রুবিনা, শফিক ও এক জোড়া নীল জুতা

প্রায় এক দশক আগের জুন মাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছুটি। হলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বাড়িতে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসার আগে একপশলা বৃষ্টি ঝরেছে। বছরের প্রথম দিকের হিম হিম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে ভিজেছে এক জোড়া নীল জুতা। হলের ব্যালকনিতে শুকাতে দেওয়া জুতা জোড়ার ভেতরে একটু পানি। সেই জুতা জোড়ার দিকেই এক পলকে তাকিয়ে এক তরুণ শিক্ষার্থী, একজন বন্ধু। যার গাল বেয়ে অঝোরে ঝরছে উষ্ণ অশ্রু। এই জুতা জোড়া উদ্যমী, দুরন্ত যে তরুণের, সে আর কোনো দিন এই জুতা পরে ছুটবে না। সে ছুটবে না তেজগাঁও, পুরান ঢাকার অলিগলি বা কড়াইল বস্তিতে। হনহন করে হাঁটবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে। এই জুতা যার, সে আর কোনো দিন জুতা পরবে না। তার দুই পা মুহূর্তে কেড়ে নিয়েছে রেলগাড়ি নামের এক নিদারুণ নিষ্ঠুর যন্ত্রদানব। এই যন্ত্রদানবের নিষ্ঠুরতাতেই অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে বন্ধুর চোখে। রেললাইনে বন্ধুর পা হারানো আর ওই জুতা জোড়ার নীল কষ্টের কাহিনি শুনেছিলাম পা হারানো দুরন্ত ওই তরুণের বন্ধুর কাছেই। সেই থেকে রেললাইন বা রেলগাড়ি মনের ভেতর অন্য রকম গা শিরশির করা ভয় জাগায়, যা বহাল আছে এখনো। গা ছমছম করা সেই ভয় আবার পেলাম পত্রিকা মারফত ২২ জানুয়ারি। নীল জুতা জোড়ার মালিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মতোই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক তরুণ পা হারিয়েছে সিরাজগঞ্জে। তার নাম শফিকুল ইসলাম। শফিকুল বাড়ি থেকে ফিরছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সামান্য অসতর্কতার চড়া মূল্য দিতে হলো তাকে। ট্রেনে উঠতে গিয়ে দুই পা হারিয়েছে ধাতব চাকার নিচে। প্রাণ বাঁচলেও এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছে এই তরুণ। শফিকুলের এই দুঃখ-যন্ত্রণা হালকা না হতেই আবার পত্রিকায় এল রুবিনা আক্তারের করুণ কাহিনি। রুবিনা ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরেছিল। পরিকল্পনা ছিল দ্রুত ক্লাসে ফেরার। কিন্তু কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এসে কী যে হলো! একটু অসতর্কতা অথবা ক্ষণিকের খেয়াল। তাতেই সব শেষ। ইঞ্জিনের নিচে পিষ্ট হয়ে দুই পা হারাল। সঙ্গে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল একটি সংগ্রামময় পরিবারের বাধা পেরোনোর প্রচেষ্টার কান্ডারি। আহ্, রুবিনা, একটু সতর্ক থাকতে পারলে না! আহা রে! তোমার জন্য পরিবারের যে গভীর দীর্ঘশ্বাস, তা কীভাবে দূর হবে? কিসে মিটবে অঙ্গ হারানোর এই ক্ষতি? বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে রেলওয়ে লাইন আছে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার। প্রতিদিন চলাচল করে প্রায় ৩৫০টি ট্রেন। রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। আর প্রতি মাসে গড়ে রেল দুর্ঘটনা ঘটে প্রায় ৫০ টি, যা রেললাইন ও চলাচলকারী রেলের সংখ্যা অনুপাতে ভারতের চেয়েও বেশি। এসব তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ কতটা অনিরাপদ। এ ক্ষেত্রে যেমন অবকাঠামো আর অরক্ষিত রেলক্রসিং দায়ী, ঠিক তেমনি আরও বেশি দরকার জনসাধারণের সচেতনতা। রেলওয়ে তার নিজস্ব লাইনেই চলে। তারপরও অসতর্কতা, তাড়াহুড়াসহ নানাবিধ কারণে এই দুর্ঘটনার পরিমাণ বাড়ছেই, যা কমাতে উদ্যোগ খুবই জরুরি। তা না হলে নীল জুতার স্বত্বাধিকারীদের সংখ্যা বাড়বেই। নীল জুতার ওই তরুণ রেললাইনে পা হারানোর পর তার পাশে দাঁড়িয়েছিল তার অফিস। বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে একজন শিক্ষিকা মা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা ওই শিক্ষিকাকে দেখেছি পরম মমতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওই তরুণকে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘তোমার পা নেই তো কী হয়েছে, আমার দুই পা আছে, এই পায়ের শক্তিতেই তুমি চলবে।’ নানা মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার পর একসময় নীল জুতার ওই তরুণ সত্যিই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। পা হারিয়েও সে এখন সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। অনেক অসাধ্য সাধন করে যাচ্ছে। শফিকুল ও রুবিনার এখন বন্ধু, সহপাঠী আর পিতা-মাতার রূপ ধারণকারী শিক্ষক-শিক্ষিকার খুবই প্রয়োজন। তাঁরাই এই দুজনের শক্তি হতে পারেন। তাঁরাই সাহস জোগাতে পারেন, যাতে ভর দিয়ে আবার জগৎ-সংসার জয়ের চেষ্টা করতে পারে শফিকুল ও রুবিনা। একটু কি চেষ্টা করবেন রুবিনা ও শফিকুলের বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী আর শিক্ষক-শিক্ষিকারা!
তাহমিনা হক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
dina.haque@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.