পুলিশ সংস্কারের খসড়া আইন কার্যকর হোক
প্রথম আলো: পুলিশে সংস্কারে ২০১১ সালে যে খসড়া অধ্যাদেশ করা হয়েছিল, তার অগ্রগতি? দলীয় প্রভাবের বাইরে আনতে এটা সুফল দেবে?
শহীদুল হক: সেটি কার্যকর হওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাইয়ে কমিটি করেছিল, তার রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। হ্যাঁ, সেটা বাস্তবায়িত হলে একটা পর্যায়ে আসবে। দলনিরপেক্ষভাবে কাজ করতে ব্যক্তি অফিসারের মানসিকতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমার চাকরিজীবনে দলীয় প্রভাবে বেআইনি কিছু করাতে পারেনি। বিএনপি আমলে সিরাজগঞ্জে এসপি ছিলাম। রাঁধুনীবাড়ি ক্যাম্পে পুলিশের চার সদস্যকে হত্যা করে ক্যাম্প লুট হলো। ওই মামলায় একটি রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতাকে জড়াতে চাপ দিলে আমি তা অগ্রাহ্য করেছিলাম। এটা বিবেকের বিষয়, কারও তা করা উচিত নয়।
প্রথম আলো: আপনি বলেছিলেন কারা পেট্রলবোমা মেরেছে, তা সূর্যের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু আমরা তো অমাবস্যায় আছি।
শহীদুল হক: একটি দলের আন্দোলনের অংশ হিসেবে এটা ঘটেছিল, তাদের নেতা-কর্মীরাই করেছে। বস্তুনিষ্ঠ সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তদন্তেও তা প্রমাণিত।
প্রথম আলো: আপনার এই মৌখিক উক্তির বাইরে বিষয়টির বিচারিক প্রক্রিয়া কী বলে?
শহীদুল হক: বোমাসহ কেউ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হলেই তো চিহ্নিত হয়ে যায়, অধিকাংশই মামলাতেই অভিযোগপত্র হয়ে গেছে। কোনো বিচার শেষ বা রায় হয়েছে কি না, সে তথ্য এখন নেই, জানতে হবে।
প্রথম আলো: জামায়াতের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের ৩০ জন সদস্যকে হত্যার দায়ে কারও দণ্ড হয়েছে কি?
শহীদুল হক: সবটাতেই অভিযোগপত্র দিয়েছি, কোনোটিতেই বিচারকার্য শেষ হয়নি।
প্রথম আলো: ৩২ বছরের চাকরিজীবনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশের যে অপব্যবহার, আপনি এখন কীভাবে দেখেন?
শহীদুল হক: অভিযোগ পুরোনো। অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানিতে ব্যবহার করা উচিত নয়। আমরা সরকারি দল, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী-সবার কাছ থেকেই তদবির পাই, আইনি প্রক্রিয়ায় তার সুরাহা করি, বাইরে সম্ভব নয়, কর্তৃপক্ষকেও আদালতে জবাবদিহি করতে হয়।
প্রথম আলো: এখন আর দলীয় বিবেচনায় পুলিশ নিয়োগ হয় না, নাকি আরও অবনতি ঘটেছে? জনসংখ্যা ও লোকবলের আনুপাতিক হার সন্তোষজনক?
শহীদুল হক: আমরা কনস্টেবল নিয়োগ দিই। ২০০৯ সালে ১ হাজার ১০০ জনে ১ জন ছিল, সেটা কমিয়ে ৮৫০ জনে ১ জন করা হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ৪০০ জনে ১ জন থাকবে। একটা বড় অংশ প্রটোকলে থাকে, তাতে থানার কাজ ব্যাহত হয়, তাই আমরা গার্ড অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রস্তাব করেছি। আর প্রভাবশালীরা তাঁদের গ্রুপের লোক ঢোকাতে চাইবেন। আমি আইজিপি হওয়ার পর নিশ্চিত করি যে লিখিত পরীক্ষায় পাস না করলে কোনো তদবির আমার কাছে আসবে না। ভাইভায় অনেকে তদবির করতে পারে। বন্ধুবান্ধব, আপনাদের সাংবাদিকেরা অনেক সময় তদবির করেন। রিটেনে ভালো করলে হয়তো ভাইভায় একটু কমবেশি দেওয়া হয়, এর চেয়ে বেশি কিছু করিনি।
প্রথম আলো: নিয়োগ কীভাবে আরও স্বচ্ছ করা যায়?
শহীদুল হক: শতভাগ স্বচ্ছতায় পুলিশ সার্জেন্ট ও এসআই নিয়োগ হেডকোয়ার্টার করে, কারও কোনো অভিযোগ নেই। গত তিন বছরে আমি প্রায় তিন হাজার নিয়েছি।
প্রথম আলো: চাকরি পেতে কারও ঘুষ দিতে হয়নি?
শহীদুল হক: না, হয়নি।
প্রথম আলো: আপনার অজ্ঞাতসারে টাকাপয়সার লেনদেন হতে পারে।
শহীদুল হক: আমার অজ্ঞাতসারে বলতে পারব না। কিন্তু এ রকম কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। শুধু কনস্টেবল নিয়ে অভিযোগ আসছে, যা জেলা এসপিরা করে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, রিটেনে শতভাগ স্বচ্ছ হতে হবে, রিটেনে পাস করতে হবে। স্থানীয় নিয়োগ বোর্ডের ডিসক্রিশন থাকে, কিন্তু ভাইভায় তেমন মার্কও থাকে না। আর সরকার রাজি হলে হেডকোয়ার্টারের সরাসরি তদারকিতে নিয়োগ হতে পারে, কিন্তু দুই শ বছর ধরে স্থানীয় এসপি যেটা করছেন, সেটা খর্ব হলে তাঁরা আহত বোধ করতে পারেন।
প্রথম আলো: সাধারণ মানুষ প্রথমেই থানায় যান, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু আচরণের অভিযোগ আছে।
শহীদুল হক: এটা আছে, এর অপনোদনে তাদের প্রশিক্ষণ ও মাইন্ডসেট পরিবর্তনে আমরা বহুমুখী চেষ্টা করেছি। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থায় কিন্তু জনগণের কাছে একটা জবাবদিহি থাকছে।
প্রথম আলো: দুই ইতালীয়কে হত্যার পর ঘটনা ঘটতেই থাকল, এখন বন্ধ, এর মানে জঙ্গিবাদ কার্যকরভাবে দমন হয়েছে? আমরা আইএসের হুমকিমুক্ত?
শহীদুল হক: এটা বৈশ্বিক সমস্যা। আল-কায়েদার পর আইএস এসেছে, যে সমস্যা আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকে বেশি হয়েছে। ওরা ওদের মতাদর্শ ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে, সেটা দেখে তরুণেরা স্বপ্রণোদিত হয়েছে। ৯০ ভাগ মুসলিম দেশের কিছু তরুণ ইন্টারনেটে ওসব পড়ে প্রণোদিত হয়েছে। ৬৩ জেলায় বোমাবাজি করা জেএমবির বিচারের ফলে তারা অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, পরে তারা ইন্টারনেটে পুনরায় উদ্দীপ্ত হয় এবং অনুসারী বাড়িয়ে সংগঠিত হয়ে অপারেশন শুরু করেছিল। তারা অনেকগুলো সুইসাইড স্কোয়াড করেছিল। হোলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার পর পুলিশ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের মানুষও রাস্তায় নেমেছিলেন। গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে আমরা ওদের নেটওয়ার্ক ও আস্তানা চিহ্নিত এবং তাতে প্রায় ৪০টি অভিযান চালাই। তারা এখন অবশ্যই দুর্বল হয়ে গেছে। আইএস সরাসরি কোনো লিংক স্থাপন করতে পারেনি, তাদের কোনো নেতা এখানে কারও সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করেছে, তার প্রমাণ এখনো পাইনি।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে ইন্টারপোল বা বিদেশি রাষ্ট্রের কোনো অনুরোধে কিছু তদন্ত করছেন?
শহীদুল হক: না। জঙ্গি বিষয়ে কোনো দেশ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু পাইনি।
প্রথম আলো: পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারসসহ আমরা বিদেশে টাকা পাচারের কিছু অভিযোগ শুনি। কোনো তদন্ত চলমান?
শহীদুল হক: না। কেউ এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য চায়নি।
প্রথম আলো: দেশে গুম কারা করছে?
শহীদুল হক: গুম বলে তো আইনে কিছু নেই, এটা অপহরণ।
প্রথম আলো: রাষ্ট্র যেখানে পদ্ধতিগতভাবে মানুষ নিধন করে, সেটা আন্তর্জাতিক আইনে গুম বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স। আপনার তিন বছরে শতাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম হয়েছে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও কি আপনি পুলিশের জড়িত থাকা তদন্ত করেছেন? এনকাউন্টারের পর প্রেস রিলিজ পেতাম, তা বন্ধ করলেন কেন?
শহীদুল হক: কিছু ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ঘটেছে। কাউকে জোর করে নিলে পুলিশের দায়িত্ব আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলি না, এনকাউন্টার হয়। না, আমরা পুলিশ জড়িত থাকাসংক্রান্ত কোনো তদন্ত করিনি। প্রতিটি এনকাউন্টার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন, এতে কাউকে দায়ী করা হয়নি। আর প্রেস রিলিজ পুলিশের দেওয়ার কথা, অনেক সময় দেওয়া হয় না। যারা মারা যায়, তারা বেশির ভাগ সন্ত্রাসী, খারাপ লোক।
প্রথম আলো: আপনার মন্তব্য সংবিধানবিরোধী। কারণ, খুনিরও মানবাধিকার আছে। আর এমন যুক্তি দিয়েই অপারেশন ক্লিন হার্ট শুরু করেছিল বিএনপি। বিচার বিভাগে প্রতিকার নেই, তাই এভাবে রাষ্ট্র নিষ্ফল প্রতিকার খুঁজছে।
শহীদুল হক: না, পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি এটা বলতে পারি না। এটা মানুষের ধারণা, সেটাই বলেছি মাত্র। এরা দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল, বারবার তারা গ্রেপ্তার হয়েছে। বিচার হচ্ছে না। জেলে রাখা যাচ্ছে না। কাজেই এগুলো সমাজ ও মানুষের জন্য হুমকি। একসময় চুয়াত্তরের স্পেশাল অ্যাক্টে এ ধরনের লোকদের আমরা ডিটেনশন দিতাম। কিন্তু বিভিন্ন সময় হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে অনেকে ডিটেনশন দিতে ভয় পান। এল ক্লিন হার্ট, এরপর পাবলিক ক্রসফায়ার আবিষ্কার করল। দুর্ধর্ষ অপরাধীরা পুলিশকে পরোয়া করে না, তখন পুলিশ বাধ্য হয়ে এগুলো করে।
প্রথম আলো: ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা কতটা কার্যকর?
শহীদুল হক: তিন বছরে অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে, অনেকে জামিনে বেরিয়ে গেছে, এটা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক।
প্রথম আলো: ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির দায়ে আপনি গত তিন বছরে কতজন বড় অফিসারকে চাকরিচ্যুত করেছেন, সংখ্যায় তাঁরা কত?
শহীদুল হক: (হেসে) আমরা জিরো টলারেন্স রাখি।
প্রথম আলো: জিরো টলারেন্সের নমুনা দেখান। পুলিশের ভালো কাজ আছে, আবার ব্যাপক অভিযোগ আছে, তারা মাদক ব্যবসাসহ বিরাট অপরাধের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুষ ছাড়া পুলিশি সেবা মেলে না।
শহীদুল হক: ঢালাও অভিযোগের বাইরে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ আছে, তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে শাস্তি হয়। ফৌজদারি অপরাধে জড়ালে কোনো খাতির করি না। নিয়মিত মামলা হয়। এসব পত্রিকায় যতটা ব্যাপক, বাস্তবে ততটা নয়।
প্রথম আলো: তিন বছরে একটি দৃষ্টান্ত দিন, যা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব বিচলিত করেছে।
শহীদুল হক: কক্সবাজার থেকে ফিরছিলাম। একজন সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে সাত লাখ ইয়াবা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পুলিশের জন্য এটা লজ্জার।
প্রথম আলো: আপনার চাকরিজীবনের ৩২ বছরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত?
শহীদুল হক: ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামে অতিরিক্ত এসপি হিসেবে ২২টি পরোয়ানা জারি থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীপ্রধান শিবির ক্যাডার নাছিরের আস্তানায় সফল অভিযান চালাই, পরে তাকে গ্রেপ্তার করি। ওই বছরই হাটহাজারীতে সাড়ে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়ি থেকে অস্ত্রসহ এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করি, ছোট এক অফিসার হয়ে তাঁকে এভাবে আটকে রাখা অকল্পনীয় ছিল।
প্রথম আলো: এবার একটু তুলনামূলক মন্তব্য করুন। আপনি ১৯৮৬ সালের পরের সব ঘটনারই সাক্ষী।’ ৯৩-এ বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, আর তার ক্ষমতাবান মিত্র সাকা চৌধুরী। এই ২০১৮ সালের বাংলাদেশে কোনো অতিরিক্ত অফিসারের পক্ষে এমন অভিযান চালানোর বাস্তবতা আছে? ছাত্রলীগের জেলা নেতা ধরতেও পুলিশ দ্বিধান্বিত।
শহীদুল হক: বাস্তবতা অবশ্যই আছে। দ্বিধান্বিত যেটা বলছেন, সেটা কোনো ব্যক্তি কর্মকর্তার সীমাবদ্ধতা হতে পারে। সার্বিকভাবে আইনপ্রয়োগে দলনির্বিশেষে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। সাকা চৌধুরীর মতো সন্ত্রাসী গডফাদার আওয়ামী লীগে নেই। তা ছাড়া চট্টগ্রাম বিএনপির কেউ তাঁকে পছন্দ করতেন না। আর অতীতে, ইমদুর সঙ্গে সরকারপ্রধানের ছবি, কালীগঞ্জের ঘটনা দেখেছি। এরশাদের আমলের ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার ছিল না, তখন ছিল প্রশাসন ঠিক তো ক্ষমতা ঠিক।
প্রথম আলো: পুলিশের বদলি ও পদোন্নতিতে বিএনপিপন্থী, আওয়ামী লীগপন্থী, এসব কেমন চলছে? আপনি বিএনপি আমলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন?
শহীদুল হক: আমার বহু কাজের স্বীকৃতি দিতে বিভাগীয় প্রস্তাব ছিল, আমাকে আওয়ামী ঘরানার বিবেচনায় বিএনপি সেসব নাকচ করেছে। দলীয় ভালো লোক, পরিচয়নির্বিশেষে তাদের নিয়ে আমরা কমিউনিটি পুলিশিং চালু করেছি।
প্রথম আলো: সরকার চায়নি, কিন্তু পুলিশপ্রধান হিসেবে আপনার স্বাধীন সিদ্ধান্তে বিএনপিকে সভা করতে দেওয়ার একটি নজিরও আছে কি?
শহীদুল হক: সরকার চায়নি, এ রকম কম হয়েছে। জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও জনদুর্ভোগ দেখতে হয়।
প্রথম আলো: জনমনে ধারণা হলো আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা চাইলেই সভা করতে পারে, গত ৫ জানুয়ারিতে এক অখ্যাত সংগঠনের করা দরখাস্তের যুক্তি দেবেন, কিন্তু মানুষ এসব বোঝে না? আপনাদের প্রতি এতে জন-আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?
শহীদুল হক: যাঁরা আগে আসবেন, তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। এখানে জনগণ ভুল বুঝলে আমাদের কিছু করার নেই।
প্রথম আলো: ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, এর আগের নয় মাসেই পুলিশি হেফাজতে অন্তত ১৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। খালেদা জিয়া এক টুইটে প্রায় সাড়ে সাত শ কর্মী গুমের অভিযোগ করেছেন, এর সত্যতা চ্যালেঞ্জ করবেন না?
শহীদুল হক: পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে গত তিন বছরে কোনো নির্যাতন বা হত্যা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আগে যেটা থার্ড ডিগ্রি হতো বলে কথা ছিল, সেটা আমরা করি না। এখন ডিজিটালসহ নানা কৌশল আছে। কাউকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই না। চেষ্টা করব তথ্যটা তাদের (বিএনপি) কাছ থেকে আনতে। প্রতিটি অভিযোগই আমরা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
প্রথম আলো: আপনাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, খুন বছরে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার ছিল, যা ২০১৩ সালের পর গড়ে সাড়ে চার হাজারের দিকে যাচ্ছে। কেন?
শহীদুল হক: এই পরিসংখ্যানের ভিত্তি কী, আমি জানি না। তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৪ সাল থেকে ক্রমাগত অপরাধ কমেছে।
প্রথম আলো: তোফায়েল আহমেদ ও মির্জা ফখরুল ইসলামের নামে যথাক্রমে ৫৯টি ও ৮৬টি মামলা হয়েছিল। এটা কি ইঙ্গিতবহ যে মিথ্যা মামলা করার একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে?
শহীদুল হক: কিছু কালচার তো বাংলাদেশের আছে। তোফায়েল আহমেদের মতো ব্যক্তির নামে যদি এতগুলো মামলা নিয়ে থাকে, তিনি তো এত কিছু করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এটাই বাস্তবতা। এটা কমাতে হলে সবার চেষ্টা লাগবে। পুলিশ রাজনীতিসংশ্লিষ্টতার বাইরে, অপরাধ দমনে যা করে, তাতে হস্তক্ষেপ নেই, আর তার যতটা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট, তা দূর করতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে।
প্রথম আলো: আপনার অর্জন কী? বাহিনীর মূল চ্যালেঞ্জ কী?
শহীদুল হক: আমার বড় অর্জন জঙ্গি দমনে, বিদেশিরা চলে যাচ্ছিল, জঙ্গি আতঙ্ক দূর করে বাংলাদেশকে একটি মোটামুটি নিরাপদ দেশে পরিণত করতে ভূমিকা রেখেছি। ক্রমাগতভাবে বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া তার সাক্ষ্য দেবে। ২২টি দেশের পুলিশপ্রধানরা এলেন। আমরা প্রতিটি মামলা চিহ্নিত করে ব্লগার ও মুক্তমনাদের হত্যা বন্ধ করেছি। আরেকটি হলো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কমিউনিটিভিত্তিক অর্থাৎ গণমুখী পুলিশিং চালু করা। দেশি-বিদেশি সবাই বলে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। জঙ্গিবাদ দমনে ইন্টারপোল বিশেষজ্ঞরা আমার বক্তব্য জেনেছেন। ৯৯৯ যে বাংলাদেশে চালু করা যায়, তা অনেকে ভাবতেই পারেননি, এটা যুগান্তকারী। মূল চ্যালেঞ্জ বলতে পুলিশের মনোবল টিকিয়ে রাখা ও পুলিশের সামর্থ্য বৃদ্ধি। পরিবহন ও লোকবল বাড়ানো। তিন শতাংশের কম পুলিশ আবাসন সুবিধা পায়, এ সমস্যা দূর করতে হবে। ডিজিটাল সরঞ্জাম যা দরকার, তা সেভাবে আমাদের নেই। পুলিশকেও তার মাইন্ডসেট, আচার-আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। জনগণের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে, তাহলে কোনো চ্যালেঞ্জই আর চ্যালেঞ্জ থাকবে না।
প্রথম আলো: গুলশানের হোলি আর্টিজানের ঘটনার অপ্রকাশিত কোনো দিক? ফারাজের আত্মত্যাগকে পুলিশ কীভাবে দেখেছে?
শহীদুল হক: এর সবকিছুই প্রকাশ পেয়েছে। সব আসামি ধরা পড়েছে। এর অভিযোগপত্র ফেব্রুয়ারির মধ্যেই হবে। ফারাজ সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। বন্ধুকে ছাড়া তিনি যাবেন না, এই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। অত বড় বিপদের মধ্যেও তিনি যে মহত্তম ভূমিকা রেখেছেন, সেটা তো সবাই নিতে পারেন না।
প্রথম আলো: বেগম খালেদা জিয়াকে লক্ষ করে আপনি বলেছিলেন, জঙ্গিবাদের জন্য একটি দল দায়ী। বলেছিলেন, রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীল হওয়া উচিত, আপনার সমালোচনা হলো, রাজনীতিকরা অসত্য মন্তব্য করলেও সে বিষয়ে বলা পুলিশপ্রধানের কাজ নয়, এটা আপনার পদমর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
শহীদুল হক: জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গি দমন করেছে পুলিশ। তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুললে, অহেতুক তার কর্মকাণ্ড বিতর্কিত করলে তার উত্তর দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি সেটাই করেছিলাম। আমি বেগম জিয়ার কোনো রাজনৈতিক মন্তব্যের উত্তর দিইনি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
শহীদুল হক: ধন্যবাদ।
শহীদুল হক: সেটি কার্যকর হওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাইয়ে কমিটি করেছিল, তার রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। হ্যাঁ, সেটা বাস্তবায়িত হলে একটা পর্যায়ে আসবে। দলনিরপেক্ষভাবে কাজ করতে ব্যক্তি অফিসারের মানসিকতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমার চাকরিজীবনে দলীয় প্রভাবে বেআইনি কিছু করাতে পারেনি। বিএনপি আমলে সিরাজগঞ্জে এসপি ছিলাম। রাঁধুনীবাড়ি ক্যাম্পে পুলিশের চার সদস্যকে হত্যা করে ক্যাম্প লুট হলো। ওই মামলায় একটি রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতাকে জড়াতে চাপ দিলে আমি তা অগ্রাহ্য করেছিলাম। এটা বিবেকের বিষয়, কারও তা করা উচিত নয়।
প্রথম আলো: আপনি বলেছিলেন কারা পেট্রলবোমা মেরেছে, তা সূর্যের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু আমরা তো অমাবস্যায় আছি।
শহীদুল হক: একটি দলের আন্দোলনের অংশ হিসেবে এটা ঘটেছিল, তাদের নেতা-কর্মীরাই করেছে। বস্তুনিষ্ঠ সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তদন্তেও তা প্রমাণিত।
প্রথম আলো: আপনার এই মৌখিক উক্তির বাইরে বিষয়টির বিচারিক প্রক্রিয়া কী বলে?
শহীদুল হক: বোমাসহ কেউ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হলেই তো চিহ্নিত হয়ে যায়, অধিকাংশই মামলাতেই অভিযোগপত্র হয়ে গেছে। কোনো বিচার শেষ বা রায় হয়েছে কি না, সে তথ্য এখন নেই, জানতে হবে।
প্রথম আলো: জামায়াতের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের ৩০ জন সদস্যকে হত্যার দায়ে কারও দণ্ড হয়েছে কি?
শহীদুল হক: সবটাতেই অভিযোগপত্র দিয়েছি, কোনোটিতেই বিচারকার্য শেষ হয়নি।
প্রথম আলো: ৩২ বছরের চাকরিজীবনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশের যে অপব্যবহার, আপনি এখন কীভাবে দেখেন?
শহীদুল হক: অভিযোগ পুরোনো। অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানিতে ব্যবহার করা উচিত নয়। আমরা সরকারি দল, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী-সবার কাছ থেকেই তদবির পাই, আইনি প্রক্রিয়ায় তার সুরাহা করি, বাইরে সম্ভব নয়, কর্তৃপক্ষকেও আদালতে জবাবদিহি করতে হয়।
প্রথম আলো: এখন আর দলীয় বিবেচনায় পুলিশ নিয়োগ হয় না, নাকি আরও অবনতি ঘটেছে? জনসংখ্যা ও লোকবলের আনুপাতিক হার সন্তোষজনক?
শহীদুল হক: আমরা কনস্টেবল নিয়োগ দিই। ২০০৯ সালে ১ হাজার ১০০ জনে ১ জন ছিল, সেটা কমিয়ে ৮৫০ জনে ১ জন করা হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ৪০০ জনে ১ জন থাকবে। একটা বড় অংশ প্রটোকলে থাকে, তাতে থানার কাজ ব্যাহত হয়, তাই আমরা গার্ড অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রস্তাব করেছি। আর প্রভাবশালীরা তাঁদের গ্রুপের লোক ঢোকাতে চাইবেন। আমি আইজিপি হওয়ার পর নিশ্চিত করি যে লিখিত পরীক্ষায় পাস না করলে কোনো তদবির আমার কাছে আসবে না। ভাইভায় অনেকে তদবির করতে পারে। বন্ধুবান্ধব, আপনাদের সাংবাদিকেরা অনেক সময় তদবির করেন। রিটেনে ভালো করলে হয়তো ভাইভায় একটু কমবেশি দেওয়া হয়, এর চেয়ে বেশি কিছু করিনি।
প্রথম আলো: নিয়োগ কীভাবে আরও স্বচ্ছ করা যায়?
শহীদুল হক: শতভাগ স্বচ্ছতায় পুলিশ সার্জেন্ট ও এসআই নিয়োগ হেডকোয়ার্টার করে, কারও কোনো অভিযোগ নেই। গত তিন বছরে আমি প্রায় তিন হাজার নিয়েছি।
প্রথম আলো: চাকরি পেতে কারও ঘুষ দিতে হয়নি?
শহীদুল হক: না, হয়নি।
প্রথম আলো: আপনার অজ্ঞাতসারে টাকাপয়সার লেনদেন হতে পারে।
শহীদুল হক: আমার অজ্ঞাতসারে বলতে পারব না। কিন্তু এ রকম কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। শুধু কনস্টেবল নিয়ে অভিযোগ আসছে, যা জেলা এসপিরা করে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, রিটেনে শতভাগ স্বচ্ছ হতে হবে, রিটেনে পাস করতে হবে। স্থানীয় নিয়োগ বোর্ডের ডিসক্রিশন থাকে, কিন্তু ভাইভায় তেমন মার্কও থাকে না। আর সরকার রাজি হলে হেডকোয়ার্টারের সরাসরি তদারকিতে নিয়োগ হতে পারে, কিন্তু দুই শ বছর ধরে স্থানীয় এসপি যেটা করছেন, সেটা খর্ব হলে তাঁরা আহত বোধ করতে পারেন।
প্রথম আলো: সাধারণ মানুষ প্রথমেই থানায় যান, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু আচরণের অভিযোগ আছে।
শহীদুল হক: এটা আছে, এর অপনোদনে তাদের প্রশিক্ষণ ও মাইন্ডসেট পরিবর্তনে আমরা বহুমুখী চেষ্টা করেছি। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থায় কিন্তু জনগণের কাছে একটা জবাবদিহি থাকছে।
প্রথম আলো: দুই ইতালীয়কে হত্যার পর ঘটনা ঘটতেই থাকল, এখন বন্ধ, এর মানে জঙ্গিবাদ কার্যকরভাবে দমন হয়েছে? আমরা আইএসের হুমকিমুক্ত?
শহীদুল হক: এটা বৈশ্বিক সমস্যা। আল-কায়েদার পর আইএস এসেছে, যে সমস্যা আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকে বেশি হয়েছে। ওরা ওদের মতাদর্শ ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে, সেটা দেখে তরুণেরা স্বপ্রণোদিত হয়েছে। ৯০ ভাগ মুসলিম দেশের কিছু তরুণ ইন্টারনেটে ওসব পড়ে প্রণোদিত হয়েছে। ৬৩ জেলায় বোমাবাজি করা জেএমবির বিচারের ফলে তারা অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, পরে তারা ইন্টারনেটে পুনরায় উদ্দীপ্ত হয় এবং অনুসারী বাড়িয়ে সংগঠিত হয়ে অপারেশন শুরু করেছিল। তারা অনেকগুলো সুইসাইড স্কোয়াড করেছিল। হোলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার পর পুলিশ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের মানুষও রাস্তায় নেমেছিলেন। গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে আমরা ওদের নেটওয়ার্ক ও আস্তানা চিহ্নিত এবং তাতে প্রায় ৪০টি অভিযান চালাই। তারা এখন অবশ্যই দুর্বল হয়ে গেছে। আইএস সরাসরি কোনো লিংক স্থাপন করতে পারেনি, তাদের কোনো নেতা এখানে কারও সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করেছে, তার প্রমাণ এখনো পাইনি।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে ইন্টারপোল বা বিদেশি রাষ্ট্রের কোনো অনুরোধে কিছু তদন্ত করছেন?
শহীদুল হক: না। জঙ্গি বিষয়ে কোনো দেশ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু পাইনি।
প্রথম আলো: পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারসসহ আমরা বিদেশে টাকা পাচারের কিছু অভিযোগ শুনি। কোনো তদন্ত চলমান?
শহীদুল হক: না। কেউ এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য চায়নি।
প্রথম আলো: দেশে গুম কারা করছে?
শহীদুল হক: গুম বলে তো আইনে কিছু নেই, এটা অপহরণ।
প্রথম আলো: রাষ্ট্র যেখানে পদ্ধতিগতভাবে মানুষ নিধন করে, সেটা আন্তর্জাতিক আইনে গুম বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স। আপনার তিন বছরে শতাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম হয়েছে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও কি আপনি পুলিশের জড়িত থাকা তদন্ত করেছেন? এনকাউন্টারের পর প্রেস রিলিজ পেতাম, তা বন্ধ করলেন কেন?
শহীদুল হক: কিছু ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ঘটেছে। কাউকে জোর করে নিলে পুলিশের দায়িত্ব আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলি না, এনকাউন্টার হয়। না, আমরা পুলিশ জড়িত থাকাসংক্রান্ত কোনো তদন্ত করিনি। প্রতিটি এনকাউন্টার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন, এতে কাউকে দায়ী করা হয়নি। আর প্রেস রিলিজ পুলিশের দেওয়ার কথা, অনেক সময় দেওয়া হয় না। যারা মারা যায়, তারা বেশির ভাগ সন্ত্রাসী, খারাপ লোক।
প্রথম আলো: আপনার মন্তব্য সংবিধানবিরোধী। কারণ, খুনিরও মানবাধিকার আছে। আর এমন যুক্তি দিয়েই অপারেশন ক্লিন হার্ট শুরু করেছিল বিএনপি। বিচার বিভাগে প্রতিকার নেই, তাই এভাবে রাষ্ট্র নিষ্ফল প্রতিকার খুঁজছে।
শহীদুল হক: না, পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি এটা বলতে পারি না। এটা মানুষের ধারণা, সেটাই বলেছি মাত্র। এরা দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল, বারবার তারা গ্রেপ্তার হয়েছে। বিচার হচ্ছে না। জেলে রাখা যাচ্ছে না। কাজেই এগুলো সমাজ ও মানুষের জন্য হুমকি। একসময় চুয়াত্তরের স্পেশাল অ্যাক্টে এ ধরনের লোকদের আমরা ডিটেনশন দিতাম। কিন্তু বিভিন্ন সময় হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে অনেকে ডিটেনশন দিতে ভয় পান। এল ক্লিন হার্ট, এরপর পাবলিক ক্রসফায়ার আবিষ্কার করল। দুর্ধর্ষ অপরাধীরা পুলিশকে পরোয়া করে না, তখন পুলিশ বাধ্য হয়ে এগুলো করে।
প্রথম আলো: ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা কতটা কার্যকর?
শহীদুল হক: তিন বছরে অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে, অনেকে জামিনে বেরিয়ে গেছে, এটা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক।
প্রথম আলো: ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির দায়ে আপনি গত তিন বছরে কতজন বড় অফিসারকে চাকরিচ্যুত করেছেন, সংখ্যায় তাঁরা কত?
শহীদুল হক: (হেসে) আমরা জিরো টলারেন্স রাখি।
প্রথম আলো: জিরো টলারেন্সের নমুনা দেখান। পুলিশের ভালো কাজ আছে, আবার ব্যাপক অভিযোগ আছে, তারা মাদক ব্যবসাসহ বিরাট অপরাধের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুষ ছাড়া পুলিশি সেবা মেলে না।
শহীদুল হক: ঢালাও অভিযোগের বাইরে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ আছে, তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে শাস্তি হয়। ফৌজদারি অপরাধে জড়ালে কোনো খাতির করি না। নিয়মিত মামলা হয়। এসব পত্রিকায় যতটা ব্যাপক, বাস্তবে ততটা নয়।
প্রথম আলো: তিন বছরে একটি দৃষ্টান্ত দিন, যা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব বিচলিত করেছে।
শহীদুল হক: কক্সবাজার থেকে ফিরছিলাম। একজন সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে সাত লাখ ইয়াবা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পুলিশের জন্য এটা লজ্জার।
প্রথম আলো: আপনার চাকরিজীবনের ৩২ বছরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত?
শহীদুল হক: ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামে অতিরিক্ত এসপি হিসেবে ২২টি পরোয়ানা জারি থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীপ্রধান শিবির ক্যাডার নাছিরের আস্তানায় সফল অভিযান চালাই, পরে তাকে গ্রেপ্তার করি। ওই বছরই হাটহাজারীতে সাড়ে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়ি থেকে অস্ত্রসহ এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করি, ছোট এক অফিসার হয়ে তাঁকে এভাবে আটকে রাখা অকল্পনীয় ছিল।
প্রথম আলো: এবার একটু তুলনামূলক মন্তব্য করুন। আপনি ১৯৮৬ সালের পরের সব ঘটনারই সাক্ষী।’ ৯৩-এ বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, আর তার ক্ষমতাবান মিত্র সাকা চৌধুরী। এই ২০১৮ সালের বাংলাদেশে কোনো অতিরিক্ত অফিসারের পক্ষে এমন অভিযান চালানোর বাস্তবতা আছে? ছাত্রলীগের জেলা নেতা ধরতেও পুলিশ দ্বিধান্বিত।
শহীদুল হক: বাস্তবতা অবশ্যই আছে। দ্বিধান্বিত যেটা বলছেন, সেটা কোনো ব্যক্তি কর্মকর্তার সীমাবদ্ধতা হতে পারে। সার্বিকভাবে আইনপ্রয়োগে দলনির্বিশেষে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। সাকা চৌধুরীর মতো সন্ত্রাসী গডফাদার আওয়ামী লীগে নেই। তা ছাড়া চট্টগ্রাম বিএনপির কেউ তাঁকে পছন্দ করতেন না। আর অতীতে, ইমদুর সঙ্গে সরকারপ্রধানের ছবি, কালীগঞ্জের ঘটনা দেখেছি। এরশাদের আমলের ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার ছিল না, তখন ছিল প্রশাসন ঠিক তো ক্ষমতা ঠিক।
প্রথম আলো: পুলিশের বদলি ও পদোন্নতিতে বিএনপিপন্থী, আওয়ামী লীগপন্থী, এসব কেমন চলছে? আপনি বিএনপি আমলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন?
শহীদুল হক: আমার বহু কাজের স্বীকৃতি দিতে বিভাগীয় প্রস্তাব ছিল, আমাকে আওয়ামী ঘরানার বিবেচনায় বিএনপি সেসব নাকচ করেছে। দলীয় ভালো লোক, পরিচয়নির্বিশেষে তাদের নিয়ে আমরা কমিউনিটি পুলিশিং চালু করেছি।
প্রথম আলো: সরকার চায়নি, কিন্তু পুলিশপ্রধান হিসেবে আপনার স্বাধীন সিদ্ধান্তে বিএনপিকে সভা করতে দেওয়ার একটি নজিরও আছে কি?
শহীদুল হক: সরকার চায়নি, এ রকম কম হয়েছে। জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও জনদুর্ভোগ দেখতে হয়।
প্রথম আলো: জনমনে ধারণা হলো আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা চাইলেই সভা করতে পারে, গত ৫ জানুয়ারিতে এক অখ্যাত সংগঠনের করা দরখাস্তের যুক্তি দেবেন, কিন্তু মানুষ এসব বোঝে না? আপনাদের প্রতি এতে জন-আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?
শহীদুল হক: যাঁরা আগে আসবেন, তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। এখানে জনগণ ভুল বুঝলে আমাদের কিছু করার নেই।
প্রথম আলো: ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, এর আগের নয় মাসেই পুলিশি হেফাজতে অন্তত ১৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। খালেদা জিয়া এক টুইটে প্রায় সাড়ে সাত শ কর্মী গুমের অভিযোগ করেছেন, এর সত্যতা চ্যালেঞ্জ করবেন না?
শহীদুল হক: পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে গত তিন বছরে কোনো নির্যাতন বা হত্যা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আগে যেটা থার্ড ডিগ্রি হতো বলে কথা ছিল, সেটা আমরা করি না। এখন ডিজিটালসহ নানা কৌশল আছে। কাউকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই না। চেষ্টা করব তথ্যটা তাদের (বিএনপি) কাছ থেকে আনতে। প্রতিটি অভিযোগই আমরা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
প্রথম আলো: আপনাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, খুন বছরে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার ছিল, যা ২০১৩ সালের পর গড়ে সাড়ে চার হাজারের দিকে যাচ্ছে। কেন?
শহীদুল হক: এই পরিসংখ্যানের ভিত্তি কী, আমি জানি না। তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৪ সাল থেকে ক্রমাগত অপরাধ কমেছে।
প্রথম আলো: তোফায়েল আহমেদ ও মির্জা ফখরুল ইসলামের নামে যথাক্রমে ৫৯টি ও ৮৬টি মামলা হয়েছিল। এটা কি ইঙ্গিতবহ যে মিথ্যা মামলা করার একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে?
শহীদুল হক: কিছু কালচার তো বাংলাদেশের আছে। তোফায়েল আহমেদের মতো ব্যক্তির নামে যদি এতগুলো মামলা নিয়ে থাকে, তিনি তো এত কিছু করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এটাই বাস্তবতা। এটা কমাতে হলে সবার চেষ্টা লাগবে। পুলিশ রাজনীতিসংশ্লিষ্টতার বাইরে, অপরাধ দমনে যা করে, তাতে হস্তক্ষেপ নেই, আর তার যতটা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট, তা দূর করতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে।
প্রথম আলো: আপনার অর্জন কী? বাহিনীর মূল চ্যালেঞ্জ কী?
শহীদুল হক: আমার বড় অর্জন জঙ্গি দমনে, বিদেশিরা চলে যাচ্ছিল, জঙ্গি আতঙ্ক দূর করে বাংলাদেশকে একটি মোটামুটি নিরাপদ দেশে পরিণত করতে ভূমিকা রেখেছি। ক্রমাগতভাবে বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া তার সাক্ষ্য দেবে। ২২টি দেশের পুলিশপ্রধানরা এলেন। আমরা প্রতিটি মামলা চিহ্নিত করে ব্লগার ও মুক্তমনাদের হত্যা বন্ধ করেছি। আরেকটি হলো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কমিউনিটিভিত্তিক অর্থাৎ গণমুখী পুলিশিং চালু করা। দেশি-বিদেশি সবাই বলে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। জঙ্গিবাদ দমনে ইন্টারপোল বিশেষজ্ঞরা আমার বক্তব্য জেনেছেন। ৯৯৯ যে বাংলাদেশে চালু করা যায়, তা অনেকে ভাবতেই পারেননি, এটা যুগান্তকারী। মূল চ্যালেঞ্জ বলতে পুলিশের মনোবল টিকিয়ে রাখা ও পুলিশের সামর্থ্য বৃদ্ধি। পরিবহন ও লোকবল বাড়ানো। তিন শতাংশের কম পুলিশ আবাসন সুবিধা পায়, এ সমস্যা দূর করতে হবে। ডিজিটাল সরঞ্জাম যা দরকার, তা সেভাবে আমাদের নেই। পুলিশকেও তার মাইন্ডসেট, আচার-আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। জনগণের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে, তাহলে কোনো চ্যালেঞ্জই আর চ্যালেঞ্জ থাকবে না।
প্রথম আলো: গুলশানের হোলি আর্টিজানের ঘটনার অপ্রকাশিত কোনো দিক? ফারাজের আত্মত্যাগকে পুলিশ কীভাবে দেখেছে?
শহীদুল হক: এর সবকিছুই প্রকাশ পেয়েছে। সব আসামি ধরা পড়েছে। এর অভিযোগপত্র ফেব্রুয়ারির মধ্যেই হবে। ফারাজ সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। বন্ধুকে ছাড়া তিনি যাবেন না, এই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। অত বড় বিপদের মধ্যেও তিনি যে মহত্তম ভূমিকা রেখেছেন, সেটা তো সবাই নিতে পারেন না।
প্রথম আলো: বেগম খালেদা জিয়াকে লক্ষ করে আপনি বলেছিলেন, জঙ্গিবাদের জন্য একটি দল দায়ী। বলেছিলেন, রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীল হওয়া উচিত, আপনার সমালোচনা হলো, রাজনীতিকরা অসত্য মন্তব্য করলেও সে বিষয়ে বলা পুলিশপ্রধানের কাজ নয়, এটা আপনার পদমর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
শহীদুল হক: জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গি দমন করেছে পুলিশ। তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুললে, অহেতুক তার কর্মকাণ্ড বিতর্কিত করলে তার উত্তর দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি সেটাই করেছিলাম। আমি বেগম জিয়ার কোনো রাজনৈতিক মন্তব্যের উত্তর দিইনি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
শহীদুল হক: ধন্যবাদ।
No comments