কতটা বিপজ্জনক ট্রাম্পের নতুন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন? -নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়
প্রেসিডেন্ট
ডনাল্ড ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের ভালো দিক
হলো, তিনি যা মনে করেন, ঠিক সেটাই মুখ দিয়ে বলেন। আর খারাপটা হলো তিনি যা
মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রে বোল্টনের মতো খুব কম লোকই আছেন, যারা দেশকে
যুদ্ধের দিকে ধাবিত করতে এত বেশি আগ্রহী। তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
হিসেবে বেছে নেওয়াটা ট্রাম্পের অন্যান্য সিদ্ধান্তের মতো উদ্বেগজনক। বোল্টন
ছাড়াও, আরেক কট্টরপন্থি সিআইএ পরিচালক মাইক পম্পের্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পদে মনোনীত করেছেন ট্রাম্প। এ থেকে বোঝা যায় ট্রাম্প নিজের জাতীয়তাবাদী
চিন্তাভাবনা দ্বারা কতটা আলোড়িত হচ্ছেন।
বিশেষ করে, বোল্টন বিশ্বাস করেন যে, আন্তর্জাতিক আইন, সনদ ও পূর্বেকার প্রশাসনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তোয়াক্কা না করে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যা খুশি তা-ই করতে পারে। তিনি উত্তর কোরিয়ায় হামলা করে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি অসাড় করে দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। অথচ, এ ধরনের যেকোনো হামলা এক ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে যার দরুন মারা যেতে পারে হাজার হাজার মানুষ।
একই সঙ্গে তিনি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে খাটো করেছেন। আগামী মে মাসের শেষের দিকে ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মধ্যে যে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে, সেটিরও বিরোধী তিনি। এ ছাড়া যে ছয় দলীয় ইরান পারমাণবিক চুক্তির ফলে ২০১৫ সাল থেকে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প উল্লেখযোগ্য হারে সীমিত রাখা সম্ভব হয়েছে, বোল্টন সেই চুক্তি শুধু বাতিলই করতে চান না; তিনি ইরানে বোমা হামলা চালানোর আহ্বান পর্যন্ত জানিয়েছেন। জাতিসংঘ ও অন্যান্য বহুদেশীয় সনদের প্রতি ট্রাম্পের মতো তার বিদ্বেষও সুবিদিত। তিনি একতরফা সমাধানে বিশ্বাসী।
৩০ বছরের ক্যারিয়ার জুড়ে বোল্টন তিনজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেছেন। ছিলেন জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ অস্ত্রনিরোধ কর্মকর্তা। এমন গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক পদে কাজ করলেও, বোল্টন মূলত কূটনীতি ও অস্ত্র-নিরোধ নীতিকেই অবজ্ঞা করে এসেছেন। তিনি সবসময়ই ছিলেন সামরিক সমাধানের পক্ষপাতী। ১৯৯৪ সালে উত্তর কোরিয়ার প্লুটোনিয়াম প্রকল্প স্থগিত করার বদলে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদানের আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল করতে বোল্টনের মতো কেউই এত সোচ্চার ছিলেন না। ওই চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার কারণেই উত্তর কোরিয়া নিয়ে বর্তমান সংকটের মুখে বিশ্ব।
নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলাকালে ডনাল্ড ট্রাম্প ইরাক যুদ্ধের সমালোচনা করেছিলেন। তখন অনেকের মনে হয়েছিল যে, তিনি হয়তো পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করবেন। বোল্টনের মতো ওই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের কট্টর সমর্থক কেউ ছিলেন না। তার তখনকার যুদ্ধংদেহী অবস্থান তিনি কখনই পরিত্যাগ করেননি। ওই সময়ে বোল্টন বলেছিলেন যে, ইরাকি জনগণ মার্কিন সৈন্যদের স্বাগত জানাবে। তিনি আরো বলেছিলেন যে, আমেরিকার সামরিক ভূমিকার অবসান হবে শিগগিরই, কারণ সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে ইরাকিরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। ঠিক এ ধরনের সরলীকৃত ও একগুঁয়ে অবস্থানই বোল্টন বেশির ভাগ সময় নিয়ে থাকেন।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে বোল্টন স্থলাভিষিক্ত হবেন তিন তারকা জেনারেল এইচ আর ম্যাকমাস্টারের। সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় না রেখে ইরান পারমাণবিক চুক্তি ভেস্তে দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন ম্যাকমাস্টার। এ ছাড়াও ট্রাম্পের সঙ্গে অন্যান্য নীতিগত বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল তার। ট্রাম্পের ১৪ মাসের বিশৃঙ্খল শাসনামলে বোল্টন হলেন তৃতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। হোয়াইট হাউজের ম্যাকমাস্টারের সময়কাল কখনই মসৃণ ছিল না। অথচ, বোল্টনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের এক ধরনের বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে। এই পদে আসার আগেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে তার। এ ছাড়া তিনি ফক্স নিউজ চ্যানেলে প্রায়ই বিশেষজ্ঞ হিসেবে মন্তব্য দেন। প্রেসিডেন্ট এই চ্যানেলটির নিয়মিত একজন দর্শক।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ পেতে বোল্টন ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি ট্রাম্প আগে এই পদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে তাকে প্রত্যাখ্যান করার পরও দমে যাননি বোল্টন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য আগে তাকে বাদ দিয়েছেন তার বিপজ্জনক অবস্থানের কারণে নয়; বরং তার গোঁফ পছন্দ হয়নি বলে।
আমেরিকায় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ হলো এটি নিশ্চিত করা যে প্রেসিডেন্ট যাতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সহ দেশের সব জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারেন। কিন্তু বোল্টন তার এই দায়িত্ব পালনে সৎ থাকবেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি যে প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছেন, সেখানেই আমলাতান্ত্রিক দ্বৈরথে জয় পেতে ও তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের অপসারণে নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি এত বেশি কট্টর যে, ২০০৫ সালে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার মনোনয়ন নিশ্চিত করেনি সিনেট। বাধ্য হয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তাকে বিশেষ কায়দায় নিয়োগ দেন। তিনি ওই পদে এক বছরের মতো টিকতে পেরেছিলেন। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সিনেট মেনে নেবে, এমন সম্ভাবনা কম। এ কারণেই হয়তো ট্রাম্প তাকে জাতীয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার পদে নিয়োগ দিয়েছেন, কারণ এই পদে সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এখনকার সংবেদনশীল সময়ে বোল্টনকে নিয়োগ দেয়াটা খুবই বাজে একটি সিদ্ধান্ত। ট্রাম্প নিজে যদিও প্রায়ই উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়েছেন, তবুও অন্তত তিনি কিম জং উনের সাক্ষাতের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট, যিনি পারমাণবিক সংকটের কূটনৈতিক সমাধান পেতে আগ্রহী, তিনিই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এ মাসের শুরুতে বোল্টন ফক্স নিউজকে বলেছেন যে, কিম জং উনের সঙ্গে আলোচনা হবে মূল্যহীন। দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা কূটনৈতিক পন্থা বেঁছে নেয়ায় তিনি তাদেরকে অবজ্ঞা পর্যন্ত করেছেন। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে লেখা এক কলামে তিনি লিখেছেন যে, উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকায় এখন যে ‘প্রয়োজনীয়তা’ সৃষ্টি হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে দেশটিতে স্বতঃপ্রণোদিত আক্রমণ করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পুরোপুরি যথার্থ একটি পন্থা। এর আগেও তিনি লিখেছেন যে, বলপ্রয়োগের আগে অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের ঐকমত্য চাওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু কিম জং উনের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য আমেরিকার পদক্ষেপে কোনো বিদেশি সরকারের ভেটো প্রদানের অধিকার নেই, এমনকি তারা ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও।
ইরানের ক্ষেত্রে বোল্টন ও প্রেসিডেন্ট একমত। তারা উভয়েই বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়া। ২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে বোল্টন লিখেছেন, ইসরাইল যেমন ১৯৮১ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লি ও ২০০৭ সালে সিরিয়ার চুল্লি ধ্বংস করেছিল, তেমন কিছু একটাই প্রয়োজন।
সিরিয়া ও ইরান ইস্যুতে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ফলে অযথা রক্তই শুধু ঝরবে না, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। ইরান চুক্তির কারণে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি অনেকখানি সীমিত হয়েছে। এই চুক্তি বহাল থাকা উচিত। উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতার পথও একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
অবশ্য রাশিয়া ইস্যুতে বোল্টনের অবস্থান ট্রাম্পের চেয়ে কিছুটা ভালো। বোল্টন মনে করেন, বৃটেনে রাশিয়ার সাবেক পক্ষত্যাগী গুপ্তচরদের যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে, সেই প্রেক্ষিতে ন্যাটোর উচিত কড়া প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা। কিন্তু বোল্টন যেমনটা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং মুসলিম-বিদ্বেষী অ্যাক্টিভিস্ট পাম গেলারের বইয়ের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, তা যেকোনো শীর্ষ আমেরিকান কর্মকর্তার বেলায় অগ্রহণযোগ্য।
এটি নিশ্চিত যে বোল্টন মিত্র দেশ ও বাকি বিশ্ব থেকে আমেরিকার বিচ্ছিন্নতাকে ত্বরান্বিত করবেন। কংগ্রেস হয়তো তার নিয়োগ থামাতে পারবে না। কিন্তু কংগ্রেসের উচিত এই নিয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলা। পাশাপাশি, কখন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যাবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার কংগ্রেসের। তাই এই বিষয়টিও কংগ্রেসের উচিত পুনর্ব্যক্ত করা।
বিশেষ করে, বোল্টন বিশ্বাস করেন যে, আন্তর্জাতিক আইন, সনদ ও পূর্বেকার প্রশাসনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তোয়াক্কা না করে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যা খুশি তা-ই করতে পারে। তিনি উত্তর কোরিয়ায় হামলা করে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি অসাড় করে দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। অথচ, এ ধরনের যেকোনো হামলা এক ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে যার দরুন মারা যেতে পারে হাজার হাজার মানুষ।
একই সঙ্গে তিনি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে খাটো করেছেন। আগামী মে মাসের শেষের দিকে ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মধ্যে যে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে, সেটিরও বিরোধী তিনি। এ ছাড়া যে ছয় দলীয় ইরান পারমাণবিক চুক্তির ফলে ২০১৫ সাল থেকে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প উল্লেখযোগ্য হারে সীমিত রাখা সম্ভব হয়েছে, বোল্টন সেই চুক্তি শুধু বাতিলই করতে চান না; তিনি ইরানে বোমা হামলা চালানোর আহ্বান পর্যন্ত জানিয়েছেন। জাতিসংঘ ও অন্যান্য বহুদেশীয় সনদের প্রতি ট্রাম্পের মতো তার বিদ্বেষও সুবিদিত। তিনি একতরফা সমাধানে বিশ্বাসী।
৩০ বছরের ক্যারিয়ার জুড়ে বোল্টন তিনজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেছেন। ছিলেন জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ অস্ত্রনিরোধ কর্মকর্তা। এমন গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক পদে কাজ করলেও, বোল্টন মূলত কূটনীতি ও অস্ত্র-নিরোধ নীতিকেই অবজ্ঞা করে এসেছেন। তিনি সবসময়ই ছিলেন সামরিক সমাধানের পক্ষপাতী। ১৯৯৪ সালে উত্তর কোরিয়ার প্লুটোনিয়াম প্রকল্প স্থগিত করার বদলে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদানের আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল করতে বোল্টনের মতো কেউই এত সোচ্চার ছিলেন না। ওই চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার কারণেই উত্তর কোরিয়া নিয়ে বর্তমান সংকটের মুখে বিশ্ব।
নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলাকালে ডনাল্ড ট্রাম্প ইরাক যুদ্ধের সমালোচনা করেছিলেন। তখন অনেকের মনে হয়েছিল যে, তিনি হয়তো পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করবেন। বোল্টনের মতো ওই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের কট্টর সমর্থক কেউ ছিলেন না। তার তখনকার যুদ্ধংদেহী অবস্থান তিনি কখনই পরিত্যাগ করেননি। ওই সময়ে বোল্টন বলেছিলেন যে, ইরাকি জনগণ মার্কিন সৈন্যদের স্বাগত জানাবে। তিনি আরো বলেছিলেন যে, আমেরিকার সামরিক ভূমিকার অবসান হবে শিগগিরই, কারণ সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে ইরাকিরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। ঠিক এ ধরনের সরলীকৃত ও একগুঁয়ে অবস্থানই বোল্টন বেশির ভাগ সময় নিয়ে থাকেন।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে বোল্টন স্থলাভিষিক্ত হবেন তিন তারকা জেনারেল এইচ আর ম্যাকমাস্টারের। সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় না রেখে ইরান পারমাণবিক চুক্তি ভেস্তে দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন ম্যাকমাস্টার। এ ছাড়াও ট্রাম্পের সঙ্গে অন্যান্য নীতিগত বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল তার। ট্রাম্পের ১৪ মাসের বিশৃঙ্খল শাসনামলে বোল্টন হলেন তৃতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। হোয়াইট হাউজের ম্যাকমাস্টারের সময়কাল কখনই মসৃণ ছিল না। অথচ, বোল্টনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের এক ধরনের বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে। এই পদে আসার আগেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে তার। এ ছাড়া তিনি ফক্স নিউজ চ্যানেলে প্রায়ই বিশেষজ্ঞ হিসেবে মন্তব্য দেন। প্রেসিডেন্ট এই চ্যানেলটির নিয়মিত একজন দর্শক।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ পেতে বোল্টন ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি ট্রাম্প আগে এই পদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে তাকে প্রত্যাখ্যান করার পরও দমে যাননি বোল্টন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য আগে তাকে বাদ দিয়েছেন তার বিপজ্জনক অবস্থানের কারণে নয়; বরং তার গোঁফ পছন্দ হয়নি বলে।
আমেরিকায় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ হলো এটি নিশ্চিত করা যে প্রেসিডেন্ট যাতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সহ দেশের সব জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারেন। কিন্তু বোল্টন তার এই দায়িত্ব পালনে সৎ থাকবেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি যে প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছেন, সেখানেই আমলাতান্ত্রিক দ্বৈরথে জয় পেতে ও তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের অপসারণে নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি এত বেশি কট্টর যে, ২০০৫ সালে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার মনোনয়ন নিশ্চিত করেনি সিনেট। বাধ্য হয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তাকে বিশেষ কায়দায় নিয়োগ দেন। তিনি ওই পদে এক বছরের মতো টিকতে পেরেছিলেন। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সিনেট মেনে নেবে, এমন সম্ভাবনা কম। এ কারণেই হয়তো ট্রাম্প তাকে জাতীয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার পদে নিয়োগ দিয়েছেন, কারণ এই পদে সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এখনকার সংবেদনশীল সময়ে বোল্টনকে নিয়োগ দেয়াটা খুবই বাজে একটি সিদ্ধান্ত। ট্রাম্প নিজে যদিও প্রায়ই উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়েছেন, তবুও অন্তত তিনি কিম জং উনের সাক্ষাতের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট, যিনি পারমাণবিক সংকটের কূটনৈতিক সমাধান পেতে আগ্রহী, তিনিই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এ মাসের শুরুতে বোল্টন ফক্স নিউজকে বলেছেন যে, কিম জং উনের সঙ্গে আলোচনা হবে মূল্যহীন। দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা কূটনৈতিক পন্থা বেঁছে নেয়ায় তিনি তাদেরকে অবজ্ঞা পর্যন্ত করেছেন। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে লেখা এক কলামে তিনি লিখেছেন যে, উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকায় এখন যে ‘প্রয়োজনীয়তা’ সৃষ্টি হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে দেশটিতে স্বতঃপ্রণোদিত আক্রমণ করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পুরোপুরি যথার্থ একটি পন্থা। এর আগেও তিনি লিখেছেন যে, বলপ্রয়োগের আগে অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের ঐকমত্য চাওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু কিম জং উনের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য আমেরিকার পদক্ষেপে কোনো বিদেশি সরকারের ভেটো প্রদানের অধিকার নেই, এমনকি তারা ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও।
ইরানের ক্ষেত্রে বোল্টন ও প্রেসিডেন্ট একমত। তারা উভয়েই বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়া। ২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে বোল্টন লিখেছেন, ইসরাইল যেমন ১৯৮১ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লি ও ২০০৭ সালে সিরিয়ার চুল্লি ধ্বংস করেছিল, তেমন কিছু একটাই প্রয়োজন।
সিরিয়া ও ইরান ইস্যুতে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ফলে অযথা রক্তই শুধু ঝরবে না, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। ইরান চুক্তির কারণে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি অনেকখানি সীমিত হয়েছে। এই চুক্তি বহাল থাকা উচিত। উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতার পথও একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
অবশ্য রাশিয়া ইস্যুতে বোল্টনের অবস্থান ট্রাম্পের চেয়ে কিছুটা ভালো। বোল্টন মনে করেন, বৃটেনে রাশিয়ার সাবেক পক্ষত্যাগী গুপ্তচরদের যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে, সেই প্রেক্ষিতে ন্যাটোর উচিত কড়া প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা। কিন্তু বোল্টন যেমনটা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং মুসলিম-বিদ্বেষী অ্যাক্টিভিস্ট পাম গেলারের বইয়ের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, তা যেকোনো শীর্ষ আমেরিকান কর্মকর্তার বেলায় অগ্রহণযোগ্য।
এটি নিশ্চিত যে বোল্টন মিত্র দেশ ও বাকি বিশ্ব থেকে আমেরিকার বিচ্ছিন্নতাকে ত্বরান্বিত করবেন। কংগ্রেস হয়তো তার নিয়োগ থামাতে পারবে না। কিন্তু কংগ্রেসের উচিত এই নিয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলা। পাশাপাশি, কখন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যাবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার কংগ্রেসের। তাই এই বিষয়টিও কংগ্রেসের উচিত পুনর্ব্যক্ত করা।
No comments