আবু বকর, রাজীব, লিমন কিংবা তুহিনের জীবন! by আহসান কবির
মানুষকে জেগে উঠতে দেখি না এখন, পরাজিত হতে দেখি বার বার। আর্নেস্ট হোমিংওয়ের দিন সম্ভবত অনেক আগেই শেষ হয়েছে।
‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসের শেষে হোমিংওয়ে তার উপন্যাসের নায়ক সান্টিয়াগোকে দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন—মানুষকে পরাজিত করা যায় না কখনও! ধ্বংস করা হলেও নাকি ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠতে পারে।
এমন আশাবাদের পরও মনে হয়—চলন্ত দুই বাসের নির্মম রেসের বলি হয়ে যখন রাজীবের হাত কাটা যায়, তখন মানুষ পরাজিত হয়!
যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ক্ষমতবান কোনও বাহিনীর সদস্য সন্ত্রাসী ভেবে নিষ্পাপ কোনও ছেলের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে বুলেট ছোড়ে, যখন জীবনের স্বপ্ন দেখতে থাকা লিমনদের পা কাটা যায়, মানুষ তখন আসলেই পরাজিত হয়।
যখন একাত্তরের ঘাতক শ্রেণির সহযোগী কথিত ‘ধনাঢ্য ব্যবসায়ী’ মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে প্রতিবেদন করার দায়ে প্রবীর শিকদারকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ চালানো হয়, বেঁচে থাকার জন্য যখন প্রবীরদের পা কেটে ফেলতে হয়, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়। এই কাটা পা নিয়ে, ক্র্যাচে ভর করে হাঁটা এই মানুষটাকে যখন পুনর্বার গ্রেফতার করে হাজতে নেওয়া হয়, তখন মানুষ পরাজিত হয়।
যখন তনুরা ধর্ষণের পরে খুন হয়ে যায়, যখন বছর কেটে যায় তনুর ধর্ষকরা ধরা পড়ে না কিংবা বিচার হয় না, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়! হয়তো তনুকে কেউ ধর্ষণ করেনি, কেউ তাকে খুন করেনি।
যখন আবু বকর সিদ্দিকরা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মধ্যে পড়ে মারা যায়, যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ধুলায় মিশে যায়, তখন মানুষ আসলে পরাজিত হয়। আবু বকরের মা মাথায় তেল দিতেন না। গাছের নারকেল জমিয়ে রাখতেন, মুরগির ডিম না খেয়ে সেগুলো বিক্রি করে আবু বকর সিদ্দিকের পড়ালেখার খরচ জোগাতেন। এই দুঃখিনী মা এখন কোথায় আছেন, কীভাবে বেঁচে আছেন, যখন রাষ্ট্র নিজে সেটা অনুভব করতে পারে না, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়।
হয়তোবা খুব সাধারণ মানুষ যারা, এদেশে তাদের জন্মই হয়েছে পরাজিত হওয়ার জন্য। হয়তো এ কারণেই কোনও একসময়ে দাউদ হায়দার লিখেছিলেন, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। ১৯৭১ সালে যারা বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, ত্রিশ লাখ শহীদের নির্মম মৃত্যু হয়েছিল যাদের অঙুলি হেলনে, স্বাধীনতার সাত বছরের ভেতরেই তারা কোনও না কোনোভাবে ফিরে এসেছিল ক্ষমতার পাদপ্রদীপের নিচে! যে সিপাহী, যে কুমার-কামার, যে শ্রমিক, যে গায়ক, যে সাধারণ ছাত্র কিংবা মানুষ দেশ-মাতৃকার তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল, তারা পরাজিত হয়েছিল সেদিনই! যারা স্বাধীনতা আনার বিনিময়ে কোনও স্বার্থসিদ্ধির জন্য তদ্বির, ধান্দাবাজি কিংবা ক্ষমতার জন্য খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়নি, যারা হতে চেয়েছিল শুধুই ‘সাধারণ স্বাধীন নাগরিক’, সেই তারা কত সহজেই চলে গেলো পরাজিতদের কাতারে। পরাজিত হওয়াটাই যেন হয়ে গেলো খুব সাধারণদের নিয়তি!
তাই ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’—এই স্লোগান বুকে ও পিঠে লিখে স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনীর মুখোমুখি যে দাঁড়ায়, তার মৃত্যু হয় খোলা রাস্তায়, গরম রক্ত ভিজিয়ে দেয় রাস্তার পিচ। খুব সাধারণ একজন নুর হোসেন ব্যতিক্রম, যিনি সাময়িক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, কিন্তু পরাজিত হতে হয় নুর হোসেনের স্বজনদের, হয়তো কেউ খোঁজও নেয় না তাদের। হয়তো বীরশ্রেষ্ঠদের কোনও কোনও স্বজন বেঁচে থাকেন অমানবিকভাবে। পরাজয় লেখে নাম, রাস্তায়, মাঠে, কার্যক্ষেত্রে, রাজনীতিতে। সাধারণ মানুষ হারায় বিশ্বাস, ঘুরে দাঁড়ানোর বিপরীতে পলায়নপর মানসিকতার ঘুণপোকা বাসা বাঁধে মনে ও মগজে!
রাষ্ট্র নিজেই যখন ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দাঁড়ায়, রাষ্ট্র নিজেই যখন অসহায়দের সঙ্গে প্রতারণা করে, রাষ্ট্র নিজেই যখন ধর্ম নিয়ে বিশ্বাসের ভাইরাসে ভোগে, সংখ্যালঘুদের সীমাহীন অসহায় করে তোলে, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়। তাই এদেশে অভিজিৎদের লাশ পড়ে থাকে রাস্তায়, এদেশে ফয়সাল আরেফিন দীপনদের হত্যাকাণ্ডের কোনও বিচার হয় না, স্বজনরা বিচারও চান না! রাষ্ট্র নিজে কখনও-সখনও তার যোগ্য নাগরিকদেরও পরাজিত হতে বাধ্য করে! তাই মিতুরা খুন হয় রাস্তায়, এসপি বাবুলদের বিচার হয় না, পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে না। মিতুরা পরাজিত হওয়ার জন্যই জন্মায়। হয়তো মিতুর ছেলে আর মেয়ে বেড়ে উঠবে প্রতিশোধ স্পৃহায়, মানুষের মুখকে মনে হবে খুনির নির্মম মুখ!
এদেশে প্রবীর শিকদাররা ক্রাচে ভর দিয়ে ‘কথিত মানুষ’ এড়িয়ে চলে। অথচ স্বাধীনতার জন্য একদিন এই মানুষটার পরিবারের অনেক সদস্যকে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে খুন করা হয়েছিল! আবু বকর যে কিনা ভালো ছাত্র ছিল, যে কিনা স্বপ্ন দেখতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার, স্বপ্ন ভুলে তার বাবা-মাকে নীরবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়! পরাজয় লেখে নাম দরোজার গায়ে, জানালার শিকে, বাসার দেয়ালে। পরাজয় লেখে নাম সিদ্দিকের কবরের গায়ে।
পরাজয় লেখে নাম তুহিনের জীবন যাপনে। চাচার মৃত্যু সংবাদ শুনে টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুহিন টাঙ্গাইল থেকে ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগে গিয়েছিল মাকে নিতে। এরপর চাচাকে শেষবারের মতো দেখতে তাদের যাওয়ার কথা ছিল আব্দুল্লাহপুর। ইজিবাইকে যাচ্ছিল তুহিন জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বৈরাটি গ্রামে দ্রুতগামী বাস ধাক্কা দেয় ইজিবাইককে, ছিটকে পড়েন তুহিনের মা। বাস তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। তুহিন মাতম করে, চিৎকার করে বাস থামাতে বলে। তুহিন মানুষ ডাকে। কিন্তু ঘাতক বাস শেষমেষ তার মাকে চাপা দেয়, পিষ্ঠ করে। তুহিন তারপরও মাতম করে মানুষ ডাকে, নিজেই বাস ঠেলে মাকে বাসের চাকার নিচ থেকে বের করে আনে! তুহিন তার মৃত মা শিউলি আক্তারকে যখন বের করে আনতে পারে, তখনই পালিয়ে যায় বাস ড্রাইভার। উত্তেজিত মানুষ বাসে আগুন দেয়, তারপর পোড়া বাসকে ফেলে দেয় পথের পাশের ডোবায়! পরাজয়ের আগুনে পোড়ে বাস, তবু তুহিনের দুঃখ পোড়ে না। যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন তার মগজের কোষে মায়ের স্মৃতিপোকা তাকে ঠেলে দেবে দুঃখের গহীনে। মার কথা মনে হলে তুহিনের মনে হবে, সে তার মাকে বাঁচাতে পারেনি, সে পরাজিত হয়েছে!
রাজীবও বেঁচে থাকবে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে। খুব ছোটকালে মা তারপর বাবাকেও হারিয়েছে রাজীব। খালার আশ্রয়ে থেকে এসএসসি পাস করেছিল। তারপর যাত্রাবাড়ির মেস, টিউশানি। ছোট দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ, বেঁচে থাকার টাকা জোগানো। পড়ালেখার পাশাপাশি ছোটখাটো কাজ করা।এই দেশের লাখো মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এমনই। সেই রাজীব এখন হাসপাতালের আইসিইউতে, তার মাথার খুলিতে ফাটল ধরেছে, চোখের পেছনে মস্তিষ্কে পানি ও রক্ত জমেছে।বেসরকারি যে হাসপাতালে রাজীবকে প্রথম ভর্তি করা হয়েছিল, সেখানে বিল উঠেছিল লাখ টাকার বেশি। রাজীবের স্বজনেরা দিতে পেরেছেন পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো। তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজীবকে ঢাকা মেডিক্যালে যেতে দিয়েছে। মন্ত্রী ঢাকা মেডিক্যালে রাজীবকে দেখতে গিয়েছেন, তার চিকিৎসা ও চাকরির দায়িত্ব নিয়েছেন। তবু রাজীব কখনও স্বাভাবিক হতে পারবে না, তার রক্তমাখা হাত পড়ে আছে রাস্তায় সেটা সে কখনও ভুলতে পারবে না। তার হাত দিয়ে সে ছোট ভাইদের আদর করতে পারবে না, ধরতে পারবে না প্রিয়তমার হাত।
রাজীব টিকটিকি হলে পারতো। লেজ খসে গেলে যেমন লেজ গজায়, তেমনি হয়তো তার নতুন হাত গজাতো। রাজীব মানুষ। তাই আজীবন সে হারানো হাতের স্মৃতি নিয়ে ধুকে ধুকে বাঁচবে। চারিদিক থেকে শান্তনা আর সহমর্মিতার কোনও কোনও হাত হয়তো তাকে সাময়িক শান্তি দেবে। শুধু আজীবন ধুকে ধুকে বাঁচার কষ্টটা একান্তই তার হবে।
আমরা বাস করছি পরাজিত সময়ের বেদনা নিয়ে। যারা আজও বিশ্বাস করে, মানুষ জাগবে ফের কিংবা দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে তাদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! জীবন এখন তুহিন, রাজীব, আবু বকর বা প্রবীর সিকদারদের ক্রাচে ভর করে হাঁটে।
যে জীবন দোয়েলের-ফড়িংয়ের, যে জীবন স্বপ্নের, যে জীবন মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেডের, যে জীবন রুখে দাঁড়ানোর তার সঙ্গে যেন দেখা হয় তুহিনের। তার সঙ্গে যেন দেখা হয় রাজীবের!
লেখক: রম্যলেখক
‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসের শেষে হোমিংওয়ে তার উপন্যাসের নায়ক সান্টিয়াগোকে দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন—মানুষকে পরাজিত করা যায় না কখনও! ধ্বংস করা হলেও নাকি ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠতে পারে।
এমন আশাবাদের পরও মনে হয়—চলন্ত দুই বাসের নির্মম রেসের বলি হয়ে যখন রাজীবের হাত কাটা যায়, তখন মানুষ পরাজিত হয়!
যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ক্ষমতবান কোনও বাহিনীর সদস্য সন্ত্রাসী ভেবে নিষ্পাপ কোনও ছেলের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে বুলেট ছোড়ে, যখন জীবনের স্বপ্ন দেখতে থাকা লিমনদের পা কাটা যায়, মানুষ তখন আসলেই পরাজিত হয়।
যখন একাত্তরের ঘাতক শ্রেণির সহযোগী কথিত ‘ধনাঢ্য ব্যবসায়ী’ মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে প্রতিবেদন করার দায়ে প্রবীর শিকদারকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ চালানো হয়, বেঁচে থাকার জন্য যখন প্রবীরদের পা কেটে ফেলতে হয়, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়। এই কাটা পা নিয়ে, ক্র্যাচে ভর করে হাঁটা এই মানুষটাকে যখন পুনর্বার গ্রেফতার করে হাজতে নেওয়া হয়, তখন মানুষ পরাজিত হয়।
যখন তনুরা ধর্ষণের পরে খুন হয়ে যায়, যখন বছর কেটে যায় তনুর ধর্ষকরা ধরা পড়ে না কিংবা বিচার হয় না, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়! হয়তো তনুকে কেউ ধর্ষণ করেনি, কেউ তাকে খুন করেনি।
যখন আবু বকর সিদ্দিকরা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মধ্যে পড়ে মারা যায়, যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ধুলায় মিশে যায়, তখন মানুষ আসলে পরাজিত হয়। আবু বকরের মা মাথায় তেল দিতেন না। গাছের নারকেল জমিয়ে রাখতেন, মুরগির ডিম না খেয়ে সেগুলো বিক্রি করে আবু বকর সিদ্দিকের পড়ালেখার খরচ জোগাতেন। এই দুঃখিনী মা এখন কোথায় আছেন, কীভাবে বেঁচে আছেন, যখন রাষ্ট্র নিজে সেটা অনুভব করতে পারে না, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়।
হয়তোবা খুব সাধারণ মানুষ যারা, এদেশে তাদের জন্মই হয়েছে পরাজিত হওয়ার জন্য। হয়তো এ কারণেই কোনও একসময়ে দাউদ হায়দার লিখেছিলেন, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। ১৯৭১ সালে যারা বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, ত্রিশ লাখ শহীদের নির্মম মৃত্যু হয়েছিল যাদের অঙুলি হেলনে, স্বাধীনতার সাত বছরের ভেতরেই তারা কোনও না কোনোভাবে ফিরে এসেছিল ক্ষমতার পাদপ্রদীপের নিচে! যে সিপাহী, যে কুমার-কামার, যে শ্রমিক, যে গায়ক, যে সাধারণ ছাত্র কিংবা মানুষ দেশ-মাতৃকার তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল, তারা পরাজিত হয়েছিল সেদিনই! যারা স্বাধীনতা আনার বিনিময়ে কোনও স্বার্থসিদ্ধির জন্য তদ্বির, ধান্দাবাজি কিংবা ক্ষমতার জন্য খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়নি, যারা হতে চেয়েছিল শুধুই ‘সাধারণ স্বাধীন নাগরিক’, সেই তারা কত সহজেই চলে গেলো পরাজিতদের কাতারে। পরাজিত হওয়াটাই যেন হয়ে গেলো খুব সাধারণদের নিয়তি!
তাই ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’—এই স্লোগান বুকে ও পিঠে লিখে স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনীর মুখোমুখি যে দাঁড়ায়, তার মৃত্যু হয় খোলা রাস্তায়, গরম রক্ত ভিজিয়ে দেয় রাস্তার পিচ। খুব সাধারণ একজন নুর হোসেন ব্যতিক্রম, যিনি সাময়িক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, কিন্তু পরাজিত হতে হয় নুর হোসেনের স্বজনদের, হয়তো কেউ খোঁজও নেয় না তাদের। হয়তো বীরশ্রেষ্ঠদের কোনও কোনও স্বজন বেঁচে থাকেন অমানবিকভাবে। পরাজয় লেখে নাম, রাস্তায়, মাঠে, কার্যক্ষেত্রে, রাজনীতিতে। সাধারণ মানুষ হারায় বিশ্বাস, ঘুরে দাঁড়ানোর বিপরীতে পলায়নপর মানসিকতার ঘুণপোকা বাসা বাঁধে মনে ও মগজে!
রাষ্ট্র নিজেই যখন ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দাঁড়ায়, রাষ্ট্র নিজেই যখন অসহায়দের সঙ্গে প্রতারণা করে, রাষ্ট্র নিজেই যখন ধর্ম নিয়ে বিশ্বাসের ভাইরাসে ভোগে, সংখ্যালঘুদের সীমাহীন অসহায় করে তোলে, তখন আসলে মানুষ পরাজিত হয়। তাই এদেশে অভিজিৎদের লাশ পড়ে থাকে রাস্তায়, এদেশে ফয়সাল আরেফিন দীপনদের হত্যাকাণ্ডের কোনও বিচার হয় না, স্বজনরা বিচারও চান না! রাষ্ট্র নিজে কখনও-সখনও তার যোগ্য নাগরিকদেরও পরাজিত হতে বাধ্য করে! তাই মিতুরা খুন হয় রাস্তায়, এসপি বাবুলদের বিচার হয় না, পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে না। মিতুরা পরাজিত হওয়ার জন্যই জন্মায়। হয়তো মিতুর ছেলে আর মেয়ে বেড়ে উঠবে প্রতিশোধ স্পৃহায়, মানুষের মুখকে মনে হবে খুনির নির্মম মুখ!
এদেশে প্রবীর শিকদাররা ক্রাচে ভর দিয়ে ‘কথিত মানুষ’ এড়িয়ে চলে। অথচ স্বাধীনতার জন্য একদিন এই মানুষটার পরিবারের অনেক সদস্যকে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে খুন করা হয়েছিল! আবু বকর যে কিনা ভালো ছাত্র ছিল, যে কিনা স্বপ্ন দেখতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার, স্বপ্ন ভুলে তার বাবা-মাকে নীরবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়! পরাজয় লেখে নাম দরোজার গায়ে, জানালার শিকে, বাসার দেয়ালে। পরাজয় লেখে নাম সিদ্দিকের কবরের গায়ে।
পরাজয় লেখে নাম তুহিনের জীবন যাপনে। চাচার মৃত্যু সংবাদ শুনে টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুহিন টাঙ্গাইল থেকে ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগে গিয়েছিল মাকে নিতে। এরপর চাচাকে শেষবারের মতো দেখতে তাদের যাওয়ার কথা ছিল আব্দুল্লাহপুর। ইজিবাইকে যাচ্ছিল তুহিন জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বৈরাটি গ্রামে দ্রুতগামী বাস ধাক্কা দেয় ইজিবাইককে, ছিটকে পড়েন তুহিনের মা। বাস তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। তুহিন মাতম করে, চিৎকার করে বাস থামাতে বলে। তুহিন মানুষ ডাকে। কিন্তু ঘাতক বাস শেষমেষ তার মাকে চাপা দেয়, পিষ্ঠ করে। তুহিন তারপরও মাতম করে মানুষ ডাকে, নিজেই বাস ঠেলে মাকে বাসের চাকার নিচ থেকে বের করে আনে! তুহিন তার মৃত মা শিউলি আক্তারকে যখন বের করে আনতে পারে, তখনই পালিয়ে যায় বাস ড্রাইভার। উত্তেজিত মানুষ বাসে আগুন দেয়, তারপর পোড়া বাসকে ফেলে দেয় পথের পাশের ডোবায়! পরাজয়ের আগুনে পোড়ে বাস, তবু তুহিনের দুঃখ পোড়ে না। যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন তার মগজের কোষে মায়ের স্মৃতিপোকা তাকে ঠেলে দেবে দুঃখের গহীনে। মার কথা মনে হলে তুহিনের মনে হবে, সে তার মাকে বাঁচাতে পারেনি, সে পরাজিত হয়েছে!
রাজীবও বেঁচে থাকবে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে। খুব ছোটকালে মা তারপর বাবাকেও হারিয়েছে রাজীব। খালার আশ্রয়ে থেকে এসএসসি পাস করেছিল। তারপর যাত্রাবাড়ির মেস, টিউশানি। ছোট দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ, বেঁচে থাকার টাকা জোগানো। পড়ালেখার পাশাপাশি ছোটখাটো কাজ করা।এই দেশের লাখো মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এমনই। সেই রাজীব এখন হাসপাতালের আইসিইউতে, তার মাথার খুলিতে ফাটল ধরেছে, চোখের পেছনে মস্তিষ্কে পানি ও রক্ত জমেছে।বেসরকারি যে হাসপাতালে রাজীবকে প্রথম ভর্তি করা হয়েছিল, সেখানে বিল উঠেছিল লাখ টাকার বেশি। রাজীবের স্বজনেরা দিতে পেরেছেন পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো। তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজীবকে ঢাকা মেডিক্যালে যেতে দিয়েছে। মন্ত্রী ঢাকা মেডিক্যালে রাজীবকে দেখতে গিয়েছেন, তার চিকিৎসা ও চাকরির দায়িত্ব নিয়েছেন। তবু রাজীব কখনও স্বাভাবিক হতে পারবে না, তার রক্তমাখা হাত পড়ে আছে রাস্তায় সেটা সে কখনও ভুলতে পারবে না। তার হাত দিয়ে সে ছোট ভাইদের আদর করতে পারবে না, ধরতে পারবে না প্রিয়তমার হাত।
রাজীব টিকটিকি হলে পারতো। লেজ খসে গেলে যেমন লেজ গজায়, তেমনি হয়তো তার নতুন হাত গজাতো। রাজীব মানুষ। তাই আজীবন সে হারানো হাতের স্মৃতি নিয়ে ধুকে ধুকে বাঁচবে। চারিদিক থেকে শান্তনা আর সহমর্মিতার কোনও কোনও হাত হয়তো তাকে সাময়িক শান্তি দেবে। শুধু আজীবন ধুকে ধুকে বাঁচার কষ্টটা একান্তই তার হবে।
আমরা বাস করছি পরাজিত সময়ের বেদনা নিয়ে। যারা আজও বিশ্বাস করে, মানুষ জাগবে ফের কিংবা দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে তাদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! জীবন এখন তুহিন, রাজীব, আবু বকর বা প্রবীর সিকদারদের ক্রাচে ভর করে হাঁটে।
যে জীবন দোয়েলের-ফড়িংয়ের, যে জীবন স্বপ্নের, যে জীবন মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেডের, যে জীবন রুখে দাঁড়ানোর তার সঙ্গে যেন দেখা হয় তুহিনের। তার সঙ্গে যেন দেখা হয় রাজীবের!
লেখক: রম্যলেখক
No comments