রোহিঙ্গাদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক দাতাদের দ্বিধা by রিফাত আহমাদ
মিয়ানমারের
রাখাইনে পূর্বে রোহিঙ্গা মুসলিমদের দখলে থাকা জমি বিভাজন (রি-জোন) ও
পুনর্বণ্টনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারি কর্মকর্তারা। তাদের এই পদক্ষেপ সরকারের
রোহিঙ্গা পুনর্বাসন পরিকল্পনার পথে বাধা। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মিয়ানমার
সরকারের ভেতর রোহিঙ্গা পুনর্বাসন পরিকল্পনার পুরোপুরি সমর্থন নেই।
গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনে প্রায় ৩০০ গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইনকে পুনরায় সাজাতে এর মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হবে।
রাখাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিন মাওং সুয়ি নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে এ বিষয়ে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সরকারি বিভাগগুলো রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের পরিত্যক্ত জমি বনায়ন, কৃষি ও নতুন গ্রাম গড়ার জন্যে ব্যবহার করবে। রাখাইন ও অন্যান্য অঞ্চলে শিবির তৈরি করবে সরকার। তবে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরত যেতে দেয়া হবে না। সরকারি সমীক্ষণকারীরা রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের মানচিত্র নতুন করে আঁকছে। সুয়ি জানান, এ প্রক্রিয়া শেষ হতে আরো কয়েক মাস লাগবে। তিনি বলেন, আমাদের জিএডি জমি সম্বন্ধীয় তথ্য সংগ্রহ করবে। এটা একটা জাতীয় পরিকল্পনা। এ প্রক্রিয়া অনুসারে, এই ভূখণ্ডকে গ্রাম, ধান ক্ষেত, বন ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হবে। আমরা আপাতত নতুন মানচিত্র তৈরির জন্য জরিপ চালিয়ে যাচ্ছি। এই জরিপ, জমিগুলোর ব্যবহার মালিকানার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। তিনি জানান, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন এসব জমিতে করা হতে পারে। তাদের হয়তো এখানে চাষ করতেও দেয়া হতে পারে। তবে তাদের এসব জমির মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, এসব তাদের জমি নয়। তারা এই জমির আসল মালিক নন। আসল মালিক হচ্ছে এই দেশ। আমাদের পূর্বপুরুষরা। আমরা কখনোই এসব জমি বিলিয়ে দেবো না। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু অবশ্যই তা কিভাবে করা হবে সেসব আমাদের জাতীয় নীতিমালার ওপর নির্ভর করে। সুয়ির মন্তব্য ও মিয়ানমারের প্রভাবশালী সেনাপ্রধান জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের মন্তব্যের মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। তাদের উভয়ের মন্তব্য অনুসারে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে থাকার অধিকার নেই। কিন্তু অন্যদিকে বেসামরিক সরকার তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তাদের নিজের জমি ও বাড়ি ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সরকারের দুই পক্ষের এই দুই ধরনের মনোভাব ও পরিকল্পনা প্রকট আকারে বিভ্রান্তিকর।
সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী উইন মেয়াত আয়ে বলেন, মিয়ানমারের আইনানুসারে, কোনো পুড়ে যাওয়া জমি সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে চলে যায়। পরবর্তীতে অক্টোবরে নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা চাইলে তাদের নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবেন। মধ্য-অক্টোবরে দেশটির কার্যত নেত্রী, স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি বলেন, তিনি রাখাইনের পুনর্নির্মাণ ও রোহিঙ্গাদের ফিরে আসার বিষয়টি দেখাশোনার জন্য একটি মিশ্র সংগঠন গঠন করেছেন। অন্যদিকে, সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে সামরিক জান্তা-চালিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রাখাইনে আদর্শ গ্রাম (মডেল ভিলেজ) নির্মাণের কথা বলছেন। ত্রাণ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এই আদর্শ গ্রাম হতে পারে সম্ভাব্য স্থায়ী শিবির। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পলায়ন থামাতে ও মিয়ানমারে তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা নিয়ে ২৪শে অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে এক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে ওই চুক্তিতে তাদের বসতি স্থাপন ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। রাখাইন রাজ্যের উন্নয়ন বিষয়ক কর্মকাণ্ডে পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োজিত এক জাতিসংঘ কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, এটি আমাদের ভীতিকে আরো বাড়িয়েই দিচ্ছে। হয়তো গুটিকয়েক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তাদের হয়তো নামমাত্র ‘পটেমকিনে’ (ভুয়া গ্রাম) থাকার ব্যবস্থা করা হবে। আর এতেই শেষ।
রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলছে। এর পেছনে বেশকিছু কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। সমপ্রতি রাখাইনের আঞ্চলিক সরকার রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া জমি, গৃহপালিত পশু ও চাষ করা ফসলাদি সম্পর্কে যে ঘোষণা দিয়েছে সেটি ওইসব প্রভাবকের একটি। আঞ্চলিক সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, তারা রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া গবাদিপশু বিক্রি করে দেবে; তাদের বুনে যাওয়া ধান ও অন্যান্য ফসল কেটে সরকারি গুদামে মজুদ করবে ও স্থানীয়দের মধ্যে (যাদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ) বিলিয়ে দেবে। এসবের চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাখাইনের পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা প্রদান করা নিয়ে তৈরি হওয়া সংশয়। একটি দাতা দেশের এক কূটনীতিক বলেন, তাদের উন্নয়নে সহায়তা করাটা অনেকটা জাতি নিধনের জন্য পুরস্কার দেয়ার মতো হয়ে যায়। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাখাইনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও শরণার্থীদের ফেরত যাওয়া নিয়ে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নির্যাতন চালানোর প্রতিবেদন ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পলায়ন বিশ্বের শীর্ষ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও দাতা দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের গভীর বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে মিয়ানয়ারকে দেয়া ত্রাণ সহায়তা ও ঋণের বিষয়। উদাহরণ হিসেবে বিশ্ব ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডকে ধরা যায়। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারকে সহায়তা প্রদান প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে ২০ কোটি ডলারের এক বাজেট আগস্টে চূড়ান্ত করে বিশ্ব ব্যাংক। পাশাপাশি রাখাইনে জরুরি সহায়তা প্রোগ্রামের জন্যও একটি প্রস্তাব রাখা হয়। তবে বর্তমানে ওই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে উল্লিখিত উভয় প্রোগ্রামের প্রস্তাবই বাতিল করে দেয়া নিয়ে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। অং সান সুচি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর ও কার্যত নেত্রীর দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও দাতা প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলো মিয়ানমারের আধা-গণতান্ত্রিক সিস্টেমে সামরিক জান্তাদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। দাতা সংস্থাগুলোর কাছে এখন মুখ্য চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তাদের সহায়তা সামরিক জান্তাদের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হবে কি না! এছাড়া রাখাইনে পাঠানো কোনো সহায়তা সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কাও রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বিভিন্ন পশ্চিমা ও মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যে আহ্বান জানাচ্ছে তা এই বিতর্ক আরো উস্কে দিচ্ছে। এইরকম কোনো নিষেধাজ্ঞা রাখাইনে সহায়তা প্রদানের বিষয়টি শুধু জটিলই করে তুলবে না, পাশাপাশি মিয়ানমারে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও কঠিন করে তুলবে। কেননা, মাত্র এক বছর আগেই দেশটির সামরিক জান্তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক আইন সংস্থা ফিলসবুরি শ পিটম্যানের সঙ্গে কাজ করা বাণিজ্য বিষয়ক অ্যাটর্নি ও নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ এরন হুটম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেখাচ্ছে যে মিয়ানমারের ব্যবহারের জন্য তাদের ঝুলিতে শাস্তি ও পুরস্কার উভয়ই আছে। কিন্তু তারা মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করা ছাড়া সেখানকার সামরিক নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ও রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, মার্কিন কর্মকর্তারা কি ব্যবস্থা নিবেন তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সম্ভবত তারা সামরিক নেতাদের ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। যেমন, ভিসা সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা। এতে করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মানবিক সহায়তার প্রক্রিয়াও এগিয়ে নেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণলায়ের কর্মকর্তাদের দেখা যাচ্ছে, তারা সরকারের পরিকল্পিত ব্যবস্থাগুলো নিয়ে কথা বলছেন। তাদের এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একই সঙ্গে জনগণকে মানবিক সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা ও এটাও পরীক্ষা করে দেখা যে, এসব নিষেধাজ্ঞার হুমকি সামরিক বাহিনীর আচরণে কোনো পরিবর্তন আনে কিনা।
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন থামাতে ও তাদের নিরাপদভাবে ফিরিয়ে আনতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য এবং এই সংকটের সমাধান করতে আরো জোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য এ সপ্তাহে বৃটেন ও ফ্রান্স জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে চীন এখনো নীরব ভূমিকা পালন করছে। তাই সন্দেহ থেকে যায়, নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও, চীন তার সমর্থন করবে কি-না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা ও অন্যান্য প্রভাবশালী দেশগুলোকে সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাপ দিবে। জাতিসংঘের ব্ল্যাকলিস্টকে টেনে হুটম্যান বলেন, যদি বহুপাক্ষিক না-ও হয় তাহলে আমরা সম্ভবত একপাক্ষিক ইউএস এসডিএন-এর প্রয়োগ দেখবো। উল্লেখ্য, ব্ল্যাকলিস্ট কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্বত্বার ওপর অবরোধ আরোপ করে আসছে। ওই তালিকায় যোগ হওয়া ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখা নিষিদ্ধ।
(নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুবাদ।)
গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনে প্রায় ৩০০ গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইনকে পুনরায় সাজাতে এর মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হবে।
রাখাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিন মাওং সুয়ি নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে এ বিষয়ে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সরকারি বিভাগগুলো রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের পরিত্যক্ত জমি বনায়ন, কৃষি ও নতুন গ্রাম গড়ার জন্যে ব্যবহার করবে। রাখাইন ও অন্যান্য অঞ্চলে শিবির তৈরি করবে সরকার। তবে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরত যেতে দেয়া হবে না। সরকারি সমীক্ষণকারীরা রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের মানচিত্র নতুন করে আঁকছে। সুয়ি জানান, এ প্রক্রিয়া শেষ হতে আরো কয়েক মাস লাগবে। তিনি বলেন, আমাদের জিএডি জমি সম্বন্ধীয় তথ্য সংগ্রহ করবে। এটা একটা জাতীয় পরিকল্পনা। এ প্রক্রিয়া অনুসারে, এই ভূখণ্ডকে গ্রাম, ধান ক্ষেত, বন ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হবে। আমরা আপাতত নতুন মানচিত্র তৈরির জন্য জরিপ চালিয়ে যাচ্ছি। এই জরিপ, জমিগুলোর ব্যবহার মালিকানার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। তিনি জানান, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন এসব জমিতে করা হতে পারে। তাদের হয়তো এখানে চাষ করতেও দেয়া হতে পারে। তবে তাদের এসব জমির মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, এসব তাদের জমি নয়। তারা এই জমির আসল মালিক নন। আসল মালিক হচ্ছে এই দেশ। আমাদের পূর্বপুরুষরা। আমরা কখনোই এসব জমি বিলিয়ে দেবো না। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু অবশ্যই তা কিভাবে করা হবে সেসব আমাদের জাতীয় নীতিমালার ওপর নির্ভর করে। সুয়ির মন্তব্য ও মিয়ানমারের প্রভাবশালী সেনাপ্রধান জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের মন্তব্যের মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। তাদের উভয়ের মন্তব্য অনুসারে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে থাকার অধিকার নেই। কিন্তু অন্যদিকে বেসামরিক সরকার তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তাদের নিজের জমি ও বাড়ি ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সরকারের দুই পক্ষের এই দুই ধরনের মনোভাব ও পরিকল্পনা প্রকট আকারে বিভ্রান্তিকর।
সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী উইন মেয়াত আয়ে বলেন, মিয়ানমারের আইনানুসারে, কোনো পুড়ে যাওয়া জমি সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে চলে যায়। পরবর্তীতে অক্টোবরে নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা চাইলে তাদের নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবেন। মধ্য-অক্টোবরে দেশটির কার্যত নেত্রী, স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি বলেন, তিনি রাখাইনের পুনর্নির্মাণ ও রোহিঙ্গাদের ফিরে আসার বিষয়টি দেখাশোনার জন্য একটি মিশ্র সংগঠন গঠন করেছেন। অন্যদিকে, সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে সামরিক জান্তা-চালিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রাখাইনে আদর্শ গ্রাম (মডেল ভিলেজ) নির্মাণের কথা বলছেন। ত্রাণ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এই আদর্শ গ্রাম হতে পারে সম্ভাব্য স্থায়ী শিবির। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পলায়ন থামাতে ও মিয়ানমারে তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা নিয়ে ২৪শে অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে এক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে ওই চুক্তিতে তাদের বসতি স্থাপন ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। রাখাইন রাজ্যের উন্নয়ন বিষয়ক কর্মকাণ্ডে পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োজিত এক জাতিসংঘ কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, এটি আমাদের ভীতিকে আরো বাড়িয়েই দিচ্ছে। হয়তো গুটিকয়েক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তাদের হয়তো নামমাত্র ‘পটেমকিনে’ (ভুয়া গ্রাম) থাকার ব্যবস্থা করা হবে। আর এতেই শেষ।
রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলছে। এর পেছনে বেশকিছু কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। সমপ্রতি রাখাইনের আঞ্চলিক সরকার রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া জমি, গৃহপালিত পশু ও চাষ করা ফসলাদি সম্পর্কে যে ঘোষণা দিয়েছে সেটি ওইসব প্রভাবকের একটি। আঞ্চলিক সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, তারা রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া গবাদিপশু বিক্রি করে দেবে; তাদের বুনে যাওয়া ধান ও অন্যান্য ফসল কেটে সরকারি গুদামে মজুদ করবে ও স্থানীয়দের মধ্যে (যাদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ) বিলিয়ে দেবে। এসবের চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাখাইনের পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা প্রদান করা নিয়ে তৈরি হওয়া সংশয়। একটি দাতা দেশের এক কূটনীতিক বলেন, তাদের উন্নয়নে সহায়তা করাটা অনেকটা জাতি নিধনের জন্য পুরস্কার দেয়ার মতো হয়ে যায়। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাখাইনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও শরণার্থীদের ফেরত যাওয়া নিয়ে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নির্যাতন চালানোর প্রতিবেদন ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পলায়ন বিশ্বের শীর্ষ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও দাতা দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের গভীর বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে মিয়ানয়ারকে দেয়া ত্রাণ সহায়তা ও ঋণের বিষয়। উদাহরণ হিসেবে বিশ্ব ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডকে ধরা যায়। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারকে সহায়তা প্রদান প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে ২০ কোটি ডলারের এক বাজেট আগস্টে চূড়ান্ত করে বিশ্ব ব্যাংক। পাশাপাশি রাখাইনে জরুরি সহায়তা প্রোগ্রামের জন্যও একটি প্রস্তাব রাখা হয়। তবে বর্তমানে ওই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে উল্লিখিত উভয় প্রোগ্রামের প্রস্তাবই বাতিল করে দেয়া নিয়ে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। অং সান সুচি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর ও কার্যত নেত্রীর দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও দাতা প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলো মিয়ানমারের আধা-গণতান্ত্রিক সিস্টেমে সামরিক জান্তাদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। দাতা সংস্থাগুলোর কাছে এখন মুখ্য চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তাদের সহায়তা সামরিক জান্তাদের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হবে কি না! এছাড়া রাখাইনে পাঠানো কোনো সহায়তা সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কাও রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বিভিন্ন পশ্চিমা ও মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যে আহ্বান জানাচ্ছে তা এই বিতর্ক আরো উস্কে দিচ্ছে। এইরকম কোনো নিষেধাজ্ঞা রাখাইনে সহায়তা প্রদানের বিষয়টি শুধু জটিলই করে তুলবে না, পাশাপাশি মিয়ানমারে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও কঠিন করে তুলবে। কেননা, মাত্র এক বছর আগেই দেশটির সামরিক জান্তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক আইন সংস্থা ফিলসবুরি শ পিটম্যানের সঙ্গে কাজ করা বাণিজ্য বিষয়ক অ্যাটর্নি ও নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ এরন হুটম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেখাচ্ছে যে মিয়ানমারের ব্যবহারের জন্য তাদের ঝুলিতে শাস্তি ও পুরস্কার উভয়ই আছে। কিন্তু তারা মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করা ছাড়া সেখানকার সামরিক নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ও রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, মার্কিন কর্মকর্তারা কি ব্যবস্থা নিবেন তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সম্ভবত তারা সামরিক নেতাদের ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। যেমন, ভিসা সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা। এতে করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মানবিক সহায়তার প্রক্রিয়াও এগিয়ে নেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণলায়ের কর্মকর্তাদের দেখা যাচ্ছে, তারা সরকারের পরিকল্পিত ব্যবস্থাগুলো নিয়ে কথা বলছেন। তাদের এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একই সঙ্গে জনগণকে মানবিক সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা ও এটাও পরীক্ষা করে দেখা যে, এসব নিষেধাজ্ঞার হুমকি সামরিক বাহিনীর আচরণে কোনো পরিবর্তন আনে কিনা।
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন থামাতে ও তাদের নিরাপদভাবে ফিরিয়ে আনতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য এবং এই সংকটের সমাধান করতে আরো জোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য এ সপ্তাহে বৃটেন ও ফ্রান্স জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে চীন এখনো নীরব ভূমিকা পালন করছে। তাই সন্দেহ থেকে যায়, নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও, চীন তার সমর্থন করবে কি-না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা ও অন্যান্য প্রভাবশালী দেশগুলোকে সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাপ দিবে। জাতিসংঘের ব্ল্যাকলিস্টকে টেনে হুটম্যান বলেন, যদি বহুপাক্ষিক না-ও হয় তাহলে আমরা সম্ভবত একপাক্ষিক ইউএস এসডিএন-এর প্রয়োগ দেখবো। উল্লেখ্য, ব্ল্যাকলিস্ট কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্বত্বার ওপর অবরোধ আরোপ করে আসছে। ওই তালিকায় যোগ হওয়া ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখা নিষিদ্ধ।
(নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুবাদ।)
No comments