শাল ল। চিফও বলেছেন, আই অ্যাম দ্য লাস্ট ম্যান টু ডিক্লেয়ার মার্শাল ল।
ঠিক আছে। তাহলে হু উইল বি দ্য কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট? কেয়ারটেকার চিফ হওয়ার জন্য আমরা ড. ইউনূসকে বললাম। উনি বললেন যে, না।
মহি: কে কে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে?
বারী: জেনারেল মাসুদ আর আমি। না না, তার আগে তো ইমার্জেন্সি দেওয়া হলো। এর মধ্যে আমি অনেকগুলো গ্রাউন্ডওয়ার্ক করেছি। ইমার্জেন্সি প্রক্লেমেশনের জন্য যে একটা গেজেট বের করতে হবে, গেজেটে কী লেখা থাকবে? আমি দেখলাম বঙ্গবন্ধুর আমলে ইমার্জেন্সির গেজেট আছে, এরশাদ সাহেবের আমলের একটা গেজেট আছে। দুইটা এনে দেখলামÑএকটা মডারেট ভার্সন তৈরি করলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, দেশে নরমালসি আসবে। তারপর ছোটখাটো কিছু ডিজনিস আছেÑবড় আঙ্গিকের ছোটখাটো জিনিস, দলীয়করণ-টরন বাদ দিয়ে মেধাবী লোকজনকে বসানোÑএটা বোধ হয় এভাবেই করা হয়েছিল। আমি জানি না, বিচার করবেন আপনারা। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের যে সদস্যরা ছিলেন, অ্যাডভাইজাররা ছিলেন, এটা আপনারা বিচার করবেন, এরা ভালো ছিল না খারাপ ছিল। হিউম্যান এরর তো থাকবেই।
ইমার্জেন্সি হলো ১১ তারিখ। ১০ তারিখ রাতে চিফের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়। চিফ ১০ তারিখ রাতে আমাকে ফোন করলেন যে, বারী, একটা জিনিস তো পাওয়া গেছেÑইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করার পক্ষে একটা শক্ত ডকুমেন্টÑইউএন মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈনিকদের আর নিবে না। এটা তো একটা বড় প্লি আমাদের জন্য। এইমটা তো ইমার্জেন্সি না, এইম হলো পিস রি-এস্টাবলিশ করা। এটা করতে গেলে, আমরা মনে করি যে, ইমার্জেন্সিক দিতে হবে। ইমার্জেন্সি করতে গেলে এটারও তো একটা সাপোর্টিং ইয়ে লাগবে। এটা আমি দেখিও নাই কোনো দিন। উনি বলছেন। আর্মিতে তো ওরাল অর্ডার বলে একটা কথা আছে। মৌখিক অর্ডার। এটা আইনসম্মত।
এটা সিওর যে উনি আমাকে রাতে ফোন করেছিলেন। আমি জেনারেল মাসুদকে বললাম, স্যার, চিফ তো বলছেন, স্যার আপনি তাড়াতাড়ি আসেন। উনি তখন সাভারে।
উনি রওনা করলেন। আসলেন আমার অফিসে। এটা ঐতিহাসিক একটা ঘটনা। বললেন, আমিনকে (ডিজিএফআইয়ের আরেকজন পরিচালক ব্রি. জে. এ টি এম আমিন) ডাকো। আমিন-এর মধ্যে ছিল না। দেশের মধ্যে একটা মোড় নিয়া নিল আমিনকে ডাইকা। এই সব লোকÑআমিন, মইন-সাধারণ মানুষের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এরা পড়াশোনা করছে আইসোলেটেড স্কুলে। আমিনের ফাদার সম্ভবত ফরেন মিনিস্ট্রতে ছিল, বিদেশ ঘুইরা বেড়াইছে। সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে বসে যে ক্লাস করা, পালস বোঝা, গ্রামে কাদার মধ্যে লুঙ্গি উঠায়া আসাÑএ রকম তো দেখে নাই। এদের কাছে চিত্র এক রকম। আমাদের কাছে চিত্র এক রকম। যার ফলে তারা ফুটপাতে বাড়ি দিয়া উঠায়া দাও, মার্শাল ল কইরা ফেল, ভাইঙ্গা ফেলÑএই টাইপের অ্যাটিচ্যুড। টক শো বন্ধ কইরা দাও। আমি বললাম, আরে নরমালসি আনতে চাই আমরা। যখন ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হলো, সব টক শো বন্ধ। আমাকে তৃতীয় মাত্রার জিল্লুর সাহেব ফোন করলেন, ভাই আমি কি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করব? আমি তখনো বঙ্গভবনে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেনাপ্রধানকে ফোন করলাম। স্যার, এগুলা বন্ধ করবেন না। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। আমরা যদি খারাপ করি, বলুক। আমাদের বক্তব্য আমরা দিব। ভালো করলে সেটা বলবে। মানুষ তো খারাপ বলে নাই প্রথম দিকে।
যা হোক, আমিনকে আনল জেনারেল মাসুদ। তার সঙ্গে নাইন ডিভে কাজ করেছে, নাইন ডিভের আর্টিলারি কমান্ডার ছিল আমিন। আরও আগে থেকেই হয়তো পরিচয়-টরিচয় আছে। আমিনরে লাগানো হলো। আমি আমার কাজ করতে থাকলাম।
পরের দিন ১১ তারিখ মিটিং। প্রেসিডেন্টের সবাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং, ইলেকশন উপলক্ষে। ইলেকশন তো ২২ জানুয়ারি। মিটিং শুরু হলো। মিটিংয়ের মধ্যে চিফ আমাকে ফোন করে বললেন, আমি আসতেছি। তুমি থাইকো। প্রেসিডেন্টকে সব কিছু বুঝায়া বলব। সিচুয়েশন রিপোর্টটা তুমি বলবা, ফ্রম ইন্সেলিজেন্স পয়েন্ট অব ভিউ।
এর মধ্যে গোছগাছ করে আমি রেডি হয়ে গেলাম। চিফ আসরেন, বাহিনী প্রধানরা আসলেন। রাষ্ট্রপতির কাছে সময় নেওয়া হলো। উনি সময় দিলেন, লাঞ্চের পরে। তারপর ওনারা ওনাদের বক্তব্য দিলেন। সেনাপ্রধান তার বক্তব্য দিলেন। রাষ্ট্রপতি বললেন, কী করা? উনি বললেন, ইমার্জেন্সি দেওয়া।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি একটু আলাপ-আলোচনা করে দেখি।
কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে।
আমাকে পদত্যাগ করতে হবে নাকি?
না, আপনাকে প্রেসিডেন্টশিপ থেকে পদত্যাগ করতে হবে না। বাট অ্যাজ কেয়ারটেকার চিফ ইউ হ্যাভ টু রিজাইন।
তো মেকানিজম যা করার করা হইল। জেনারেল মাসুদ ওই দিকে থাকলেন, নাইন ডিভ নিয়া। ওনাকে রেডি রাখা হইল। এটা স্বাভাবিক। এখানে তো পিজিআর আছে, এসএসএফ আছে। তবে কেউ ইয়া করে নাই। সিচুয়েশন যা হইছিল, এ ছাড়া বিকল্প ছিল না। পলিটিশিয়ানস হ্যাভ ফেইলড। আই ডু নট হ্যাভ ডিসরেসপেক্ট।
তারা যেভাবে আগাইতেছিলেন-দেশের মানুষের দুই দিন পরে পরে পাছার মধ্যে লাথি দিয়া, সরি মহিউদ্দিন ভাই, আমি এ রকম দু-একটা শব্দ অতি ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করছি। দেশের মানুষের কী হলো না হলো এটা নয়, হিটলারের মতো কমান্ড পোস্ট বানাইয়া ওনারা কমান্ড দিতে থাকলেন আর মানুষ মরতে থাকল। ৬৮ জন মারা গেছে। হু রিমেম্বারস দেম? হুইচ পলিটিশিয়ান ইজ রিমেম্বারিং দেম?
ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হইল। বক্তৃতা আমরাই লেখায়া দিলাম। উনি কিছু কাটছাঁট করলেন। কট্টরপন্থী কোনো কিছু করা হয় নাইÑরাষ্ট্রপতি, আপনাকে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। বাইরে তো নানান ধরনের গুজব, সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্টের ইয়েকে চড় মারছেন, মুখলেছ সাহেবকে। অল বানোয়াট, বাখোয়াজ। উনিও দেখলাম লেখলেন বিশাল বড় এক পত্রিকার মধ্যে যে, আমি ট্রাক-ট্রুক নিয়া রেডি হইয়া আছি। আমি ট্রাক কই পাব? আমার ঢাল-তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার, আমি অ্যাকটিং ডিজি-জিজিএফআই। আমি এখানে আছি সেনাপ্রধানের সঙ্গে, প্রেসিডেন্টর সঙ্গে, কী হচ্ছে না হচ্ছে এগুলো নিয়ে।
যা হোক, ওনাদেরও পদত্যাগ করানো হলো। পদত্যাগ করানোর সঙ্গে সঙ্গেÑহু উইল বি দ্য কেয়ারটেকার চিফ? নাম আসল ড. ইউনূসের। তখন জেনারেল মাসুদকে বলা হলো, আমিনকে নিয়ে উনি গেলেন ওনার কাছে। ওনার প্রথম কথা হলো টাইম ফ্রেম কত দিনের জন্য?
তা তো আমরা বলতে পারি না?
কেউই বলতে পারে না মইনুদ্দিনও জানে না, কত দিন।
উনি বললেন, কম সময় যদি হয়, কোনো পরিবর্তন আনা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।
তারপর কাকে করা যায়? আমি সার্চ লাগাইলাম। আমার অপিসাররা বলল, স্যার, আরেকজন আছে, ফখরুদ্দীন সাহেব। আমি কল দিলাম ফখরুদ্দীন সাহেবকে।
মহি: ফখরুদ্দীন সাহেবের নাম কি ড. ইউনূস সাজেস্ট করেছিলেন, না-কি এটা আপনার চয়েস?
বারী: এটা একদম আমাদের সার্চ। আমরা তো দীর্ঘদিন ধরেই কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের নামধাম চর্চা করতেছি। আমি তখন ওনাকে ফোন করলাম। দেখেন, আগে থেকে কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা নাই। এগুলি ইনস্টেন্টলি আসতেছে, একটার পর একটা।
যদি ক্যু করার চিন্তা, ক্ষমতার চিন্তা থাকত, তাহলে তো জেনারেল এরশাদের মতো ছক কইরা ফেলতাম, দুই বছর কী করব, তিন বছর কী করব, চার বছর কী করব? এক্সপার্ট লাগাইতাম। এগুলো তো আমরা নিজেরা নিজেররাÑনরমালসি আনার জন্য, সবই বহাল থাকবে, সবাই যার যার জায়গায় থাকবে।
ফখরুদ্দীনের বাসায় ফোন করলাম। ড. ইউনূসের বাসা থেকেই তারা সোজা চলে গেলেন। উনি বললেন, আমাকে একটু সময় দেন। উনি ওনার ওয়াইফের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে।
মহি: একটা গসিপ শুনেছি, আপনারা যখন প্রফেসর ইউনূসকে অ্যাপ্রোচ করলেন, উনি টাইম ফ্রেমের ব্যাপারে অ্যাগ্রি না করায় উনি নাকি ফখরুদ্দীন সাহেবের নাম প্রস্তাব করেছেন?
বারী: না। আমার নোটবইটা আনতে পারলে দেখাইতে পারতাম, এখন পর্যন্ত নামটা লেখা আছে। ফরিদ আর মশিউর সাহেব ছিল আবার অফিসার। ফরিদ ছিল জি-ওয়ান, আর মশিউর ছিল সিভিল। এদেরকে বললাম, নাম বাইর কর। ওরা ওনার নাম প্রপোজ করল।
মহি: ফরিদ কি আর্মির লোক?
বারী: আর্মির, মশিউর সিভিলিয়ান। আমাকে কোনো কাজ দিলে আমি তো ভিশনটা এদের দিয়া দিইÑআমার এই এই দরকার, এটা বাইর কর।
মহি: ফরিদের পুরো নাম কী।
বারী: ফরিদুল ইসলাম বোধ হয়।
মহি: উনি কি ওই সময় মেজর ছিলেন?
বারী: না, লে. কর্নেল। তো এরা বাইর করল ওনার নাম। ফোন নম্বর ছিল। ওই নম্বরেই যোগাযোগ করি।
মহি: তাহলে বলছেন, এটা আপনার ইনিশিয়েটিভে হয়েছে?
বারী: কোনটা?
মহি: ফখরুদ্দীন সাহেবেরটা।
বারী: না। এরপর যখন প্যানেল করা হইল, প্যানেলের মধ্যে আমরা ২০-২৫ জনের নাম নিয়া আসছি। তারপর চিফের কাছে গিয়া সবাই মিলে আলোচনা কইরা-ওনাকে দেখ, ওনাকে নক কর।
ইভেন আমি শাইখ সিরাজকে-আমি চাইছি একটা ইয়ং অ্যাডভাইজার গ্রুপ, ডাইনামিক, পরীক্ষিত কাজের লোক। চিন্তাধারা-মতাদর্শ যা-ই হোক। হোসেন জিল্লুর রহমান-এগুলি এন্টায়ারলি আমি করছি। ইভেন আনিসুল হকের কথা আমি বলছিলাম।
মহি: ইফতেখারুজ্জামানের কথা কি আপনি বলেছিলেন?
বারী: হ্যাঁ, ইফতেখারুজ্জামান আমার লিস্টে ছিলেন। নন-মুসলিম হিসেবে নাম দরকার ছিল। তারপর তপন বাবুর নাম ছিল। তারপর আরও একজন ‘হিন্দু’ ছিল। নামটা ভুলে গেছি। মহিলা ছিলেন একজন, সিলেটের। উনি তখন ইন্ডিয়ায় ছিলেন। ইন্ডিয়ায় আমি ফোন করছি। ফোন কইরা বলছি, আপনি চইলা আসেন তাড়াতাড়ি।
মহি: এ রকম কেউ ছিল লিস্টে, আপনি চাচ্ছিলেন কিন্তু উনি রিফিউজ করেছে?
বারী: শাইখ সিরাজ।
মহি: ইফতেখারুজ্জামানও আসেন নাই।
বারী: উনি আসেন নাই বা কেউ একজন চায় নাই-এই দুইটার একটা হবে।
মহি: মইনুল হোসেনকে পরে বাদ দেওয়া হলো কেন?
বারী: ওনার কথাবার্তা একটু...। মানুষ তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেক্ট পাওয়া মুশকিল। ওনার মতো স্ট্রেচারের লোক দরকার ছিল।
মহি: ফাইনাল সিলেকশন তো চিফ করেছেন?
বারী: চিফই করেছেন, তবে অন্যদের সঙ্গে কনসাল্ট করে। আমরা লিস্ট দিছি।
মহি: একাডেমিক কাউকে পান নাই? ঢাকা ইউনিভার্সিটির?
বারী: একজনের নাম ছিল, জেনারেল মাসুদের ভায়রা। এ কারণেই ওনাকে আর করা হয় নাই। যেহেতু হি ইজ আ রিলেটিভ অব দ্য সিনিয়র মিলিটারি অফিসার।
মহি: ওই ক্যাবিনেটে ফখরুদ্দীন সাহেবের তো দুই জন রিলেটিভ ছিল?
বারী: কিন্তু এরাতো নিজস্ব গুনে এসেছিল। ফখরুদ্দীনের আত্মীয় বলেতো বাদ দিয়ে দেয়া যায় না। ফখরুদ্দীনের নিজের আত্মীয় না, ওনার ওয়াইফের দিক দিয়া আত্মীয়।
মহি: এখানে ফখরুদ্দীন সাহেবের কোন চয়েস ছিল না?
বারী: না। ফখরুদ্দীন সাহেব তো নিজেই পিকড আপ। হি নেভার নিউ অ্যাবাউট দ্য ইমার্জেন্সি।
No comments