বৈরী আবহাওয়ায় চা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা by ইমাদ উদ দীন
ভরা
মৌসুমে বৈরী আবহাওয়া। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। তাই এবছর আশানুরূপ উৎপাদন নিয়ে
উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় চা শিল্পের লোকজন। এবছর মৌসুম শুরুর দিকে কয়েক সপ্তাহ
অনূকুলে ছিল আবহাওয়া। তাই অনেকটা সম্ভাবনাও ছিল উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা
ছাড়িয়ে যাওয়ার। গেল বছর দেশে চা উৎপাদনে চা শিল্পের ১৩৬ বছরের রের্কড
ভাঙ্গে। এবছর শুরুর দিকে এমন সম্ভাবনা আর স্বপ্ন ও প্রত্যাশায় উৎফুল্ল
ছিলেন চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু হঠাৎ এমন সম্ভাবনায় পড়েছে
ভাটা। কার টানা ভারীবর্ষণ, অতিবৃষ্টি, উচ্চতাপমাত্রা আর মেঘলা আবহাওয়ায়
নানা রোগবালাই আর মশার উপদ্রবের ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে
জানা গেল এমন আবহাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের চা উৎপাদনের অন্যতম অব্জল
মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোতে। চা গাছগুলোতে নতুন পাতা আসছে কম। আর যে
গাছগুলোতে পাতা আসছে তার মানও তেমন ভালো থাকছে না। কারণ মৌসুমের প্রথমদিকে
খরা ও টানা ভারী বর্ষণ হওয়াতে চা গাছগুলো ধকল সামলে উঠার আগেই আবারও একই
আবহাওয়া। তাই দুর্বল হয়ে পড়া চা গাছগুলোতে নতুন পাতা (কুঁড়ি) কম আসায় বাড়ছে
দুশ্চিন্তা। এবছর ভরা মৌসুমে বাগানগুলোতে আশানুরূপ চায়ের পাতা সংগ্রহ
করতে না পারায় এখন অনেকটাই হতাশ মালিক, শ্রমিকসহ এ শিল্পের সংশ্লিষ্টরা।
জেলার বেশ ক’টি চাবাগানের ম্যানেজারদের সঙ্গে আলাপে তারা জানালেন গত বছরের
তুলনায় এবছর এখন পর্যন্ত বাগান গুলোতে প্রায় ১৫%-২০% উৎপাদন পিছিয়ে রয়েছে।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা যাবে কিনা তা নিয়ে তারা
সন্দিহান। তবে সময়ে সঠিক পরিচর্যা আর প্রতিকূল আবহাওয়া কাটিয়ে উঠলে
উৎপাদনের পরিসংখ্যান ধরে রাখা সম্ভব বলে আশাবাদী চা গবেষকরা। এজন্য চা
উৎপাদনের বিরূপ আবহাওয়ায় চা গাছগুলোর সঠিক পরিচর্যা ও আরো অধিক যত্নশীল
হওয়ার পরামর্শ তাদের। তথ্য মতে দেশে ১৬৬ টি চা বাগানের মধ্যে ১৪৫টি
চাবাগানের অবস্থান সিলেটে। এর মধ্যে ৯২টি চা বাগানের অবস্থান মৌলভীবাজারে।
এখনাকার পাহাড়ি টিলা, মাটি, ভৌগলিক অবস্থান আর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায়
অগ্রসর হচ্ছে এ শিল্প। ধরে রাখছে তার ঐতিহ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নানা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিকাশমান এ শিল্পের অগ্রযাত্রা অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। সে
জন্য এ অঞ্চলে চা শিল্পের অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে নানাভাবে প্রাকৃতিক
নির্ভরশীলতা কমানোর তাগিদ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের। বাংলাদেশ চা বোর্ডের
মহাব্যবস্থাপক, চা ব্যবস্থাপনা কোষ (নিউ সমনভাগ চা বাগান) মো. শাহজাহান
আকন্দ বলেন, এ বছর চা উৎপাদনের ভরা মৌসুমে বৈরী আবহাওয়া যথেষ্ট প্রভাব
ফেলবে। তাই কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এমন প্রাকৃতিক দূর্যোগ
আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ফারাক ঘটে। আবহাওয়ার এমন বিবর্তন
আমাদের জন্য আগাম সতর্কবার্তা। তিনি বলেন, নানা কারণে এখন প্রকৃতির বিরূপ
প্রভাব লক্ষ্যণীয়। তাই এই শিল্পের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে অতিপ্রকৃতি
নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আর এজন্য চা বাগানগুলোতে নির্দিষ্ট ছায়াতরু,
পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ, ঝোপ-ঝাড় আর আগাছা
পরিষ্কার রাখা, সময় উপযোগী রুপন ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পানি সেচ ব্যবস্থা,
মৌসুমের শুরুতে পোকামাকড় দমনে প্রতিষেধক ওষধ ছিটানো, পরিমাণ মতো সার ও
বিশেষ কৌশলে চা গাছের গোড়ার যত্ন নেয়াসহ নানা পরামর্শ তার। জানা যায় এখন
চলছে চা পাতা তুলার ভরা মৌসুম। বছরের এই সময়ে চা শ্রমিকরা হাতের মুঠি ভরে
পাতা তুললেও এবছর ভিন্ন দৃশ্য। যে সময়ে একজন শ্রমিকের দৈনিক ৫০ থেকে ৬০
কেজি পাতা তুলার কথা সেখানে একজন শ্রমিক ১৫/২০ কেজির উপরে পাতা তুলতে
পারছেন না। আর অনেক সেকশনে পাতা সংগ্রহের কাজও রয়েছে বন্ধ। জেলার কয়েকটি চা
বাগানের চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানালেন, বাগানে চা গাছগুলোতে
মশা ও লাল মাকড়শা আক্রমণে নতুন পাতা গজাতে পারছে না। তাছাড়া অনেক গাছ কারণ
ছাড়াই পাতা বিবর্ণ হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। তারা জানান, এই সময়ে তাদের নিরিখ ৮৫
টাকা হাজিরার অনুকূলে ২৩ কেজি পাতা তুলার পরও তারা পাতা তুলতেন ৫০ থেকে
৬০ কেজি। অতিরিক্ত উত্তোলিত পাতার জন্য কেজি প্রতি ২-৪ টাকা হারে তারা
দৈনিক দুই থেকে আড়াইশ’ টাকা আয় করেন। কিন্তু এই এ বছর হঠাৎ এমন প্রাকৃতিক
দুর্যোগে এখন তারা দৈনিক হাজিরার পাতাও তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ বিষয়ে
হামিদিয়া চা বাগানের মহাব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন বৃষ্টি ছাড়া
যেমন চা উৎপাদন সম্ভব হয় না তেমনি অতি বৃষ্টিও চায়ের জন্য ক্ষতিকর।
অতিবৃষ্টিতে সেকশনের উপরের মাটি ধুয়ে উর্বরতা কমিয়ে দেয়। তাছাড়াও অতিরিক্ত
তাপমাত্রা ও চায়ের জন্য খুব ক্ষতিকর। তিনি জানান এ বছর বাগানগুলোতে চা
বাগানের মশা ও লাল মাকড়শা উপদ্রব কিছুতেই থামছে না। ওষুধ ছিটিয়েও কোনো
উপকার পাওয়া যাচ্ছে না। চা গাছের পাতা কালচে হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ছে। এ বছর
চা মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি ছিল কম। পওে যে বৃষ্টি পাওয়া গেছে তা
মাত্রারিক্ত। যা উপকারের চেয়ে ক্ষতি আশঙ্কাই বেশি। অতিবৃষ্টি হলে
পানিবদ্ধতায় গাছের বাড়ার ক্ষমতা কমে যায়। আর ২৫-২৮ আর ডিগ্রি তাপমাত্রা হল
চা গাছের জন্য সহনীয়। ২৮ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা হলে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায় এ বছর বেশির ভাগ সময়ে এ অঞ্চলের
তাপমাত্রা ছিল ৩২ থেকে ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়ারস। চলমান জুন মাসে প্রথম
সাপ্তাহে তারা বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছেন ৩৩২ মিলিমিটার আর মে মাসে বৃষ্টি
রেকর্ড করেছিলেন ৩৫৫ মিলিমিটার। এমন বৈরী আবহাওয়ার কারণে বাগানগুলোতে নতুন
চা পাতার (কুড়ি) গজাতে পারেনি। এমন প্রতিকূল আবহাওয়াতে বাংলাদেশ চা গবেষণা
কেন্দ্রেরের পরামর্শ থাকছে বাগানগুলোতে নিয়ম মাফিক পানি নিষ্কাশন ও নিয়মমতো
সঠিক মাত্রায় ওষুধ ব্যবহারের। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে আবহাওয়ার এমন
পরিস্থিতে চা বাগানে চায়ের মশা ও লাল মাকড়সা দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে। লাল
মাকড়সার আক্রমণে গাছের পাতা লালচে হয়ে যায়। তখন পাতা যে পরিমাণ খাদ্য তৈরী
করার কথা তা করতে পাওে না ফলে বন্ধ হয়ে যায় নতুন সুট। আর মশা পাতার সবুজ
অংশ (মেইন্টেনেন্স লিপ) খেয়ে ফেলে। আর এমন প্রতিকূল আবহাওয়ায় বেড়ে চলে মশা
আর পোকা মাকড়ের উপদ্রব। এম আর খান চা বাগানের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম
চৌধুরী জানান, বালিশরা ভেলীতে তার দু’টি চা বাগানে (নন্দ রানী ও এমআরখান)
কোনো কারণ ছাড়াই সুট আসছে না। অনেক সেকশনে মাকড়সা বা মশার উপদ্রব নেই তবুও
সুট নেই। তিনি বলেন, জুড়ী ভ্যালিতে তার অন্য দু’টি বাগানে নতুন পাতা এলেও
ওই বাগান দু’টিতে পাতা না আসায় এ বছর উৎপাদনে লক্ষমাত্রা অর্জন নিয়ে তিনি
উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ টি এস্টেট স্টাফ এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক
আলহাজ্ব মো: জাকারিয়া ও কোষাধ্যক্ষ মো: আমিনুর রহমান বলেন, গেল কয়েক বছর
থেকে দেশে চায়ের উৎপাদন অতীতের রের্কড ভেঙে অগ্রসর হচ্ছে। এটা এ শিল্পের
সঙ্গে জড়িতদের আশান্বিত করে। এবছর হঠাৎ আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে ব্যহত হচ্ছে
চায়ের উৎপাদন। তবে আমাদের প্রত্যাশা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠে এ
বছরও চায়ের উপাদন ভালো হবে।
No comments