২৫শে মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য দরকার জোর প্রচেষ্টা by কাজী রুনা
মহাভারতের
অন্যতম প্রধান চরিত্র যুধিষ্ঠিরের মতো সত্যবাদীরও চারিত্রিক স্খলন ঘটেছিল।
কেবলমাত্র যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্যই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিল
যুধিষ্ঠিরকে। আর এ কারণে তাকে নরক দর্শন পর্যন্ত করতে হয়েছিল। মহাভারত
অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় দ্রোনাচার্য যখন ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপে
তখন পঞ্চপাণ্ডীয়রা দ্রোনকে বধ করতে ছলনার আশ্রয় নেয়। এরই অংশ হিসেবে
অশ্বথামা নামে একটি হাতি মারা গেলে কৃষ্ণের প্ররোচনায় দ্রোনকে তার পুত্র
অশ্বথামার মৃত্যু সংবাদ শোনানো হয়। দ্রোন বলেছিলেন একমাত্র সত্যবাদী
যুধিষ্ঠির বললেই তিনি বিশ্বাস করবেন পুত্রের মৃত্যু সংবাদ। যুধিষ্ঠির তখন
ছলনার আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন ‘অশ্বথামা হত’। যদিও মৃদু স্বরে বলেছিলেন ‘ইতি
গজ’।
মানব সভ্যতার বর্বরোচিত অধ্যায় যুদ্ধ, যা আদিম যুগ থেকে এখনো পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে। একগোষ্ঠীর মানুষ ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে। এখান থেকে জেনোসাইড পদবাচ্যটি আলোচনায় আসে। পোলিশ ইহুদি আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। একে বাংলায় বলা হয় গণহত্যা। আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা শব্দটিকে একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা শুধুমাত্র ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে খুন নয়, বরং কোনো একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধনও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কনভেনশন অনুযায়ী এটি সংঘটিত হবে আরেক জনগোষ্ঠীর ওপর যারা জাতীয়ভাবে (হধঃরড়হধষষু), গোষ্ঠীগতভাবে (বঃযহরপধষষু), ধর্মীয়ভাবে (ৎবষরমরড়ঁংষু) বা বর্ণগতভাবে (ৎধপরধষষু) ভিন্ন। এই কনভেনশন গৃহীত হওয়ার পর স্বীকৃত নিষ্ঠুরতম গণহত্যাগুলো হলো আর্মেনীয় ও রুয়ান্ডার গণহত্যা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকহানাদার বাহিনী যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় তা অবশ্যই ইতিহাসের বর্বরোচিত একটি গণহত্যা। বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ২৫শে মার্চের রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সে রাতেই পাকবাহিনী একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল (সার্জেন্ট জহুরুল হক) হল, রোকেয়া হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সিডনি ট্রিবিউনের ভাষ্যানুযায়ী, শুধুমাত্র ২৫শে মার্চ রাতে কমবেশি এক লাখ লোককে হত্যা করা হয়। মূলত ২৫শে মার্চের রাতে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল এক মৃত্যুপুরী। এরপর টানা নয় মাস ধরে পাকহানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ পুরো বাংলাদেশ জুড়ে চালায় তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। শুধু হত্যা বা ধর্ষণই নয়, পুরো বাঙালি জাতিসত্তাকে ধ্বংস করার জন্য সব পদক্ষেপই নিয়েছিল পাকিস্তানি জান্তা। কিন্তু ইতিহাসের এই জঘন্যতম গণহত্যা এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়নি। যদিও এখানে জেনোসাইড বা গণহত্যার সবগুলো উপাদান বা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
পাকহানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে লোমহর্ষক অত্যাচার চালিয়েছিল। এখানে পাক বাহিনীর গণহারে খুন, ধর্ষণ অবশ্যই গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়বে। এছাড়া হিন্দু জনগোষ্ঠী খুন ও ভারতে চলে যাওয়া এক কোটি উদ্বাস্তু- এসব সুনির্দিষ্টভাবে গণহত্যার সংজ্ঞার আওতাভুক্ত।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউনেস্কো। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করার এই ঐতিহাসিক ভাষণটি ‘ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’র অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো। এখন একাত্তরের গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এজন্য একদিকে বিশ্বের দরবারে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা যেমন জরুরি তেমনি প্রয়োজন আন্তর্জাতিক লবিং। কেননা, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ শুরু থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি ভারত ও রাশিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ অবশ্যই এতে সমর্থন করবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক লবিং। এমন লোমহর্ষক, বর্বরোচিত গণহত্যা যখন আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পাবে তখন আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চাইতে পারবো।
জাতিসংঘ ১৯৮৫ সালে আর্মেনীয় গণহত্যাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় হুতু ও তুতসিদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেটিকেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এজন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা (আইসিটিআর) গঠন করে বেশ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সবশেষ ২০০২ সালে বিশ্বের যেকোনো দেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আইসিসি গঠন করা হয়। আমরা আশা করবো অচিরেই এই আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে পাকিস্তানকে।
মানব সভ্যতার বর্বরোচিত অধ্যায় যুদ্ধ, যা আদিম যুগ থেকে এখনো পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে। একগোষ্ঠীর মানুষ ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে। এখান থেকে জেনোসাইড পদবাচ্যটি আলোচনায় আসে। পোলিশ ইহুদি আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। একে বাংলায় বলা হয় গণহত্যা। আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা শব্দটিকে একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা শুধুমাত্র ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে খুন নয়, বরং কোনো একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধনও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কনভেনশন অনুযায়ী এটি সংঘটিত হবে আরেক জনগোষ্ঠীর ওপর যারা জাতীয়ভাবে (হধঃরড়হধষষু), গোষ্ঠীগতভাবে (বঃযহরপধষষু), ধর্মীয়ভাবে (ৎবষরমরড়ঁংষু) বা বর্ণগতভাবে (ৎধপরধষষু) ভিন্ন। এই কনভেনশন গৃহীত হওয়ার পর স্বীকৃত নিষ্ঠুরতম গণহত্যাগুলো হলো আর্মেনীয় ও রুয়ান্ডার গণহত্যা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকহানাদার বাহিনী যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় তা অবশ্যই ইতিহাসের বর্বরোচিত একটি গণহত্যা। বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ২৫শে মার্চের রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সে রাতেই পাকবাহিনী একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল (সার্জেন্ট জহুরুল হক) হল, রোকেয়া হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সিডনি ট্রিবিউনের ভাষ্যানুযায়ী, শুধুমাত্র ২৫শে মার্চ রাতে কমবেশি এক লাখ লোককে হত্যা করা হয়। মূলত ২৫শে মার্চের রাতে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল এক মৃত্যুপুরী। এরপর টানা নয় মাস ধরে পাকহানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ পুরো বাংলাদেশ জুড়ে চালায় তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। শুধু হত্যা বা ধর্ষণই নয়, পুরো বাঙালি জাতিসত্তাকে ধ্বংস করার জন্য সব পদক্ষেপই নিয়েছিল পাকিস্তানি জান্তা। কিন্তু ইতিহাসের এই জঘন্যতম গণহত্যা এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়নি। যদিও এখানে জেনোসাইড বা গণহত্যার সবগুলো উপাদান বা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
পাকহানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে লোমহর্ষক অত্যাচার চালিয়েছিল। এখানে পাক বাহিনীর গণহারে খুন, ধর্ষণ অবশ্যই গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়বে। এছাড়া হিন্দু জনগোষ্ঠী খুন ও ভারতে চলে যাওয়া এক কোটি উদ্বাস্তু- এসব সুনির্দিষ্টভাবে গণহত্যার সংজ্ঞার আওতাভুক্ত।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউনেস্কো। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করার এই ঐতিহাসিক ভাষণটি ‘ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’র অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো। এখন একাত্তরের গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এজন্য একদিকে বিশ্বের দরবারে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা যেমন জরুরি তেমনি প্রয়োজন আন্তর্জাতিক লবিং। কেননা, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ শুরু থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি ভারত ও রাশিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ অবশ্যই এতে সমর্থন করবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক লবিং। এমন লোমহর্ষক, বর্বরোচিত গণহত্যা যখন আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পাবে তখন আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চাইতে পারবো।
জাতিসংঘ ১৯৮৫ সালে আর্মেনীয় গণহত্যাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় হুতু ও তুতসিদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেটিকেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এজন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা (আইসিটিআর) গঠন করে বেশ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সবশেষ ২০০২ সালে বিশ্বের যেকোনো দেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত আইসিসি গঠন করা হয়। আমরা আশা করবো অচিরেই এই আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে পাকিস্তানকে।
No comments