খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা হোয়াইট হাউজে
বিগত
১৮ জুলাই ইসরাইলের পক্ষে কাজ করা খ্রিষ্টানদের সংগঠন ‘ক্রিশ্চিয়ান্স
ইউনাইটেড ফর ইসরাইল বা সিইউএফআই’-এর বার্ষিক সম্মেলনে মার্কিন ভাইস
প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা
‘জন হ্যাগি’ একজন ধর্মপ্রচারক, যিনি খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ
করেন। সিইউএফআইয়ের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের পক্ষে কাজ করা সবচেয়ে বড়
সংগঠন এটি। ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে হ্যাগি সমর্থন দেন ২০১৬
সালের মে মাসে। পেন্স এর আগেও একবার অঙ্গীকার করেন যে, ট্রাম্প প্রশাসন
ইসরাইলে মার্কিন দূতাবাস জেরুসালেমে সরিয়ে নেবে। বিশেষ করে নির্বাচনী
প্রচারণায় ইসরাইলের পক্ষে ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পূরণ করতে
না পারায় ইসরাইলের যেসব খ্রিষ্টান সমর্থক ক্রমাগতভাবে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে
যাচ্ছিল, তার এই অঙ্গীকার তাদের স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, হোয়াইট হাউজ
মতাদর্শগতভাবে বড় পরিবর্তনের দিকেই যাচ্ছে।
মতাদর্শগত পরিবর্তন
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের গবেষক ড্যান হামেল ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেন, ‘পেন্সের এই বক্তব্য ইসরাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুরোদস্তুর পরিবর্তনেরই স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।’ এই মৌলিক পরিবর্তন খ্রিষ্টান ইহুদিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইসরাইলের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই ‘খ্রিষ্টান ইহুদিবাদ’ অনুযায়ী, বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর স্পষ্ট নিদর্শন আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্র এবং ইসরাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারেই। পেন্সকে হামেল ব্যাখ্যা করেছেন ‘অতিউৎসাহী খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী’ হিসেবে, যিনি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করেছেন। ওই সম্মেলনে তার উপস্থিতি ছিল ‘হোয়াইট হাউজে খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের প্রভাব প্রতিপত্তির নতুন যুগের সূচনা’। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নে খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা ট্রাম্পকে দিয়ে যা করিয়ে নিতে চায়, সেই প্রচেষ্টায় পেন্স একা নন। ট্রাম্প প্রশাসন এবং অতিউৎসাহী খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করছেন আরকানসাসের সাবেক গভর্নর মাইক হুকাবি, তার মেয়ে ও হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ হুকাবি স্যান্ডার্স এবং সারাহ পলিন। এই দলে আলাবামার রয় মুরও আছেন, যাকে সিনেট নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন ট্রাম্প।
খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের শেষ লড়াই
ইসরাইল রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রায় দুই কোটি খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী কয়েক দশকে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে। রাশিয়া, ইথিওপিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে ইহুদিদের অভিবাসনে তারা অর্থ সহায়তাও দিয়েছে। ফিলিস্তিনের দখল করা ভূমিতে বাড়িঘর তৈরিতে কোটি কোটি ডলার বিলিয়ে দিয়েছে। হ্যাগি উল্লেখ করেছেন, ‘জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর প্রমাণ করেছে, আমাদের প্রেসিডেন্ট কথা রেখেছেন।’ বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের মতের বিরুদ্ধে জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর আর তালেবানের মতের বিরুদ্ধে যাওয়া একই কথা।’ এগুলো হ্যাগি বলেছেন তার নিজস্ব বিশ্বাস থেকে এবং সম্ভাবত সিইউএফআইয়ের ৩০ লাখ অনুসারীও একই বিশ্বাস লালন করেন। খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার আন্দোলনে চার কোটি অংশগ্রহণকারীও সম্ভাবত একই বিশ্বাস বা কমপক্ষে আংশিকভাবে এই বিশ্বাস লালন করেন। চিন্তার বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট কিংবা আরো অনেকেই হয়তো একই বিশ্বাস পোষণ করেন। সিইউএফআইয়ের সাবেক প্রধান ফলওয়েলসের ইসলামবিরোধী মতামতের মতোই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও হয়তো ইসলাম সম্পর্কে একই ঘোরের মধ্যেই আছেন।
সত্যের পক্ষে আর কেউ নেই
গত ৬ ডিসেম্বর দুই রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাব ট্রাম্প স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুই দশক ধরে চেষ্টা চালানোর পরও ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে টেকসই শান্তিচুক্তি সম্ভব হয়নি। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জেরুসালেমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার সময় এখনই। একই চিন্তার পুনরাবৃত্তি আলাদা বা আরো ভালো কোনো সমাধান বের করবেÑ এমন ধারণা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ জেরুসালেমকে ইসরাইলের প্রকৃত রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ অনেক বেশি কিছু। বাস্তবে এর মাধ্যমে দুই রাষ্ট্র সমাধানভিত্তিক শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতিশ্রুতিকেই অস্বীকার করা হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন। ফিলিস্তিনিরাও বুঝে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই শান্তি প্রক্রিয়ার সৎ বা পক্ষপাতহীন মধ্যস্থতাকারী নয়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র কোনো দিনই নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী ছিল না। ইসরাইলের অপরিসীম প্রভাবেই যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না এবং তার এই প্রতারণা সুস্পষ্ট। আব্বাস এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্ঘাত নিরসনের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র অযোগ্য। তার এই উক্তি কয়েক দশক ধরে দাবি করা, মার্কিন সুনামের জন্য এক বিরাট নীতিগত পরিবর্তন। আব্বাসের এই ঘোষণা আসে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায়। মুসলিম নেতাদের ওই সম্মেলনে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করে পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের দাবি তোলা হয়। ২১ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের মার্কিন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হয়। অর্থ সহায়তা বন্ধের মার্কিন হুমকির পরও জাতিসঙ্ঘের প্রায় সব সদস্য দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায়। ইসরাইলের চাহিদার কাছে ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ আত্মসমর্পণের জন্য ট্রাম্পের জামাতা ও জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জ্যারেড কুশনারের সফল প্রচেষ্টার পরই শান্তি প্রক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কুশনারের পরিবারের সদস্যরা এবং তিনি নিজেও পশ্চিম তীরে ইসরাইলের বসতি নির্মাণ কার্যক্রমে লাখ লাখ ডলার খরচ করেছেন। কোনোই সন্দেহ নেই যে, ট্রাম্প কুশনারকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছেন এবং সে কারণেই ফিলিস্তিনিরা তাদের কোনো অভিযোগেরই প্রতিকার পাবে না।
যিশুখ্রিষ্টের প্রত্যাবর্তন
কট্টর ইহুদিবাদী ও তাদের খ্রিষ্টান মিত্রদের জন্য এক জটিল বিষয় হলো আল আকসা মসজিদের সীমানা ঘেঁষে অবস্থান করা প্রথম ও দ্বিতীয় গির্জার ধ্বংসাবশেষ। তৃতীয়টি ইসলাম ধর্মের জন্যও পবিত্রতার প্রতীক। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী মতবাদের একটা মৌলিক বিষয় হলো, নতুন গির্জাটি তৈরি করতে হবে ঠিক ওই ধ্বংসাবশেষের জায়গাতেই। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে যে, আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ঠিক পাশেই খোঁড়াখুঁড়িতে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা তাদের বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্বাণী পূরণের ব্যাপারে কট্টর। তারা বিশ্বাস করে, কোনো একসময় নতুন গির্জা নির্মাণের মাধ্যমে কোনো একসময় যিশুখ্রিষ্টের প্রত্যাবর্তন পূর্ণ হবে। ফিলিস্তিনিদের জন্য একমাত্র আশা, পশ্চিম তীর ও গাজার বাসিন্দাদের ক্রমান্বয়ে এক জাতি হিসেবে ইসরাইলে অন্তর্ভুক্তি। অবশ্যই এটি খুবই অপ্রিয় পরিণতি। ইসরাইলিরা কখনোই ফিলিস্তিনি মুসলিম কিংবা খ্রিষ্টান কাউকেই নাগরিক হিসেবে বিনা আপত্তিতে মেনে নেবে না এবং ভোটের অধিকারও দিতে চাইবে না। নেতানিয়াহু ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এখন একই কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এমনো মনে করা হয়, ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তিনি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নির্ধারিত! সাবেক একজন শীর্ষ রাজনৈতিক পরামর্শক আয়াল আরাদ বলেছেন, ‘মসিহ’র সাথে প্রধানমন্ত্রীর এক ধরনের মিল আছে, যিনিই একমাত্র হলোকাস্টের মতো ঘটনা থেকে ইহুদিদের রক্ষা করতে পারেন।’ তাকে সব কিছু দ্রুতই করতে হবে। কেননা দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চতুর্থবারের মতো তদন্ত শুরু হয়েছে। স্রষ্টার আহ্বানে পেন্সও সমানভাবে অনুরক্ত। তার প্রিয় বাইবেলীয় বর্ণনা, যা থেকে তিনি প্রায়ই উদ্ধৃতি দেন এভাবে- ‘আমি জানি, আপনাদের জন্য আমার করণীয় কী। ঈশ্বরের কসম, আমার চিন্তা শুধু আপনাদের কল্যাণ, ক্ষতি নয়; আপনাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশা জাগানো।’ গ্রহণযোগ্যতার অভাব এবং গভর্নর হিসেবে রাজনৈতিক ব্যর্থতার পরও পেন্স খুবই উচ্চাকাক্সক্ষী। রিপাবলিকান দলের জাতীয় কমিটিকে পেন্স খুবই স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন যে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে হলিউডের ভিডিও টেপ প্রকাশ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতার ব্যাপারে দল যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তিনি ট্রাম্পের জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত।
আধ্যাত্মিক প্রেসিডেন্ট?
নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, মাইক পেন্স প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পেন্স অবশ্য এ সংবাদের কড়া প্রতিবাদ জানান। পেন্স বুঝতে পেরেছিলেন, ট্রাম্পের আরো একটি কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশের পর বৃহৎ এ দলটি সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে এবং ট্রাম্পের পর হয়তো তিনিই উঠে আসবেন। মূলধারার খ্রিষ্টান পণ্ডিতেরা বাইবেলের বর্ণনাকে নিয়েছেন ‘রূপক’ অর্থে। কিন্তু খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা এর শাস্তিমূলক ব্যাখ্যাকে বিবেচনা করে আক্ষরিক হিসেবে। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীর বাইবেল অনুযায়ী অলীক কল্পনার ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় শত শত বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। ১৬০০ সালে রাজা প্রথম জেমস যান, একদিন এটি ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠা পাবেই। এখনকার খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, হিব্রু উপজাতি একদিন সব জায়গা থেকে এখানে এসে জড়ো হবে এবং শয়তান ও যিশুখ্রিষ্টের অনুসারীদের মধ্যে শেষ লড়াই হবে।
আরেকটি ‘ব্যালফোর ঘোষণা’
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ব্যালফোর এবং প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ খ্রিষ্টান ইহুদিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ব্রিটেনকে কর্তৃত্ব দেয়ার তিন বছর আগে, ১৯১৭ সালে ইহুদিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যাংক ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য ও ইহুদিবাদের অন্যতম প্রবক্তা লর্ড রথচাইল্ডকে পত্র পাঠান ব্যালফোর। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় বাসভূমি প্রতিষ্ঠায় সরকারের সমর্থন আছে এবং এই লক্ষ্য অর্জনে তাদের সব প্রচেষ্টায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।’ ব্যালফোর ঘোষণা ছাড়া ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে যখন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলো, তখন আংশিকভাবে হলেও আমরাও যিশুকে ডাকতে পারি এবং ভালো-খারাপের যে যুদ্ধ হওয়ার কথা তার প্রস্তুতি নেয়াও শুরু করতে পারি। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা এটাই তাই বিশ্বাস করে এবং শাসন করার সে দাবিও ক্রমাগতভাবে তারা করেই যাচ্ছে।‘ মুসলমান, ইহুদি, বৌদ্ধ, হিন্দু, সর্বপ্রাণবাদী, ক্যারিবীয় অঞ্চলের ভুদু ধর্মের মানুষ, ক্যাথলিক, অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক এবং আরো যারা আছে তাদের সবাই খ্রিষ্টান ইহুদিবাদে দীক্ষিত হয়ে স্রষ্টার দলে অন্তর্ভুক্ত হবে। আমাদের অনিষ্টকারী সব শয়তানকে বশীভূত করে যিশুখ্রিষ্ট বিজয়ী হবেন। তিনি রাশিয়াসহ খ্রিষ্টানবিরোধী ও তাদের দোসরদের ধ্বংস করবেন এবং হাজার বছরের শান্তি ও প্রাচুর্যপূর্ণ রাজ্যের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হবেন।’ তবে বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, যিশুর এই প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রথমেই ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর ব্রিটেনের ইহুদি নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে এক পত্র লিখেছিলেন। ৬৭ শব্দের ওই চিঠিতে ব্যালফোর যে ঘোষণাটি দেন, তা প্রথমবারের মতো কোনো ক্ষমতাশালী কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আলাদা দেশ গঠনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছিল। ১৯১৭ সালে সেখানকার ৯০ ভাগ জনসংখ্যাই ছিল ফিলিস্তিনি। তারা ইহুদিবাদীদের আগ্রাসন ও তাদের ভূমি ইহুদিদের কাছে তুলে দেয়ার জন্য এই ঘোষণাকেই দায়ী করে, যা ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ওই চিঠি এখনো ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
বাইবেলীয় ইসরাইল
খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, দ্বিতীয় যে ব্যালফোর ঘোষণা আসছে তা ইহুদিদের জন্য মোটেও শুভ ইঙ্গিত নয়। এই অলৌকিক ঘটনা ঘটলে ইসরাইল রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ইহুদিরা যিশুখ্রিষ্টকে মসিহ হিসেবে মান্য না করায় তিনি ক্ষুব্ধ এবং খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ না করলে কিংবা আরো স্পষ্টভাবে বললে, খ্রিষ্টান ইহুদিবাদে বিশ্বাস না করলে তিনি সব ইহুদিকে হত্যা করবেন। সম্ভাবত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর জাতি খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা হোয়াইট হাউজে অবস্থান করা মাইক পেন্স ও তার সহকর্মীদের মতো ক্ষমতার লোকদের দিয়ে সব করায়ত্ত করতে পারে। তারা বিশ্বাস করে ওই অলৌকিক ঘটনা ঘটলেই কেবল পৃথিবীকে শুদ্ধ করা যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র হবে ঈশ্বরের ক্রোধ প্রশমনের হাতিয়ার। এই ঘটনা ঘটানোর ঐশ্বরিক পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় সম্পদ সম্ভাবত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। অন্ধ আনুগত্যের কারণেই এ দলের জন্য ট্রাম্প সব কিছুই করবেন। অর্থ ও ভোট উভয়ের জন্যই রিপাবলিকান পার্টি ওদের প্রতি অত্যাধিক ঝুঁকে পড়েছে। শুধু দল পরিচালনার ক্ষেত্রেই নয় বরং এই দলটির মধ্যে এখন রাজনীতির চেয়েও ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তা যে বেশি কাজ করছে, সে ব্যাপারেও আছে খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের গভীর প্রভাব। দুই কোটির বেশি খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী ভোট দেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহী এবং অর্থ খরচ করতে পছন্দ করে। রিপাবলিকান ধর্মতত্ত্বের তারাই মূলভিত্তি। তারা ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তি চায় না। বাইবেলীয় ইসরাইলে ফিলিস্তিনিদের কোনো জায়গা নেই। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা তাদের বিতাড়িত করে ইসরাইলের ‘পবিত্র ও চিরকালীন স্বর্গীয় শান্তি’ নিশ্চিত করতে চায়।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস বিষয়ের সাবেক অধ্যাপক
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম
মতাদর্শগত পরিবর্তন
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের গবেষক ড্যান হামেল ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেন, ‘পেন্সের এই বক্তব্য ইসরাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুরোদস্তুর পরিবর্তনেরই স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।’ এই মৌলিক পরিবর্তন খ্রিষ্টান ইহুদিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইসরাইলের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই ‘খ্রিষ্টান ইহুদিবাদ’ অনুযায়ী, বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর স্পষ্ট নিদর্শন আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্র এবং ইসরাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারেই। পেন্সকে হামেল ব্যাখ্যা করেছেন ‘অতিউৎসাহী খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী’ হিসেবে, যিনি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করেছেন। ওই সম্মেলনে তার উপস্থিতি ছিল ‘হোয়াইট হাউজে খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের প্রভাব প্রতিপত্তির নতুন যুগের সূচনা’। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নে খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা ট্রাম্পকে দিয়ে যা করিয়ে নিতে চায়, সেই প্রচেষ্টায় পেন্স একা নন। ট্রাম্প প্রশাসন এবং অতিউৎসাহী খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করছেন আরকানসাসের সাবেক গভর্নর মাইক হুকাবি, তার মেয়ে ও হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ হুকাবি স্যান্ডার্স এবং সারাহ পলিন। এই দলে আলাবামার রয় মুরও আছেন, যাকে সিনেট নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন ট্রাম্প।
খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের শেষ লড়াই
ইসরাইল রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রায় দুই কোটি খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী কয়েক দশকে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে। রাশিয়া, ইথিওপিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে ইহুদিদের অভিবাসনে তারা অর্থ সহায়তাও দিয়েছে। ফিলিস্তিনের দখল করা ভূমিতে বাড়িঘর তৈরিতে কোটি কোটি ডলার বিলিয়ে দিয়েছে। হ্যাগি উল্লেখ করেছেন, ‘জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর প্রমাণ করেছে, আমাদের প্রেসিডেন্ট কথা রেখেছেন।’ বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের মতের বিরুদ্ধে জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর আর তালেবানের মতের বিরুদ্ধে যাওয়া একই কথা।’ এগুলো হ্যাগি বলেছেন তার নিজস্ব বিশ্বাস থেকে এবং সম্ভাবত সিইউএফআইয়ের ৩০ লাখ অনুসারীও একই বিশ্বাস লালন করেন। খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার আন্দোলনে চার কোটি অংশগ্রহণকারীও সম্ভাবত একই বিশ্বাস বা কমপক্ষে আংশিকভাবে এই বিশ্বাস লালন করেন। চিন্তার বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট কিংবা আরো অনেকেই হয়তো একই বিশ্বাস পোষণ করেন। সিইউএফআইয়ের সাবেক প্রধান ফলওয়েলসের ইসলামবিরোধী মতামতের মতোই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও হয়তো ইসলাম সম্পর্কে একই ঘোরের মধ্যেই আছেন।
সত্যের পক্ষে আর কেউ নেই
গত ৬ ডিসেম্বর দুই রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাব ট্রাম্প স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুই দশক ধরে চেষ্টা চালানোর পরও ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে টেকসই শান্তিচুক্তি সম্ভব হয়নি। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জেরুসালেমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার সময় এখনই। একই চিন্তার পুনরাবৃত্তি আলাদা বা আরো ভালো কোনো সমাধান বের করবেÑ এমন ধারণা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ জেরুসালেমকে ইসরাইলের প্রকৃত রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ অনেক বেশি কিছু। বাস্তবে এর মাধ্যমে দুই রাষ্ট্র সমাধানভিত্তিক শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতিশ্রুতিকেই অস্বীকার করা হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন। ফিলিস্তিনিরাও বুঝে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই শান্তি প্রক্রিয়ার সৎ বা পক্ষপাতহীন মধ্যস্থতাকারী নয়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র কোনো দিনই নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী ছিল না। ইসরাইলের অপরিসীম প্রভাবেই যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না এবং তার এই প্রতারণা সুস্পষ্ট। আব্বাস এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্ঘাত নিরসনের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র অযোগ্য। তার এই উক্তি কয়েক দশক ধরে দাবি করা, মার্কিন সুনামের জন্য এক বিরাট নীতিগত পরিবর্তন। আব্বাসের এই ঘোষণা আসে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায়। মুসলিম নেতাদের ওই সম্মেলনে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করে পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের দাবি তোলা হয়। ২১ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের মার্কিন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হয়। অর্থ সহায়তা বন্ধের মার্কিন হুমকির পরও জাতিসঙ্ঘের প্রায় সব সদস্য দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায়। ইসরাইলের চাহিদার কাছে ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ আত্মসমর্পণের জন্য ট্রাম্পের জামাতা ও জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জ্যারেড কুশনারের সফল প্রচেষ্টার পরই শান্তি প্রক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কুশনারের পরিবারের সদস্যরা এবং তিনি নিজেও পশ্চিম তীরে ইসরাইলের বসতি নির্মাণ কার্যক্রমে লাখ লাখ ডলার খরচ করেছেন। কোনোই সন্দেহ নেই যে, ট্রাম্প কুশনারকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছেন এবং সে কারণেই ফিলিস্তিনিরা তাদের কোনো অভিযোগেরই প্রতিকার পাবে না।
যিশুখ্রিষ্টের প্রত্যাবর্তন
কট্টর ইহুদিবাদী ও তাদের খ্রিষ্টান মিত্রদের জন্য এক জটিল বিষয় হলো আল আকসা মসজিদের সীমানা ঘেঁষে অবস্থান করা প্রথম ও দ্বিতীয় গির্জার ধ্বংসাবশেষ। তৃতীয়টি ইসলাম ধর্মের জন্যও পবিত্রতার প্রতীক। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী মতবাদের একটা মৌলিক বিষয় হলো, নতুন গির্জাটি তৈরি করতে হবে ঠিক ওই ধ্বংসাবশেষের জায়গাতেই। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে যে, আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ঠিক পাশেই খোঁড়াখুঁড়িতে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা তাদের বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্বাণী পূরণের ব্যাপারে কট্টর। তারা বিশ্বাস করে, কোনো একসময় নতুন গির্জা নির্মাণের মাধ্যমে কোনো একসময় যিশুখ্রিষ্টের প্রত্যাবর্তন পূর্ণ হবে। ফিলিস্তিনিদের জন্য একমাত্র আশা, পশ্চিম তীর ও গাজার বাসিন্দাদের ক্রমান্বয়ে এক জাতি হিসেবে ইসরাইলে অন্তর্ভুক্তি। অবশ্যই এটি খুবই অপ্রিয় পরিণতি। ইসরাইলিরা কখনোই ফিলিস্তিনি মুসলিম কিংবা খ্রিষ্টান কাউকেই নাগরিক হিসেবে বিনা আপত্তিতে মেনে নেবে না এবং ভোটের অধিকারও দিতে চাইবে না। নেতানিয়াহু ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এখন একই কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এমনো মনে করা হয়, ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তিনি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নির্ধারিত! সাবেক একজন শীর্ষ রাজনৈতিক পরামর্শক আয়াল আরাদ বলেছেন, ‘মসিহ’র সাথে প্রধানমন্ত্রীর এক ধরনের মিল আছে, যিনিই একমাত্র হলোকাস্টের মতো ঘটনা থেকে ইহুদিদের রক্ষা করতে পারেন।’ তাকে সব কিছু দ্রুতই করতে হবে। কেননা দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চতুর্থবারের মতো তদন্ত শুরু হয়েছে। স্রষ্টার আহ্বানে পেন্সও সমানভাবে অনুরক্ত। তার প্রিয় বাইবেলীয় বর্ণনা, যা থেকে তিনি প্রায়ই উদ্ধৃতি দেন এভাবে- ‘আমি জানি, আপনাদের জন্য আমার করণীয় কী। ঈশ্বরের কসম, আমার চিন্তা শুধু আপনাদের কল্যাণ, ক্ষতি নয়; আপনাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশা জাগানো।’ গ্রহণযোগ্যতার অভাব এবং গভর্নর হিসেবে রাজনৈতিক ব্যর্থতার পরও পেন্স খুবই উচ্চাকাক্সক্ষী। রিপাবলিকান দলের জাতীয় কমিটিকে পেন্স খুবই স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন যে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে হলিউডের ভিডিও টেপ প্রকাশ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতার ব্যাপারে দল যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তিনি ট্রাম্পের জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত।
আধ্যাত্মিক প্রেসিডেন্ট?
নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, মাইক পেন্স প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পেন্স অবশ্য এ সংবাদের কড়া প্রতিবাদ জানান। পেন্স বুঝতে পেরেছিলেন, ট্রাম্পের আরো একটি কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশের পর বৃহৎ এ দলটি সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে এবং ট্রাম্পের পর হয়তো তিনিই উঠে আসবেন। মূলধারার খ্রিষ্টান পণ্ডিতেরা বাইবেলের বর্ণনাকে নিয়েছেন ‘রূপক’ অর্থে। কিন্তু খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা এর শাস্তিমূলক ব্যাখ্যাকে বিবেচনা করে আক্ষরিক হিসেবে। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীর বাইবেল অনুযায়ী অলীক কল্পনার ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় শত শত বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। ১৬০০ সালে রাজা প্রথম জেমস যান, একদিন এটি ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠা পাবেই। এখনকার খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, হিব্রু উপজাতি একদিন সব জায়গা থেকে এখানে এসে জড়ো হবে এবং শয়তান ও যিশুখ্রিষ্টের অনুসারীদের মধ্যে শেষ লড়াই হবে।
আরেকটি ‘ব্যালফোর ঘোষণা’
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ব্যালফোর এবং প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ খ্রিষ্টান ইহুদিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ব্রিটেনকে কর্তৃত্ব দেয়ার তিন বছর আগে, ১৯১৭ সালে ইহুদিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যাংক ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য ও ইহুদিবাদের অন্যতম প্রবক্তা লর্ড রথচাইল্ডকে পত্র পাঠান ব্যালফোর। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় বাসভূমি প্রতিষ্ঠায় সরকারের সমর্থন আছে এবং এই লক্ষ্য অর্জনে তাদের সব প্রচেষ্টায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।’ ব্যালফোর ঘোষণা ছাড়া ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে যখন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলো, তখন আংশিকভাবে হলেও আমরাও যিশুকে ডাকতে পারি এবং ভালো-খারাপের যে যুদ্ধ হওয়ার কথা তার প্রস্তুতি নেয়াও শুরু করতে পারি। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা এটাই তাই বিশ্বাস করে এবং শাসন করার সে দাবিও ক্রমাগতভাবে তারা করেই যাচ্ছে।‘ মুসলমান, ইহুদি, বৌদ্ধ, হিন্দু, সর্বপ্রাণবাদী, ক্যারিবীয় অঞ্চলের ভুদু ধর্মের মানুষ, ক্যাথলিক, অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক এবং আরো যারা আছে তাদের সবাই খ্রিষ্টান ইহুদিবাদে দীক্ষিত হয়ে স্রষ্টার দলে অন্তর্ভুক্ত হবে। আমাদের অনিষ্টকারী সব শয়তানকে বশীভূত করে যিশুখ্রিষ্ট বিজয়ী হবেন। তিনি রাশিয়াসহ খ্রিষ্টানবিরোধী ও তাদের দোসরদের ধ্বংস করবেন এবং হাজার বছরের শান্তি ও প্রাচুর্যপূর্ণ রাজ্যের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হবেন।’ তবে বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, যিশুর এই প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রথমেই ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর ব্রিটেনের ইহুদি নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে এক পত্র লিখেছিলেন। ৬৭ শব্দের ওই চিঠিতে ব্যালফোর যে ঘোষণাটি দেন, তা প্রথমবারের মতো কোনো ক্ষমতাশালী কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আলাদা দেশ গঠনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছিল। ১৯১৭ সালে সেখানকার ৯০ ভাগ জনসংখ্যাই ছিল ফিলিস্তিনি। তারা ইহুদিবাদীদের আগ্রাসন ও তাদের ভূমি ইহুদিদের কাছে তুলে দেয়ার জন্য এই ঘোষণাকেই দায়ী করে, যা ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ওই চিঠি এখনো ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
বাইবেলীয় ইসরাইল
খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, দ্বিতীয় যে ব্যালফোর ঘোষণা আসছে তা ইহুদিদের জন্য মোটেও শুভ ইঙ্গিত নয়। এই অলৌকিক ঘটনা ঘটলে ইসরাইল রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ইহুদিরা যিশুখ্রিষ্টকে মসিহ হিসেবে মান্য না করায় তিনি ক্ষুব্ধ এবং খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ না করলে কিংবা আরো স্পষ্টভাবে বললে, খ্রিষ্টান ইহুদিবাদে বিশ্বাস না করলে তিনি সব ইহুদিকে হত্যা করবেন। সম্ভাবত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর জাতি খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা হোয়াইট হাউজে অবস্থান করা মাইক পেন্স ও তার সহকর্মীদের মতো ক্ষমতার লোকদের দিয়ে সব করায়ত্ত করতে পারে। তারা বিশ্বাস করে ওই অলৌকিক ঘটনা ঘটলেই কেবল পৃথিবীকে শুদ্ধ করা যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র হবে ঈশ্বরের ক্রোধ প্রশমনের হাতিয়ার। এই ঘটনা ঘটানোর ঐশ্বরিক পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় সম্পদ সম্ভাবত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। অন্ধ আনুগত্যের কারণেই এ দলের জন্য ট্রাম্প সব কিছুই করবেন। অর্থ ও ভোট উভয়ের জন্যই রিপাবলিকান পার্টি ওদের প্রতি অত্যাধিক ঝুঁকে পড়েছে। শুধু দল পরিচালনার ক্ষেত্রেই নয় বরং এই দলটির মধ্যে এখন রাজনীতির চেয়েও ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তা যে বেশি কাজ করছে, সে ব্যাপারেও আছে খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের গভীর প্রভাব। দুই কোটির বেশি খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী ভোট দেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহী এবং অর্থ খরচ করতে পছন্দ করে। রিপাবলিকান ধর্মতত্ত্বের তারাই মূলভিত্তি। তারা ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তি চায় না। বাইবেলীয় ইসরাইলে ফিলিস্তিনিদের কোনো জায়গা নেই। খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীরা তাদের বিতাড়িত করে ইসরাইলের ‘পবিত্র ও চিরকালীন স্বর্গীয় শান্তি’ নিশ্চিত করতে চায়।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস বিষয়ের সাবেক অধ্যাপক
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম
No comments