লাশকাটা ঘরের অজানা কথা
আমি
শান্ত। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বিভাগের একজন
শিক্ষার্থী। এ নামটি নিয়ে আমার বন্ধুমহলে যথেষ্ট রাজনীতি চলে। বন্ধুদের
মধ্যে যারা কিনা একটু প্রতিক্রিয়াশীল, তারাই এর অগ্রজ। অভিযোগ একটিই-
‘নামের সঙ্গে কামের কোনোই মিল নেই।’ সুতরাং শান্ত নামটি যথাযথ নয়। আজ সময়
এসেছে পাল্টে দেওয়ার। আরও কত কি! আত্মপক্ষ সমর্থনে আমার যুক্তি- ‘ছোটবেলায়
কান্নাকাটি না করায় আমি এই শান্ত উপাধি পেয়েছি। আর আজও কান্নাকাটি করি না।
সুতরাং অদ্যাবধি আমি আপাদমস্তক শান্ত!’ এই হল আমার নামের ইতিবৃত্ত! আমি
সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন ক্লাসে স্যার আমাকে প্রশ্ন
করলেন- ধরো, কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেল। এই
নিউজটি তোমাকে করতে হবে। এর জন্য তুমি কোন কোন নিউজ সোর্স বা সংবাদ সূত্র
ব্যবহার করবে? আমি দাঁড়িয়ে একটানে মুখস্থ বিদ্যা ঝেড়ে ফেললাম-
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ আর হাসপাতাল। ব্যাস রিপোর্ট ওকে! স্যার আমার কথাগুলো
শুনলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমাকে বসতে বললেন। আমি কিন্তু মনে মনে
নিজেকে বিশাল বড় সাংবাদিক ভেবে আত্মতুষ্টিতে বিভোর হয়েছিলাম। মনে করেছিলাম
আমার মধ্যে সাংবাদিকতার বিশাল সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে
আমি যে দেশ কাঁপানো এক সাংবাদিক হব, এ ব্যাপারে আমি ছিলাম পুরোপুরি
ওয়াকিফহাল! অজ্ঞাত বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট করতে সূত্র হিসেবে
হাসপাতালকে ব্যবহার করতে হয়।
এটি আমার জানা কথা। কিন্তু এই জানা ব্যাপারটিই
হাতেকলমে শেখার জন্য কয়েক দিন আগে আমাকে যেতে হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের
মর্গে। আমাদের এই জার্নির মাস্টার প্ল্যান যিনি, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় কাজী
আনিস স্যার। আমরা মর্গের উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং যথারীতি মর্গের সামনে হাজির
হই। মর্গ। বাংলায় বললে- লাশকাটা ঘর। এটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ।
দেখলাম, মর্গের চারপাশে কেমন যেন একটি গুমোট ভাব। এ যেন বাইরের বাতাস এখানে
কিংবা এখানকার বাতাস বাইরে না যাওয়ার এক অলিখিত চুক্তির ফল। যার এতটুকু
হেরফের হচ্ছে না! সবটা মিলে দারুণ এক ভুতুড়ে পরিবেশ এই মর্গের সামনেটা।
এখানকার দুর্বাঘাসগুলো মলিন, দেয়ালগুলো রংচটা, গাছগুলো ধূসর, মানুষগুলো
নীরস, আগত দেহগুলো নিথর! এখানকার স্ট্রেচারগুলো কখনও তাজা লাশ, কখনও
অর্ধগলিত, কখনওবা পচেগলে যাওয়া নাম-পরিচয়হীন দেহগুলোকে বয়ে বেড়ায়। কখনও
লাশের পেছনে আত্মীয়স্বজনের ভিড় আবার কখনওবা কেউ-ই থাকে না দুয়েকজন পুলিশ
ছাড়া। হতভাগা এই লাশগুলো বেওয়ারিশ। এদের পরিচয় এরা অজ্ঞাত! সন্তান হারানো
হাজারো মায়ের শোকের উন্মত্ততা, শোকের প্রকোপে বাকরুদ্ধ পিতার নীরব কান্না,
ভাইবোনদের হৃদয়বিদারক চিৎকার, প্রিয়তম স্ত্রীর মূর্ছা যাওয়া আর ডুকরে ডুকরে
কান্নার নীরব সাক্ষী এখানকার গাছপালা আর নিষ্প্রাণ কনক্রিটগুলো। এখানে কেউ
হাসতে জানে না, কেউ হাসে না- হাসতে পারে না। এখানে সুখের ছিটেফোঁটাও নেই,
কেবলই শোকের মাতম। এটি মর্গ- লাশকাটা ঘর! এতদিন আমি পাঠ্যপুস্তকের কল্যাণে
সাংবাদিকতার জ্ঞানে নিজেকে পরিপূর্ণ বলে মনে করে এসেছি। সেই আমিই সব কিছুই
দেখে নির্বাক হয়ে গেলাম। কারণ ব্যাপারটি এমন নয় যে হাসপাতালে এলাম আর তথ্য
নিয়ে চলে গেলাম। এখানে লুকিয়ে আছে তার চেয়ে বেশি কিছু। এখানে ঢুকে প্রথমে
লাশকাটা ঘরটির ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। লাশ পচা গন্ধে নাক-মুখে টিস্যু
পেপার দিয়ে চেপে ধরলাম। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। তীব্র গন্ধ টিস্যুভেদ
করে নাক দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে- নিঃশ্বাস তোলার সময়
আস্ত ফুসফুসটাই ভেতর থেকে বের হয়ে যাবে। জীবনে অনেক কিছুর গন্ধ সহ্য করতে
হয়েছে। কিন্তু মানুষ পচা গন্ধের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। মানুষ পচা গন্ধ! ভাবতেই
মাথার মধ্যে ঝিম ধরে গেল। শেষমেশ সহ্য করতে না পেরে লাশকাটা ঘরের দক্ষিণ
কোণে অপেক্ষাকৃত একটু ফাঁকা স্থানে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠাৎ কোনো এক শব্দে পেছনে
ফিরে তাকালাম। ঠিক পেছনে হাতের ডানপাশে একজন গন্ধের প্রকোপ সহ্য না করতে
পেরে বমি করছে। সত্যি বলতে- তখন আমারও একই অবস্থা ছিল। কিন্তু লোকে কী
ভাববে তা চিন্তা করে অনেক কষ্টে চেপে রেখেছিলাম! আর সব দেখে মনে মনে
ভাবছিলাম- এ কোন অসহনীয় যন্ত্রণা? এ কোন পৃথিবী? সহসা মনে পড়ে যায়, ক্লাসে
স্যারের সঙ্গে আমার সেই কথাগুলো। আমার জবাবে স্যার হয়তো এমন কোনো উত্তর
খুঁজে পায়নি, যা দিয়ে আমাকে তিনি বোঝাতে পারতেন।
অথবা বোঝানো হলেও তা আসলে
আমাকে কতটা ছুঁয়ে যেত, সে চিন্তা করেই হয়তো স্যার চুপ ছিলেন। কিন্তু সেই
চুপ থাকার মানেটা আজ আমার কাছে দিবালোকের ন্যায় ধ্রুব! আমি চোখের সামনে আজ
যা দেখেছি, তা পৃথিবীর কোনো পুস্তক ধারণ করতে পারবে না। কোনো মুখ তার কথার
প্রবাহ দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারবে না। কেননা হৃদয় যা ধারণ করে, মুখ তার
যৎসামান্যই বাইরে টেনে আনতে পারে। আর যতটুকুই বাইরে আসে, ততটুকু পুস্তকে
আসে না। আর যদিও কখনও তার কিছু অংশ ধারণ করা সম্ভবপর হয়, তা কেবল আবেগ,
জীবনবোধ উপেক্ষিত কিছু বর্ণই হবে, অন্য কিছু নয়। আমি ক্লাসমেটদের সঙ্গে
মর্গের ডানপাশের ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর এলোমেলোভাবে এটা-ওটা
নিয়ে চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ মর্গের ভেতর থেকে স্ট্রেচারে করে একটি লাশ আনা
হল। ছোট্ট একটি দেহ, ছোট্ট অবয়ব। বয়স জিজ্ঞেস করে জানা গেল- বয়স মাত্র ৯
বছর। এই ৯ বছর বয়সেই ওকে সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল। পৃথিবীর কিইবা
দেখতে পেরেছিল এই ৯ বছরের মাসুম বাচ্চাটি! সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ব্যাপার
হচ্ছে- মাত্র ১৫ দিন আগেই নাকি এই শিশুটির বাবা মারা যায়! কীভাবে সহ্য করবে
ওর মা? এখন তার কাছে বেঁচে থাকার আর কি মানে থাকতে পারে? এর অল্প কিছু পরই
একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে লাশকাটা ঘরের কোণঘেঁষে দাঁড়াল। আবার আরেকটি
স্ট্রেচার এলো। এবার একজন যুবক, বয়স ২৫-৩০ হবে। পানির মধ্যে সাপে কেটেছে।
প্রথমে তার নিজ জেলা ময়মনসিংহ, পরে মহাখালী নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ
কোথাও কিছু হল না। ঠিকানা হল লাশকাটা ঘরে! তাকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা
হচ্ছিল, তার বৃদ্ধ বাবার সে কি কান্না। বৃদ্ধটি ছেলের লাশের সঙ্গে
অ্যাম্বুলেন্সে ওঠতে চাচ্ছে; কিন্তু আত্মীয়স্বজনরা দিচ্ছেন না। কিন্তু
বৃদ্ধের হাতও অ্যাম্বুলেন্সের বেড থেকে ছাড়ানো যাচ্ছে না। বৃদ্ধের মুখে
শুধু একটিই কথা- বাবা... আমার বাবা... আহারে! বাবারে!! সন্তানের লাশের পাশে
বৃদ্ধ পিতা। পৃথিবীতে এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে পারে? আমরা বাইরেই
দাঁড়িয়ে আছি। মর্গের ভেতরে এখনও যাওয়া হয়নি। স্যার জানালেন ভেতরে
পোস্টমর্টেম চলছে। আরও এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলবে। এর মধ্যে ভেতরে যাওয়া যাবে
না। তাই আমরা লাশকাটা ঘরে যাওয়ার পরিবর্তে লাশ সংরক্ষণের ঘরে যাই।
শবাগারটিতে ঢোকার সময় গায়ে কাঁটা দিয়ে আসে। অজানা এক শঙ্কায় মনটা অসাড় হয়ে
যায়। কিন্তু বহু কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে ঢুকে পড়লাম। ছোট্ট একটা একতলা ভবন।
এতে একটিই কক্ষ। সেখানে দেখতে পেলাম দুই সারিতে রাখা লাশের ফ্রিজ, যার
মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয় লাশগুলোকে। ভেতরটা কেমন যেন এক উৎকট গন্ধে ভরপুর।
গাটা ছিম ছিম করছিল। লাশ; মানুষের বিবর্তনের আরেক রূপ। মনে মনে ভাবছিলাম।
এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। তাই আমরা বের হয়ে এলাম। ফিরে আসার সময় হয়েছে।
দেখার হয়তো আরও অনেক কিছুই ছিল; কিন্তু সবার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা
করে স্যার ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা লাশকাটা ঘরটির সামনে দিয়ে আসছিলাম।
এর মধ্যে দেখলাম আরেকটি স্ট্রেচার বের হল। এর চারপাশে কোনো আত্মীয়স্বজন
নেই, কান্নাকাটি নেই- মানে অজ্ঞাতনামা বা বেওয়ারিশ। লাশের গায়ে কোনো পর্দা
দেওয়া হয়নি। শুধু একটি লুঙ্গি চিরে সোজাসুজিভাবে গায়ের ওপরে দিয়ে দেওয়া
হয়েছে, যার ফলে মাথার মাঝ বরাবর দেওয়া সেলাইগুলো স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে।
সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। আমি অবাক হই! স্যারকে জিজ্ঞেস করি, মানুষ মারা
যাওয়ার পর তার দেহ কাটলে কি রক্ত বের হয়? স্যার বলেন, হ্যাঁ বের হয়। এ
ব্যাপারটি আমার জানা ছিল না। আমরা লাশকাটা ঘরটিকে পেছনে ফেলে আসি।
উদ্দেশ্য- যার যার গন্তব্যে পৌঁছা। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বেশি দূর
এগোতে পারলাম না।
হাসপাতালের এক ভবনে আশ্রয় নিলাম। এবং সেখানে অবাক করা
আরেক ঘটনার সাক্ষী হলাম। সেখানে মধ্য বয়সী একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সেও বৃষ্টির কারণেই ওখানে আশ্রয় নেন। আমি তার হাতের দিকে তাকালাম। সেখানে
বাজারের তিনটি ব্যাগ দেখতে পেলাম। এবং প্রত্যেকটি ব্যাগেরই একেবারে নিচের
দিকে রশি দিয়ে বাঁধা। পুলিশ সদস্যটি তিনটি ব্যাগই তার বাম হাতে ধরে
রেখেছেন। আর ডান হাতে কিছু কাগজ। স্যার আমাদের আগেই বলেছিলেন- এগুলো হল
সুরতহাল রিপোর্ট। মানে লাশের কোথায় কোথায় ক্ষত ছিল, কী অবস্থায় লাশটি ছিল
তারই প্রাথমিক পুলিশি বর্ণনা। কিন্তু আমার কৌতূহলের জায়গা তার হাতে থাকা
তিনটি ব্যাগ। আমি জিজ্ঞেস করলাম- ব্যাগের মধ্যে কি আছে? উনি বললেন- লাশের
লিভার, ফুসফুস, স্টমাকসহ আরও কিছু দেহের অঙ্গ। এগুলো পরীক্ষা করার জন্য
অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। শুনে আমার মাথার মধ্যে ঝিম ধরে গেল। আমি অবাক হয়ে
ভাবলাম- মাত্র দুদিন আগে যে মানুষটি আমার মতোই স্বাভাবিক একজন মানুষ ছিল;
কিন্তু আজ দুদিন পর তার একটি অংশ বাজারের ব্যাগে অন্য এক মানুষের হাতে
ঝুলছে! মানুষের হাতে মানুষের পার্টস, বাজারের ব্যাগে মানুষের পার্টস! আমি
ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় আমরা সেখান থেকে বের হয়ে
এলাম। হাসপাতালের গেট পর্যন্ত আসতে আসতে দুটি মূল্যবান কথা শুনলাম। একটি
কাজী আনিস স্যারের মুখ থেকে- তোমাদের যখন মন ভালো থাকবে না, তখন এখান থেকে
ঘুরে যেও, জীবন কী বুঝতে পারবে। তখন দুঃখকষ্টগুলোকে অনেক তুচ্ছ মনে হবে।
অন্যটি বন্ধু রাগীব আহসানের মুখ থেকে- শান্ত। মর্গ এমন একটি জায়গা; দোয়া
করো যেন তোমার শত্রুরও এখানে না আসতে হয়।
No comments