ট্রাম্পের মুয়েলার পরীক্ষা

নিজের নির্বাচনী প্রচার শিবিরের সাবেক চেয়ারম্যান পল ম্যানাপোর্ট যখন সোমবার এফবিআই অফিসে আত্মসমর্পণ করতে ঢুকলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তখন হামলে পড়লেন টুইটারে। পুরো ঘটনার গুরুত্ব উড়িয়ে দিয়ে তিনি লিখলেন, ‘(রাশিয়ার) সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই।’ ট্রাম্পের এই ছোট টুইট যখন তার ৪ কোটি ১০ লাখ অনুসারীর কাছে পৌঁছালো, তখন বের হলো আরেক বিস্ফোরক খবর। জানা গেল, তারই এক তরুণ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করেছিলেন ট্রাম্প শিবিরের সঙ্গে রাশিয়ানদের  সংযোগ করিয়ে দিতে। এই রাশিয়ানরা ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে সংবেদনশীল তথ্য দেয়ার প্রস্তাবের পরই এই চেষ্টা চালায় ওই তরুণ উপদেষ্টা। মার্কিন শীর্ষ সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণীর শুরুটা ছিল এমনই।
এতে আরো বলা হয়, স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট মুয়েলারের আনা প্রথম অভিযোগসমূহে নির্দিষ্ট করে ট্রাম্পের কথা বলা হয়নি।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে, এটি প্রেসিডেন্টের ওপর এক চরম রাজনৈতিক আঘাত। মাসকয়েক ধরে তিনি বলে আসছেন, মুয়েলারের তদন্ত প্রকৃতপক্ষে ডেমোক্রেট আর গণমাধ্যমের উদ্ভাবিত এক ‘বানোয়াট তথ্যে’র ভিত্তিতে রচিত ‘প্রতিহিংসা চরিতার্থ’ করা বৈ কিছু নয়। কিন্তু মুয়েলার প্রমাণ করলেন, পুরো অভিযোগের সারবত্তা রয়েছে।
পল ম্যানাপোর্টের বিরুদ্ধে গঠিত অভিযোগের নথিপত্র থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, প্রেসিডেন্টের প্রাক্তন এই প্রধান সহযোগী গত বছরও কয়েক মাস ধরে রাশিয়ার স্বার্থপন্থি গোষ্ঠীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। অপরদিকে ট্রাম্পের তরুণ পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা জর্জ পাপাডোপৌলোসের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ট্রাম্প শিবির থেকে অন্তত দুই জন হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে স্পর্শকাতর তথ্য পেতে মস্কোর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এর আগে প্রেসিডেন্টের পুত্র ট্রাম্প জুনিয়রও এক রাশিয়ান আইনজীবীর সঙ্গে এই একই উদ্দেশে বৈঠক করেছিলেন।
মুয়েলারের এই পদক্ষেপের কারণে প্রেসিডেন্টের জন্য তদন্ত নতুন এক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সপ্তাহে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ, কর-হ্রাসের আইন প্রণয়ন ও শিগগির শুরু হতে যাওয়া ১২ দিনব্যাপী এশিয়া সফরের ওপর মনোনিবেশ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি এত গুরুতর যে, সেসব ইস্যুতে তিনি তেমন সময়ই দিতে পারবেন না।
কুখ্যাত ইরান-কন্ট্রা অস্ত্রপাচার কেলেঙ্কারি তদন্তে স্বতন্ত্র সহযোগী আইনি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জন কিউ. ব্যারেট এ নিয়ে বলেছেন, ‘দিনটি নিশ্চিতভাবেই বেশ ঘটনাবহুল। অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে।’
এদিকে হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরে সোমবার সকাল থেকেই পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত গুরুগম্ভীর। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর এই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্টের প্রাক্তন নির্বাচনী প্রচার প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা স্বস্তিতে ছিলেন। কারণ, ম্যানাপোর্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হতে পারে, এমনটা তাদের অনুমেয়ই ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও প্রস্তুত ছিলেন। টুইটে লিখেন, যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো পল ম্যানাপোর্ট তার প্রচার শিবিরের দায়িত্ব নেয়ার আগেই ঘটেছে। কিন্তু তাদের এই সাময়িক স্বস্তি দুশ্চিন্তায় রূপ নিতে সময় নেয়নি।
কারণ, এরপরই পাপাডোপৌলোসের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার খবর হোয়াইট হাউসকে রীতিমতো স্তব্ধ করে দেয়। এরপর থেকে ট্রাম্প সারা দিন আর কিছুই প্রকাশ্যে বলেননি, যেটি তার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বেশ বেমানান। এরপর তার উপদেষ্টারাই পরিস্থিতি সামলানোর কাজে নেমে পড়েন। তারা যুক্তি দেখান যে, ম্যানাপোর্ট যা করেছেন, তার সঙ্গে ট্রাম্প শিবিরের কোনো সংশ্রব ছিল না। পাপাডোপৌলোসের ব্যাপারে তারা বলেন, তিনি অত বড় কোনো পদে ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্রেফ একজন স্বেচ্ছাসেবী। ট্রাম্প সহযোগীদের আরো যুক্তি হলো, পাপাডোপৌলোস যেসব বৈঠক আয়োজনের চেষ্টা করেছেন, তা সফল হয়নি। তাছাড়া তিনি এফবিআই’র কাছে মিথ্যে সাক্ষী দেয়ার অভিযোগে দোষ স্বীকার করেছেন। প্রচার শিবিরের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই।
হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারি সারাহ হাকাবি স্যান্ডার্স বলেন, ‘আজকে যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তদন্ত দলের পক্ষ থেকে, তার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের, তার নির্বাচনী শিবির বা কর্মকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা প্রথম দিন থেকে দেখেছি যে, ট্রাম্প ও রাশিয়ার যোগসূত্রের কোনো প্রমাণ নেই। আজকে অভিযোগ গঠনের যে খবর বেরিয়েছে তাতেও কিছুই প্রমাণ হয়নি।’
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী জ্যা সেকুলো বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বা তার আইনি দল এসব নিয়ে চিন্তিত নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত, যেমনটা আমি শুরু থেকে ছিলাম। রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের কোনো অযাচিত যোগাযোগ ছিল না। বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার কোনো চেষ্টা হয়নি। আমি বা কেউই এ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই।’
কিন্তু অন্য আইনজীবী ও সাবেক কৌঁসুলিরা বলছেন, পাপাডোপৌলোসের স্বীকারোক্তি ও ডনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রের বৈঠকের কারণে এসব অগ্রাহ্যতার কোনো মূল্য নেই। জন কিউ. ব্যারেট বলেন, ‘পাপাডোপৌলোস যা করেছেন সেটাই তো যোগাযোগ। ট্রাম্প জুনিয়র হিলারির ব্যাপারে তথ্য পেতে রাশিয়ান আইনজীবীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সেটাই তো যোগাযোগ।’
স্পেশাল কাউন্সেল মুয়েলার এই অভিযোগ গঠন করায় প্রেসিডেন্টের পক্ষে এই তদন্ত উড়িয়ে দিয়ে ডেমোক্রেটদের দায়ী করা কঠিন হয়ে পড়লো। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে হোয়াইট হাউসের আইনি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রবার্ট এফ. বর বলেন, ‘এ সপ্তাহান্তে মুয়েলারের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে টুইটারে ঝড় তুলেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এখন তার সেসব বলার মতো মুখ নেই। মুয়েলার যেসব অভিযোগ গঠন করেছেন, তা ‘রাজনীতিরও ঊর্ধ্বে।’
কিন্তু পুরো ঘটনার মাত্রা এত বেশি যে ট্রাম্প হয়তো তদন্ত থামিয়ে দিতে উদ্ধত হতে পারেন। যেমন, তিনি হয়তো মুয়েলারকে বরখাস্ত কিংবা ম্যানাপোর্ট সহ অভিযুক্ত অন্যদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করতে পারেন। রক্ষণশীল অ্যাক্টিভিস্টরা সোমবার আওয়াজ তোলেন, মুয়েলারকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয়া উচিত। কারণ, ম্যানাপোর্টের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তা ট্রাম্প শিবিরের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়। অর্থাৎ, এসব মুয়েলারের কর্তৃত্ববহির্ভূত।
প্রেসিডেন্টের খণ্ডকালীন উপদেষ্টা রজার স্টোন জুনিয়র রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যম ডেইলি কলারকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের উচিত হবে না মুয়েলারকে বরখাস্ত করা। কিন্তু তিনি তার উদ্দেশ্য অন্যভাবেও হাসিল করতে পারেন। যেমন- হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ছিলেন, তখন রাশিয়ান এক কোম্পানিকে আমেরিকার ইউরেনিয়াম খাতে জড়িত হতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন প্রেসিডেন্ট।’ মুয়েলার ছিলেন তখন এফবিআই’র পরিচালক। এই তদন্ত শুরু হলে মুয়েলারকে নিয়েও টানাহেঁচড়া শুরু হবে। তখন ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগ তুলে মুয়েলারকে রাশিয়া তদন্ত থেকে পদত্যাগ করতে বলা হবে। রজার স্টোন বলেন, এটিই ট্রাম্পের ‘টিকে থাকার একমাত্র সুযোগ।’
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র হাকাবি স্যান্ডার্স ও ট্রাম্পের আইনজীবী সেকুলো এমন ইঙ্গিত উড়িয়ে দিচ্ছেন যে, ট্রাম্প হয়তো মুয়েলারকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করতে পারেন। স্যান্ডার্স বলেছেন, ‘স্পেশাল কাউন্সেল ইস্যুতে কোনো পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা আমাদের নেই।’ ম্যানাপোর্ট বা তদন্তে অভিযুক্ত অন্যদেরকে ট্রাম্প ক্ষমা করে দিতে পারেন, এমন সম্ভাবনাও তারা দেখছেন না বলে জানান। তবে অতীতে প্রেসিডেন্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ‘তদন্তের সীমা’ অতিক্রম করলে তিনি মুয়েলারকে বরখাস্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করবেন। তিনি প্রকাশ্যে এ-ও বলেছেন যে, নিজের আত্মীয়-স্বজন, সহযোগী এমনকি নিজেকেও ক্ষমা করার ‘সম্পূর্ণ এখতিয়ার’ তার রয়েছে।
এদিকে ডেমোক্রেটরা সোমবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ট্রাম্পের উচিত হবে না মুয়েলারের তদন্ত বাধাগ্রস্ত করা। সিনেটে ডেমোক্রেট দলীয় সর্বোচ্চ নেতা চাক শুমার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট কোনো অবস্থাতেই স্পেশাল কাউন্সেলের তদন্তে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। যদি তিনি করেন, কংগ্রেসকে অবশ্যই দলমতের ঊর্ধ্বে দ্রুততা ও স্পষ্টতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে যাতে তদন্ত অব্যাহত থাকে।’ ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট সিনেটর ডিয়েন ফেইন্সটেইন বলেছেন, অভিযোগ গঠন থেকে প্রমাণ হয় মুয়েলার তার কাজ ঠিকভাবেই করছেন।
এছাড়া মুয়েলার অনেকটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাকে খাটো করে দেখা যাবে না। যেমন- এক নথিতে তার দল পাপাডোপৌলোসকে বর্ণনা করেছে ‘সক্রিয় সহযোগী’ হিসেবে। এটি ট্রাম্প শিবিরের অনেকেরই মাথাব্যথার কারণ হতে যথেষ্ট। কারণ, পাপাডোপৌলোস তিন মাস ধরে কৌঁসুলিদের সঙ্গে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তার বিবৃতি থেকে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার আগে তিনি প্রচার শিবিরের অনেক উপদেষ্টার সঙ্গে আগে পরামর্শ করে নিয়েছিলেন।
সাবেক কৌঁসুলিরা বলছেন, ম্যানাপোর্ট ও তার দীর্ঘদিনের সহযোগী ও ট্রাম্পের উপদেষ্টা রিক গেটসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ এত গুরুতর যে, এটি হয়ে থাকতে পারে তাদের একজনকে বা উভয়কেই তদন্ত দলের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি করানোর চেষ্টা। হোয়াইট হাউসের এক আইনজীবী গত সপ্তাহে বলেছিলেন যে, ম্যানাপোর্ট যদি তদন্ত দলের সঙ্গে কথা না বলেন, তাহলে প্রেসিডেন্টের কোনো ভয় নেই। কিন্তু মুয়েলার ও তার কৌঁসুলি দল দৃশ্যত ম্যানাপোর্টের মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টাই করছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধে শপথ নিয়ে মিথ্যা বলার অভিযোগ তদন্ত চলাকালে ডেপুটি স্বতন্ত্র আইনি উপদেষ্টা ছিলেন সলোমন উইসেনবার্গ। ওই তদন্ত শেষে বিল ক্লিনটনকে প্রতিনিধি পরিষদ অভিশংসিতও করেছিল। উইসেনবার্গ এই ইস্যুতে বলেন, ‘তারা প্রকাণ্ড এক কাজ করে দেখিয়েছে। তারা খুব দ্রুততা, নিষ্ঠুরতা ও কার্যকারিতার সঙ্গে কাজ করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুয়েলারের দল আসলে বার্তা দিচ্ছে যে, আমরা এখানে থাকতে এসেছি, আমাদের সঙ্গে ঝামেলা করার চেষ্টা করো না।’

No comments

Powered by Blogger.