রূপান্তরিত মারণাস্ত্রে জীবনের আর্তি
সময়টা
নব্বই দশক। ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবিতে প্রথম
ইন্তিফাদা চলমান। সেই সময় থেকেই ইসরায়েলি মারণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ
করে যাচ্ছেন পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারখ্যাত অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায়
বেড়ে ওঠা শিল্পী মাজদি আবু তাক্কিয়েহ। উদ্দেশ্য, দখলদার বাহিনীর অমানবিক
কর্মকাণ্ডের ঐতিহাসিক স্মৃতি ধরে রাখা। ব্যবহৃত গুলির খোসা, ফিলিস্তিনিদের
শরীর ভেদ করে যাওয়া গুলির অবশেষ কিংবা টিয়ারশেলের কৌটা; তাক্কিয়েহ যেখানেই
ইসরায়েলি নৃশংসতার আলামত পেতেন, সেখান থেকেই তা কুড়িয়ে নিতেন। সংগ্রহে
রাখতেন নৃশংসতার ঐতিহাসিক আলামত হিসেবে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের ভূমি
দিবসের কর্মসূচি গ্রেট রিটার্ন মার্চ-এ ইসরায়েলি নৃশংসতার আধিক্য তার
মনোজগতে প্রতিরোধ জোরালো করার তাগিদ সৃষ্টি করে। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে
মারণাস্ত্রের অবশেষকে তিনি রূপান্তর করতে শুরু করেন ক্ষুদ্রাকৃতির
মূর্তি/ভাস্কর্যে। তাক্কিয়েহ’র কাছে এটা প্রতিবাদেরই এক ভিন্ন পথ। এর মধ্য
দিয়ে তিনি ফিলিস্তিনিদের অহিংস প্রতিরোধকে প্রতীকায়িত করতে চান। ছড়িয়ে দিতে
চান জীবনের প্রতি ফিলিস্তিনিদের ভালোবাসার বার্তা। ছড়িয়ে দিতে চান জীবনের
আহ্বান।
গাজা-ইসরায়েল সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত গুলির অবশেষ সংগ্রহ করে ফেরেন মাজদি। বুলেটের ধ্বংসাবশেষ, টিয়ারগ্যাসের খালি কৌটা এমনকি হাসপাতাল থেকে ফিলিস্তিনিদের গায়ে লাগা ইসরায়েলের গুলির অবশেষও স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করেন তিনি। ১৯৯১ সালে ফিলিস্তিনের প্রথম জাতিমুক্তি আন্দোলন প্রথম ইন্তিফাদা থেকেই এই অভ্যাস গড়ে তুলেছেন তিনি। তবে সদ্য সমাপ্ত গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন কর্মসূচীতে ইসরায়েলের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের আধিক্যের পর আবু তাক্কিয়েহ তার স্মারককে শিল্পে পরিণত করেছেন তিনি। ছোট ছোট মূর্তি বা ক্ষুদ্রাক্রিতির (মিনিয়েচার) স্থাপনা শিল্পে পরিণত করার কাজ করেন তিনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম মিডলইস্ট আই এই শিল্পীর খবর সামনে এনেছে।
গাজা-ইসরায়েল সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত গুলির অবশেষ সংগ্রহ করে ফেরেন মাজদি। বুলেটের ধ্বংসাবশেষ, টিয়ারগ্যাসের খালি কৌটা এমনকি হাসপাতাল থেকে ফিলিস্তিনিদের গায়ে লাগা ইসরায়েলের গুলির অবশেষও স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করেন তিনি। ১৯৯১ সালে ফিলিস্তিনের প্রথম জাতিমুক্তি আন্দোলন প্রথম ইন্তিফাদা থেকেই এই অভ্যাস গড়ে তুলেছেন তিনি। তবে সদ্য সমাপ্ত গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন কর্মসূচীতে ইসরায়েলের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের আধিক্যের পর আবু তাক্কিয়েহ তার স্মারককে শিল্পে পরিণত করেছেন তিনি। ছোট ছোট মূর্তি বা ক্ষুদ্রাক্রিতির (মিনিয়েচার) স্থাপনা শিল্পে পরিণত করার কাজ করেন তিনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম মিডলইস্ট আই এই শিল্পীর খবর সামনে এনেছে।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩০ মার্চ ভূমি দিবসের বিক্ষোভ
কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১২০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে
ইসরায়েলি বাহিনী। আহত হয়েছে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি। সেই আহত ফিলিস্তিনিদের
মধ্যে ছিলেন শিল্পী তাক্কিয়েহ’র ছোট ভাইও। ইসরায়েলি স্নাইপারের অব্যর্থ
নিশানা বিদ্ধ করে তার দুই পা। ইসরায়েলি সীমান্তবেড়ার ৭০০ মিটার দূরে
গুলিবিদ্ধ হন তাক্কিয়েহ’র ১৯ বছর বয়সী সহোদর। তার ডান পায়ের স্নায়ুগুলো
সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে থেকে গেছে গুলির অবশেষ। চিকিৎসা চলতে থাকা
ছোট ভাইটি এখনও হাঁটতে পারে না। তার চিকিৎসকদের কাছ থেকে ভাইয়ের পায়ে বিদ্ধ
হওয়া একটি গুলি নিজের সংগ্রহে নিয়ে আবু তাক্কিয়েহ তাকে রুপান্তর করেন একটি
কনানীয় (জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে প্রাচীন ফিলিস্তিনি বাসিন্দা) মিনিয়েচার
সৈনার। তার ভাষ্য, ‘কনানীয়রা আমাদের পূর্বপ্রজন্ম। তারাই প্রথম ফিলিস্তিনে
এসেছিলেন।’ তাক্কিয়েহ জানান, গুলিকে কনানীয় সৈন্যে রুপান্তরের মধ্য দিয়ে
তিনি বাস্তবত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিজেদের বসবাসের অধিকারকে প্রতীকায়িত করার
চেষ্টা করেছেন।
কনানীয়রা ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্তের আদিবাসী, কয়েক হাজার বছর আগে
প্রাচীন ফিলিস্তিন যার অংশ ছিল। আদি বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলিরা
তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করে। মানববিদ্যার সাম্প্রতিক এক গবেষণা অবশ্য
বলছে, প্রাচীন কনানীয়দের বংশধরেরা এখনও অস্তিত্বশীল, যারা আধুনিক লেবাননে
বসবাস করছেন। আবু তাক্কিয়েহ বলেন, ‘এইসব সহিংস অস্ত্রকে আমি হাতে তৈরি
শান্তিপূর্ণ মূর্তি আর মিনিয়েচার শিল্পে পরিণত করেছি।’ তিনি জানান,
ইসরায়েলি দখলদারিত্ব আর অবরোধের বিরুদ্ধে এটিই তার প্রতিবাদ।
তিন সন্তানের পিতা ৩৮ বছর বয়স্ক আবু তাক্কিয়েহ একজন সাবেক নৌসেনা।
বর্তমানে অবসর যাপনকারী এই ফিলিস্তিনি ১৩ বছর বয়সে কয়লা দিয়ে প্রথম ছবি
আঁকা শুরু করেন। ১৫ বছর বয়সে কাঠ খোদাই শুরু করেন তিনি। তার একটি ভাস্কর্যে
ফিলিস্তিনি মানচিত্রের সঙ্গে টেম্পল মাউন্টের স্বর্ণ-গম্বুজের দেখা মেলে।
সঙ্গে পাওয়া যায়, ইসরায়েলি সীমান্তের কাঁটাতারে খোদিত এক চাবি। ৪৮ ঘণ্টায়
নির্মিত আবু তাক্কিয়েহর ওই শিল্পকর্মটি ইসরায়েলের দখলদারিত্বের প্রতীক।
তিনি জানান, একটি কাজ শুরুর পর শেষ না করে বিশ্রাম নিতে পারেন না তিনি।
তিনি বিশ্বাস করেন একদিন তার শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে মূর্ত হবে
ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের বাস্তবতা। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের জন্য এটি
‘ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি ভালোবাসা’র বার্তা।
‘গ্রেট রিটার্ন মার্চ’ নামের সাম্প্রতিক কর্মসূচিকে শিল্পকর্মে ধরে
রাখতে আবু তাক্কিয়েহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। দুই রাত নির্ঘুম
কাটিয়ে নির্মিত ওই শিল্পকর্মে বুলেট আর টিয়ার গ্যাসের খালি কৌটার মতো
অস্ত্র-সরঞ্জামকে ব্যবহার করে কর্মসূচির ঐতিহাসিক স্মৃতি ধরে রাখতে চেয়েছেন
তিনি। ওই কর্মসূচি নিয়ে নির্মিত নিজের শিল্পকর্মে আবু তাক্কিয়েহ
বিক্ষোভকারীদের অবস্থান করার তাঁবু ও বিক্ষোভকারীদের আহত হওয়ার দুঃসহ
অভিজ্ঞতার চিহ্নও ধরে রেখেছেন। কর্মসূচিতে সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর
স্মারক হিসেবে একটি স্ট্রেচার, একটি হেলমেট ও প্রেস লেখা একটি ভেস্টও
রয়েছে তার শিল্পকর্মের তালিকায়। সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করা
প্যারিসভিত্তিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের তথ্য অনুযায়ী এবছরের
গ্রেট রিটার্ন অব মার্চ কর্মসূচিতে এ পর্যন্ত ইসরায়েলের ছোঁড়া গুলিতে আহত
হয়েছেন ১৫ সাংবাদিক। এর মধ্যে ইয়াসির মুর্তজা ও আহমেদ আবু হুসেইন নামে
দুইজন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত হন। আবু তাক্কিয়েহের শিল্পকর্মটিতে
রয়েছে দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ এক কিশোরও। ফিলিস্তিনি পতাকার রংয়ে বানানো একটি
ঘুড়ি সীমান্ত এলাকায় ওড়ানোর সময়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে।
তাক্কিয়েহের কাজের পদ্ধতি বেশ শ্রমসাধ্য। তার প্রতিটি শিল্পকর্মই
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রথমে তিনি একটি স্টোভের ওপর রেখে
মারণাস্ত্রের অবশেষে তাপ প্রয়োগ করেন। এতে নরম হয়ে যাওয়া বস্তুটি বাঁকানো
সহজ হয়ে যায় তার জন্য। পর্যাপ্ত গরম হওয়া বস্তুকে হাতুড়ি দিয়ে চ্যাপ্টা করে
নেন তিনি। পর্যায়ক্রমে ধারালো ফাইল আর ব্লেড ব্যবহার করে সেটিকে
স্থাপত্যের সুনির্দিষ্ট আকৃতি দেন তিনি। সবশেষে তেল রং ব্যবহার করে
শিল্পকর্মকে পূর্ণাঙ্গ করেন তিনি। ৩০ বছর বয়সী স্ত্রী ওয়ালা বিভিন্ন ধারণা
দিয়ে আর শিল্পকর্মে রং লাগিয়ে তাক্কিয়েহকে সহযোগিতা করেন। এছাড়া আবু
তাক্কিয়েহ তাকে স্থাপত্যের ওপরে ধারালো ফাইল আর ব্লেড ব্যবহার শেখান। ওয়ালা
বলেন, স্বামীর প্রতিটি শিল্পকর্ম তাকে গর্বিত করে। কারণ তিনি তার জীবনের
একটা বড় অংশ ব্যয় করছেন ফিলিস্তিনিদের শান্তির আহাজারি বিশ্বব্যপী ছড়িয়ে
দেওয়ার কাজে।
শিল্প আর কষ্ট-বেদনার সম্পর্ক পারস্পরিক বলেই কিনা, গ্রেট রিটার্ন মার্চ
সংক্রান্ত শিল্পকর্মটি নির্মাণ করতে গিয়ে তাক্কিয়েহেকে যেতে হয়েছে কঠোর
বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। কর্মসূচি চলাকালীন গাজা উপত্যকা থেকে সংগ্রহ করা একটি
বুলেট গরম করার সময়ে তা আবু তাক্কিয়েহের হাতেই বিস্ফোরিত হয়। আঙুলে আঘাত
পেয়ে আহত হন তিনি।
২০১৭ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জোর করে অবসরে পাঠানো ৬ হাজার সরকারি
কর্মচারির একজন আবু তাক্কিয়েহ। তিনি জানান, খুব কষ্ট করে পরিবারের জন্য
প্রয়োজনীয় বাড়িভাড়া আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারেন। প্রতিবাদী
শিল্পকর্মের মাধ্যমে তিনি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার পরিস্থিতিকে মূর্ত করতে
সক্ষম হন। তবে শিল্পকর্মে প্রতিবাদ শাণিত করতে তার আরও কিছু সরঞ্জাম কেনা
দরকার। দরকার মাইক্রো ফায়ারস্টিল, সিরামিক মাটি আর উন্নতমানের রং। অবরুদ্ধ
গাজার বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির শিকার এই তরুণের হাতে সেসব কেনার
মতো টাকা নেই। তবে তার প্রতিবাদী শিল্পকর্মকে মুনাফাবাজির উপজীব্য করতে চান
না তাক্কিয়েহ। বিক্রির পরিবর্তে গাজা পরিদর্শনে আসা মানুষদের মধ্যে
সুভ্যেন্যুর হিসেবে এসব বিতরণ করেন তাক্কিয়েহ।
একটি শিল্পকর্মে তাক্কিয়েহ গুলির ভেতর থেকে বের হতে চাওয়া পায়রাকে
প্রতীকায়িত করেছেন। এর মধ্য দিয়ে শান্তির সপক্ষে ফিলিস্তিনিদের অব্যাহত
লড়াইকেই সামনে আনতে চেয়েছেন তিনি। মিডল ইস্ট আই-এর কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে
তিনি জানান, ইসরায়েলি সীমান্তবেড়ার কাছাকাছি যেই যাক না কেন, তাকেই
মারণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। তিনি বলেন, ‘সীমান্তে যখন গুলি সংগ্রহ
করি তখন আমার জীবনও বিপন্ন হতে পারে।’ তবে মৃত্যৃর ভয়ে ভীত নন জীবনবাদী এই
শিল্পী। তিনি মনে করেন, যার কাছে বিশ্বকে দেওয়ার মতো অপরিহার্য বার্তা
থাকে, তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাকে জীবন উৎসর্গও করতে হতে পারে। ‘একজন
সাংবাদিক কিংবা শিল্পী কিংবা চিত্রকর; প্রত্যেকেরই নিজ নিজ বার্তা থাকে।’
এই ফিলিস্তিনি শিল্পীর ভাষ্য, ‘আমি জীবনের ওপারে গেলেও আমার বার্তা থেকে
যাবে এই পৃথিবীতে। গ্রেট মার্চ রিটার্নের গল্প প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম
থেকে প্রজন্মান্তরে। কখনও তার মৃত্যু হবে না’।
No comments