চীনের ৭ কাণ্ডারি by অধ্যাপক বো ঝিইয়ু
অক্টোবরের
২৫ তারিখ চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির ১৯তম কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম পূর্ণাঙ্গ
অধিবেশনে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ পলিটব্যুরো স্থায়ী কমিটির ৭
সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, পূর্বতন পলিটব্যুরো
স্থায়ী কমিটির চারজন অবসর নিয়েছেন বয়সজনিত কারণে। এরা হলেন- ঝাং দেজিয়াং,
ইউ ঝেংশেং, লিউ ইউনশান ও ঝাং গাওলি। এছাড়া, অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে অবসর
নিয়েছেন ওয়াং কিশান। তিনিও সম্ভবত বয়সজনিত কারণে অবসর নিয়েছেন। অর্থাৎ,
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং ছাড়া সাত সদস্যবিশিষ্ট
স্থায়ী কমিটির বাকি সকল সদস্যই বিদায় নিয়েছেন।
দেখে নেয়া যাক নবগঠিত স্থায়ী কমিটির সাত সদস্যের পরিচিতি, যারা অন্তত আগামী ৫ বছর চীনকে পরিচালনা করবেন।
১. শি জিনপিং: প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং (৬৪) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নতুন স্থায়ী কমিটির এক নম্বর সদস্য। পাশাপাশি দেশের ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় সামরিক কমিটির চেয়ারম্যান। ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান ও পিপল’স লিবারেশন আর্মির সর্বাধিনায়ক শি জিনপিং দলের ১৯তম অধিবেশনে নিজের ক্ষমতা আরো সুসংহত করেছেন। ‘নবযুগে চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্র নিয়ে শি জিনপিং-এর ভাবনা’ শিরোনামে তার ভাবনা দলীয় সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাও সেতুং ভাবনা, দেং শিয়াওপিং তত্ত্ব, (জিয়াং জেমিন-এর) থিওরি অব থ্রি রিপ্রেজেন্টস ও হু জিনতাওর উন্নয়নের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি এখন শি জিনপিং-এর এই ভাবনাও দলের সংবিধানে শোভা পাবে। একে দলের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দলীয় কংগ্রেস চলাকালে প্রেসিডেন্টকে ‘মহান নেতা’, ‘মাঝি’ ও নবযুগে চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্রের রূপকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি চীনকে এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
২. লি কেকিয়াং: প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং (৬২) স্থায়ী কমিটির দ্বিতীয় নেতৃত্বস্থানীয় সদস্য হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। চীনা কম্যুনিস্ট ইয়ুথ লীগের সঙ্গে কেকিয়াং-এর সম্পর্ক বেশ জোরালো। গত ৫ বছরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ছিল দারুণ। প্রেসিডেন্টের ঘরোয়া ও বৈদেশিক নীতির কড়া সমর্থক তিনি। আইন ও অর্থনীতিতে উচ্চতর পড়াশোনা আছে তার। প্রাদেশিক ও জাতীয় নেতা হিসেবে অভিজ্ঞতার পাল্লাও কেকিয়াং-এর ভারি। রাষ্ট্র পরিষদের (মন্ত্রিসভা) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থান বহাল থাকবে, এমনটাই আশা করা হচ্ছে।
৩. লি ঝাংশু: কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে তিনি ২০১২ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ৬৭ বছর বয়সী ঝাংশু যখন স্থায়ী কমিটিতে জায়গা করে নেন, তখন তাকে দেখা হচ্ছিল প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিসেবে। হেবেই অঞ্চলের বাসিন্দা ঝাংশু আশির দশকে পার্শ্ববর্তী কাউন্টির দলীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শি জিনপিং-এর সঙ্গে কাজ করেন। প্রেসিডেন্টের নিজ প্রদেশ শাংক্ষি প্রদেশে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পদে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি। ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হেইলোংজিয়াং-এর গভর্নর ও পরের দুই বছর গুইঝো প্রদেশের দলীয় সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওর আমলে কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ কার্যালয়ের পরিচালকের পদ থেকে লিং জিহুয়াকে ২০১২ সালে সরে যেতে হয়। তখন সেখানে নির্বাহী উপ-পরিচালক হিসেবে লি ঝাংশুকে বেইজিং-এ নিয়ে আসে দল। এক মাস পরেই তিনি পরিচালকের দায়িত্ব পান।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। দেশের অভ্যন্তরে সকল পরিদর্শন সফর ও বিদেশ সফরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন তিনি। এমনকি প্রেসিডেন্টের পক্ষেও তিনি একাধিক বিদেশ সফর করেন। ২০১৮ সালের মার্চে দলীয় বিভিন্ন পদে রদবদল হবে। তখন তিনি ন্যাশনাল পিপল’স কংগ্রেস স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে ঝাং দেইজাং-এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন।
৪. ওয়াং ইয়াংঃ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওয়াং ইয়াং দায়িত্ব পালন করছেন ২০১৩ সালের মার্চ থেকে। ২০০৭ সালের অক্টোবর থেকে তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য। ৬২ বছর বয়সী ইয়াং এবার অবশেষে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। ২০১২ সাল থেকেই তার স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা ছিল। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা ওয়াং চীনা রাজনীতিতে উপরে উঠেছেন নিজের যোগ্যতা দিয়ে। আনহুই প্রদেশের টংলিং শহরের মেয়র হিসেবে ১৯৮৮ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ওয়াং বিভিন্ন খাতে সাহসী সংস্কার নিয়ে আসেন। তাকে একজন সংস্কারবাদী হিসেবে দেখা হয় দলে। প্রাদেশিক ও জাতীয় নেতা হিসেবে তার অভিজ্ঞতার পাল্লা ব্যাপক। আনহুই প্রদেশের ভাইস গভর্নর, চোংকিং ও গুয়াংডং প্রদেশের দলীয় সম্পাদক ছিলেন তিনি। রাষ্ট্র পরিষদে (মন্ত্রিসভা) উপ-মহাসচিব ছিলেন একসময়। এখন আছেন উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। আগামী বছরের মার্চে তিনি চাইনিজ পিপল’স পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের চেয়ারম্যান হিসেবে ইয়ু ঝেংশেং-এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন।
৫. ওয়াং হানিং: কেন্দ্রীয় পলিসি রিসার্চ কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে তিনি ২০০২ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সাল থেকে পলিটব্যুরোর সদস্য। এবারই তিনি স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। শিক্ষাবিদ থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ওয়াং হানিং-এর বয়স ৬২। আশির দশকের পর থেকে দলের আদর্শিক উন্নয়নে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। ‘নব কর্তৃত্ববাদ’ নামে একটি বইয়ের লেখক তিনি। চীনের মতো দেশে কেন্দ্রীভূত রাজনীতির যৌক্তিকতা তিনি সেখানে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তিন দলীয় সম্পাদক তথা প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন, হু জিনতাও ও শি জিনপিং-এর অধীনে কাজ করেছেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টদের বৈদেশিক সফরে সঙ্গী ছিলেন। কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি লিউ ইউনশানের জায়গায় আসতে পারেন। এছাড়া থাকবেন পদাধিকারবলে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সচিবালয়ের দায়িত্বে। মূলত, সরকারি প্রচার ও কর্মী সংক্রান্ত ইস্যুই তার দায়িত্বে থাকবে। বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট লি ইয়ুয়ানচাও-এর স্থলে ২০১৮ সালের মার্চে সম্ভাব্য যে ৫ জনের একজন দায়িত্ব পাবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে, তার মধ্যে তিনি একজন।
৬. ঝাও লেজি: কেন্দ্রীয় সংগঠন বিভাগের পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্বে আছেন ২০১২ সাল থেকে। ৬০ বছর বয়সী লেজিও স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য। তার পিতা-মাতা শাংক্ষি প্রদেশের বাসিন্দা হলেও লেজির জন্ম ও বেড়ে ওঠা কিংঘাই প্রদেশে। ১৯৭৫ সালে ১৮ বছর বয়সে দলে যোগদান করেন তিনি। দুই বছর পর তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি তখন ছিলেন একাধারে শ্রমিক, কিষাণ, সৈন্য ও ছাত্র। পরে সফলতার সিঁড়িতে তরতর করে উপরের দিকে উঠতে থাকেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তিনি হয়ে যান চীনের নবীনতম গভর্নর। অর্থাৎ ৪২ বছর বয়সে তিনি ছিলেন কিংঘাই প্রদেশের গভর্নর। ৪ বছর পর একই প্রদেশের দলীয় সম্পাদক হন তিনি। তিনি ছিলেন তখন চীনের সবচেয়ে কমবয়সী দলীয় প্রাদেশিক সম্পাদক।
দলের কোন অংশের প্রতি তার আনুগত্য তা নিয়ে স্পষ্টতা নেই। তবে তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় সংগঠন বিভাগের নির্বাহী উপ-পরিচালক ও নিজের সহপাঠী চেন শির সঙ্গে কাজ করেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে তাদের কাজ ছিল সংগঠনের বিভিন্ন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রেসিডেন্টের অনুগতদের বসানো। কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা পরিদর্শন কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি ওয়াং কিশানের স্থলাভিষিক্ত হবেন। এছাড়া আগামী বছরের মার্চে তিনি একটি নতুন জাতীয় সুপারভাইজরি কমিশনেরও প্রধান হতে পারেন তিনি।
৭. হ্যান ঝেং: ২০১২ সাল থেকে তিনি সাংহাই প্রদেশের দলীয় সম্পাদক। ৬৩ বছর বয়সী হ্যান ১৯ তম স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য। ১৯৮৯ সালের পর থেকে এ নিয়ে সাংহাই-এর সাত জন দলীয় সম্পাদক দলের স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেলেন। ঝেনজিয়াং প্রদেশ তার পূর্বপুরুষের আবাসস্থল। তবে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সাংহাই-এ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত প্রশিক্ষণ নেই তার। দলের সাংহাই শাখায় তার পদোন্নতি ছিল মূলত দলের যুব শাখার মাধ্যমে। তিনি সরাসরি অনেক প্রাদেশিক দলীয় সম্পাদকের অধীনে কাজ করেছেন। ১৯৪৯ সালের পর সাংহাই-এর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সাংহাই শহরের মেয়র হিসেবে ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। চীনের বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল সাংহাই শহরের মেয়র থাকাকালে তিনি প্রায়ই তৎকালীন দলীয় প্রধানদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন। সাংহাই এ ব্যাপক প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকায় আগামী মার্চের রদবদলে হ্যানকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারে।
উল্লেখ্য, কম্যুনিস্ট পার্টি যদি ‘৬৮-এর নিয়ম’ অনুসরণ করে (অর্থাৎ ৬৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নেতাদের স্থায়ী কমিটি থেকে অবসর নিতে হবে। ৬৭ বা তার চেয়ে কম বয়সীরা থাকতে পারে), তাহলে ২০২২ সালে আগামী দলীয় কংগ্রেসে শি জিনপিং, লি ঝাংশু ও হ্যান ঝেংকে অবসর নিতে হবে। সেক্ষেত্রে লি কেকিয়াং, ওয়াং ইয়াং, ঝাও লেজি ও ওয়াং হানিং আরো ৫ বছর মেয়াদে স্থায়ী কমিটিতে থেকে যেতে পারেন। কিন্তু এ-ও মনে রাখা প্রয়োজন, দলীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শি জিনপিং এই নিয়মের ব্যতিক্রমও থাকতে পারেন। যদিও সাধারণ নিয়ম হলো দলীয় সাধারণ সম্পাদক দুই মেয়াদের বেশি থাকবেন না। তাই গুঞ্জন আছে চীনে যে শি জিনপিং নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তৃতীয় মেয়াদেও দলের সেক্রেটারি তথা দেশের প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যাবেন। বর্তমান স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্যই ২০তম দলীয় কংগ্রেসে শি জিনপিং-এর উত্তরাধিকারী হওয়ার মতো অল্প বয়সী নন। অর্থাৎ, বর্তমান কমিটিতে প্রেসিডেন্টের কোনো সম্ভাব্য উত্তরসূরি নেই। অন্তত তিন জনের নাম সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও, তাদের কাউকেই স্থায়ী কমিটিতে আনেননি শি জিনপিং।
(অধ্যাপক বো ঝিইয়ু চীনের অভিজাত রাজনীতির বিষয়ে বিশ্বের একজন নেতৃত্বস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। তিনি বো ঝিইয়ু চায়না ইন্সটিটিউট নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট। এই প্রতিষ্ঠান বহু রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহীদের পরামর্শ সেবা দিয়ে থাকে। তার সাম্প্রতিক বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক’ ও ‘শি জিনপিং-এর অধীনে চীনের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি।’ দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তার এই নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
দেখে নেয়া যাক নবগঠিত স্থায়ী কমিটির সাত সদস্যের পরিচিতি, যারা অন্তত আগামী ৫ বছর চীনকে পরিচালনা করবেন।
১. শি জিনপিং: প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং (৬৪) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নতুন স্থায়ী কমিটির এক নম্বর সদস্য। পাশাপাশি দেশের ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় সামরিক কমিটির চেয়ারম্যান। ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান ও পিপল’স লিবারেশন আর্মির সর্বাধিনায়ক শি জিনপিং দলের ১৯তম অধিবেশনে নিজের ক্ষমতা আরো সুসংহত করেছেন। ‘নবযুগে চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্র নিয়ে শি জিনপিং-এর ভাবনা’ শিরোনামে তার ভাবনা দলীয় সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাও সেতুং ভাবনা, দেং শিয়াওপিং তত্ত্ব, (জিয়াং জেমিন-এর) থিওরি অব থ্রি রিপ্রেজেন্টস ও হু জিনতাওর উন্নয়নের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি এখন শি জিনপিং-এর এই ভাবনাও দলের সংবিধানে শোভা পাবে। একে দলের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দলীয় কংগ্রেস চলাকালে প্রেসিডেন্টকে ‘মহান নেতা’, ‘মাঝি’ ও নবযুগে চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্রের রূপকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি চীনকে এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
২. লি কেকিয়াং: প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং (৬২) স্থায়ী কমিটির দ্বিতীয় নেতৃত্বস্থানীয় সদস্য হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। চীনা কম্যুনিস্ট ইয়ুথ লীগের সঙ্গে কেকিয়াং-এর সম্পর্ক বেশ জোরালো। গত ৫ বছরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ছিল দারুণ। প্রেসিডেন্টের ঘরোয়া ও বৈদেশিক নীতির কড়া সমর্থক তিনি। আইন ও অর্থনীতিতে উচ্চতর পড়াশোনা আছে তার। প্রাদেশিক ও জাতীয় নেতা হিসেবে অভিজ্ঞতার পাল্লাও কেকিয়াং-এর ভারি। রাষ্ট্র পরিষদের (মন্ত্রিসভা) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থান বহাল থাকবে, এমনটাই আশা করা হচ্ছে।
৩. লি ঝাংশু: কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে তিনি ২০১২ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ৬৭ বছর বয়সী ঝাংশু যখন স্থায়ী কমিটিতে জায়গা করে নেন, তখন তাকে দেখা হচ্ছিল প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিসেবে। হেবেই অঞ্চলের বাসিন্দা ঝাংশু আশির দশকে পার্শ্ববর্তী কাউন্টির দলীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শি জিনপিং-এর সঙ্গে কাজ করেন। প্রেসিডেন্টের নিজ প্রদেশ শাংক্ষি প্রদেশে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পদে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি। ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হেইলোংজিয়াং-এর গভর্নর ও পরের দুই বছর গুইঝো প্রদেশের দলীয় সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওর আমলে কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ কার্যালয়ের পরিচালকের পদ থেকে লিং জিহুয়াকে ২০১২ সালে সরে যেতে হয়। তখন সেখানে নির্বাহী উপ-পরিচালক হিসেবে লি ঝাংশুকে বেইজিং-এ নিয়ে আসে দল। এক মাস পরেই তিনি পরিচালকের দায়িত্ব পান।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। দেশের অভ্যন্তরে সকল পরিদর্শন সফর ও বিদেশ সফরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন তিনি। এমনকি প্রেসিডেন্টের পক্ষেও তিনি একাধিক বিদেশ সফর করেন। ২০১৮ সালের মার্চে দলীয় বিভিন্ন পদে রদবদল হবে। তখন তিনি ন্যাশনাল পিপল’স কংগ্রেস স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে ঝাং দেইজাং-এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন।
৪. ওয়াং ইয়াংঃ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওয়াং ইয়াং দায়িত্ব পালন করছেন ২০১৩ সালের মার্চ থেকে। ২০০৭ সালের অক্টোবর থেকে তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য। ৬২ বছর বয়সী ইয়াং এবার অবশেষে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। ২০১২ সাল থেকেই তার স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা ছিল। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা ওয়াং চীনা রাজনীতিতে উপরে উঠেছেন নিজের যোগ্যতা দিয়ে। আনহুই প্রদেশের টংলিং শহরের মেয়র হিসেবে ১৯৮৮ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ওয়াং বিভিন্ন খাতে সাহসী সংস্কার নিয়ে আসেন। তাকে একজন সংস্কারবাদী হিসেবে দেখা হয় দলে। প্রাদেশিক ও জাতীয় নেতা হিসেবে তার অভিজ্ঞতার পাল্লা ব্যাপক। আনহুই প্রদেশের ভাইস গভর্নর, চোংকিং ও গুয়াংডং প্রদেশের দলীয় সম্পাদক ছিলেন তিনি। রাষ্ট্র পরিষদে (মন্ত্রিসভা) উপ-মহাসচিব ছিলেন একসময়। এখন আছেন উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। আগামী বছরের মার্চে তিনি চাইনিজ পিপল’স পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের চেয়ারম্যান হিসেবে ইয়ু ঝেংশেং-এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন।
৫. ওয়াং হানিং: কেন্দ্রীয় পলিসি রিসার্চ কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে তিনি ২০০২ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সাল থেকে পলিটব্যুরোর সদস্য। এবারই তিনি স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। শিক্ষাবিদ থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ওয়াং হানিং-এর বয়স ৬২। আশির দশকের পর থেকে দলের আদর্শিক উন্নয়নে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। ‘নব কর্তৃত্ববাদ’ নামে একটি বইয়ের লেখক তিনি। চীনের মতো দেশে কেন্দ্রীভূত রাজনীতির যৌক্তিকতা তিনি সেখানে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তিন দলীয় সম্পাদক তথা প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন, হু জিনতাও ও শি জিনপিং-এর অধীনে কাজ করেছেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টদের বৈদেশিক সফরে সঙ্গী ছিলেন। কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি লিউ ইউনশানের জায়গায় আসতে পারেন। এছাড়া থাকবেন পদাধিকারবলে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সচিবালয়ের দায়িত্বে। মূলত, সরকারি প্রচার ও কর্মী সংক্রান্ত ইস্যুই তার দায়িত্বে থাকবে। বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট লি ইয়ুয়ানচাও-এর স্থলে ২০১৮ সালের মার্চে সম্ভাব্য যে ৫ জনের একজন দায়িত্ব পাবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে, তার মধ্যে তিনি একজন।
৬. ঝাও লেজি: কেন্দ্রীয় সংগঠন বিভাগের পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্বে আছেন ২০১২ সাল থেকে। ৬০ বছর বয়সী লেজিও স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য। তার পিতা-মাতা শাংক্ষি প্রদেশের বাসিন্দা হলেও লেজির জন্ম ও বেড়ে ওঠা কিংঘাই প্রদেশে। ১৯৭৫ সালে ১৮ বছর বয়সে দলে যোগদান করেন তিনি। দুই বছর পর তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি তখন ছিলেন একাধারে শ্রমিক, কিষাণ, সৈন্য ও ছাত্র। পরে সফলতার সিঁড়িতে তরতর করে উপরের দিকে উঠতে থাকেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তিনি হয়ে যান চীনের নবীনতম গভর্নর। অর্থাৎ ৪২ বছর বয়সে তিনি ছিলেন কিংঘাই প্রদেশের গভর্নর। ৪ বছর পর একই প্রদেশের দলীয় সম্পাদক হন তিনি। তিনি ছিলেন তখন চীনের সবচেয়ে কমবয়সী দলীয় প্রাদেশিক সম্পাদক।
দলের কোন অংশের প্রতি তার আনুগত্য তা নিয়ে স্পষ্টতা নেই। তবে তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় সংগঠন বিভাগের নির্বাহী উপ-পরিচালক ও নিজের সহপাঠী চেন শির সঙ্গে কাজ করেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে তাদের কাজ ছিল সংগঠনের বিভিন্ন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রেসিডেন্টের অনুগতদের বসানো। কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা পরিদর্শন কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি ওয়াং কিশানের স্থলাভিষিক্ত হবেন। এছাড়া আগামী বছরের মার্চে তিনি একটি নতুন জাতীয় সুপারভাইজরি কমিশনেরও প্রধান হতে পারেন তিনি।
৭. হ্যান ঝেং: ২০১২ সাল থেকে তিনি সাংহাই প্রদেশের দলীয় সম্পাদক। ৬৩ বছর বয়সী হ্যান ১৯ তম স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য। ১৯৮৯ সালের পর থেকে এ নিয়ে সাংহাই-এর সাত জন দলীয় সম্পাদক দলের স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেলেন। ঝেনজিয়াং প্রদেশ তার পূর্বপুরুষের আবাসস্থল। তবে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সাংহাই-এ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত প্রশিক্ষণ নেই তার। দলের সাংহাই শাখায় তার পদোন্নতি ছিল মূলত দলের যুব শাখার মাধ্যমে। তিনি সরাসরি অনেক প্রাদেশিক দলীয় সম্পাদকের অধীনে কাজ করেছেন। ১৯৪৯ সালের পর সাংহাই-এর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সাংহাই শহরের মেয়র হিসেবে ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। চীনের বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল সাংহাই শহরের মেয়র থাকাকালে তিনি প্রায়ই তৎকালীন দলীয় প্রধানদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন। সাংহাই এ ব্যাপক প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকায় আগামী মার্চের রদবদলে হ্যানকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারে।
উল্লেখ্য, কম্যুনিস্ট পার্টি যদি ‘৬৮-এর নিয়ম’ অনুসরণ করে (অর্থাৎ ৬৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নেতাদের স্থায়ী কমিটি থেকে অবসর নিতে হবে। ৬৭ বা তার চেয়ে কম বয়সীরা থাকতে পারে), তাহলে ২০২২ সালে আগামী দলীয় কংগ্রেসে শি জিনপিং, লি ঝাংশু ও হ্যান ঝেংকে অবসর নিতে হবে। সেক্ষেত্রে লি কেকিয়াং, ওয়াং ইয়াং, ঝাও লেজি ও ওয়াং হানিং আরো ৫ বছর মেয়াদে স্থায়ী কমিটিতে থেকে যেতে পারেন। কিন্তু এ-ও মনে রাখা প্রয়োজন, দলীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শি জিনপিং এই নিয়মের ব্যতিক্রমও থাকতে পারেন। যদিও সাধারণ নিয়ম হলো দলীয় সাধারণ সম্পাদক দুই মেয়াদের বেশি থাকবেন না। তাই গুঞ্জন আছে চীনে যে শি জিনপিং নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তৃতীয় মেয়াদেও দলের সেক্রেটারি তথা দেশের প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যাবেন। বর্তমান স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্যই ২০তম দলীয় কংগ্রেসে শি জিনপিং-এর উত্তরাধিকারী হওয়ার মতো অল্প বয়সী নন। অর্থাৎ, বর্তমান কমিটিতে প্রেসিডেন্টের কোনো সম্ভাব্য উত্তরসূরি নেই। অন্তত তিন জনের নাম সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও, তাদের কাউকেই স্থায়ী কমিটিতে আনেননি শি জিনপিং।
(অধ্যাপক বো ঝিইয়ু চীনের অভিজাত রাজনীতির বিষয়ে বিশ্বের একজন নেতৃত্বস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। তিনি বো ঝিইয়ু চায়না ইন্সটিটিউট নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট। এই প্রতিষ্ঠান বহু রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং বহুজাতিক কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহীদের পরামর্শ সেবা দিয়ে থাকে। তার সাম্প্রতিক বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক’ ও ‘শি জিনপিং-এর অধীনে চীনের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি।’ দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তার এই নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
No comments