মুক্তিযুদ্ধের যত চলচ্চিত্র by কামরুজ্জামান মিলু
৯
মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও না জানা অনেক গল্প
বাংলা চলচ্চিত্রে এসেছে। তবে অনেকের মতে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বড়
পর্দায় পুরোপুরি তুলে আনা সম্ভব হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি দেশের
যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি স্বাধীন মানচিত্রের জন্য কেড়ে নিয়েছে লাখো মানুষের
প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধ এত ঘটনাবহুল যে শতাব্দীর পর শতাব্দী এ নিয়ে চলচ্চিত্র
নির্মাণ করা যেতে পারে। কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে
মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বেশিসংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মাণ
হয়েছে, দেশের বাইরেও তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে
অসংখ্য প্রামাণ্য, স্বল্প এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে আমাদের
দেশে। মুক্তিযুদ্ধের আগেই প্রখ্যাত নির্মাতা জহির রায়হান নির্মাণ করেন
‘জীবন থেকে নেয়া’। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রে সংসারের একগোছা
চাবির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসন ক্ষমতা বোঝানো হয়। অন্যদিকে
প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’-এর প্রযোজক চলচ্চিত্রকার
মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিশাল বড় একটি ক্যানভাস।
‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র।
১৯৭২ সালে মুক্তি পেয়েছিল সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’
চলচ্চিত্রটি। একই বছর মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস উঠে এসেছে মমতাজ আলীর
‘রক্তাক্ত বাংলা’ ও আনন্দের ‘বাঘা বাঙ্গালী’ চলচ্চিত্রে। ১৯৭৬ সালে
হারুন-অর রশিদ নির্মাণ করেন ‘মেঘের অনেক রং’। সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার
শহীদুল হক খান সরকারি অনুদানে ১৯৮১ সালে নির্মাণ করেন ‘কলমিলতা’। ১৯৯৪ সালে
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিজের লেখা গল্পে নির্মাণ করলেন
‘আগুনের পরশমনি’। ৪৬ বছর ধরে বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে বেশকিছু
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। অন্যতম এই চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ওরা
১১ জন’, ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’,
‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আমার জন্মভূমি, ‘আবার তোরা
মানুষ হ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘মেঘের অনেক রঙ’, ‘কলমিলতা’, ‘নদীর নাম মধুমতি’,
‘আগামী’, ‘এখনো অনেক রাত’, ‘মুক্তির গান’, ‘মাটির ময়না’, ‘জয়যাত্রা’,
‘খেলাঘর’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘গেরিলা’, ‘জীবনঢুলী’,
‘৭১-এর সংগ্রাম’, ‘মেঘমল্লার’, ‘৭১-এর মা জননী’, ‘অনুক্রোশ’, ‘হৃদয়ে ৭১’,
‘অনিল বাগচীর একদিন’, ‘এইতো প্রেম’, ‘শোভানের স্বাধীনতা’, ‘ভুবন মাঝি’
ইত্যাদি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র বলতে আমাদের চোখের সামনে
ভেসে ওঠে ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’,
‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ ‘প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’, ‘আগামী’, ‘প্রত্যাবর্তন’
‘সূচনা’, ‘দুরন্ত’, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘ধূসর যাত্রা’, ‘৭১-এর যিশু’,
‘স্মৃতি ৭১’, ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’ প্রভৃতি। তবে বর্তমানে
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যাটা অনেকটাই কমেছে।
তাই অনেক নির্মাতার মতে, চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকার যে অনুদান দেয় তাতে একটি
মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হয় না। এর ফলে
দেশাত্মবোধক চলচ্চিত্র নির্মাণে নির্মাতাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। নতুন অনেক
মেধাবী নির্মাতার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে থাকা
সত্ত্বেও বাজেটের কারণে বারবারই পিছিয়ে যাচ্ছেন। তাই সরকারি এই অনুদানের
অঙ্কটা বাড়ানোর বিষয়েও কর্তৃপক্ষকে বিশেষ নজর দেয়ার অনুরোধ জানান এই
প্রজন্মের বেশ কিছু নির্মাতা।
No comments