ট্রাম্প–মোদি বৈঠক: নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত? by আলী রীয়াজ
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর একাধিক কারণে
গুরুত্বপূর্ণ। ২৫ ও ২৬ জুন দুই দিনের এই সফরের প্রধান দিক হচ্ছে
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, যা অনুষ্ঠিত হবে
সফরের দ্বিতীয় দিনে। নির্বাচিত হওয়ার পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেটা যে নেহাতই
সৌজন্য কথোপকথন, তা বোধগম্য। আনুষ্ঠানিক এই বৈঠক একাদিক্রমে
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক, এশিয়ার বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি
এবং সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। দক্ষিণ
এশিয়ার রাজনীতি ও আঞ্চলিক সম্পর্কের বিষয়ে যাঁরা উৎসাহী, তাঁদের কাছে এই
বৈঠকের গুরুত্ব আলাদা। সেখানে উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর বাইরে আরও কোনো বার্তা
আছে কি না, সেটাই তাঁরা দেখতে চাইবেন।
প্রায় ছয় মাস ধরে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন তার পররাষ্ট্রনীতির কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেনি বা এই বিষয়ে আগ্রহী হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে তারা একধরনের অ্যাডহক বা সাময়িক পদক্ষেপ দিয়েই আপাতত পররাষ্ট্র সম্পর্ক বহাল রাখবে। বড় আকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে যেগুলো ঘোষিত হয়েছে, তা হচ্ছে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিটিপি) এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি (প্যারিস চুক্তি) থেকে প্রত্যাহার, যা ‘একলা চলো’ নীতির প্রতিফলন ঘটায়। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের উদ্যোগে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সামরিক জোট গঠনে উৎসাহ প্রদান ও কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপে সমর্থন থেকে ইঙ্গিত মেলে যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ও কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেয়ে শক্তি প্রদর্শনকেই ট্রাম্প প্রশাসন যথাযথ মনে করে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসন যতটা সুস্পষ্টভাবে ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অন্য দেশগুলোকে উসকানি দিচ্ছে, সেটা নিঃসন্দেহে সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপে যে তাঁর প্রশাসনের সবার সমর্থন আছে, তা মনে হয় না। কাতার প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের বক্তব্য এবং হোয়াইট হাউসের অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব সহজেই প্রকাশিত হয়েছে, কাতারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পদত্যাগও একই ধারণা দেয়। ইতিমধ্যেই আমরা এ-ও দেখেছি যে ইউরোপের সঙ্গে ট্রাম্পের দূরত্ব বেড়েছে বৈ কমেনি, ন্যাটোর ব্যাপারে প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী অবস্থানও দেখা গেছে। বিশ্বরাজনীতির বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের এ ধরনের অবস্থানের পটভূমিকায়ই মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক হবে।
এটা আলাদা করে বলার দরকার হয় না যে ভারত এখন নিজেকে আর কেবল দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় দেশ বলেই বিবেচনা করে না, আচরণের দিক থেকে নিজেকে সে এশিয়ার একটি প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে এবং আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে সে নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবেই দেখতে চায়। ফলে এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। সহযোগিতার দিকটি প্রধানত এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব-বলয় বিস্তারের চেষ্টা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণেই। এই সহযোগিতা গত দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে। এশিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সে কারণেই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের একটি প্রধান পটভূমি।
এশিয়ার ব্যাপারেও আমরা ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই ধরনের পদক্ষেপ দেখতে পাই। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় চীনের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ সমালোচনার ধারই যে এখন কমে এসেছে তা নয়, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবি করা বিভিন্ন দ্বীপের কাছে যে নৌ মহড়া চালানো হয়, সেটি নিয়ে মে মাসে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ (ফোনপোস) নামের এই মহড়া নতুন কিছু নয়, কিন্তু বারাক ওবামার প্রশাসন ঘোষণা দিয়েই এই মহড়া চালাত, যাতে করে অন্যান্য মিত্র বুঝতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে আছে। কিন্তু মে মাসের পর মার্কিন নৌবাহিনী এই মহড়ার বিষয়ে ‘লো-কি’ বা কম প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চীনের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থানের পাশাপাশি মনে রাখা দরকার যে টিটিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের ফলে গোটা এশিয়ায় চীনের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর অন্যতম প্রভাব পড়বে ভারতের ওপর। প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন ও ভারত বায়ুমণ্ডলে কার্বন গ্যাস নিঃসরণের ক্ষেত্রে যারা প্রথম ও তৃতীয় অবস্থানে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এশিয়ায় চীনের সঙ্গে ভারতের প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রেই আরও বেশি জোরদার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদি নিশ্চয় বুঝতে চাইবেন ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থান নেবে কি না। ভারত যেমন চাইবে ট্রাম্প প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিক, তেমনি চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতিটি বাড়াক বা এমন পদক্ষেপ নিক, যাতে এখানে উত্তেজনা বাড়ে।
চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ অবকাঠামোগত প্রকল্পে ভারত যোগ দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অতীতে এই বিষয়ে যথেষ্ট আপত্তি দেখালেও প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে যুক্তরাষ্ট্র একটি ছোট প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। এই প্রকল্পের আপাত লক্ষ্য যদিও অর্থনৈতিক, এটা বুঝতে কারোরই কষ্ট হয় না যে, এ হচ্ছে চীনের প্রভাব বিস্তারের কৌশল। কিন্তু ভারত তা থেকে সরে থেকে লাভবান হবে এমন মনে করার কারণ নেই। চীনের এই প্রকল্পের সূত্রেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে আরও বেশি টানাপোড়েনের সূচনা হয়েছে। চীন শিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরে যুক্ত হওয়ার পথ হিসেবে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ (সিপ্যাক) স্থাপনের কাজ করছে এবং ভারত তাকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবেই দেখছে। কেননা এর একটি অংশ যাবে কাশ্মীরের এমন এক অংশের মধ্য দিয়ে, যা ভারত নিজের বলে দাবি করে।
এই প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে পাকিস্তান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সব সময়েই ভারতের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিবাদে জড়াতে রাজি নয়। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে কংগ্রেসের সদস্য টেড পো দাবি করেছেন, এ–যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে ৩৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে। ওবামা প্রশাসনের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে অনেক রকম টানাপোড়েন দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সাহায্য অব্যাহত রাখলেও এই সম্পর্ক আগের মতো ঘনিষ্ঠ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় নীতিতে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতের কার্যত অবসান ঘটেছে জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলেই। সেই সময়ে ভারতের সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা স্বাক্ষরিত হয়। তবে ওবামার আমলে তা ধীরগতিতে এগিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন জটিলতার কারণে এটা আরও দেরি হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে ওবামার আমলে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সহযোগিতায় ভাটা নামার কারণ এখনো তৈরি হয়নি।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তান নীতি। ভারত মনে করে যে পাকিস্তান আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতার কারণ। পাকিস্তানে তালেবানের হাক্কানি নেটওয়ার্কের উপস্থিতি এবং পাকিস্তানের সরকারের মধ্যে তাদের প্রতি সমর্থন ভারতের উদ্বেগের উৎস। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের কোনো কোনো সদস্য এই মতের সঙ্গে একমত। সম্প্রতি সিনেটের আর্মড সার্ভিসেস কমিটির এক শুনানিতে নিরাপত্তাবিষয়ক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান উদ্বিগ্ন। এ–যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপে ভারত খুব খুশি নয়, ট্রাম্প প্রশাসন এই বিষয়ে আর কী পদক্ষেপ নেবে, সেটা নিশ্চয় ভারত জানতে চাইবে বলে ধারণা করা যায়। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ছাড়াও অন্যান্য প্রতিবেশীর সম্পর্কে যে টানাপোড়েন আছে, সেই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উৎসাহ রয়েছে। চীনের প্রভাববলয়ের মোকাবিলার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে ভারত তার প্রতিবেশীদের ব্যাপারে কী দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছে, সেটা গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। এই বিশ্লেষকেরা এই দিকটি বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলে মনে করেন এই কারণে যে এতে করে অনেক দেশ ভবিষ্যতে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও সম্প্রতি কিছু বিষয়ে ভারত মোটেই খুশি নয়। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন যে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য ভারত উন্নত দেশগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভারত কেবল তার প্রতিবাদই করেনি, দেখিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের পাওয়া সাহায্যের পরিমাণ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভারতের কেনা কাজুবাদামের চেয়েও কম। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিককালে চাকরি–সংক্রান্ত মার্কিন ভিসার (এইচ১-বি) ক্ষেত্রে পরিবর্তন। এই ভিসার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের ফলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চাকরিতে ভারতীয় নাগরিকেরা যেসব সুবিধা পেতেন, তা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব বিষয়ের পাশাপাশি ট্রাম্প-মোদি আলোচনায় সন্ত্রাসবাদের কথা আলোচিত হবে। ভারতের নেতারা মনে করেন, ভারত যত বেশি ‘সন্ত্রাসী’ হামলার শিকার হয়, সেই তুলনায় তা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। এই প্রশ্নকে ভারত স্থানে আনতে চায় এই কারণেও যে তাতে করে এর দায় অনেকটাই তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের ওপর চাপানো যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে আরও দূরত্ব তৈরি করা যাবে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
প্রায় ছয় মাস ধরে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন তার পররাষ্ট্রনীতির কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেনি বা এই বিষয়ে আগ্রহী হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে তারা একধরনের অ্যাডহক বা সাময়িক পদক্ষেপ দিয়েই আপাতত পররাষ্ট্র সম্পর্ক বহাল রাখবে। বড় আকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে যেগুলো ঘোষিত হয়েছে, তা হচ্ছে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিটিপি) এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি (প্যারিস চুক্তি) থেকে প্রত্যাহার, যা ‘একলা চলো’ নীতির প্রতিফলন ঘটায়। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের উদ্যোগে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সামরিক জোট গঠনে উৎসাহ প্রদান ও কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপে সমর্থন থেকে ইঙ্গিত মেলে যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ও কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেয়ে শক্তি প্রদর্শনকেই ট্রাম্প প্রশাসন যথাযথ মনে করে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসন যতটা সুস্পষ্টভাবে ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অন্য দেশগুলোকে উসকানি দিচ্ছে, সেটা নিঃসন্দেহে সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপে যে তাঁর প্রশাসনের সবার সমর্থন আছে, তা মনে হয় না। কাতার প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের বক্তব্য এবং হোয়াইট হাউসের অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব সহজেই প্রকাশিত হয়েছে, কাতারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পদত্যাগও একই ধারণা দেয়। ইতিমধ্যেই আমরা এ-ও দেখেছি যে ইউরোপের সঙ্গে ট্রাম্পের দূরত্ব বেড়েছে বৈ কমেনি, ন্যাটোর ব্যাপারে প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী অবস্থানও দেখা গেছে। বিশ্বরাজনীতির বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের এ ধরনের অবস্থানের পটভূমিকায়ই মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক হবে।
এটা আলাদা করে বলার দরকার হয় না যে ভারত এখন নিজেকে আর কেবল দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় দেশ বলেই বিবেচনা করে না, আচরণের দিক থেকে নিজেকে সে এশিয়ার একটি প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে এবং আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে সে নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবেই দেখতে চায়। ফলে এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। সহযোগিতার দিকটি প্রধানত এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব-বলয় বিস্তারের চেষ্টা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণেই। এই সহযোগিতা গত দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে। এশিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সে কারণেই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের একটি প্রধান পটভূমি।
এশিয়ার ব্যাপারেও আমরা ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই ধরনের পদক্ষেপ দেখতে পাই। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় চীনের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ সমালোচনার ধারই যে এখন কমে এসেছে তা নয়, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবি করা বিভিন্ন দ্বীপের কাছে যে নৌ মহড়া চালানো হয়, সেটি নিয়ে মে মাসে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ (ফোনপোস) নামের এই মহড়া নতুন কিছু নয়, কিন্তু বারাক ওবামার প্রশাসন ঘোষণা দিয়েই এই মহড়া চালাত, যাতে করে অন্যান্য মিত্র বুঝতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে আছে। কিন্তু মে মাসের পর মার্কিন নৌবাহিনী এই মহড়ার বিষয়ে ‘লো-কি’ বা কম প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চীনের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থানের পাশাপাশি মনে রাখা দরকার যে টিটিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের ফলে গোটা এশিয়ায় চীনের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর অন্যতম প্রভাব পড়বে ভারতের ওপর। প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন ও ভারত বায়ুমণ্ডলে কার্বন গ্যাস নিঃসরণের ক্ষেত্রে যারা প্রথম ও তৃতীয় অবস্থানে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এশিয়ায় চীনের সঙ্গে ভারতের প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রেই আরও বেশি জোরদার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদি নিশ্চয় বুঝতে চাইবেন ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থান নেবে কি না। ভারত যেমন চাইবে ট্রাম্প প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিক, তেমনি চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতিটি বাড়াক বা এমন পদক্ষেপ নিক, যাতে এখানে উত্তেজনা বাড়ে।
চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ অবকাঠামোগত প্রকল্পে ভারত যোগ দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অতীতে এই বিষয়ে যথেষ্ট আপত্তি দেখালেও প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পরে যুক্তরাষ্ট্র একটি ছোট প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। এই প্রকল্পের আপাত লক্ষ্য যদিও অর্থনৈতিক, এটা বুঝতে কারোরই কষ্ট হয় না যে, এ হচ্ছে চীনের প্রভাব বিস্তারের কৌশল। কিন্তু ভারত তা থেকে সরে থেকে লাভবান হবে এমন মনে করার কারণ নেই। চীনের এই প্রকল্পের সূত্রেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে আরও বেশি টানাপোড়েনের সূচনা হয়েছে। চীন শিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরে যুক্ত হওয়ার পথ হিসেবে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ (সিপ্যাক) স্থাপনের কাজ করছে এবং ভারত তাকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবেই দেখছে। কেননা এর একটি অংশ যাবে কাশ্মীরের এমন এক অংশের মধ্য দিয়ে, যা ভারত নিজের বলে দাবি করে।
এই প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে পাকিস্তান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সব সময়েই ভারতের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিবাদে জড়াতে রাজি নয়। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে কংগ্রেসের সদস্য টেড পো দাবি করেছেন, এ–যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে ৩৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে। ওবামা প্রশাসনের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে অনেক রকম টানাপোড়েন দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সাহায্য অব্যাহত রাখলেও এই সম্পর্ক আগের মতো ঘনিষ্ঠ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় নীতিতে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতের কার্যত অবসান ঘটেছে জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলেই। সেই সময়ে ভারতের সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা স্বাক্ষরিত হয়। তবে ওবামার আমলে তা ধীরগতিতে এগিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন জটিলতার কারণে এটা আরও দেরি হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে ওবামার আমলে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সহযোগিতায় ভাটা নামার কারণ এখনো তৈরি হয়নি।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তান নীতি। ভারত মনে করে যে পাকিস্তান আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতার কারণ। পাকিস্তানে তালেবানের হাক্কানি নেটওয়ার্কের উপস্থিতি এবং পাকিস্তানের সরকারের মধ্যে তাদের প্রতি সমর্থন ভারতের উদ্বেগের উৎস। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের কোনো কোনো সদস্য এই মতের সঙ্গে একমত। সম্প্রতি সিনেটের আর্মড সার্ভিসেস কমিটির এক শুনানিতে নিরাপত্তাবিষয়ক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান উদ্বিগ্ন। এ–যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপে ভারত খুব খুশি নয়, ট্রাম্প প্রশাসন এই বিষয়ে আর কী পদক্ষেপ নেবে, সেটা নিশ্চয় ভারত জানতে চাইবে বলে ধারণা করা যায়। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ছাড়াও অন্যান্য প্রতিবেশীর সম্পর্কে যে টানাপোড়েন আছে, সেই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উৎসাহ রয়েছে। চীনের প্রভাববলয়ের মোকাবিলার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে ভারত তার প্রতিবেশীদের ব্যাপারে কী দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছে, সেটা গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। এই বিশ্লেষকেরা এই দিকটি বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলে মনে করেন এই কারণে যে এতে করে অনেক দেশ ভবিষ্যতে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও সম্প্রতি কিছু বিষয়ে ভারত মোটেই খুশি নয়। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন যে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য ভারত উন্নত দেশগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভারত কেবল তার প্রতিবাদই করেনি, দেখিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের পাওয়া সাহায্যের পরিমাণ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভারতের কেনা কাজুবাদামের চেয়েও কম। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিককালে চাকরি–সংক্রান্ত মার্কিন ভিসার (এইচ১-বি) ক্ষেত্রে পরিবর্তন। এই ভিসার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের ফলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চাকরিতে ভারতীয় নাগরিকেরা যেসব সুবিধা পেতেন, তা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব বিষয়ের পাশাপাশি ট্রাম্প-মোদি আলোচনায় সন্ত্রাসবাদের কথা আলোচিত হবে। ভারতের নেতারা মনে করেন, ভারত যত বেশি ‘সন্ত্রাসী’ হামলার শিকার হয়, সেই তুলনায় তা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। এই প্রশ্নকে ভারত স্থানে আনতে চায় এই কারণেও যে তাতে করে এর দায় অনেকটাই তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের ওপর চাপানো যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে আরও দূরত্ব তৈরি করা যাবে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments