নিপীড়ন আর হত্যাযজ্ঞ কেন ‘দুই পক্ষের সংঘাত’ আখ্যা পায়? by ড. রামজি বারুদ
ড.
রামজি বারুদ মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লিখছেন ২০ বছর ধরে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক
বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব এক্সিটার-এ ফিলিস্তিন অধ্যয়ন বিষয়ে গবেষণা
করে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। ফিলিস্তিনে জন্ম নেওয়া আরব বংশোদ্ভূত এই
আমেরিকান বেড়ে উঠেছেন পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারখ্যাত গাজা উপত্যকার
শরণার্থী শিবিরে। তার বাবা জীবনভর লড়েছেন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার দাবিতে।
বারুদ নিজেও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার পক্ষে একজন সোচ্চার কণ্ঠস্বর। বেশকিছু
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিদ্বান
হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন বিশ্বজুড়ে। বারুদ ২০টিরও বেশি দেশে বক্তৃতা করেছেন
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন
অতিথি-প্রভাষক হিসেবে। স্বনামধন্য এই আন্তর্জাতিক সাংবাদিক, লেখক ও
কলামিস্টের সাড়া জাগানো বই ‘পৃথিবীর প্রান্তে: একটি ফিলিস্তিনি আখ্যান’
(দ্য লাস্ট আর্থ, অ্যা প্যালেস্টানিয়ান স্টোরি)। সার্চিং জেনিন, দ্য
সেকেন্ড প্যালেস্টাইনিয়ান ইন্তিফাদা, মাই ফাদার ওয়াজ অ্যা ফ্রিডম ফাইটার :
গাজাস আনটোল্ড স্টোরি নামেও বই লিখেছেন তিনি।
১৯৯৯ সাল থেকে প্যালেস্টাইন ক্রনিক্যাল সম্পাদনা করছেন বারুদ। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন লন্ডনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের উপ-ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে। কাতারভিত্তিক আল জাজিরার হয়েও একই ধরনের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আলজাজিরা-ইংলিশের গবেষণা ও অধ্যয়ন বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তির পদেও ছিলেন তিনি। ফরাসি, তুর্কি, আরবি ও কোরিয়ানসহ নানা ভাষায় তার বইয়ের অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
১৯৮৭ সালের প্রথম ইন্তিফাদার সময় বারুদ ১৫ বছরের কিশোর। কাতারভিত্তিক আলজাজিরায় গত বছর (২০১৭) ডিসেম্বরে লেখা তার এক নিবন্ধ (চিলড্রেন অব স্টোনস: দ্য ডে প্যালেস্টাইন ওয়াজ রিবর্ন) থেকে জানা যায়, মুক্তির লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যুক্ত ছিলেন তিনি। ওই বছরেই ইসরায়েলি দখলদারিত্ব আর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের সূচনা করেছিল ফিলিস্তিনিরা। পরিচয় আর মর্যাদা রক্ষায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ভারি মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের মুক্তিকামী প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল পাথরকে অস্ত্র বানিয়ে। বারুদ মনে করেন, তার নিজের পাশাপাশি প্রত্যেক ফিলিস্তিনির পুনর্জন্ম প্রথম ইন্তিফাদার মধ্য দিয়ে, তারা প্রত্যেকেই ‘পাথরের সন্তান’।
প্যালেস্টাইন ক্রনিক্যাল ও মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বারুদ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংকটকে ‘সংঘাত’ নামে ডাকার ভয়াবহতা উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। সংকটের নেপথ্যের মার্কিন ও ইসরায়েলি নীতির রাজনৈতিকতাকে সামনে এনে তিনি ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষার অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতি নতজানু নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সেই অংশকে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি শুড নট স্ট্যান্ড বাই এজ ইসরায়েল অ্যাবিউজ প্যালেস্টানিয়ানস’ শিরোনামে লেখা বারুদের সেই নিবন্ধের পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য তুলে ধরা হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকের জন্য। ভাষান্তর করেছেন, ফাহমিদা উর্ণি।
ফিলিস্তিনে যা ঘটছে তাকে ঠিক ‘সংঘাত’ বলা যায় না। আমরা শব্দটি ব্যবহার করি ঠিকই, তবে ‘সংঘাত’ শব্দ দিয়ে আসলে সেখানকার পরিস্থিতি বোঝানো যায় না। ‘সংঘাত’ বললে মনে হয়, যেন জাতিসংঘের অগণিত প্রস্তাব লঙ্ঘনকারী সামরিক শক্তি ইসরায়েল আর অবদমনের শিকার ফিলিস্তিন একই কাজ করছে। ‘সংঘাত’ এমন এক অস্পষ্ট পরিভাষা যা ব্যবহার করে জাতিসংঘের মার্কিন দূত নিকি হ্যালি ইসরায়েলের ‘নিজের সুরক্ষা নিশ্চিতের অধিকার’ থাকার কথা বলতে পারেন। তার কথায় মনে হয়, যেন সামরিক দখলদারিত্বে উপনিবেশিত থাকা ফিলিস্তিনিরাই তাদের দখলদার আর নিপীড়ক ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আসলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কুয়েত উত্থাপিত এক খসড়া প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে হ্যালি ইসরায়েলের সুরক্ষার প্রশ্নটি সামনে এনেছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত ওই খসড়া প্রস্তাবটিতে ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যুনতম পর্যায়ের সুরক্ষা চাওয়া হয়েছিল। হ্যালি ওই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিলেন। যার মানে, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ধারাবাহিকতা রক্ষা। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যে এ পর্যন্ত ৮০টি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, তার বেশিরভাগই ইসরায়েলকে সুরক্ষার জন্য। ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম কোনও প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিলো ১৯৭২ সালে। আর সর্বশেষ হ্যালি নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিলেন গত ১ জুন।
ভোটাভুটির আগে খসড়া প্রস্তাবটিকে নমনীয় করতে তিনবার পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রথমে খসড়া প্রস্তাবটিতে ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে সব ফিলিস্তিনির সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তাবে শুধু ‘গাজা উপত্যকাসহ অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পদক্ষপ’ নেওয়ার কথা বলা হয়। তারপরও হ্যালির কাছে একে ‘প্রচণ্ডরকমের একপেশে’ বলে মনে হলো। ঐকমত্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে থাকা কুয়েতের খসড়া প্রস্তাবটি হ্যালির নিজস্ব একটি প্রস্তাবের কারণে পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়। হ্যালির ওই খসড়া প্রস্তাবে দাবি করা হয়, ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলো গাজায় ‘সব ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ চালাচ্ছে। ‘উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ বলতে গাজা উপত্যকায় বসবাসরত লাখো ফিলিস্তিনির কয়েক সপ্তাহের গণ-আন্দোলনকে ইঙ্গিত করেছেন হ্যালি। কয়েক সপ্তাহ ধরে [ভূমি দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘গ্রেট রিটার্ন মার্চ’ নামে] শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিলেন ফিলিস্তিনিরা। তাদের আশা ছিল, এ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে গাজায় ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিষয়টিকে জাতিসংঘের আলোচ্যসূচিতে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।
ভূমি দিবসের কর্মসূচি 'গ্রেট রিটার্ন মার্চ'
নিজেদের পাল্টা প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র কেবল একটি ভোটই পেতে সমর্থ হয়েছে, সেটি তাদের নিজের ভোট। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ধরনের দৈন্যকে যুক্তরাষ্ট্র পাত্তা দেয় না। যেনতেনভাবে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে নিজের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও পররাষ্ট্র নীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতেও ভ্রুক্ষেপ করছে না দেশটি। এমনকি যে নিরস্ত্র পর্যবেক্ষকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কেবল প্রতিবেদন তৈরি করেন; তাদের হাত থেকেও ইসরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়ার তাগিদ বোধ করে যুক্তরাষ্ট্র। যেমনটা ঘটেছিল টেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল প্রেজেন্স ইন হেবরন (টিআইপিএইচ) নামের পর্যবেক্ষক দলের ক্ষেত্রে। ১৯৯৬ সালের মে মাসে টিআইপিএইচ প্রতিষ্ঠিত হয়। অধিকৃত ফিলিস্তিনি শহরের পরিস্থিতি নিয়ে বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদনটি ছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত এলাকা এইচ-টু এর পরিস্থিতি নিয়ে। কিছু সহিংস অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ওই অঞ্চলটি ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রণাধীন রাখত। নরওয়েজিয়ান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জ্যান ক্রিস্টেনসেন টিআইপিএইচ-এর নেতৃত্ব দিতেন। প্রথমে এর সদস্য সংস্খ্যা ৬০ থাকলেও তা বাড়িয়ে পরে ৯০ করা হয়। ২০০৪ সালে হেবরনে এক বছরের মিশন পরিচালনা শেষে তিনি বলেছিলেন: ‘হেবরনের এইচ-টু এলাকায় সেনাবাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীরা মিলে অভাবনীয় পরিস্থিতি তৈরি করছে। এক অর্থে সেখানে নিধনযজ্ঞ চলছে। অন্য অর্থে, এ পরিস্থিতি যদি আরও কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে, তবে আর কোনও ফিলিস্তিনি সেখানে থাকবে না।’
১৯৯৯ সাল থেকে প্যালেস্টাইন ক্রনিক্যাল সম্পাদনা করছেন বারুদ। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন লন্ডনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের উপ-ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে। কাতারভিত্তিক আল জাজিরার হয়েও একই ধরনের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আলজাজিরা-ইংলিশের গবেষণা ও অধ্যয়ন বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তির পদেও ছিলেন তিনি। ফরাসি, তুর্কি, আরবি ও কোরিয়ানসহ নানা ভাষায় তার বইয়ের অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
১৯৮৭ সালের প্রথম ইন্তিফাদার সময় বারুদ ১৫ বছরের কিশোর। কাতারভিত্তিক আলজাজিরায় গত বছর (২০১৭) ডিসেম্বরে লেখা তার এক নিবন্ধ (চিলড্রেন অব স্টোনস: দ্য ডে প্যালেস্টাইন ওয়াজ রিবর্ন) থেকে জানা যায়, মুক্তির লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যুক্ত ছিলেন তিনি। ওই বছরেই ইসরায়েলি দখলদারিত্ব আর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের সূচনা করেছিল ফিলিস্তিনিরা। পরিচয় আর মর্যাদা রক্ষায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ভারি মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের মুক্তিকামী প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল পাথরকে অস্ত্র বানিয়ে। বারুদ মনে করেন, তার নিজের পাশাপাশি প্রত্যেক ফিলিস্তিনির পুনর্জন্ম প্রথম ইন্তিফাদার মধ্য দিয়ে, তারা প্রত্যেকেই ‘পাথরের সন্তান’।
প্যালেস্টাইন ক্রনিক্যাল ও মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বারুদ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংকটকে ‘সংঘাত’ নামে ডাকার ভয়াবহতা উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। সংকটের নেপথ্যের মার্কিন ও ইসরায়েলি নীতির রাজনৈতিকতাকে সামনে এনে তিনি ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষার অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতি নতজানু নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সেই অংশকে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি শুড নট স্ট্যান্ড বাই এজ ইসরায়েল অ্যাবিউজ প্যালেস্টানিয়ানস’ শিরোনামে লেখা বারুদের সেই নিবন্ধের পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য তুলে ধরা হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকের জন্য। ভাষান্তর করেছেন, ফাহমিদা উর্ণি।
ফিলিস্তিনে যা ঘটছে তাকে ঠিক ‘সংঘাত’ বলা যায় না। আমরা শব্দটি ব্যবহার করি ঠিকই, তবে ‘সংঘাত’ শব্দ দিয়ে আসলে সেখানকার পরিস্থিতি বোঝানো যায় না। ‘সংঘাত’ বললে মনে হয়, যেন জাতিসংঘের অগণিত প্রস্তাব লঙ্ঘনকারী সামরিক শক্তি ইসরায়েল আর অবদমনের শিকার ফিলিস্তিন একই কাজ করছে। ‘সংঘাত’ এমন এক অস্পষ্ট পরিভাষা যা ব্যবহার করে জাতিসংঘের মার্কিন দূত নিকি হ্যালি ইসরায়েলের ‘নিজের সুরক্ষা নিশ্চিতের অধিকার’ থাকার কথা বলতে পারেন। তার কথায় মনে হয়, যেন সামরিক দখলদারিত্বে উপনিবেশিত থাকা ফিলিস্তিনিরাই তাদের দখলদার আর নিপীড়ক ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আসলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কুয়েত উত্থাপিত এক খসড়া প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে হ্যালি ইসরায়েলের সুরক্ষার প্রশ্নটি সামনে এনেছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত ওই খসড়া প্রস্তাবটিতে ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যুনতম পর্যায়ের সুরক্ষা চাওয়া হয়েছিল। হ্যালি ওই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিলেন। যার মানে, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ধারাবাহিকতা রক্ষা। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যে এ পর্যন্ত ৮০টি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, তার বেশিরভাগই ইসরায়েলকে সুরক্ষার জন্য। ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম কোনও প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিলো ১৯৭২ সালে। আর সর্বশেষ হ্যালি নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিলেন গত ১ জুন।
ভোটাভুটির আগে খসড়া প্রস্তাবটিকে নমনীয় করতে তিনবার পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রথমে খসড়া প্রস্তাবটিতে ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে সব ফিলিস্তিনির সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তাবে শুধু ‘গাজা উপত্যকাসহ অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পদক্ষপ’ নেওয়ার কথা বলা হয়। তারপরও হ্যালির কাছে একে ‘প্রচণ্ডরকমের একপেশে’ বলে মনে হলো। ঐকমত্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে থাকা কুয়েতের খসড়া প্রস্তাবটি হ্যালির নিজস্ব একটি প্রস্তাবের কারণে পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়। হ্যালির ওই খসড়া প্রস্তাবে দাবি করা হয়, ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলো গাজায় ‘সব ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ চালাচ্ছে। ‘উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ বলতে গাজা উপত্যকায় বসবাসরত লাখো ফিলিস্তিনির কয়েক সপ্তাহের গণ-আন্দোলনকে ইঙ্গিত করেছেন হ্যালি। কয়েক সপ্তাহ ধরে [ভূমি দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘গ্রেট রিটার্ন মার্চ’ নামে] শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিলেন ফিলিস্তিনিরা। তাদের আশা ছিল, এ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে গাজায় ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিষয়টিকে জাতিসংঘের আলোচ্যসূচিতে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।
ভূমি দিবসের কর্মসূচি 'গ্রেট রিটার্ন মার্চ'
নিজেদের পাল্টা প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র কেবল একটি ভোটই পেতে সমর্থ হয়েছে, সেটি তাদের নিজের ভোট। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ধরনের দৈন্যকে যুক্তরাষ্ট্র পাত্তা দেয় না। যেনতেনভাবে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে নিজের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও পররাষ্ট্র নীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতেও ভ্রুক্ষেপ করছে না দেশটি। এমনকি যে নিরস্ত্র পর্যবেক্ষকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কেবল প্রতিবেদন তৈরি করেন; তাদের হাত থেকেও ইসরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়ার তাগিদ বোধ করে যুক্তরাষ্ট্র। যেমনটা ঘটেছিল টেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল প্রেজেন্স ইন হেবরন (টিআইপিএইচ) নামের পর্যবেক্ষক দলের ক্ষেত্রে। ১৯৯৬ সালের মে মাসে টিআইপিএইচ প্রতিষ্ঠিত হয়। অধিকৃত ফিলিস্তিনি শহরের পরিস্থিতি নিয়ে বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদনটি ছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত এলাকা এইচ-টু এর পরিস্থিতি নিয়ে। কিছু সহিংস অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ওই অঞ্চলটি ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রণাধীন রাখত। নরওয়েজিয়ান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জ্যান ক্রিস্টেনসেন টিআইপিএইচ-এর নেতৃত্ব দিতেন। প্রথমে এর সদস্য সংস্খ্যা ৬০ থাকলেও তা বাড়িয়ে পরে ৯০ করা হয়। ২০০৪ সালে হেবরনে এক বছরের মিশন পরিচালনা শেষে তিনি বলেছিলেন: ‘হেবরনের এইচ-টু এলাকায় সেনাবাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীরা মিলে অভাবনীয় পরিস্থিতি তৈরি করছে। এক অর্থে সেখানে নিধনযজ্ঞ চলছে। অন্য অর্থে, এ পরিস্থিতি যদি আরও কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে, তবে আর কোনও ফিলিস্তিনি সেখানে থাকবে না।’
তখন থেকে হেবরনে কী পরিস্থিতি চলছে, কারও পক্ষে সেটা কেবল কল্পনাই করা
সম্ভব। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা এতোটাই বেপরোয়া হয়ে
ওঠে যে তারা ফিলিস্তিনিদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে শুরু করে। এর জন্য
তাদের কোনও পরিণামও ভোগ করতে হয় না। একবার ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল ঠাণ্ডা
মাথায় খুনের এক ঘটনা। ২০১৫ সালের ২৪ মার্চ ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে
এক ইসরায়েলি সেনা প্রতিবন্ধী এক ফিলিস্তিনির মাথায় গুলি চালায়। নিহত
ব্যক্তির নাম আব্দ আল-ফাত্তাহ আল শরিফ। তার বয়ষ ছিল ২১। হত্যাকাণ্ডের
দৃশ্যটি ভিডিও করেন ইমাদ আবু শামসিয়া নামের এক ব্যক্তি। ইন্টারনেটে ভাইরাল
হওয়া ভিডিওটি ইসরায়েলকে চরম লজ্জার মুখে ফেলে দেয়। আল শরিফের হত্যাকারীর
বিরুদ্ধে বিচার শুরু করতে বাধ্য হয় তারা। বিচার শেষে হত্যাকারীকে লঘু দণ্ড
দেওয়া হয়। আর কারামুক্তির সময় তাকে দেওয়া হয় নায়কোচিত সংবর্ধনা। উল্টোদিকে
ওই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ধারণকারী আবু শামসিয়া ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও পুলিশের
হয়রানির শিকার হন। অসংখ্যবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয় তাকে।
খবরদাতাকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ইসরায়েলে নতুন নয়। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে তার কিশোরী মেয়ের সংঘর্ষের ভিডিও ধারণ করায় আহেদ তামিমির মা নারিমানকে আটক করে সাজা দেওয়া হয়েছিল। ইসরাযেলি সেনাদের অত্যাচারের শিকার ফিলিস্তিনি যদি নিজেই সে ঘটনা রেকর্ড করেন তবে তার জন্যও শাস্তি পেতে হয়। একইসময়ে সেনাদেরকে তাদের খেয়াল-খুশিমতো চলার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনের এ বাস্তবতাকে আইনে পরিণত করার জন্য এখন প্রক্রিয়া চলছে। মে মাসের শেষ দিকে ইসরায়েলি পার্লামেন্টে (নেসেট) একটি প্রস্তাব আনা হয়। ওই প্রস্তাবের আওতায় ‘ইসরায়েলি সেনাদের দখলদারিত্বের ছবি ও ভিডিও’ ধারণ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, যারা দায়িত্ব পালনরত সেনাদের ছবি তুলবে ও ভিডিও ধারণ করবে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। এই ধারারর ‘অপরাধী’দেরকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার সুপারিশ করা হয় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান সমর্থিত প্রস্তাবটিতে। প্রায়োগিক অর্থে যার মানে হলো ইসরায়েলি সেনাদের ওপর যেকোনও ধরনের নজরদারিই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে বিবেচিত হবে। একে অব্যাহত যুদ্ধাপরাধের অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
দ্বিতীয় একটি প্রস্তাবে সামরিক অভিযানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সন্দেহভাজন বলে বিবেচিত সেনাদের দায়মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। ইসরায়েলের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী এলি বেন দাহানের উদ্যোগে বিলটি উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং ইসরায়েলি নেসেটে তা সমর্থন কুড়াচ্ছে। ইসরায়েলি +৯৭২ ওয়েবসাইটে ওরি নয় লিখেছেন: ‘সত্যি কথা হলো, দাহানের বিলটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।’ ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন ইয়েশ দিনের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করেছেন ওরি নয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অধিকৃত ভূখণ্ডে যেসব সেনা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী বলে অভিযোগ করা হচ্ছে তাদের জন্য প্রায় পূর্ণাঙ্গ দায়মুক্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে।’ এখন ফিলিস্তিনিরা আগের চেয়ে অনেক বেশি অসহায়। আর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে ইসরায়েল এখন আগের চেয়ে আরও বেশি নিষ্ঠুর। এ ট্র্যাজেডি দিনের পর দিন চলতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো-যারা কিনা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তাদের লজ্জাজনক ভেটো থেকে স্বাধীন; তাদেরকে ইসরায়েলি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের নৈতিক দায়িত্ব নিতে হবে। ফিলিস্তিনিদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে কার্যকর সুরক্ষা।
ইসরায়েল মুক্তভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে
যেতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও নিরন্তর উন্মোচিত হতে থাকা এসব
রক্তক্ষয়ী দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা উচিত নয়।
No comments