এক বোতল ফেনসিডিলের বিচার শেষ হয়নি সাড়ে ৮ বছরেও! by আমানুর রহমান রনি
রাজধানীর
বিমানবন্দর থানার এক বোতল ফেনসিডিল মামলার বিচার গত সাড়ে আট বছরেও শেষ
হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা মামলার অভিযোগপত্র দিলেও আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি
পক্ষের আইনজীবী নিয়মিত আবেদনের মাধ্যমে গত আট বছর ধরে কালক্ষেপণ করছেন।
সাক্ষীর তালিকায় থাকা পুলিশের বিরুদ্ধে একাধিকবার সমনের পর গ্রেফতারি
পরোয়ানা জারি হয়। কিন্তু পরে আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই সাক্ষী না
থাকায় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দায়ের করা ওই মামলার বিচারকাজ চলছে এখনও।
এভাবেই সাক্ষীর অভাবে মাদক সংশ্লিষ্ট মোট মামলার ৬২ শতাংশ আসামিই খালাস
পেয়ে যায়।
২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি বিমানবন্দর থানার সিভিল অ্যাভিয়েশন কোয়ার্টারের দক্ষিণ পাশে রাত ১২টার দিকে এক তরুণ ওই থানার টহল পুলিশের সামনে থেকে সন্দেহজনকভাবে পালানোর চেষ্টা করেছিল। এমন সময় টহলরত পুলিশ তাকে গতিরোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই টহল পুলিশ দলের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন বিমানবন্দর থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আব্দুল আওয়াল। তার সঙ্গে ছিলেন একজন কনস্টেবল ও দুই আনসার সদস্য।
সন্দেহভাজন তরুণকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এএসআই। সে তার নাম জানায় জহিরুল ইসলাম রানা খান (২৯)। পুলিশ তাকে তল্লাশি করে। একসময় পুলিশের জেরার মুখে রানা খান তার প্যান্টের ডান পকেট থেকে একবোতল ফেনসিডিল বের করে দেয়। এরপর তাকে আটক করা হয়। এই ঘটনায় এএসআই আব্দুল আওয়াল বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ওইদিন রাতেই একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর ৪৫। পরদিন আদালতে পাঠানো হয় রানাকে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গাজীপুরের বোর্ডবাজারে শাহিন ও দেলোয়ার নামে দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে নিষিদ্ধ ফেনসিডিল কিনেছিলেন তিনি।
মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আহসান হাবীব। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা হন একই থানার আরেক এসআই অংশু কুমার দেব। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি চার্জশিট দাখিল করেন তিনি। তবে যাদের কাছ থেকে রানা ফেনসিডিল বোতল কিনেছিলেন বলে পুলিশকে তথ্য দেন, তাদেরকে চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছে পুলিশ। এর কারণ হিসেবে এজাহারে উল্লেখ করা হয়, তাদের সঠিক নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই অংশু কুমার দেব ২০১০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মুখ্য মহানরগর হাকিমের (সিএমএম) কোর্টে চার্জশিট দাখিল করেন। সেটি গ্রহণ করে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠান সিএমএম কোর্ট। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য একই বছরের ২১ মার্চ ঢাকার ৮ নম্বর বিচারিক আদালতে পাঠান। এই সময়ে কারাগারেই ছিলেন রানা। ওই বছরের জুনে জামিন পান তিনি।
নথি থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের আগস্ট ও অক্টোবরে পৃথক দুটি মামলার ধার্য তারিখ ছিল। তবে আদালত অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এর কার্যক্রম হয়নি। একই বছরের ৩০ নভেম্বর আদালতে মামলার নির্ধারিত তারিখ ছিল। ওইদিনও আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১১ সালের ৮ মার্চ রানার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। তবে মামলার বাদী উপস্থিত না থাকায় এর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ ফের সময় আবেদন করেন। বাদীর জবানবন্দি নেওয়ার জন্য পুনরায় সময়ের আবেদন করা হয়। মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ ৩৭ বার সময় আবেদন করেছেন। কখনও সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারা, কখনও প্রস্তুতি না থাকা; এমন কিছু কারণ দেখানো হয়েছে আবেদনে। এতকিছুর পরও সাক্ষীদের হাজির করা যায়নি। সাক্ষীর তালিকায় যেসব পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে, তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কেউ এখন আর বিমানবন্দর থানায় নেই। কে কোথায় আছেন তাও জানেন না কেউ।
২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল আদালত বাদী এএসআই আব্দুল আউয়ালকে কোর্টে সাক্ষী দেওয়ার জন্য পরোয়ানা জারি করেছিল। তাও তিনি হাজির হননি। এরপর ৩১ মে মামলার তারিখের দিন রাষ্ট্রপক্ষ আবার সময় আবেদন করেন। ২০১২ সালে এভাবে প্রতিটি তারিখে সাক্ষীর জন্য কালক্ষেপণ হয়েছে। তবে আসামি রানা হাজির ছিলেন নিয়মিত। কোর্টে হাজির হতে না পেরে ২০১৩ সালের এপ্রিলে একটি সময় চেয়ে আবেদন করেন তিনি।
প্রায় আড়াই বছর পর ২০১৩ সালের ২৯ মে মামলার বাদী আদালতে হাজির হলেও তার প্রস্তুতি না থাকায় সাক্ষী দিতে পারেননি। উপায় না পেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবার সময়ের আবেদন করেন। একই বছরের জুলাই আর অক্টোবরেও সময় আবেদন করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের ক্রমাগত এমন সময় আবেদন দেখে ২০১৪ সালের আগস্টে আদালত মামলার তিন সাক্ষীর বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। তারা হলেন এক কনস্টেবল ও দুই আনসার সদস্য। যারা ঘটনার সময় টহল পুলিশ দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তারপরও সেই তিন সাক্ষী হাজির হননি। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ এভাবেই আসামিদের আসার অপেক্ষায় সময় আবেদন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মামলার সব সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এই পরোয়ানা বিমানবন্দর থানায় পাঠিয়ে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই পরোয়ানার পর পুলিশ আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়— এএসআই আব্দুল আউয়াল, কনস্টেবল আব্দুল মোমিন, এএসআই শফিকুল ইসলাম, এসআই আহসান হাবীব ও এসআই অংশু কুমার দেবের খোঁজ মিলছে না। কেউ এখন বিমানবন্দর থানায় নেই। তারা কেউ সেখানে বেশিদিন কর্মরত ছিলেন না বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। এভাবে শেষ হয়েছে ২০১৭ সাল।
২০১৮ সালের এপ্রিলে মামলার নির্ধারিত তারিখ ছিল। ওইদিন বিশেষ জজ আদালত ৮-এর বিচারক শামীম আহমেদ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সমালোচনা করেন। এ সময় সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অপরাগতা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। আগামী জুলাইয়ে মামলাটির পুনরায় তারিখ ধার্য করা হয়।
মামলার বাদী আব্দুল আউয়াল বর্তমানে লালবাগ থানায় কর্মরত আছেন। এই আট বছরে পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে লালবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আউয়াল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আট থেকে নয় বছর আগের ঘটনা, আমার সব মনে নেই। তবে আসামিকে গ্রেফতারের পর মামলা দিয়ে এসেছিলাম। পরদিন তাকে কোর্টে চালান করা হয়। আসামি রানা ফেনসিডিল বোতল কাউকে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। সে স্বীকার করেছে। তবে কাকে দেবে তা বলেনি, যার কাছ থেকে কিনেছিল তার ঠিকানাও পাইনি।’
বিচার প্রক্রিয়া এত বিলম্বের বিষয়টি জানেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছি, বিচারের বিষয় আদালত বলতে পারবে। আমার সাক্ষী দিয়ে এসেছি। অন্য সাক্ষীরা কে কোথায় আছে তা বলতে পারবো না। যেদিন সাক্ষী দিয়েছি, সেদিন আদালত জানতে চেয়েছিলেন— আর কোনও কাজ পাওনি, এক বোতল ফেনসিডিলের মামলা ধরাইয়া দিয়ে আসছো?’
মামলার বিচার কাজ এতদিনেও শেষ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশেষ জজ আদালত ৮-এর সরকারি কৌঁসুলী আমির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরাও চাচ্ছি ২০১০ সালের মামলা দ্রুত শেষ করতে কিন্তু সাক্ষী আসে না। আমরা সাক্ষীর বিরুদ্ধে সমন, গ্রেফতারি পরোয়ানা, পুলিশ সদর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত লিখেছি, তাও আসে না। সাক্ষী না এলে মামলা শেষ করবো কীভাবে?’
এরকম শত শত মামলা আছে বলেও জানান আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ না এলে কী করবো? তারা আসে, কখনও দূরে থাকে। আমি বিভিন্ন সময় তাদের ফোন করি, তাও আসে না। আদালত চেষ্টা করছেন, তবে মামলার কাজ শেষ হচ্ছে না।’
আসামি পক্ষের আইনজীবী মো. আবদুল মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক তথ্য অনুযায়ী— ২০১৬ সালে র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়ের করা মামলার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৭৩৯টি। এসব মামলায় আসামি ৮৭ হাজার ১৪ জন।
২০১৭ সালে সারাদেশে মাদক মামলা হয় ১ লাখ ৬ হাজার ৫৩৬টি। এর মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ১১ হাজার ৬১২টি মামলা করে। তবে সেই তুলনায় ২০১৭ সালে আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে খুবই কম— মাত্র ২ হাজার ৫৩৯টি। নিষ্পত্তি হওয়া বেশিরভাগ মামলাই ৭-৮ বছর আগের পুরনো। এসব মামলায় মোট আসামি ছিল ২ হাজার ৬৮০ জন। তাদের মধ্যে সাজা হয়েছে ১ হাজার ৬৫ জনের ও খালাস পেয়েছে ১ হাজার ৬১৫ জন। মূলত মাদক বহনকারীরাই বেশি শাস্তি পেয়েছে। মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে ৬২ শতাংশ।
২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি বিমানবন্দর থানার সিভিল অ্যাভিয়েশন কোয়ার্টারের দক্ষিণ পাশে রাত ১২টার দিকে এক তরুণ ওই থানার টহল পুলিশের সামনে থেকে সন্দেহজনকভাবে পালানোর চেষ্টা করেছিল। এমন সময় টহলরত পুলিশ তাকে গতিরোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই টহল পুলিশ দলের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন বিমানবন্দর থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আব্দুল আওয়াল। তার সঙ্গে ছিলেন একজন কনস্টেবল ও দুই আনসার সদস্য।
সন্দেহভাজন তরুণকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এএসআই। সে তার নাম জানায় জহিরুল ইসলাম রানা খান (২৯)। পুলিশ তাকে তল্লাশি করে। একসময় পুলিশের জেরার মুখে রানা খান তার প্যান্টের ডান পকেট থেকে একবোতল ফেনসিডিল বের করে দেয়। এরপর তাকে আটক করা হয়। এই ঘটনায় এএসআই আব্দুল আওয়াল বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ওইদিন রাতেই একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর ৪৫। পরদিন আদালতে পাঠানো হয় রানাকে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গাজীপুরের বোর্ডবাজারে শাহিন ও দেলোয়ার নামে দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে নিষিদ্ধ ফেনসিডিল কিনেছিলেন তিনি।
মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আহসান হাবীব। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা হন একই থানার আরেক এসআই অংশু কুমার দেব। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি চার্জশিট দাখিল করেন তিনি। তবে যাদের কাছ থেকে রানা ফেনসিডিল বোতল কিনেছিলেন বলে পুলিশকে তথ্য দেন, তাদেরকে চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছে পুলিশ। এর কারণ হিসেবে এজাহারে উল্লেখ করা হয়, তাদের সঠিক নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই অংশু কুমার দেব ২০১০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মুখ্য মহানরগর হাকিমের (সিএমএম) কোর্টে চার্জশিট দাখিল করেন। সেটি গ্রহণ করে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠান সিএমএম কোর্ট। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য একই বছরের ২১ মার্চ ঢাকার ৮ নম্বর বিচারিক আদালতে পাঠান। এই সময়ে কারাগারেই ছিলেন রানা। ওই বছরের জুনে জামিন পান তিনি।
নথি থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের আগস্ট ও অক্টোবরে পৃথক দুটি মামলার ধার্য তারিখ ছিল। তবে আদালত অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এর কার্যক্রম হয়নি। একই বছরের ৩০ নভেম্বর আদালতে মামলার নির্ধারিত তারিখ ছিল। ওইদিনও আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১১ সালের ৮ মার্চ রানার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। তবে মামলার বাদী উপস্থিত না থাকায় এর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ ফের সময় আবেদন করেন। বাদীর জবানবন্দি নেওয়ার জন্য পুনরায় সময়ের আবেদন করা হয়। মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ ৩৭ বার সময় আবেদন করেছেন। কখনও সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারা, কখনও প্রস্তুতি না থাকা; এমন কিছু কারণ দেখানো হয়েছে আবেদনে। এতকিছুর পরও সাক্ষীদের হাজির করা যায়নি। সাক্ষীর তালিকায় যেসব পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে, তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কেউ এখন আর বিমানবন্দর থানায় নেই। কে কোথায় আছেন তাও জানেন না কেউ।
২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল আদালত বাদী এএসআই আব্দুল আউয়ালকে কোর্টে সাক্ষী দেওয়ার জন্য পরোয়ানা জারি করেছিল। তাও তিনি হাজির হননি। এরপর ৩১ মে মামলার তারিখের দিন রাষ্ট্রপক্ষ আবার সময় আবেদন করেন। ২০১২ সালে এভাবে প্রতিটি তারিখে সাক্ষীর জন্য কালক্ষেপণ হয়েছে। তবে আসামি রানা হাজির ছিলেন নিয়মিত। কোর্টে হাজির হতে না পেরে ২০১৩ সালের এপ্রিলে একটি সময় চেয়ে আবেদন করেন তিনি।
প্রায় আড়াই বছর পর ২০১৩ সালের ২৯ মে মামলার বাদী আদালতে হাজির হলেও তার প্রস্তুতি না থাকায় সাক্ষী দিতে পারেননি। উপায় না পেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবার সময়ের আবেদন করেন। একই বছরের জুলাই আর অক্টোবরেও সময় আবেদন করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের ক্রমাগত এমন সময় আবেদন দেখে ২০১৪ সালের আগস্টে আদালত মামলার তিন সাক্ষীর বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। তারা হলেন এক কনস্টেবল ও দুই আনসার সদস্য। যারা ঘটনার সময় টহল পুলিশ দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তারপরও সেই তিন সাক্ষী হাজির হননি। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ এভাবেই আসামিদের আসার অপেক্ষায় সময় আবেদন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মামলার সব সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এই পরোয়ানা বিমানবন্দর থানায় পাঠিয়ে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই পরোয়ানার পর পুলিশ আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়— এএসআই আব্দুল আউয়াল, কনস্টেবল আব্দুল মোমিন, এএসআই শফিকুল ইসলাম, এসআই আহসান হাবীব ও এসআই অংশু কুমার দেবের খোঁজ মিলছে না। কেউ এখন বিমানবন্দর থানায় নেই। তারা কেউ সেখানে বেশিদিন কর্মরত ছিলেন না বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। এভাবে শেষ হয়েছে ২০১৭ সাল।
২০১৮ সালের এপ্রিলে মামলার নির্ধারিত তারিখ ছিল। ওইদিন বিশেষ জজ আদালত ৮-এর বিচারক শামীম আহমেদ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সমালোচনা করেন। এ সময় সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অপরাগতা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। আগামী জুলাইয়ে মামলাটির পুনরায় তারিখ ধার্য করা হয়।
মামলার বাদী আব্দুল আউয়াল বর্তমানে লালবাগ থানায় কর্মরত আছেন। এই আট বছরে পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে লালবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আউয়াল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আট থেকে নয় বছর আগের ঘটনা, আমার সব মনে নেই। তবে আসামিকে গ্রেফতারের পর মামলা দিয়ে এসেছিলাম। পরদিন তাকে কোর্টে চালান করা হয়। আসামি রানা ফেনসিডিল বোতল কাউকে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। সে স্বীকার করেছে। তবে কাকে দেবে তা বলেনি, যার কাছ থেকে কিনেছিল তার ঠিকানাও পাইনি।’
বিচার প্রক্রিয়া এত বিলম্বের বিষয়টি জানেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছি, বিচারের বিষয় আদালত বলতে পারবে। আমার সাক্ষী দিয়ে এসেছি। অন্য সাক্ষীরা কে কোথায় আছে তা বলতে পারবো না। যেদিন সাক্ষী দিয়েছি, সেদিন আদালত জানতে চেয়েছিলেন— আর কোনও কাজ পাওনি, এক বোতল ফেনসিডিলের মামলা ধরাইয়া দিয়ে আসছো?’
মামলার বিচার কাজ এতদিনেও শেষ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশেষ জজ আদালত ৮-এর সরকারি কৌঁসুলী আমির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরাও চাচ্ছি ২০১০ সালের মামলা দ্রুত শেষ করতে কিন্তু সাক্ষী আসে না। আমরা সাক্ষীর বিরুদ্ধে সমন, গ্রেফতারি পরোয়ানা, পুলিশ সদর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত লিখেছি, তাও আসে না। সাক্ষী না এলে মামলা শেষ করবো কীভাবে?’
এরকম শত শত মামলা আছে বলেও জানান আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ না এলে কী করবো? তারা আসে, কখনও দূরে থাকে। আমি বিভিন্ন সময় তাদের ফোন করি, তাও আসে না। আদালত চেষ্টা করছেন, তবে মামলার কাজ শেষ হচ্ছে না।’
আসামি পক্ষের আইনজীবী মো. আবদুল মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক তথ্য অনুযায়ী— ২০১৬ সালে র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়ের করা মামলার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৭৩৯টি। এসব মামলায় আসামি ৮৭ হাজার ১৪ জন।
২০১৭ সালে সারাদেশে মাদক মামলা হয় ১ লাখ ৬ হাজার ৫৩৬টি। এর মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ১১ হাজার ৬১২টি মামলা করে। তবে সেই তুলনায় ২০১৭ সালে আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে খুবই কম— মাত্র ২ হাজার ৫৩৯টি। নিষ্পত্তি হওয়া বেশিরভাগ মামলাই ৭-৮ বছর আগের পুরনো। এসব মামলায় মোট আসামি ছিল ২ হাজার ৬৮০ জন। তাদের মধ্যে সাজা হয়েছে ১ হাজার ৬৫ জনের ও খালাস পেয়েছে ১ হাজার ৬১৫ জন। মূলত মাদক বহনকারীরাই বেশি শাস্তি পেয়েছে। মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে ৬২ শতাংশ।
No comments