মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করবে by জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
মন্ত্রিসভায়
অনুমোদিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া দেখে মনে হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইনে
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাই নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এখানে যেসব
বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে প্রচারিত খসড়ায় তার অনেক কিছুই ছিল
না। বিশেষ করে আইনের ২৫,২৮, ৩০,৩১ ও ৩২ ধারা নিয়ে শঙ্কা ও ঝুঁকি থেকেই যায়।
এ কথা ঠিক যে নতুন আইনে কোনো কোনো বিষয়ে শাস্তির মাত্রা কমানো হয়েছে। যেমন
মানহানি মামলায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৭ বছর থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি
টাকা জরিমানার বিধান ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিন বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ
লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই আইনের তো
প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ৫০০ ধারায় এর শাস্তি নির্ধারিত আছে।
আবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্ম অবমাননার বিষয়ে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫
থেকে ২৯৮ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই আইনে সংশ্লিষ্ট ধারা
সংযোজনের কোনো দরকার ছিল বলে মনে করি না। আর ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাখ্যা কার
কাছে পাব? আমরা দেখতে পাই, ধর্মীয় অনুভূতি বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী
মানুষের অনুভূতির কথাই বোঝানো হয়। অন্য ধর্মের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত নিয়ে
কোনো মামলা হতে দেখি না। বরং নাসিরনগরে দেখেছি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত
দেওয়ার নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক তরুণের বিরুদ্ধ ৫৭ ধারায় মামলা করে
তাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছে। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি ছিল
সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমাদের ভয়ের আরেকটি কারণ হলো, বাংলাদেশে অন্যান্য
ক্ষেত্র যেমন এখানেও আইন ক্ষমতাবানদের পক্ষে এবং দুর্বলের বিপক্ষে
ব্যবহারের সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। অনেকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপব্যবহারের
কথা বলে থাকেন। এর মাধ্যমে কিন্তু আইনটির যৌক্তিকতা দেওয়া হয়। আমরা মনে
করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্বারা আমলাদের দুর্নীতি আড়াল করার একটা প্রয়াস
রয়েছে। এই আইনে সংযুক্ত উল্লিখিত ধারাগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও
সংকুচিত করবে। গণমাধ্যম বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খবর
প্রকাশ করে থাকে। স্বভাবতই তারা সূত্রের নিরাপত্তার স্বার্থে তথ্যসূত্র
গোপন রাখা হয়। কিন্তু আইন বলছে গোপনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো তথ্য সংগ্রহ
করা যাবে না। কেউ সরকারি অফিস থেকে গোপনে কোনো তথ্য সংগ্রহ করলে তার জন্য
কৈফিয়ত দিতে হবে।
পৃথিবীব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি বড় উপাদান হলো
সূত্র প্রকাশ না করা। গণমাধ্যম কোন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেটি
জানাতে বাধ্য নয়। সংশ্লিষ্টদের দেখার বিষয়, তথ্যটি ঠিক আছে কি না। সাংবাদিক
কোথা থেকে এই তথ্য পেলেন, তা জানতে চাওয়া সাংবাদিকতার স্বাধীনতার
পরিপন্থী। তদুপরি ২০০৯ সালে প্রণীত তথ্য অধিকার আইনে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে
যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছিল, বর্তমান আইন তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেই আইনের
উদ্দেশ্য ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত
করা। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা এই অধিকার খর্ব করবে। আইনটি
যেভাবে করা হয়েছে, তাতে কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছবি প্রকাশ করলেও এই আইনে
মামলা করা যাবে। কর্তৃপক্ষ বলতে পারে, এ ছবি তাদের অনুমতি ছাড়া ব্যবহার
করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গবেষণার ক্ষেত্রও সংকুচিত হবে।
যেমন, সড়ক দুর্ঘটনাবিষয়ক গবেষণার কাজে যদি কেউ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্য
ব্যবহার করে থাকেন, এই আইনবলে সেই তথ্যের জন্য তাঁর কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হতে
পারে। এটিও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করি। ডিজিটাল নিরাপত্তা
আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব
জানিয়েছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, এসব ধারার প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশ
দণ্ডবিধিতেই সংশ্লিষ্ট অপরাধের শাস্তি ও প্রতিকারের বিধান রয়েছে। এসব ধারা
যেমন জটিলতা বাড়াবে, তেমনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত করবে।
No comments