রাজনীতিতে শিষ্টাচার by শামীমুল হক
আধুনিক
থেকে অত্যাধুনিক। সাদাকালো থেকে রঙিন। এনালগ থেকে ডিজিটাল। হাতের মুঠোয়
বিশ্ব। সাইবার যুগ। ঘরে বসে দেখা যাচ্ছে গোটা পৃথিবী। আর বিশ্বের সঙ্গে তাল
মিলিয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশ যেন দিন দিন
পিছিয়ে যাচ্ছে। শিষ্টাচার, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌজন্যতা সম্পূর্ণভাবে
হারিয়ে যাচ্ছে রাজনীতি থেকে। কমেছে সামাজিক মূল্যবোধও। এক দলের নেতার সঙ্গে
আরেক দলের নেতানেত্রীর এখন আর আগের মতো হৃদ্যতা নেই। কবে কখন যে আওয়ামী
লীগ-বিএনপির প্রধান দুই নেত্রীর দেখা হয়েছে মানুষ ভুলে গেছে। অথচ এক সময়
দেশের রাজনীতিতে শিষ্টাচার উদাহরণ ছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী
আন্দোলনের পরও বিএনপি আর আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল। কারো
কারো সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সরকার গঠন করে
বিএনপি। এর কিছু দিন পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা
ওয়াজেদ পুতুলের বিয়ে হয়। সেই অনুষ্ঠানে দাওয়াতি প্রধানমন্ত্রী খালেদা
জিয়াসহ বিএনপির অনেক নেতা। রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হন তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাকে দেখেই সেদিন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আপনি
এসেছেন। আমি খুব খুশি হয়েছি। অন্যদিকে খালেদা পুত্র তারেক রহমানের বিয়েতেও
যান শেখ হাসিনা। এর কিছুদিন পর থেকেই দূরত্ব বাড়তে থাকে নেতায় নেতায়। দলে
আর দলে। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যায় সেনাকুঞ্জের দরবারে দুই নেত্রী পাশাপাশি
বসলেও দুই জন ছিলেন দুই দিকে তাকিয়ে। এ ছবিই বলে দিয়েছিল তাদের সম্পর্ক
কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। এ মুহূর্তে দুই দলের নেতারা যেন একে অন্যের শত্রু। অথচ
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই?
১৯৭৩ সালের ঘটনা। ভাসানী ন্যাপ-এর সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক। সরকারের বিরুদ্ধে তখন তিনি রাজপথে অনশন করেন। সেই অনশনও ভাঙান বঙ্গবন্ধু নিজেই। ভাসানীর মুখে শরবত তুলে দিয়ে সেদিনের অনশন ভাঙানোর কথা সবাই জানেন। আরেক ঘটনা। ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক তখন কাজী জাফর আহমদ। সামনে ঈদ। কাজী জাফর বহু খোঁজাখুঁজি করে মওলানা ভাসানীর জন্য তার পছন্দের পোশাক কিনেন। সঙ্গে ভাসানী পত্নীর জন্যও। ঈদের আগের দিন ভাসানীর বাড়িতে সেই পোশাক নিয়ে যান কাজী জাফর নিজে। পোশাক দেখে খুশি হন ভাসানী। আর মুখে বলেন, তোমার দেয়া পোশাক ঈদের দিন বিকালে পরব। কথা শোনে কাজী জাফরতো থ মেরে যান। এত খোঁজাখুঁজি করে আনা পোশাক মওলানা ভাসানী পরবেন বিকালে তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। জাফরের ইচ্ছা এই পোশাক পরে মওলানা ভাসানী ঈদের জামাতে যাবেন। একপর্যায়ে ভাসানীর কাছে বিকালে এই পোশাক পরার কারণ জানতে চান। ভাসানী তাকে জানান, ঈদের জামাতে যাব মজিবরের পোশাক পরে। রাতেই মজিবরের পোশাক পেয়ে যাব। তাজ্জব বনে যান কাজী জাফর। বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আপনি রাজপথে আন্দোলন করছেন। তার সরকারের সমালোচনা করছেন। আর তার দেয়া পোশাক পরে আপনি ঈদের জামাতে যাবেন? মওলানা ভাসানী তখন কাজী জাফরকে বলেন, শোন জাফর, শুধু কালকের ঈদই নয়, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মজিবরের দেয়া পোশাক পরে আমি ঈদের নামাজ পড়ি। পাকিস্তান আমলে মজিবর জেলে থাকলেও তার স্ত্রী ঈদের পারিবারিক বাজারের সঙ্গে আমার পোশাক কিনতে ভুলতো না। যথারীতি ঈদের আগের রাতে সেই পোশাক আমার কাছে পাঠিয়ে দিতো সে। ১৯৯২ সালে ঢাকা ক্রীড়া সংস্থার মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের শিষ্টাচার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কাজী জাফর নিজে এসব কথা তার বক্তব্যে তুলে ধরেন।
অপরদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব নিজে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ১৯৭৪ সালের দিকে আমরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। আন্দোলনে পুলিশি হামলায় আহত হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হই আমি। হঠাৎ রাতে দেখি বঙ্গবন্ধু এসে হাজির। আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, কি হইছে তোর। আমি বিষয়টি দেখতেছি।
এমন কথাও প্রচলিত আছে, ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। স্বাধীনতার পর তিনি কারান্তরীণ হন। বঙ্গবন্ধু তাকে জেলে চিঠি লিখতেন। টেলিফোন করে কথা বলতেন। খোঁজ-খবর রাখতেন। অন্যদিকে জেলে থাকা অবস্থায় মুসলিম লীগ নেতা সবুর খানের পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়মিত রাখতেন বঙ্গবন্ধু। সেই সংস্কৃতি এখন আর নেই। এখন কে কার সম্পর্কে কত কটূক্তি করতে পারেন তার প্রতিযোগিতা চলছে। নবম সংসদের দিকে তাকালে লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে। মহান জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের মুখের ভাষা শুনে জাতি লজ্জিত হয়েছে। কিন্তু এমপিরা করেছেন উল্লাস। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এক এগারো থেকে শিক্ষা নিয়ে গঠিত সংসদেই ঘটেছে এসব ঘটনা। কিন্তু এক এগারোর পর বৃহত্তম দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে উভয় দলের প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন। যা জাতির মনে আশার সঞ্চার করেছিল। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে। এখনও মাঝে মাঝে খবর হয়, ঈদ, নববর্ষে এক নেত্রী আরেক নেত্রীকে দাওয়াত দেয়ার। এটা শুধু দাওয়াত কার্ড বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃতুর খবর শোনে ছুটে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়াসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ শোনে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের গেট খোলা হয়নি। বন্ধ গেটের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। সার্বিক দিক বিবেচনায় দেখা যায় কোথায় যেন এক বাধা। সেই বাধাতো ভাঙতে হবে রাজনীতিবিদদেরই।
১৯৭৩ সালের ঘটনা। ভাসানী ন্যাপ-এর সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক। সরকারের বিরুদ্ধে তখন তিনি রাজপথে অনশন করেন। সেই অনশনও ভাঙান বঙ্গবন্ধু নিজেই। ভাসানীর মুখে শরবত তুলে দিয়ে সেদিনের অনশন ভাঙানোর কথা সবাই জানেন। আরেক ঘটনা। ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক তখন কাজী জাফর আহমদ। সামনে ঈদ। কাজী জাফর বহু খোঁজাখুঁজি করে মওলানা ভাসানীর জন্য তার পছন্দের পোশাক কিনেন। সঙ্গে ভাসানী পত্নীর জন্যও। ঈদের আগের দিন ভাসানীর বাড়িতে সেই পোশাক নিয়ে যান কাজী জাফর নিজে। পোশাক দেখে খুশি হন ভাসানী। আর মুখে বলেন, তোমার দেয়া পোশাক ঈদের দিন বিকালে পরব। কথা শোনে কাজী জাফরতো থ মেরে যান। এত খোঁজাখুঁজি করে আনা পোশাক মওলানা ভাসানী পরবেন বিকালে তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। জাফরের ইচ্ছা এই পোশাক পরে মওলানা ভাসানী ঈদের জামাতে যাবেন। একপর্যায়ে ভাসানীর কাছে বিকালে এই পোশাক পরার কারণ জানতে চান। ভাসানী তাকে জানান, ঈদের জামাতে যাব মজিবরের পোশাক পরে। রাতেই মজিবরের পোশাক পেয়ে যাব। তাজ্জব বনে যান কাজী জাফর। বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আপনি রাজপথে আন্দোলন করছেন। তার সরকারের সমালোচনা করছেন। আর তার দেয়া পোশাক পরে আপনি ঈদের জামাতে যাবেন? মওলানা ভাসানী তখন কাজী জাফরকে বলেন, শোন জাফর, শুধু কালকের ঈদই নয়, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মজিবরের দেয়া পোশাক পরে আমি ঈদের নামাজ পড়ি। পাকিস্তান আমলে মজিবর জেলে থাকলেও তার স্ত্রী ঈদের পারিবারিক বাজারের সঙ্গে আমার পোশাক কিনতে ভুলতো না। যথারীতি ঈদের আগের রাতে সেই পোশাক আমার কাছে পাঠিয়ে দিতো সে। ১৯৯২ সালে ঢাকা ক্রীড়া সংস্থার মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের শিষ্টাচার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কাজী জাফর নিজে এসব কথা তার বক্তব্যে তুলে ধরেন।
অপরদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব নিজে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ১৯৭৪ সালের দিকে আমরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। আন্দোলনে পুলিশি হামলায় আহত হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হই আমি। হঠাৎ রাতে দেখি বঙ্গবন্ধু এসে হাজির। আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, কি হইছে তোর। আমি বিষয়টি দেখতেছি।
এমন কথাও প্রচলিত আছে, ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। স্বাধীনতার পর তিনি কারান্তরীণ হন। বঙ্গবন্ধু তাকে জেলে চিঠি লিখতেন। টেলিফোন করে কথা বলতেন। খোঁজ-খবর রাখতেন। অন্যদিকে জেলে থাকা অবস্থায় মুসলিম লীগ নেতা সবুর খানের পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়মিত রাখতেন বঙ্গবন্ধু। সেই সংস্কৃতি এখন আর নেই। এখন কে কার সম্পর্কে কত কটূক্তি করতে পারেন তার প্রতিযোগিতা চলছে। নবম সংসদের দিকে তাকালে লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে। মহান জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের মুখের ভাষা শুনে জাতি লজ্জিত হয়েছে। কিন্তু এমপিরা করেছেন উল্লাস। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এক এগারো থেকে শিক্ষা নিয়ে গঠিত সংসদেই ঘটেছে এসব ঘটনা। কিন্তু এক এগারোর পর বৃহত্তম দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে উভয় দলের প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন। যা জাতির মনে আশার সঞ্চার করেছিল। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে। এখনও মাঝে মাঝে খবর হয়, ঈদ, নববর্ষে এক নেত্রী আরেক নেত্রীকে দাওয়াত দেয়ার। এটা শুধু দাওয়াত কার্ড বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃতুর খবর শোনে ছুটে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়াসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ শোনে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের গেট খোলা হয়নি। বন্ধ গেটের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। সার্বিক দিক বিবেচনায় দেখা যায় কোথায় যেন এক বাধা। সেই বাধাতো ভাঙতে হবে রাজনীতিবিদদেরই।
No comments