পানি, ট্যানারি এবং সুপ্রিম কোর্টে বিরল ঘটনা
আজকের কলামটির বিন্যাস অতীতের কলামগুলোর তুলনায় একটু ভিন্ন প্রকৃতির। একাধিক বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। আলোচনাটা এমনভাবে করতে চাই যেন পাঠকের বুঝতে কোনো কষ্ট না হয়। নতুন খনন করা পুকুরে পানি জমতে যেমন সময় লাগে, একটু একটু করে জমতে জমতে পানির স্তর ওপরে ওঠে, ওই রকমই নদীর মাঝখানে একটি চর জাগতেও অনেক বছর সময় লাগে, অর্থাৎ একটু একটু করে পলিমাটি জমতে জমতে অনেক বছরে একটি চর জেগে উঠে। ভূগোলের এ ঘটনা বা প্রকৃতির এ বৈশিষ্ট্য থেকেই এসেছে কবির সেই অমোঘ বাক্য: ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকনা বিন্দু বিন্দু জল; গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল।’ কবিতার এই লাইনগুলোর সঙ্গে এই কলামের পাঠকদের বেশির ভাগেরই পরিচয় আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। অতএব, একটু একটু করে আলোচনা যদি অনেক দিন ধরে করা হয়, তাহলে এটি পাঠকের চিন্তার জগতে একটু একটু করে ভিত্তি পায়।
পানি নিয়ে আলোচনা: কিন্তু কেন?
প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে দিনাজপুর গিয়েছিলাম, স্থানীয় জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সম্মেলন উপলক্ষে। সেই সময় পুরনো বিষয় নতুন করে উপলব্ধি করলাম। ঢাকার কাছে সাভারে প্রায়ই যাই। যাওয়ার পথে ছোট ছোট নদীর ওপর দিয়ে যে ব্রিজগুলো, সেগুলো পার হতে হয়। নদীগুলোর ১২ মাসে যে চারটি রূপ হয় সেটি বহু বছর ধরেই আমার মনে দাগ কাটে। সাত-আট দিন আগে সড়ক পথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিলাম। কুমিল্লা এবং ঢাকার মাঝখানে তিনটি বড় ব্রিজ আছে, যথা দাউদকান্দি ব্রিজ, মেঘনা ব্রিজ এবং কাঁচপুর ব্রিজ। দাউদকান্দি ব্রিজ পার হওয়ার সময় আমার গাড়ির (দীর্ঘ দিনের পুরনো) ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, আসল নদী কোনটা চেনা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে; আপনি যেহেতু যাতায়াত করতে করতে পরিচিত, আপনি চিনবেন কোনটা নদীর মূল স্রোত। ঢাকা কুমিল্লা ইত্যাদি অঞ্চল, বাংলাদেশের পূর্ব অংশে পড়ে। কিন্তু আমি বাংলাদেশের অন্য অংশের নদী নিয়ে আলোচনা করব; যদিও ক্ষুদ্র পরিসরে।
ভারত-বাংলাদেশ ও নদীর পানি বণ্টন
বাংলাদেশের সুবৃহৎ প্রতিবেশীর বদৌলতে বাংলাদেশের নদী-নালাগুলো শুকিয়ে মৃতপ্রায়। বাংলাদেশকে যদি চারটি ভৌগোলিক ভাগে ভাগ করি, তাহলে একটি অংশ হতে পারে উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশ তথা উত্তরবঙ্গ; যার পরিচয় নিম্নরূপ: সাধারণভাবে পদ্মা নদীর উত্তরে এবং যমুনা নদীর পশ্চিমে ও ভারত সীমান্ত দিয়ে বেষ্টিত; অর্থাৎ বর্তমানের রংপুর বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগ। পদ্মা নদীর দক্ষিণে এবং যমুনার পশ্চিমে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশ বলা যেতে পারে; অর্থাৎ খুলনা বিভাগ। যমুনা নদীর পূর্ব দিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সিলেট ঢাকা কুমিল্লা ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্ব অংশ; অর্থাৎ ঢাকা বিভাগের উত্তর অংশ, নতুন ঘোষিত ময়মনসিংহ বিভাগ, সিলেট বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর অংশ তথা কুমিল্লা ও নোয়াখালী। দক্ষিণ বাংলা বা দক্ষিণ বঙ্গ বলতে বোঝায় ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর জেলা এবং পুরো বরিশাল বিভাগ। অনেকে খুলনাকেও দক্ষিণ বঙ্গ হিসেবে গণ্য করে; আবার অনেকে ফরিদপুরকে দক্ষিণবঙ্গের অংশ হিসেবে মানতে চান না। এটা বড় কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। বাংলাদেশের উত্তর অংশে বা দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে, অর্থাৎ রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে, রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে, এবং খুলনা বিভাগের উত্তর অংশে বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও বৃহত্তর যশোর জেলায়, বাংলাদেশের অন্য অংশগুলোর তুলনায় নদীনালা কম এবং যা-ও আছে সেগুলো শুকিয়ে যায় দ্রুত। এর কারণ হচ্ছে, এই অঞ্চলগুলোর নদীগুলোর উজানের অংশ ভারতের মাটিতে। আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী কর্তৃক পদ্মার উজানে ফারাক্কার বাঁধ নির্মাণ এবং তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি নিয়ন্ত্রণ করায়, আমাদের নদীগুলোতে, শুকনা মৌসুমে যথেষ্ট পানি আসে না কিন্তু, বর্ষা মৌসুমে অঢেল পানি এসে বন্যা ঘটায়। ভারত পানির সরবরাহ বা গতি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রবাহ ভারতের শুভেচ্ছা বা আন্তরিকতার ওপর নির্ভরশীল। অপর পক্ষে বাংলাদেশের কৃষি এবং গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা আমাদের নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল। আমার আলোচনার উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুধু ভারতকে দোষারোপ ও কটাক্ষ করা নয়; বরং আমার উদ্দেশ্য হলো, আমাদেরকে বিষয়টি সমাধানের জন্য আরো যে সচেষ্ট হতে হবে, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নদীর উভয় তীরে জবরদখল ব্যাপক হয়েছে। ফলে বর্ষাকালে পানির স্রোত বাধা পায়।
পানি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক
দুইটি রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বের অন্যতম শর্তই হলো, এই বন্ধুত্ব উভয় পক্ষের জন্য উপকারী হতে হবে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যত প্রকারের বিষয় জড়িত, সবগুলো বিষয়েই যে উভয় রাষ্ট্রের স্বার্থ সমানভাবে রক্ষিত হবে-এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। অর্থাৎ একটি বিষয়ে একটি রাষ্ট্র বেশি ত্যাগ স্বীকার করবে এবং অপর একটি বিষয়ে অন্য রাষ্ট্র বেশি ত্যাগ স্বীকার করবে। ইংরেজি পরিভাষায় বলতে পারি, গিভ অ্যান্ড টেক। কিন্তু বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্কের মধ্যে পানি বণ্টনের বিষয়টি যেন একটি গলার কাঁটা। এখানে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ থিওরি কাজ করে না। তবে একটি চিন্তার খোরাক উপস্থাপন করে রাখি। আগামী সম্ভাব্য পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হওয়া খুবই সম্ভাবনাময়। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকারকে, আগামী নির্বাচনে সুবিধা দেয়ার জন্য এই কাজটি করতে পারে। অর্থাৎ তখন বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বলবে, আমরাই পারি সমস্যার সমাধান করতে; আমরাই পারি আমাদের অধিকার আদায় করতে। নিবেদন করে রাখছি যে, তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের জন্য ভারত বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া মানেই, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ভিন্ন নদীগুলোর পানি সমস্যার সমাধান নয়। কিন্তু টেলিভিশন প্রচারণার সুযোগ নিয়ে, মিষ্টি মিষ্টি ভাষণ ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষের ভাবনা ও চিন্তাকে আবেগাপ্লুত করে রাখার সম্ভাবনা প্রচুর। বৃষ্টির পানি যখন মাটিতে পড়ে, সেই পানি খাল, বিল, নদী দিয়ে বয়ে যায়; পানি একটু একটু করে চুইয়ে পৃথিবীর ভেতরে প্রবেশ করে। হাজার-কোটি বছর ধরে এরূপ হতে হতে এবং পৃথিবীর জন্মলগ্নের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় যেরূপ হয়েছিল সেই মতে, ভূগর্ভে পানির আধার আছে; যার কারণে আমরা চাষাবাদ এবং অন্যান্য প্রয়োজনে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বত্র, বিশেষত উত্তর-পশ্চিম অংশে তথা উত্তরবঙ্গে, এবং দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অতি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। কারণ, সেচের জন্য ও অন্যান্য কারণে আমরা যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করি, তত পানি ভেতরে প্রবেশ করছে না। কারণ মাটির ওপরের অংশে তথা নদী-নালা-খালে-বিলে-পুকুরে পানি থাকছে না। দীর্ঘ মেয়াদে এটা আমাদের জন্য মারণফাঁদ। বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ বা মধ্যম পশ্চিম অংশে মরুকরণের লক্ষণ ব্যাপক। এর জন্য দায়ী, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। সম্মানিত পাঠক সম্প্রদায়ের মধ্যে এ প্রসঙ্গে সচেতনতা যেন বজায় থাকে, সেই আবেদন করছি।
পলিউশন তথা ট্যানারি দূষণ
পুরনো ঢাকার নাগরিকদের জন্য একটি বড় ধরনের সঙ্কট হিসেবে পরিচিত ছিল হাজারীবাগের ট্যানারি। ট্যানারি মানে চামড়া শিল্প। ট্যানারি এবং তার থেকে উদ্ভূত বিশেষ দুর্গন্ধের সাথে আমি ছোটকাল থেকে পরিচিত। কারণ, গ্রামের বাড়ি থেকে আমরা চট্টগ্রাম শহরে আসার জন্য যে মহাসড়ক ব্যবহার করতাম এবং এখনো করি, সেটার নাম কাপ্তাই-চট্টগ্রাম মহাসড়ক; সাধারণ ভাষায় কাপ্তাই রোড। কাপ্তাই থেকে শুরু হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের মোহরা অংশে এসে রাস্তাটি কালুরঘাট রোডের সাথে মিলিত হয়। স্থানীয় মানুষের কাছে এ মিলন স্থানটির নাম কাপ্তাই-রাস্তার মাথা। এখানে একটি বড় ট্যানারি ছিল দীর্ঘ দিন ধরে। ছোটকালে এই ট্যানারির বদৌলতে, চামড়া শিল্পের এবং চামড়ার দুর্গন্ধের সাথে পরিচয়। ঢাকা মহানগরে থাকি অনেক দিন এবং হাজারীবাগের সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের। হাজারীবাগ বলি বা অন্য জায়গার কথা বলি, বাংলাদেশে ট্যানারি ছিল এবং থাকবে। চামড়া শিল্প থাকতেই হবে। চামড়া শিল্প বাংলাদেশের রফতানি আয়ের অন্যতম বড় মাধ্যম। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও চামড়া শিল্প আছে। কোনো কোনো বছর আমাদের দেশ থেকে কাঁচা চামড়া বেশি চোরাচালান হয়ে ভারতে ঢোকে, কোনো বছর কম ঢোকে। চামড়া চোরাচালান কেন কম বা বেশি হয় ওই প্রসঙ্গে এখানে আলোচনায় যাবো না। ট্যানারির দুর্গন্ধের প্রভাব থেকে এবং এই শিল্প থেকে বের হওয়া দূষিত তরল পদার্থের প্রভাব থেকে, মানুষের জীবনকে বাঁচানোই হলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা মহানগরের হাজারীবাগে যখন ট্যানারি শিল্প ছিল, তখন সে এলাকায় প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছিল এবং ট্যানারি থেকে দূষিত তরল পদার্থ বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ত। এর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে, টেলিভিশন টকশোতে বলাবলি হয়েছে, পার্লামেন্টে আলোচনা হয়েছে। একপর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি পল্লীকে সরিয়ে ফেলা হবে। অনেক জরিপ করার পর, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার তেঁতুলঝোরা ইউনিয়নে, নতুন জায়গা নির্ধারণ করা হয়। প্রাইভেট সেক্টরের বিভিন্ন অসুবিধা ছিল, ঢাকা মহানগর থকে সরে যাওয়ায় অনীহা ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং ও তদারকি কম ছিল। ফলে সাভার ট্যানারি পল্লীতে, অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং শিল্পগুলো স্থানান্তর করায় বহুদিন বিলম্ব ঘটে। ২০১৬ সালের শেষের দিক এবং ২০১৭ সালের শুরুর দিক থেকে বর্তমান রাজনৈতিক সরকার এ বিষয়ে কঠোরভাবে মনোযোগী হয়। সরকার ট্যানারি শিল্প মালিকদের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করে যাতে তারা দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তর করে। শিল্প মালিকরাও হঠাৎ চাপ প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে কী করবেন এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। একপর্যায়ে হাইকোর্টে মামলা হয়। হাইকোর্টের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত রায় বের হয় এ মর্মে যে, একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে অবশ্যই যেন হাজারীবাগ থেকে সব চামড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়। সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে, হাজারীবাগের শিল্পগুলোতে বিদ্যুৎ ও পানি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। যতটুকু জানি, সাভারে যাওয়ায় বিলম্ব যে ঘটেছে তার অন্যতম কারণ সেখানে সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যর্থতা বা বিলম্ব এবং ট্যানারি থেকে বের হবে এমন বর্জ্য পদার্থগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব। ট্যানারি মালিকদের দুঃখের কথা কেউ শুনেছেন কেউ শুনেননি। গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাভার ট্যানারি পল্লী এখন কর্মচঞ্চল। হাজার হাজার মানুষ সেখানে শ্রম দিচ্ছেন; শ্রমিকদের আবাসনের জন্য নানা প্রকারের অস্থায়ী-স্থায়ী ঘর-বাড়ি নির্মিত হচ্ছে। রিকশা, ভ্যানগাড়ি ও ছোট মালবাহী মোটরগাড়ি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। নতুন নতুন বিল্ডিং হয়েছে ট্যানারি শিল্পের। আশেপাশে জমির দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। সাথে একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, ট্যানারি শিল্পগুলো থেকে দূষিত তরল পদার্থ বের হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে যাচ্ছে। হাজারীবাগে দূষিত পদার্থ সংশোধনের ব্যবস্থা ছিল না; সাভারের তেঁতুলঝোরা ট্যানারি পল্লীতে দূষিত বর্জ্য সংশোধনের প্রকল্প এখনো অসম্পূর্ণ বা অপ্রতুল। কারিগরি বা ব্যবসায়িক ভাষায় এগুলোকে ‘এফফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ বলে। সাভারের ট্যানারি পল্লীর চতুর্দিকের গ্রামের মানুষগুলো এখন দূষণের প্রভাবে, চামড়া শিল্পের তরল ছাড়াও অন্যান্য বর্জ্যরে গন্ধে জর্জরিত। আমার প্রশ্ন বা আমার নিবেদন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এটুকু সমন্বয় করতে ব্যর্থ হলো কেন? হাইকোর্ট সরকারের জন্য কোনো ধরনের সতর্কবাণী তাদের গুরুত্বপূর্ণ রায়ে রেখেছিলেন কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। যে দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা নষ্ট হচ্ছিল, সেই দূষণের কারণে এখন ধলেশ্বরী নষ্ট হচ্ছে। চূড়ান্তপর্যায়ে ধলেশ্বরীর পানি বুড়িগঙ্গার সাথে এসে মিশে বুড়িগঙ্গার পানিতেই পড়ে; অর্থাৎ ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা যমজ বোনের মতো। যেকোনো সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারের কাজ কর্মে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত। এক্ষেত্রে প্রকট আরেকটি উদাহরণ হলো, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পেছনের কারণগুলো; সেখানেও সমন্বয়ের অভাবই প্রধানত দায়ী; তবে আজ এ নিয়ে আলোচনা করছিনা।
দু’টি সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে মিল বা অমিল
ব্রিটিশ আমলে একটি কথা প্রচলিত ছিল: যেটা বঙ্গ আজকে চিন্তা করে, সেটা অবশিষ্ট ভারতবর্ষ আগামীকাল চিন্তা করে। ইংরেজি পরিভাষায় কথাটা অনেকটা এরকম ছিল: হোয়াট বেঙ্গল থিংক্স টুডে, রেস্ট অব ইন্ডিয়া থিংকস টুমোরো। এই কথা মনে এসে গেল। কারণ, বাংলাদেশের বিচার বিভাগে গত তিন-চার মাসের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। পত্রপত্রিকায় যেরূপ সংবাদ বা সংবাদ ভাষ্য বা মূল্যায়ন উঠে এসেছে সেই মোতাবেক আমার বক্তব্য। প্রথম কাজটি বা ঘটনাটি সম্বন্ধে প্রায় সবাই অবহিত। তা হলো, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে ‘বিবিধ পরিস্থিতি’ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রথমে ছুটিতে যেতে এবং পরে অবসরে যেতে বাধ্য করা। এ রূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং তাঁকে বাধ্য করার কাজটি কে বা কারা করেছে এবং কেন করেছে তা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, প্রধান বিচারপতি কর্তৃক কথিত অথবা বাস্তব পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার আগের একটি ঘটনা। তা হলো এ রূপ: মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়েছিলেন আলোচনা বা মতবিনিময়ের জন্য বা অবহিতকরণের জন্য। বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বিচারপতিদের হাতে কিছু তথ্য ও প্রামান্য কাগজ তুলে দেন। প্রশ্ন: কিসের তথ্য ও কিসের কাগজ? উত্তর: বিচারপতি সিনহা দুর্নীতি করেছেন-এ রূপ অভিযোগের সপক্ষে তথ্য ও প্রামান্য কাগজ। প্রকাশিত খবর মোতাবেক বা খবরের মূল্যায়ন করে আমরা বুঝতে পারি, বিচারপতিরা ওইরূপ পরিস্থিতিতে কনভিন্সড বা আশ্বস্ত হয়েছেন যে, বিচারপতি সিনহা দুর্নীতি করেছেন। অতএব বিচারপতিরা সিদ্ধান্ত নেন, তারা সিনহার সাথে একসাথে বসে আর কোনো বিচারকার্য পরিচালনা করবেন না। এ সিদ্ধান্ত তারা মিডিয়াকে জানালেন। দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনরত অবস্থায় কোনো বিচারপতি কর্তৃক বা বিচারপতিদের মাধ্যমে মিডিয়াকে এরূপ প্রত্যক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত জানানোর উদাহরণ বা প্রিসিডেন্স দুষ্প্রাপ্য। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের গৃহীত পদক্ষেপটি ভালো না মন্দ, তা নিয়ে আলোচনা করছি না। আমার আলোচনার ফোকাস অন্যত্র; এখন সে বিষয়ে বলতে চাই। ১২-১৪ দিন আগে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র হিসেবে অধিকতর পুরনো ও অধিকতর ঐতিহ্যবাহী ভারতের রাজধানী দিল্লিতে, বাংলাদেশের মতো একটি ঘটনা ঘটেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পরবর্তী চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি একজোট বা একমত হন। ওই চারজন বিচারপতির মধ্যে চতুর্থজন আগামী অক্টোবরে নিজেই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেবেন। কারণ বর্তমান প্রধান বিচারপতি তখন অবসরে যাবেন। এই চারজন এমন একটি কাজ করেছেন যা ভারতের সচেতন বোদ্ধা মহলের কিছু অংশের নিকট অভিনন্দিত এবং কিছু অংশের নিকট অতি পরিত্যাজ্য। প্রশ্ন: কাজটি কী ছিল? উত্তর: এটি ছিল একটি সংবাদ সম্মেলন। ওই চারজন বিচারপতি, প্রেস কনফারেন্স ডাকেন এবং সাংবাদিকদের সামনে সুপ্রিম কোর্ট পরিচালনায় বিশেষত মামলা বণ্টনের কর্মে, প্রধান বিচারপতির কিছু নীতির সমালোচনা ও সংশোধন কামনা করেন। তারা জানান যে, তারা চেষ্টা করেছেন প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে আশ্বস্ত করতে যে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। ওই চারজনের মতে, যেহেতু প্রধান বিচারপতি তাদের আহ্বানে সাড়া দেননি, তাদের ইতিবাচক সমালোচনায় সাড়া দেননি, সেহেতু তারা বাধ্য হয়েছেন মিডিয়ার সামনে আসতে। মিডিয়ার মাধ্যমে তারা ভারতবাসীকে সচেতন করতে চাচ্ছেন, যদি ত্রুটিগুলো বা ভুলগুলো সংশোধন করা না হয়, তাহলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তথা ঊর্ধ্বতন বিচার ব্যবস্থা বিপদে পড়বে। খবরটি যখন পত্রিকায় পড়লাম, বিস্তারিত যখন ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনে পড়লাম, তখন মুচকি হাসলাম। মনে মনে বললাম, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দিল্লিকে অনুসরণ করি; এই একটা বিষয়ে মনে হয়, দিল্লি আমাদের অনুসরণ করল। এখন সিরিয়াস প্রশ্ন হলো, বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন অংশ এবং মিডিয়ার মধ্যে সম্পর্ক কী হতে পারে? সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য কি শুধু প্রদান করা হবে, নাকি বক্তব্য আদান-প্রদান হবে? প্রিসিডেন্সবিহীন বা ‘রেয়ার’ ঘটনা ঢাকা ও দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে যেমন ঘটেছে, তেমন কোনো কিছু অন্য কোথাও যেন না ঘটে এটাই কামনা। অর্থাৎ স্বাভাবিকতা, ধারাবাহিকতা ও যৌক্তিকতা কাম্য।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
পানি নিয়ে আলোচনা: কিন্তু কেন?
প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে দিনাজপুর গিয়েছিলাম, স্থানীয় জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সম্মেলন উপলক্ষে। সেই সময় পুরনো বিষয় নতুন করে উপলব্ধি করলাম। ঢাকার কাছে সাভারে প্রায়ই যাই। যাওয়ার পথে ছোট ছোট নদীর ওপর দিয়ে যে ব্রিজগুলো, সেগুলো পার হতে হয়। নদীগুলোর ১২ মাসে যে চারটি রূপ হয় সেটি বহু বছর ধরেই আমার মনে দাগ কাটে। সাত-আট দিন আগে সড়ক পথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিলাম। কুমিল্লা এবং ঢাকার মাঝখানে তিনটি বড় ব্রিজ আছে, যথা দাউদকান্দি ব্রিজ, মেঘনা ব্রিজ এবং কাঁচপুর ব্রিজ। দাউদকান্দি ব্রিজ পার হওয়ার সময় আমার গাড়ির (দীর্ঘ দিনের পুরনো) ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, আসল নদী কোনটা চেনা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে; আপনি যেহেতু যাতায়াত করতে করতে পরিচিত, আপনি চিনবেন কোনটা নদীর মূল স্রোত। ঢাকা কুমিল্লা ইত্যাদি অঞ্চল, বাংলাদেশের পূর্ব অংশে পড়ে। কিন্তু আমি বাংলাদেশের অন্য অংশের নদী নিয়ে আলোচনা করব; যদিও ক্ষুদ্র পরিসরে।
ভারত-বাংলাদেশ ও নদীর পানি বণ্টন
বাংলাদেশের সুবৃহৎ প্রতিবেশীর বদৌলতে বাংলাদেশের নদী-নালাগুলো শুকিয়ে মৃতপ্রায়। বাংলাদেশকে যদি চারটি ভৌগোলিক ভাগে ভাগ করি, তাহলে একটি অংশ হতে পারে উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশ তথা উত্তরবঙ্গ; যার পরিচয় নিম্নরূপ: সাধারণভাবে পদ্মা নদীর উত্তরে এবং যমুনা নদীর পশ্চিমে ও ভারত সীমান্ত দিয়ে বেষ্টিত; অর্থাৎ বর্তমানের রংপুর বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগ। পদ্মা নদীর দক্ষিণে এবং যমুনার পশ্চিমে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশ বলা যেতে পারে; অর্থাৎ খুলনা বিভাগ। যমুনা নদীর পূর্ব দিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সিলেট ঢাকা কুমিল্লা ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্ব অংশ; অর্থাৎ ঢাকা বিভাগের উত্তর অংশ, নতুন ঘোষিত ময়মনসিংহ বিভাগ, সিলেট বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর অংশ তথা কুমিল্লা ও নোয়াখালী। দক্ষিণ বাংলা বা দক্ষিণ বঙ্গ বলতে বোঝায় ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর জেলা এবং পুরো বরিশাল বিভাগ। অনেকে খুলনাকেও দক্ষিণ বঙ্গ হিসেবে গণ্য করে; আবার অনেকে ফরিদপুরকে দক্ষিণবঙ্গের অংশ হিসেবে মানতে চান না। এটা বড় কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। বাংলাদেশের উত্তর অংশে বা দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে, অর্থাৎ রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে, রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে, এবং খুলনা বিভাগের উত্তর অংশে বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও বৃহত্তর যশোর জেলায়, বাংলাদেশের অন্য অংশগুলোর তুলনায় নদীনালা কম এবং যা-ও আছে সেগুলো শুকিয়ে যায় দ্রুত। এর কারণ হচ্ছে, এই অঞ্চলগুলোর নদীগুলোর উজানের অংশ ভারতের মাটিতে। আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী কর্তৃক পদ্মার উজানে ফারাক্কার বাঁধ নির্মাণ এবং তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি নিয়ন্ত্রণ করায়, আমাদের নদীগুলোতে, শুকনা মৌসুমে যথেষ্ট পানি আসে না কিন্তু, বর্ষা মৌসুমে অঢেল পানি এসে বন্যা ঘটায়। ভারত পানির সরবরাহ বা গতি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রবাহ ভারতের শুভেচ্ছা বা আন্তরিকতার ওপর নির্ভরশীল। অপর পক্ষে বাংলাদেশের কৃষি এবং গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা আমাদের নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল। আমার আলোচনার উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুধু ভারতকে দোষারোপ ও কটাক্ষ করা নয়; বরং আমার উদ্দেশ্য হলো, আমাদেরকে বিষয়টি সমাধানের জন্য আরো যে সচেষ্ট হতে হবে, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নদীর উভয় তীরে জবরদখল ব্যাপক হয়েছে। ফলে বর্ষাকালে পানির স্রোত বাধা পায়।
পানি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক
দুইটি রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বের অন্যতম শর্তই হলো, এই বন্ধুত্ব উভয় পক্ষের জন্য উপকারী হতে হবে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যত প্রকারের বিষয় জড়িত, সবগুলো বিষয়েই যে উভয় রাষ্ট্রের স্বার্থ সমানভাবে রক্ষিত হবে-এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। অর্থাৎ একটি বিষয়ে একটি রাষ্ট্র বেশি ত্যাগ স্বীকার করবে এবং অপর একটি বিষয়ে অন্য রাষ্ট্র বেশি ত্যাগ স্বীকার করবে। ইংরেজি পরিভাষায় বলতে পারি, গিভ অ্যান্ড টেক। কিন্তু বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্কের মধ্যে পানি বণ্টনের বিষয়টি যেন একটি গলার কাঁটা। এখানে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ থিওরি কাজ করে না। তবে একটি চিন্তার খোরাক উপস্থাপন করে রাখি। আগামী সম্ভাব্য পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হওয়া খুবই সম্ভাবনাময়। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকারকে, আগামী নির্বাচনে সুবিধা দেয়ার জন্য এই কাজটি করতে পারে। অর্থাৎ তখন বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বলবে, আমরাই পারি সমস্যার সমাধান করতে; আমরাই পারি আমাদের অধিকার আদায় করতে। নিবেদন করে রাখছি যে, তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের জন্য ভারত বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া মানেই, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ভিন্ন নদীগুলোর পানি সমস্যার সমাধান নয়। কিন্তু টেলিভিশন প্রচারণার সুযোগ নিয়ে, মিষ্টি মিষ্টি ভাষণ ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানুষের ভাবনা ও চিন্তাকে আবেগাপ্লুত করে রাখার সম্ভাবনা প্রচুর। বৃষ্টির পানি যখন মাটিতে পড়ে, সেই পানি খাল, বিল, নদী দিয়ে বয়ে যায়; পানি একটু একটু করে চুইয়ে পৃথিবীর ভেতরে প্রবেশ করে। হাজার-কোটি বছর ধরে এরূপ হতে হতে এবং পৃথিবীর জন্মলগ্নের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় যেরূপ হয়েছিল সেই মতে, ভূগর্ভে পানির আধার আছে; যার কারণে আমরা চাষাবাদ এবং অন্যান্য প্রয়োজনে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বত্র, বিশেষত উত্তর-পশ্চিম অংশে তথা উত্তরবঙ্গে, এবং দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অতি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। কারণ, সেচের জন্য ও অন্যান্য কারণে আমরা যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করি, তত পানি ভেতরে প্রবেশ করছে না। কারণ মাটির ওপরের অংশে তথা নদী-নালা-খালে-বিলে-পুকুরে পানি থাকছে না। দীর্ঘ মেয়াদে এটা আমাদের জন্য মারণফাঁদ। বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ বা মধ্যম পশ্চিম অংশে মরুকরণের লক্ষণ ব্যাপক। এর জন্য দায়ী, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। সম্মানিত পাঠক সম্প্রদায়ের মধ্যে এ প্রসঙ্গে সচেতনতা যেন বজায় থাকে, সেই আবেদন করছি।
পলিউশন তথা ট্যানারি দূষণ
পুরনো ঢাকার নাগরিকদের জন্য একটি বড় ধরনের সঙ্কট হিসেবে পরিচিত ছিল হাজারীবাগের ট্যানারি। ট্যানারি মানে চামড়া শিল্প। ট্যানারি এবং তার থেকে উদ্ভূত বিশেষ দুর্গন্ধের সাথে আমি ছোটকাল থেকে পরিচিত। কারণ, গ্রামের বাড়ি থেকে আমরা চট্টগ্রাম শহরে আসার জন্য যে মহাসড়ক ব্যবহার করতাম এবং এখনো করি, সেটার নাম কাপ্তাই-চট্টগ্রাম মহাসড়ক; সাধারণ ভাষায় কাপ্তাই রোড। কাপ্তাই থেকে শুরু হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের মোহরা অংশে এসে রাস্তাটি কালুরঘাট রোডের সাথে মিলিত হয়। স্থানীয় মানুষের কাছে এ মিলন স্থানটির নাম কাপ্তাই-রাস্তার মাথা। এখানে একটি বড় ট্যানারি ছিল দীর্ঘ দিন ধরে। ছোটকালে এই ট্যানারির বদৌলতে, চামড়া শিল্পের এবং চামড়ার দুর্গন্ধের সাথে পরিচয়। ঢাকা মহানগরে থাকি অনেক দিন এবং হাজারীবাগের সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের। হাজারীবাগ বলি বা অন্য জায়গার কথা বলি, বাংলাদেশে ট্যানারি ছিল এবং থাকবে। চামড়া শিল্প থাকতেই হবে। চামড়া শিল্প বাংলাদেশের রফতানি আয়ের অন্যতম বড় মাধ্যম। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও চামড়া শিল্প আছে। কোনো কোনো বছর আমাদের দেশ থেকে কাঁচা চামড়া বেশি চোরাচালান হয়ে ভারতে ঢোকে, কোনো বছর কম ঢোকে। চামড়া চোরাচালান কেন কম বা বেশি হয় ওই প্রসঙ্গে এখানে আলোচনায় যাবো না। ট্যানারির দুর্গন্ধের প্রভাব থেকে এবং এই শিল্প থেকে বের হওয়া দূষিত তরল পদার্থের প্রভাব থেকে, মানুষের জীবনকে বাঁচানোই হলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা মহানগরের হাজারীবাগে যখন ট্যানারি শিল্প ছিল, তখন সে এলাকায় প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছিল এবং ট্যানারি থেকে দূষিত তরল পদার্থ বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ত। এর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে, টেলিভিশন টকশোতে বলাবলি হয়েছে, পার্লামেন্টে আলোচনা হয়েছে। একপর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি পল্লীকে সরিয়ে ফেলা হবে। অনেক জরিপ করার পর, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার তেঁতুলঝোরা ইউনিয়নে, নতুন জায়গা নির্ধারণ করা হয়। প্রাইভেট সেক্টরের বিভিন্ন অসুবিধা ছিল, ঢাকা মহানগর থকে সরে যাওয়ায় অনীহা ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং ও তদারকি কম ছিল। ফলে সাভার ট্যানারি পল্লীতে, অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং শিল্পগুলো স্থানান্তর করায় বহুদিন বিলম্ব ঘটে। ২০১৬ সালের শেষের দিক এবং ২০১৭ সালের শুরুর দিক থেকে বর্তমান রাজনৈতিক সরকার এ বিষয়ে কঠোরভাবে মনোযোগী হয়। সরকার ট্যানারি শিল্প মালিকদের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করে যাতে তারা দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তর করে। শিল্প মালিকরাও হঠাৎ চাপ প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে কী করবেন এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। একপর্যায়ে হাইকোর্টে মামলা হয়। হাইকোর্টের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত রায় বের হয় এ মর্মে যে, একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে অবশ্যই যেন হাজারীবাগ থেকে সব চামড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়। সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে, হাজারীবাগের শিল্পগুলোতে বিদ্যুৎ ও পানি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। যতটুকু জানি, সাভারে যাওয়ায় বিলম্ব যে ঘটেছে তার অন্যতম কারণ সেখানে সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যর্থতা বা বিলম্ব এবং ট্যানারি থেকে বের হবে এমন বর্জ্য পদার্থগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব। ট্যানারি মালিকদের দুঃখের কথা কেউ শুনেছেন কেউ শুনেননি। গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাভার ট্যানারি পল্লী এখন কর্মচঞ্চল। হাজার হাজার মানুষ সেখানে শ্রম দিচ্ছেন; শ্রমিকদের আবাসনের জন্য নানা প্রকারের অস্থায়ী-স্থায়ী ঘর-বাড়ি নির্মিত হচ্ছে। রিকশা, ভ্যানগাড়ি ও ছোট মালবাহী মোটরগাড়ি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। নতুন নতুন বিল্ডিং হয়েছে ট্যানারি শিল্পের। আশেপাশে জমির দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। সাথে একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, ট্যানারি শিল্পগুলো থেকে দূষিত তরল পদার্থ বের হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে যাচ্ছে। হাজারীবাগে দূষিত পদার্থ সংশোধনের ব্যবস্থা ছিল না; সাভারের তেঁতুলঝোরা ট্যানারি পল্লীতে দূষিত বর্জ্য সংশোধনের প্রকল্প এখনো অসম্পূর্ণ বা অপ্রতুল। কারিগরি বা ব্যবসায়িক ভাষায় এগুলোকে ‘এফফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ বলে। সাভারের ট্যানারি পল্লীর চতুর্দিকের গ্রামের মানুষগুলো এখন দূষণের প্রভাবে, চামড়া শিল্পের তরল ছাড়াও অন্যান্য বর্জ্যরে গন্ধে জর্জরিত। আমার প্রশ্ন বা আমার নিবেদন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এটুকু সমন্বয় করতে ব্যর্থ হলো কেন? হাইকোর্ট সরকারের জন্য কোনো ধরনের সতর্কবাণী তাদের গুরুত্বপূর্ণ রায়ে রেখেছিলেন কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। যে দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা নষ্ট হচ্ছিল, সেই দূষণের কারণে এখন ধলেশ্বরী নষ্ট হচ্ছে। চূড়ান্তপর্যায়ে ধলেশ্বরীর পানি বুড়িগঙ্গার সাথে এসে মিশে বুড়িগঙ্গার পানিতেই পড়ে; অর্থাৎ ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা যমজ বোনের মতো। যেকোনো সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারের কাজ কর্মে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত। এক্ষেত্রে প্রকট আরেকটি উদাহরণ হলো, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পেছনের কারণগুলো; সেখানেও সমন্বয়ের অভাবই প্রধানত দায়ী; তবে আজ এ নিয়ে আলোচনা করছিনা।
দু’টি সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে মিল বা অমিল
ব্রিটিশ আমলে একটি কথা প্রচলিত ছিল: যেটা বঙ্গ আজকে চিন্তা করে, সেটা অবশিষ্ট ভারতবর্ষ আগামীকাল চিন্তা করে। ইংরেজি পরিভাষায় কথাটা অনেকটা এরকম ছিল: হোয়াট বেঙ্গল থিংক্স টুডে, রেস্ট অব ইন্ডিয়া থিংকস টুমোরো। এই কথা মনে এসে গেল। কারণ, বাংলাদেশের বিচার বিভাগে গত তিন-চার মাসের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। পত্রপত্রিকায় যেরূপ সংবাদ বা সংবাদ ভাষ্য বা মূল্যায়ন উঠে এসেছে সেই মোতাবেক আমার বক্তব্য। প্রথম কাজটি বা ঘটনাটি সম্বন্ধে প্রায় সবাই অবহিত। তা হলো, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে ‘বিবিধ পরিস্থিতি’ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রথমে ছুটিতে যেতে এবং পরে অবসরে যেতে বাধ্য করা। এ রূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং তাঁকে বাধ্য করার কাজটি কে বা কারা করেছে এবং কেন করেছে তা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, প্রধান বিচারপতি কর্তৃক কথিত অথবা বাস্তব পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার আগের একটি ঘটনা। তা হলো এ রূপ: মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়েছিলেন আলোচনা বা মতবিনিময়ের জন্য বা অবহিতকরণের জন্য। বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বিচারপতিদের হাতে কিছু তথ্য ও প্রামান্য কাগজ তুলে দেন। প্রশ্ন: কিসের তথ্য ও কিসের কাগজ? উত্তর: বিচারপতি সিনহা দুর্নীতি করেছেন-এ রূপ অভিযোগের সপক্ষে তথ্য ও প্রামান্য কাগজ। প্রকাশিত খবর মোতাবেক বা খবরের মূল্যায়ন করে আমরা বুঝতে পারি, বিচারপতিরা ওইরূপ পরিস্থিতিতে কনভিন্সড বা আশ্বস্ত হয়েছেন যে, বিচারপতি সিনহা দুর্নীতি করেছেন। অতএব বিচারপতিরা সিদ্ধান্ত নেন, তারা সিনহার সাথে একসাথে বসে আর কোনো বিচারকার্য পরিচালনা করবেন না। এ সিদ্ধান্ত তারা মিডিয়াকে জানালেন। দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনরত অবস্থায় কোনো বিচারপতি কর্তৃক বা বিচারপতিদের মাধ্যমে মিডিয়াকে এরূপ প্রত্যক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত জানানোর উদাহরণ বা প্রিসিডেন্স দুষ্প্রাপ্য। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের গৃহীত পদক্ষেপটি ভালো না মন্দ, তা নিয়ে আলোচনা করছি না। আমার আলোচনার ফোকাস অন্যত্র; এখন সে বিষয়ে বলতে চাই। ১২-১৪ দিন আগে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র হিসেবে অধিকতর পুরনো ও অধিকতর ঐতিহ্যবাহী ভারতের রাজধানী দিল্লিতে, বাংলাদেশের মতো একটি ঘটনা ঘটেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পরবর্তী চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি একজোট বা একমত হন। ওই চারজন বিচারপতির মধ্যে চতুর্থজন আগামী অক্টোবরে নিজেই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেবেন। কারণ বর্তমান প্রধান বিচারপতি তখন অবসরে যাবেন। এই চারজন এমন একটি কাজ করেছেন যা ভারতের সচেতন বোদ্ধা মহলের কিছু অংশের নিকট অভিনন্দিত এবং কিছু অংশের নিকট অতি পরিত্যাজ্য। প্রশ্ন: কাজটি কী ছিল? উত্তর: এটি ছিল একটি সংবাদ সম্মেলন। ওই চারজন বিচারপতি, প্রেস কনফারেন্স ডাকেন এবং সাংবাদিকদের সামনে সুপ্রিম কোর্ট পরিচালনায় বিশেষত মামলা বণ্টনের কর্মে, প্রধান বিচারপতির কিছু নীতির সমালোচনা ও সংশোধন কামনা করেন। তারা জানান যে, তারা চেষ্টা করেছেন প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে আশ্বস্ত করতে যে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। ওই চারজনের মতে, যেহেতু প্রধান বিচারপতি তাদের আহ্বানে সাড়া দেননি, তাদের ইতিবাচক সমালোচনায় সাড়া দেননি, সেহেতু তারা বাধ্য হয়েছেন মিডিয়ার সামনে আসতে। মিডিয়ার মাধ্যমে তারা ভারতবাসীকে সচেতন করতে চাচ্ছেন, যদি ত্রুটিগুলো বা ভুলগুলো সংশোধন করা না হয়, তাহলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তথা ঊর্ধ্বতন বিচার ব্যবস্থা বিপদে পড়বে। খবরটি যখন পত্রিকায় পড়লাম, বিস্তারিত যখন ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনে পড়লাম, তখন মুচকি হাসলাম। মনে মনে বললাম, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দিল্লিকে অনুসরণ করি; এই একটা বিষয়ে মনে হয়, দিল্লি আমাদের অনুসরণ করল। এখন সিরিয়াস প্রশ্ন হলো, বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন অংশ এবং মিডিয়ার মধ্যে সম্পর্ক কী হতে পারে? সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য কি শুধু প্রদান করা হবে, নাকি বক্তব্য আদান-প্রদান হবে? প্রিসিডেন্সবিহীন বা ‘রেয়ার’ ঘটনা ঢাকা ও দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে যেমন ঘটেছে, তেমন কোনো কিছু অন্য কোথাও যেন না ঘটে এটাই কামনা। অর্থাৎ স্বাভাবিকতা, ধারাবাহিকতা ও যৌক্তিকতা কাম্য।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
No comments