টিউশনির সাত-সতেরো by পিয়াস সরকার
আনি
নগদ টাকা, মাসের শেষে হাত ফাঁকা। শিক্ষা জীবনে শিক্ষার্থীদের এ যেন নিয়মিত
চিত্র। পরিবার থেকে হাত খরচের টাকা যতই আনুক না কেন মাসের শেষে হাত ফাঁকা
থাকবেই। এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ খুঁজে নেন
টিউশনি। পার্টটাইম চাকরির চেষ্টাও করেন অনেকে। ভাগ্যের জোরে চাকরি পেলেও
যোগ হয় সমস্যা। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির সময় ভারসাম্য রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে
পড়ে। এমনই কঠিন বাস্তবতায় শিক্ষা জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন লাখো শিক্ষার্থী।
আবার অনেক চাকরিজীবী বাড়তি আয়ের জন্য চাকরির পাশাপাশি যুক্ত হচ্ছেন
টিউশনিতে। গৃহিণীরাও পিছিয়ে নেই। তারাও অনেকেই আয়ের জন্য বেছে নিচ্ছেন
টিউশনি।
লালমাটিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তানিয়া রহমান বলেন, চাইলেই আমি চাকরি খুঁজে পাচ্ছি না। আর চাকরি পেলেও পড়ালেখার পাশাপাশি সময় মেলানো কষ্টকর হয়ে যায়। হাত খরচের টাকা জোগানোর পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীর টিউশনির উপর ভর করে পার করে দিচ্ছেন শিক্ষা জীবন। শিক্ষা জীবনের পর বেকার সময়ে মাথা উঁচু করে চলার প্রধান হাতিয়ার টিউশনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ বিভাগ থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করেছেন সেলিম আহমেদ। এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস এবং সরকারি চাকরির। প্রস্তুতির পাশাপাশি ছয়টি টিউশনি করান তিনি। মাসে আয় করেন ১৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ইংলিশে পড়বার কারণে টিউশনি পেতে খুব একটা সমস্যা হয় না। লেখাপড়া শেষ চাকরি মিলছে না। আবার বাড়ি থেকে টাকাও নিতে পারছি না। ভালোই আছি টিউশনি করিয়ে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুম খন্দকার। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান, পরিবার থেকে লেখাপড়ার খরচ চালানো সক্ষমতা নেই। টিউশনি একমাত্র সম্বল তার। তিনি বলেন, টিউশনি আমার লেখাপড়া টিকিয়ে রেখেছে। আমি নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাই। বলতে পারেন আমার টাকায় ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া চলছে। টিউশনিতে রয়েছে অনেক সুবিধা। দিনে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দিলেই হয়। তাই একের অধিক শিক্ষার্থীকেও পড়ানো সম্ভব খুব সহজে। এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সীমান্ত চৌধুরী এভাবেই জানান তার প্রতিক্রিয়া।
শিক্ষার্থীরা টিউশনি করিয়ে যেমন পান সম্মান আবার হাত খরচের টাকার জন্য সর্বোত্তম মাধ্যম। অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের জন্য টিউশনিতে গুনতে হয় সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা থেকে আট-দশ হাজার টাকা পর্যন্ত। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফা তাবাচ্ছুম নিমগ্নর জন্য তার বাবা-মা গুনেন দুই হাজার টাকা মাসে। আবার মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন ধানমন্ডি বয়েজের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম তোরণ। ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান তাকে পড়াতে আসেন বাড়িতে সপ্তাহে চারদিন। এর জন্য তিনি মাসে পান সাত হাজার টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অমিত রহমান বলেন, এক বাড়িতে পড়াতে যেতাম আজিমপুরে। প্রথম সাত মাস ঠিকমতো বেতন দিলেও তারপরের মাসে জানান এ মাসের বেতনটা দিতে পারবে না পরের মাসে একসঙ্গে দুই মাসের টাকা দিবেন। এভাবে তিন মাসের টাকা বাকি হবার পরে বুঝতে পারি তারা টাকা দিবেন না। তাই টিউশনি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আবিব রহমান বলেন, টিউশনি করানোর কারণে চাইলেও যখন তখন বাড়িতে যেতে পারি না। সেমিস্টার ব্রেক বা ঈদের আগে বন্ধুরা সব বাড়িতে গেলেও টিউশনির কারণে তাকে থাকতে হয় ঢাকায়। সেই সঙ্গে বাড়িতে গেলেও ফিরতে হয় খুব তাড়াতাড়ি। সব থেকে খারাপ লাগে যখন বন্ধুরা আড্ডা বা ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা করে। আড্ডায় থাকা কিংবা ঘুরতে যাওয়াও সম্ভব হয় না টিউশনির কারণে। আবার ডিসেম্বর মাসে শিক্ষার্থীদের ছুটি থাকে। তাই এই মাসে বেতন ছাড়া থাকতে হয়। ঢাকার কত শতাংশ শিক্ষার্থী বা পেশার মানুষ টিউশনির সঙ্গে জড়িত এমন পরিসংখ্যান না মিললেও ঢাকার ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ২টি কলেজের ৭০ জন শিক্ষার্থীকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরাসরি প্রশ্ন করে দেখা যায় এর মধ্যে ১৬ জন অর্থাৎ ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী টিউশনির সঙ্গে জড়িত। ছেলে শিক্ষার্থী ৯ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৭ জন। আবার ১৬ জনের মাঝে ১৫ জনই একের অধিক টিউশনি করেন। এই ১৬ জনের মধ্যে ৩ জন বাড়ি থেকে টাকা নেন না। টিউশনি তাদের একমাত্র অবলম্বন। ৭০ জনের ৫৪ জনেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে টিউশনি করানোর। আবার ১৮টি পরিবারের টিউশনির শিক্ষকদের তথ্যে দেখা যায়, ১০ জন শিক্ষক এবং ৮ জন শিক্ষিকা। ১৫ জন এখনো অধ্যয়নরত আছেন। তার মধ্যে ১৫ জনই একের অধিক টিউশনি করান। আবার তাদের মধ্যে ১১ জনের শিক্ষা জীবন চলছে। ৩ জনের শিক্ষা জীবন শেষ। ১ জন চাকরির পাশাপাশি টিউশনি করান।
অনেকে ইচ্ছা থাকলেও মিলাতে পারছেন না টিউশনি। এর জন্য ভরসা করতে হয় পরিচিত জনদের ওপর। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে টিউশন খুঁজে দেয়াকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে নানান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেমন টিউটর দিচ্ছি নিচ্ছি, টিউশন বিডি, ঢাকা টিউশন মিডিয়া, টিউশন মিডিয়া লিমিটেড, ঢাকা টিউটর ইত্যাদি। এসব অনলাইন কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মোনালিসা প্রামাণিক টিউশনি খুঁজে পেয়েছেন ঢাকা টিউশনের মাধ্যমে। তিনি বলেন, আমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম, বিভাগ, পরিচয় ইত্যাদি তথ্য দেই ঢাকা টিউশনকে। তারা আমাকে টিউশনি খুঁজে দেন। এর জন্য প্রথম মাসের বেতনের অর্ধেক টাকা দিতে হয়।
ঢাকা টিউশন মিডিয়ার স্বত্বাধিকারী মারুফুল ইসলাম বলেন, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশনি খুঁজে পাওয়া কতটুকু গুরত্বপূর্ণ তা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি। এছাড়াও অভিভাবকদের জন্য যোগ্য শিক্ষক পাওয়াটাও কষ্টকর। এসব কথা চিন্তা করে এই উদ্যোগ হাতে নেই। প্রথম মাসের বেতনের অর্ধেক টাকা রাখছি। এতে যেমন লাভবান হচ্ছি সঙ্গে উপকৃত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরাও খুঁজে পাচ্ছেন মনমতো শিক্ষক।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টিউশনি পাবার পর প্রথম সপ্তাহে দিতে হয় টাকা। গৃহিণী রেহানা বলেন, সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি। সময় কাটে না তাই চিন্তা করি টিউশনি করাব। ৫০০ টাকা দিয়ে ফর্ম পূরণ করি একটি টিউশন মিডিয়া হাউজের। প্রায় দুই সপ্তাহ পর আমাকে টিউশনি ঠিক করে দেয় তারা। তাদের চুক্তি অনুযায়ী বেতনের অর্ধেক দেড় হাজার টাকা পরিশোধ করি। এক তারিখ পড়ানো শুরু করে নয় তারিখে জানিয়ে দেয়া হয় তাকে দিয়ে আর বাচ্চা পড়াবেন না। মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী টিউশনি দিয়েছি, আপনিও টাকা পরিশোধ করেছেন। এখন বাচ্চা আপনার কাছে না পড়লে সে দায়ভারতো আমরা নিব না। তিনি আরো বলেন, আমি যে বাড়িতে সাব-লেট থাকি এখন তাদের মেয়েকে পড়াই। আমাদের ঘর ভাড়া ৭ হাজার টাকা ঠিক হলেও এখন তারা আমাদের কাছে রাখেন ৪ হাজার টাকা। বাকি টাকা আমার বেতন হিসাবে গণ্য করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইউসুফ ইসলাম রিফাদ বলেন, অভিভাবকদের চাওয়া এবং অভিযোগের কোনো শেষ নেই। সন্তান কেন রেজাল্ট খারাপ করলো? কী পড়ান আপনি। যাবার পর কিছুই বলতে পারে না? গণিত করান বেশি করে। ইংলিশে এত দুর্বল কেন? পড়া নেবেন প্রতিদিন, বেশিচাপ হয়ে যাচ্ছে। দেরি হলো কেন আসতে ইত্যাদি প্রশ্নে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় প্রায়ই।
বায়িং হাউজে কর্মরত বাবা ইমদাদুল ইসলাম ও মা রাহেলা ফারজানা কর্মরত একটি কল সেন্টারে। তাদের কন্যা জায়ান পড়েন ধানমন্ডি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তাদের মেয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থী খুঁজছেন। কিন্তু শিক্ষিকা কেন? বাবা ইমদাদুল হক বলেন, আমরা সারা দিন বাড়িতে থাকি না। মেয়ে তার দাদির কাছে থাকে তাই নিরাপত্তা যেমন একটা বড় ব্যাপার আবার শিক্ষিকা হলে মেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এসব অনলাইন মাধ্যমে অভিভাবকদের চাহিদাগুলোতে দেখা যায় প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্রীর জন্য শিক্ষিকা চান অভিভাবকরা। আবার ছাত্রের জন্যও শিক্ষিকার আবেদন দেখা যায়। সঙ্গে শুধু শিক্ষক চেয়ে আবেদন নেই বললেও চলে।
বাবা-মা শিক্ষিকা খোঁজার পাশাপাশি শিক্ষিকারা টিউশনি নেবার আগে চেষ্টা করেন দেখে শুনে বুঝে নেয়ার। আদিবা রাকা অধ্যয়নরত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে। তিনি বলেন, টিউশনি নেবার আগে দেখে নেই বাড়িতে কে কে থাকে। পড়াবার সময় মহিলা সদস্যরা বাড়িতে থাকেন কী না? ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিরা জাহান বলেন, আমি টিউশনিতে ঢোকার সময় আমার এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে ঢুকি। আবার ঘণ্টাখানিক পর টিউশনি শেষে তাকে জানিয়ে দেই। এক ঘণ্টার বেশি হলে সে খোঁজ নেয় কোনো সমস্যা হয়েছে কী না?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ২০১৭ সালে পড়াতাম একটি মেয়েকে। আমার ছাত্রীর বড় ভাই প্রায়ই চেষ্টা করতেন আমার সঙ্গে কথা বলার। মোবাইল ফোনে প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার পাশাপাশি বিরক্ত করতেন প্রায়ই। একদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। শুধু তার বড় ভাই ছিল। আমি পড়াতে গেলে বড় ভাই বলেন, এখনই চলে আসবে সবাই। তার কথায় অসঙ্গতি এবং বিপদের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি বাড়ি থেকে। আর যাইনি পড়াতে- সেই বাড়িতে।
মোহাম্মদপুর নিবাসী গৃহিণী রিতা রায় বলেন, আশা ইউনিভার্সিটির এক মেয়ে পড়াতে আসত আমার ছেলেকে। খুবই মিষ্টি মেয়ে, ভালো ব্যবহার, বুদ্ধিমতী। আমাদের পরিবারের সদস্য ভাবতাম তাকে। প্রায় দুই বছর আমার ছেলেকে পড়িয়েছিল। কিন্তু এক মাসে সে বলে টাকার কারণে ভার্সিটির রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। তার বেতন মাসিক তিন হাজার টাকা, ধার হিসেবে তাকে দেই দশ হাজার টাকা। সেই টাকা নেয়ার পর আর আমাদের বাড়িতে আসেনি সে। মোবাইল নম্বরটাও বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তার ভার্সিটি শেষ হয়ে গেছে মেস ছেড়ে দিয়েছে, কোথায় গেছে তা বলতে পারেনি তার মেসের সদস্যরা। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সজল মাহমুদ তিন বছর আগে পড়াতেন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়কে। তিনি এখন সম্পর্কে তার শ্যালক। ছাত্রের বড়বোন নিশি পড়তেন ইডেন কলেজে। সেই সময় প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে এক বছর পর পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তারা।
লালমাটিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তানিয়া রহমান বলেন, চাইলেই আমি চাকরি খুঁজে পাচ্ছি না। আর চাকরি পেলেও পড়ালেখার পাশাপাশি সময় মেলানো কষ্টকর হয়ে যায়। হাত খরচের টাকা জোগানোর পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীর টিউশনির উপর ভর করে পার করে দিচ্ছেন শিক্ষা জীবন। শিক্ষা জীবনের পর বেকার সময়ে মাথা উঁচু করে চলার প্রধান হাতিয়ার টিউশনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ বিভাগ থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করেছেন সেলিম আহমেদ। এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস এবং সরকারি চাকরির। প্রস্তুতির পাশাপাশি ছয়টি টিউশনি করান তিনি। মাসে আয় করেন ১৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ইংলিশে পড়বার কারণে টিউশনি পেতে খুব একটা সমস্যা হয় না। লেখাপড়া শেষ চাকরি মিলছে না। আবার বাড়ি থেকে টাকাও নিতে পারছি না। ভালোই আছি টিউশনি করিয়ে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুম খন্দকার। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান, পরিবার থেকে লেখাপড়ার খরচ চালানো সক্ষমতা নেই। টিউশনি একমাত্র সম্বল তার। তিনি বলেন, টিউশনি আমার লেখাপড়া টিকিয়ে রেখেছে। আমি নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাই। বলতে পারেন আমার টাকায় ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া চলছে। টিউশনিতে রয়েছে অনেক সুবিধা। দিনে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দিলেই হয়। তাই একের অধিক শিক্ষার্থীকেও পড়ানো সম্ভব খুব সহজে। এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সীমান্ত চৌধুরী এভাবেই জানান তার প্রতিক্রিয়া।
শিক্ষার্থীরা টিউশনি করিয়ে যেমন পান সম্মান আবার হাত খরচের টাকার জন্য সর্বোত্তম মাধ্যম। অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের জন্য টিউশনিতে গুনতে হয় সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা থেকে আট-দশ হাজার টাকা পর্যন্ত। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফা তাবাচ্ছুম নিমগ্নর জন্য তার বাবা-মা গুনেন দুই হাজার টাকা মাসে। আবার মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন ধানমন্ডি বয়েজের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম তোরণ। ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান তাকে পড়াতে আসেন বাড়িতে সপ্তাহে চারদিন। এর জন্য তিনি মাসে পান সাত হাজার টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অমিত রহমান বলেন, এক বাড়িতে পড়াতে যেতাম আজিমপুরে। প্রথম সাত মাস ঠিকমতো বেতন দিলেও তারপরের মাসে জানান এ মাসের বেতনটা দিতে পারবে না পরের মাসে একসঙ্গে দুই মাসের টাকা দিবেন। এভাবে তিন মাসের টাকা বাকি হবার পরে বুঝতে পারি তারা টাকা দিবেন না। তাই টিউশনি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আবিব রহমান বলেন, টিউশনি করানোর কারণে চাইলেও যখন তখন বাড়িতে যেতে পারি না। সেমিস্টার ব্রেক বা ঈদের আগে বন্ধুরা সব বাড়িতে গেলেও টিউশনির কারণে তাকে থাকতে হয় ঢাকায়। সেই সঙ্গে বাড়িতে গেলেও ফিরতে হয় খুব তাড়াতাড়ি। সব থেকে খারাপ লাগে যখন বন্ধুরা আড্ডা বা ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা করে। আড্ডায় থাকা কিংবা ঘুরতে যাওয়াও সম্ভব হয় না টিউশনির কারণে। আবার ডিসেম্বর মাসে শিক্ষার্থীদের ছুটি থাকে। তাই এই মাসে বেতন ছাড়া থাকতে হয়। ঢাকার কত শতাংশ শিক্ষার্থী বা পেশার মানুষ টিউশনির সঙ্গে জড়িত এমন পরিসংখ্যান না মিললেও ঢাকার ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ২টি কলেজের ৭০ জন শিক্ষার্থীকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরাসরি প্রশ্ন করে দেখা যায় এর মধ্যে ১৬ জন অর্থাৎ ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী টিউশনির সঙ্গে জড়িত। ছেলে শিক্ষার্থী ৯ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৭ জন। আবার ১৬ জনের মাঝে ১৫ জনই একের অধিক টিউশনি করেন। এই ১৬ জনের মধ্যে ৩ জন বাড়ি থেকে টাকা নেন না। টিউশনি তাদের একমাত্র অবলম্বন। ৭০ জনের ৫৪ জনেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে টিউশনি করানোর। আবার ১৮টি পরিবারের টিউশনির শিক্ষকদের তথ্যে দেখা যায়, ১০ জন শিক্ষক এবং ৮ জন শিক্ষিকা। ১৫ জন এখনো অধ্যয়নরত আছেন। তার মধ্যে ১৫ জনই একের অধিক টিউশনি করান। আবার তাদের মধ্যে ১১ জনের শিক্ষা জীবন চলছে। ৩ জনের শিক্ষা জীবন শেষ। ১ জন চাকরির পাশাপাশি টিউশনি করান।
অনেকে ইচ্ছা থাকলেও মিলাতে পারছেন না টিউশনি। এর জন্য ভরসা করতে হয় পরিচিত জনদের ওপর। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে টিউশন খুঁজে দেয়াকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে নানান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেমন টিউটর দিচ্ছি নিচ্ছি, টিউশন বিডি, ঢাকা টিউশন মিডিয়া, টিউশন মিডিয়া লিমিটেড, ঢাকা টিউটর ইত্যাদি। এসব অনলাইন কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মোনালিসা প্রামাণিক টিউশনি খুঁজে পেয়েছেন ঢাকা টিউশনের মাধ্যমে। তিনি বলেন, আমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম, বিভাগ, পরিচয় ইত্যাদি তথ্য দেই ঢাকা টিউশনকে। তারা আমাকে টিউশনি খুঁজে দেন। এর জন্য প্রথম মাসের বেতনের অর্ধেক টাকা দিতে হয়।
ঢাকা টিউশন মিডিয়ার স্বত্বাধিকারী মারুফুল ইসলাম বলেন, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশনি খুঁজে পাওয়া কতটুকু গুরত্বপূর্ণ তা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি। এছাড়াও অভিভাবকদের জন্য যোগ্য শিক্ষক পাওয়াটাও কষ্টকর। এসব কথা চিন্তা করে এই উদ্যোগ হাতে নেই। প্রথম মাসের বেতনের অর্ধেক টাকা রাখছি। এতে যেমন লাভবান হচ্ছি সঙ্গে উপকৃত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরাও খুঁজে পাচ্ছেন মনমতো শিক্ষক।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টিউশনি পাবার পর প্রথম সপ্তাহে দিতে হয় টাকা। গৃহিণী রেহানা বলেন, সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি। সময় কাটে না তাই চিন্তা করি টিউশনি করাব। ৫০০ টাকা দিয়ে ফর্ম পূরণ করি একটি টিউশন মিডিয়া হাউজের। প্রায় দুই সপ্তাহ পর আমাকে টিউশনি ঠিক করে দেয় তারা। তাদের চুক্তি অনুযায়ী বেতনের অর্ধেক দেড় হাজার টাকা পরিশোধ করি। এক তারিখ পড়ানো শুরু করে নয় তারিখে জানিয়ে দেয়া হয় তাকে দিয়ে আর বাচ্চা পড়াবেন না। মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী টিউশনি দিয়েছি, আপনিও টাকা পরিশোধ করেছেন। এখন বাচ্চা আপনার কাছে না পড়লে সে দায়ভারতো আমরা নিব না। তিনি আরো বলেন, আমি যে বাড়িতে সাব-লেট থাকি এখন তাদের মেয়েকে পড়াই। আমাদের ঘর ভাড়া ৭ হাজার টাকা ঠিক হলেও এখন তারা আমাদের কাছে রাখেন ৪ হাজার টাকা। বাকি টাকা আমার বেতন হিসাবে গণ্য করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইউসুফ ইসলাম রিফাদ বলেন, অভিভাবকদের চাওয়া এবং অভিযোগের কোনো শেষ নেই। সন্তান কেন রেজাল্ট খারাপ করলো? কী পড়ান আপনি। যাবার পর কিছুই বলতে পারে না? গণিত করান বেশি করে। ইংলিশে এত দুর্বল কেন? পড়া নেবেন প্রতিদিন, বেশিচাপ হয়ে যাচ্ছে। দেরি হলো কেন আসতে ইত্যাদি প্রশ্নে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় প্রায়ই।
বায়িং হাউজে কর্মরত বাবা ইমদাদুল ইসলাম ও মা রাহেলা ফারজানা কর্মরত একটি কল সেন্টারে। তাদের কন্যা জায়ান পড়েন ধানমন্ডি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তাদের মেয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থী খুঁজছেন। কিন্তু শিক্ষিকা কেন? বাবা ইমদাদুল হক বলেন, আমরা সারা দিন বাড়িতে থাকি না। মেয়ে তার দাদির কাছে থাকে তাই নিরাপত্তা যেমন একটা বড় ব্যাপার আবার শিক্ষিকা হলে মেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এসব অনলাইন মাধ্যমে অভিভাবকদের চাহিদাগুলোতে দেখা যায় প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্রীর জন্য শিক্ষিকা চান অভিভাবকরা। আবার ছাত্রের জন্যও শিক্ষিকার আবেদন দেখা যায়। সঙ্গে শুধু শিক্ষক চেয়ে আবেদন নেই বললেও চলে।
বাবা-মা শিক্ষিকা খোঁজার পাশাপাশি শিক্ষিকারা টিউশনি নেবার আগে চেষ্টা করেন দেখে শুনে বুঝে নেয়ার। আদিবা রাকা অধ্যয়নরত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে। তিনি বলেন, টিউশনি নেবার আগে দেখে নেই বাড়িতে কে কে থাকে। পড়াবার সময় মহিলা সদস্যরা বাড়িতে থাকেন কী না? ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিরা জাহান বলেন, আমি টিউশনিতে ঢোকার সময় আমার এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে ঢুকি। আবার ঘণ্টাখানিক পর টিউশনি শেষে তাকে জানিয়ে দেই। এক ঘণ্টার বেশি হলে সে খোঁজ নেয় কোনো সমস্যা হয়েছে কী না?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ২০১৭ সালে পড়াতাম একটি মেয়েকে। আমার ছাত্রীর বড় ভাই প্রায়ই চেষ্টা করতেন আমার সঙ্গে কথা বলার। মোবাইল ফোনে প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার পাশাপাশি বিরক্ত করতেন প্রায়ই। একদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। শুধু তার বড় ভাই ছিল। আমি পড়াতে গেলে বড় ভাই বলেন, এখনই চলে আসবে সবাই। তার কথায় অসঙ্গতি এবং বিপদের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি বাড়ি থেকে। আর যাইনি পড়াতে- সেই বাড়িতে।
মোহাম্মদপুর নিবাসী গৃহিণী রিতা রায় বলেন, আশা ইউনিভার্সিটির এক মেয়ে পড়াতে আসত আমার ছেলেকে। খুবই মিষ্টি মেয়ে, ভালো ব্যবহার, বুদ্ধিমতী। আমাদের পরিবারের সদস্য ভাবতাম তাকে। প্রায় দুই বছর আমার ছেলেকে পড়িয়েছিল। কিন্তু এক মাসে সে বলে টাকার কারণে ভার্সিটির রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। তার বেতন মাসিক তিন হাজার টাকা, ধার হিসেবে তাকে দেই দশ হাজার টাকা। সেই টাকা নেয়ার পর আর আমাদের বাড়িতে আসেনি সে। মোবাইল নম্বরটাও বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তার ভার্সিটি শেষ হয়ে গেছে মেস ছেড়ে দিয়েছে, কোথায় গেছে তা বলতে পারেনি তার মেসের সদস্যরা। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সজল মাহমুদ তিন বছর আগে পড়াতেন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়কে। তিনি এখন সম্পর্কে তার শ্যালক। ছাত্রের বড়বোন নিশি পড়তেন ইডেন কলেজে। সেই সময় প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে এক বছর পর পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তারা।
No comments