দৃশ্যমান হচ্ছে সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক by আলফাজ আনাম
সৌদি
আরব ও ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে যে গোপন যোগাযোগ চলে আসছিল তা এখন
প্রকাশ্য রূপ নিতে যাচ্ছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছেÑ
সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে বিমান যোগাযোগ চালু হচ্ছে। ইসরাইলের এল আল
এয়ারলাইনস সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে ফ্লাইট চালু করার পরিকল্পনা করছে।
এর আগে ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল- সৌদি আরব ও
ইসরাইলের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর লক্ষে বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়ে
আলোচনা চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি আরব দেশের পক্ষ থেকে ইসরাইলের সাথে সরাসরি
টেলিফোন সংযোগ প্রতিষ্ঠা ও বিমান যোগাযোগ স্থাপনের প্রস্তাবও ছিল। এসব
উদ্যোগের মাধ্যমে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক
স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে।
মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট্র ট্রাম্পের সৌদি আরব ও ইসরাইল সফরের পর দুই দেশের
সম্পর্ক জোরদারের এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ট্রাম্পের উপদেষ্টা ও ইহুদি জামাই
জ্যারেড কুশনার এবং সৌদি ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের
মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের সময় দুইজন ইসরাইলের
সাথে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নত করা ও ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে আলাদাভাবে
আলোচনা করেন। ধারনা করা হচ্ছে- হামাসের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার জন্য
কাতারের ওপর সৌদি আরব যেভাবে চাপ সৃষ্টি করছে তার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে-
ইসরাইলের আস্থা অর্জন করা।
নিউজ
উইককে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা সম্প্রতি বলেছেন, ইসরাইলের
সাথে সন্ত্রাস দমন ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মতবিনিময় বা
অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ আছে। ইসরাইলের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর এ যোগাযোগের
অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে- সংযুক্ত আরব আমিরাত। দুবাইয়ে ইসরাইলের একটি কূটনৈতিক
অফিসের মাধ্যমে আরব দেশগুলোর লিয়াজোঁ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখন ইসরাইলের
সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর এই যোগাযোগ প্রকাশ্য রূপ নেয়ার জন্য ব্যবসায়,
বাণিজ্য ও গণমাধ্যমকে কাজে লাগানো হবে। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের তাৎপর্য ও
প্রভাব নিয়ে একজন সৌদি সাংবাদিক এই প্রথম ইসরাইলের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে
স্কাইপের মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
সৌদি-ইসরাইল
গোপন যোগাযোগ দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসছে। ২০১৫ সালে কাউন্সিল অব ফরেন
রিলেশন্সের এক অনুষ্ঠানে সৌদি জেনারেল আনোয়ার মাজেদ ইশকি ও জাতিসঙ্ঘে
ইসরাইলের দূত দোরে গোল্ড রিভেলড জানান, ইরানকে মোকাবেলার জন্য ইসরাইল ও
সৌদি আরবের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের অন্তত পাঁচটি গোপন বৈঠক হয়েছে। জেনারেল
ইশকি সামরিক দায়িত্বের পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক
মিশনেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ সময় সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত
ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেদ্দাভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা
করেন। জেনারেল আনোয়ার মাজেদ ইশকি সৌদি বাদশাহ সালমানের একজন সিনিয়র
উপদেষ্টা। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক জোরদারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করছেন বলে মনে করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে নিয়ে ২০১৫ এর মে পর্যন্ত
১৭ মাসে তিনি সৌদি সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে ওয়াশিংটনে ইসরাইলি
প্রতিনিধিদের সাথে মোট পাঁচবার বৈঠকে মিলিত হন। ২০১৬ সালে জুলাই মাসে একটি
উচ্চপদস্থ সৌদি প্রতিনিধিদল সাথে নিয়ে ইসরাইল সফর করেন এবং ইসারাইলি
পার্লামেন্ট নেসেটের প্রভাবশালী বিভিন্ন সদস্য এবং মোসাদের উপরস্থ
কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কোনো সৌদি কর্মকর্তার আনুষ্ঠানিকভাবে এটাই
প্রথম ইসরাইল সফর। ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের কৌশলগত সম্পর্কের কিছু ভিত্তি
তিনি তুলে ধরেন, যার মধ্যে রয়েছে- ১.আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী
শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, ২. ইরানের বর্তমান সরকারকে পরিবর্তন করা এবং
হিজবুল্লাহ ও হামাসের প্রভাব খর্ব করা, ৩. জিসিসিভুক্ত রাষ্ট্র্রগুলোর
ঐক্য, ৪. ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি এডেনে একটি স্বাধীন কর
মুক্ত নৌবন্দর প্রতিষ্ঠা করা, ৫. আমেরিকা এবং ইউরোপের সাহায্যে একটি
সম্মিলিত আরব সেনাবাহিনী গঠন করা যাতে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
যায়, ৬. ধীরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়া। ৭. বৃহত্তর কুর্দিস্থান
প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। কুর্দিস্থান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ
এলাকায় তুর্কি, ইরানি এবং ইরাকি কমানো সম্ভব হবে।
জেনারেল
ইশকির আগে সাবেক সৌদি গোয়েন্দা প্রধান তুর্কি আল ফয়সালের সময় ইসরাইলের
গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ
সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি ছিল ইরানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা
করা। সৌদি আরব ২০০৯ সালে ইরানে হামলার জন্য প্রয়োজনে সৌদি আকাশসীমা
ইসরাইলকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার কথা জানিয়েছিল। এ ছাড়া ইয়েমেনের যুদ্ধে
সৌদি আরবের কাছে ইসরাইল আয়রন ডোম মিশাইল ডিফেন্স প্রযুক্তি বিক্রির
প্রস্তাব দিয়েছিল। এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় হামাস, হিজবুল্লাহ ও মুসলিম
ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সাথে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো এক সাথে
কাজ করতে যাচ্ছে। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করার পর ইসরাইলের
প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান বলেন, আরব দেশগুলো কাতারের ওপর যে
কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে তাতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক
বাড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তিনি কাতারের ওপর অবরোধ আরোপকে সন্ত্রাসের
বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ বলে তাতে জোরালো সমর্থন জানান। ইসরাইলের
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর কাতারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের
মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় ইসরাইল কিংবা ফিলিস্তিন ইস্যু নয়, ইসলামী সন্ত্রাস
প্রধান সমস্যা।
কাতারের
ওপর অবরোধ আরোপ, হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে সৌদি আরবসহ
উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রকাশ্য অবস্থান ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক
কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিচ্ছে। হামাসের প্রতিরোধ আন্দোলনকে যখন সৌদি আরব
সন্ত্রাসী আন্দোলন বলে উল্লেখ করে তখন হামাস নেতাদের হত্যা করা ইসরাইলের
জন্য সহজ হয়ে যায়। হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দেয়ার জন্য কাতারের
ওপর যখন অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, একই সময় ইসরাইল হামাস শাসিত গাজায় বিদ্যুৎ
সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টির সৌদি-ইসরাইল
পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করা হয়।
No comments